বৃষ্টি বন্দনা

এক

মাঝ রাতের বৃষ্টির পাড় ভাঙ্গা ক্ষমতা নাকি অসাধারণ। জানা নেই। এই হিসেবি জীবনের বৃষ্টি মানেই এক পশলা নাগরিক ভোগান্তি। দৌড়ে গিয়ে জানালার স্লাইড বন্ধ করার তাড়াহুড়া। কাদা ছিটকে জামা নষ্ট হবার একরাশ বিরক্তি। ঘরের ছাদে বৃষ্টির স্বরবৃত্ত তাল কল্পনা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। তারপরও, কোন কোন মাঝরাতে বৃষ্টি নামে। কল্পলোকের কল্পনাতে বাস্তবতা দৌড়ে পালায়। স্মৃতির পাড় বেয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সোমেশ্বরী। অবিরল বৃষ্টিতে দুধ সাদা বিরিশিরি। কিংবা হঠাত করেই চমকে দিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নির্জন করিডোর, হুড খোলা রিকশায় হেঁড়ে গলার গান। এ সব, স-ব কিছুই। আমি মানুষটা বাড়াবাড়ি রকমের নষ্টালজিক। অর্ধেক জীবন কাটে বাকি অর্ধেকের হাহাকারে। তাই কোন কোন মাঝ রাতে যখন বৃষ্টি নামে, তখন মনে হয় –

“একা একা ভালবেসে এইভাবে বেড়ে যায় পাপ,
তুমি কোনদিন দেখবেনা, তার দুঃখ মনস্তাপ।
কোন কোন মাঝ রাতে বৃষ্টি হবে,
সে তখন তোমাকে পাবেনা।“
– সে তোমাকে পাবে না, মইনুল আহসান সাবের

দুই

আমার মনে হয় আমি একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে আছি। একটা বয়সের বৃত্ত। ৬ থেকে শুরু করে ১৯ বছর সময় পর্যন্ত। এই বৃত্তের মাঝে সোমেশ্বরী নদী আছে। হঠাত হঠাত রূপ বদলে যাওয়া সোমেশ্বরী। ধোঁয়া ওঠা শীতের সকালে অচেনা সোমেশ্বরী। যেখানে আমার শৈশব আছে। আছে দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতে অবিরাম দৌড়ে বেড়ানো। আছে আমার নানু বাড়ীর পাশে অচেনা মানুষের কবর। যেখানে আছে আমার প্রথম স্কুল – নাইট প্রিপারেটরী গ্রামার স্কুল। আমার খুব মনে আছে, আমি যে দিন আমার স্কুল ছেড়ে চলে আসি, সেদিন আমার স্কুলের সব বন্ধুরা মিলে আমাকে অনেক মার্বেল উপহার দিয়েছিলো। সে বৃত্তে রাজা শশাঙ্কের রাজবাড়ী আছে। যার কিছু কিছু ঘর আমাকে অদ্ভুত রহস্যময়তায় ডাকতো। আমার অসম্ভব অহঙ্কার আছে। ভালো ছাত্র হবার অহংকার। কখনো দ্বিতীয় না হবার অহংকার। প্রথম প্রথম সিগারেট খাবার নিষিদ্ধ আনন্দ আছে। আমার ক্যাডেট কলেজ আছে। ষ্টাফদের বকুনি আছে। এডজুটেন্টের রাগী চেহারা আছে। বিকেলে খেলার বদলে Punishment খাবার সীমাহীন আনন্দ আছে। প্রতি সপ্তাহে একটা চিঠি পাবার অদ্ভুত আকুতি আছে। হঠাত দুপুরে ডাইনিং এ যাবার সময় হলুদ খামের অজানা সংবাদ আছে। এছাড়া আর কি কিছু আছে? জানা নেই অথবা মনে নেই। কেমন যেন একটা না মানুষী জীবন। বড্ড নাজুক আর অস্বস্তিকর অবস্থা। মনে হচ্ছে ভেজা কলার সহ শার্ট পড়ে ফেলেছি। তার উপর দিনমান বৃষ্টি। যেন নিপুণ হাতে পৃথিবীর বস্ত্র হরণ করে চলেছে। অনুপ ঘোষালও অস্থির করে দিচ্ছে আজ – একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে, একঝাঁক বুনো হাঁস পথ হারালো! আমার মন আজ সত্যি পথ হারিয়েছে! ভাবনার বৃষ্টিতে আমিও ভিজে চলেছি। আহ! আজ নস্টালজিয়া আমাকে অবশ করে দিচ্ছে…।

শেষ

থাক আজ এসব কথা। ঝুম বৃষ্টিতে পুরো শহর ভেসে যাচ্ছে। জানলা খোলার সাথে সাথে যে বাতাস স্পর্শ করে গেলো সে শুধু মুখে নয়, মনেও লেগেছে। তাই কী জানি কি হয় জানি না। ওদিকে আছেন একজন, রবি বাবু – এমন বাদল দিনে নাকি তারে বলা যায়। কি বলা যায়, কারে বলা যায়? জানিনা। এই ফাঁকে বাপ্পা অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে – বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারায়, বৃষ্ট পড়ে লজ্জা হারায়। আজ মনে হয় লজ্জা হারানোর ই দিন।

“আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক-/আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত।
তোমার বাড়ির কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম,
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর/একটি প্রাচীন বুড়ি।
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটি মেজে চলেছে আপন মনে।
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ ধ্বনি শুয়ে আছে পিরিচে,পেয়ালায়।
ঐ বাজনা শুনতে নেই/ ঐ বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ঐ বাজনা ষ্টীমারকে ডাঙার ওপর
আছড়ে ফ্যালে;/ ঐ বাজনা গ্রাস করে প্রেম,
স্মৃতি, শস্য, শয্যা, ও গৃহ।“
– আজ সারাদিন ,শহীদ কাদরী

১,০৪৮ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “বৃষ্টি বন্দনা”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো আরিফ ভাই, অসাধারন :hatsoff:

    ব্লগে স্বাগতম ভাই, আশা করি নিয়মিত এরকম দারুন সব লেখা পাবো।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    🙂
    ভালো হইছে।
    প্রথম লেখায় স্বাগতম।
    বেশ কয়েকজন নতুন লেখক পেলাম গত কয়েকদিনে। ভালো লাগলো।
    ক্যাডেট নম্বরের আগে j দেইখা মনে করছিলাম বৃক্ষ।
    পরে দেখলাম রংপুর।
    তবে কি ঐটা হাউজের অদ্দ্যাক্ষর?
    সিসিবির রীতি অনুযায়ী
    ০১ নাম বাঙলায় করে ফেলতে হবে।
    ০২ গোটাদশেক :frontroll: দিতে হবে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আরিফ (৯৩-৯৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।