ক্যাডেট নম্বর ১৮৬২-অসময়ে হারিয়ে যাওয়া অতি আপনজন (পর্ব ২)

পাঁচ…..

ক্লাশ নাইনে সময় অদ্ভুত দ্রুত কাটতে লাগল।সময়টাকে আমার এখনও মনে হয় বড়ই মধুর।আমি দেখতে থাকি আমার বন্ধুদের চিঠি চালাচালি।এখন ই মেইলের যুগে হারিয়ে যাওয়া চিঠি তখন ছিল অদ্ভুত শিহরণ সঞ্চারী।যখনই কারো চিঠি আসত আমরা ছুটে যেতাম কোথা থেকে এল দেখতে।গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে আসা চিঠিগুলো অবশ্যি দেখলেই বুঝা যেত।কেননা ওদের হাতের লেখা গুলো যেন একই রকম ছিলো।তা আলমের কাছে যে চিঠি আসত তা দেখার সুযোগ হতো আমার।শাহরুখ নামধারী কোন মেয়ের কাছ থেকে আসত চিঠিগুলো।আর আলমের চিঠি গার্লস কলেজে যেত রুশি নামের মেয়ের পক্ষ থেকে।ক্যাডেট কলেজের স্যারদের সন্দেহের হাত থেকে বাচার এই পদ্ধতি বোধ করি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছিলো।তাই স্যাররা বুঝে না বুঝার সুনিপুন অভিনয় করত যা পত্রপ্রেরক এবং প্রাপক দুই পক্ষকেই উৎসাহিত করত।রুশি-শাহরুক কিংবা রুশো-শাখরুনার এই অভিনয় চলতে থাকে পুরো ক্লাশ নাইন জুড়ে।প্রেম ভালোবাসা নামক সূক্ষ্ম মানবিক আবেগগুলোকে আমি চিনতে শুরু করি প্রিয় বন্ধু আলমকে দেখেই।পরের বন্ধে ম্যাবসে পড়তে যাওয়ার আগ্রহও বাড়তে থাকে এভাবেই।

আলমকে নতুনভাবে দেখতে থাকি ।তার মধ্যকার পরিবর্তন গুলো ধরা পরে আমার চোখে।সে মাঝে মাঝে একা একা বসে কী যেন ভাবে?একদিন আমি জিজ্ঞেস করতে সে বলল,আচ্ছা আমি এখন যেভাবে বসে একজনকে ভাবছি আরেকজনও কি আমাকে ভাবছে সেই ভাবে?আমি কিছু বলি না,কিন্তু জানি ।হ্যা আলম,তোমার মত আরেকজনও তোমাকেই ভাবছে আর তার পাশে এখন আমার মত হয়তো কেউ জানতে চাইছে তার উদাসীনতার কারণ।পরেও অনেক বারই পরিচয় পেয়েছি ওদের ভালোবাসার গভীরতা।যেদিন আলমের সাথে শেষ দেখা হলো সেদিনও আমার পাশে রিকশায় বসে সে কথা বলছিল ওর সাথে ফোনে।না আমার কিছু হবে না ,আমি ঠিক পৌছে যাবো বাসায়-তাকে নিয়ে সদাউৎকন্ঠিত শাখরুনাকে এভাবেই শান্ত করেছিলো আলম।

ক্যাডেট কলেজের ফুর্তি থেমে ছিলো না অবশ্য।আমি ধীরে ধীরে উচু শ্রেনীর চাপাবাজে পরিণত হলাম।চাপাবাজি মানে যে কোন বিষয় নিয়ে একটা চাপা মেরে দেওয়া ছিল আমার স্বভাব।শুধু আমি ই না এরকম আরো অনেকেই ছিলো।বিশেষত খেলার স্কোর নিয়ে চাপাবাজিটা জমত বেশি।ক্রিকেটের জোয়ারের কারণে যা মনে চায় একটা কিছু বলে রেফারেন্স দিতাম সিনিয়র এক ভাইয়ের যার রেডিও আছে।আলম এক্ষেত্রে ছিলো আমার বিপরীত-অচাপাবাজ।এই অদ্ভুত শব্দটা আমদানি করলাম ওকে বোঝাতেই।সে একটা সত্যি স্কোরকে বলত চাপাবাজির ভঙ্গিতে।এতে সবাই ওটা চাপা মনে করত।সে সোজা বাজি লেগে যেত।এবং বাজিতে তার জয় হত।বাজি জিতের এ কৌশল অবলম্বনে সে যে অভিনয়(চাপা মারার) করত তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

আলমের একটা বিখ্যাত নিকনাম ছিলো কাহিনীবাজ।কারন সে সব ঘটনা কে কাহিনী করে বলত।আর মজার ব্যাপার হলো ক্লাশে স্যারদের সব কাহিনী সব জোকসই তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো।সে বিষয়টা এনজয় করত।যদিও আমরা বললে সে কপট রাগের ভান করত।মনে পড়ে আমরা যখন টুয়েলভে আলম কাহিনী বলা শুরু করলে আমার এক বন্ধু রিফাত কাগজ কলম নিয়ে গোনা শুরু করত।ব্যাপারটা আলম প্রথমে বুঝে নি।সে আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করল ব্যাপারটা।তখন আমরা সব কিছুই রেটিং করতাম।যেমন জোকস রেটিং মোটা রেটিং ন্যাস্টি রেটিং ইত্যাদি।আলম ভেবেছিলো সে রকম হয়তো কিছু।কিন্তু আমি পুরো ব্যাপারটা বলতেই সে আমার দিকে কপট রাগের ভান করে তেড়ে এল।

তা এ কাহিনীবাজ আলমের বহু কাহিনীর সাক্ষী আমি।সেই কাহিনী গুলো কেবলই স্মৃতির দুয়ারে হানা দেয়।কিছুক্ষনের জন্য আমাকে থামিয়ে দেয়।
বহুদিনের সাথী বহু যুদ্ধের সহযোদ্ধা আলম এসে পড়ে আমার স্মৃতি পটে।তার সহজ সরল কিছুটা বোকামি পুর্ন কিছুটা কৌতুক ময় আচরন আমাকে হারিয়ে নিয়ে যায় সেই দিন গুলোর মাঝে। একদিনকার কথা।আফটারনুন প্রেপ থেকে ফিরছি। চুরালিয়া খ্যাত মোহিব ভাই আমাদের সামনে।তার প্রিয় ডায়লগ ছিল,সিনিয়র মনে হয় না।লাথথি মাইরা হাউস থেকে বাইর কইরা দিমু।তা তাকে দেখে আলম বলে বসল।ফুটবলার মনে হয় না।গোল দিয়া জাল ছিড়া ফালামু।সাথে সাথেই চুরালিয়া মোহিব আমাদের দুইজনকে ডেকে বসলেন।তখন যে কী অবস্থা হয়েছিলো তা নিশ্চয় সবাই বুঝতে পারছেন।

আরেকদিনের কাহিনী।নতুন জুনিয়র প্রিফেক্ট সাজিদ ভাই।তিনি যেমন একদিকে রাগী অপরদিকে মজার।তা আমরা রুম ক্রিকেট খেলে ধরা খেলাম।সাজিদ ভাই ডাকলেন।বললেন,হুম আমি কে?উত্তরটা কি হতে পারে আমরা ভেবে বসার আগে আলম বলে বসল,জ্বী,আপনি সাজিদ ভাই।
সাজিদ ভাই ক্ষেপে গেলেন।যাও গেমস ড্রেস পরে আসো।তো এলাম।এইবার বলো আমি কে?আমরা ততক্ষনে বুঝে গেছি কী বলতে হবে।কিন্তু হাসান নামে আমাদের একজন শয়তানি করে আবার বলল।আপনি সাজিদ ভাই।হ্যান্ডস ডাউন হও সবাই।বল আমি কে?আমরা একত্রে বলে উঠলাম আপনি জুনিয়র প্রিফেক্ট।সাজিদ ভাই হাসলেন।
সবাই যাও শুধু হাসান থাকো।তার পর হাসানের ভাগ্যে কিছু প্যাদানি জুটল।আসলে সাজিদ ভাই সবসময় তক্কে তক্কে থাকতেন হাসানকে সাইজ দিতে।আর হাসানও লেগে থাকত সাজিদ ভাইকে বিরক্ত করার নিত্য নতুন কৌশল বের করতে।

নাইন টেনের সেই দিন গুলো আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান।বড়ই স্মৃতি কাতর করে তুলে দিন গুলি।আড্ডা দুষ্টামি ঝগড়া জুনিয়র সাইজ দেয়া কিংবা সিনিয়রের পিছে লাগা এসব নিয়ে দিন গুলো ছিল বৈচিত্র‌ ময়।আর সে দিন গুলোর সবচেয়ে বর্নাঢ্য চরিত্র আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আলম।

ছয়…..

সময়টা নিউ টেন।আমি কলেজের বন্ধে এসে আমার বাবা মাকে বুঝালাম কোচিং এ পড়ার গুরুত্ব।অনুমোদন মিলল।এটা আমাকে একরকম হাফ ছেড়ে বাচিয়ে দিল।বন্ধগুলিতে আমি যে হাপিয়ে উঠতাম তা ঠিক নয় তবে কলেজের বন্ধুদের মুখে ম্যাবস নামক শব্দটি আমার কানে এমনভাবে বিধছিল আমি পারছিলাম না স্বচক্ষে পরিভ্রমন থেকে নিজেকে বিরত করতে।তা যাই হোক কোচিং সেন্টারে দুরুদুরু বুকে কিছুটা ভয় আর কিছুটা কৌতুহল নিয়ে ঢুকলাম।ঢুকা মাত্র অতি পরিচিত কন্ঠে নিজের নাম ধরে ডাক শুনে সব ভয় কেটে গেল।হ্যা আমার বন্ধু আলম সেখানে।আমি দেরি না করে আলমের পাশে গিয়ে বসলাম।আমাদের কলেজের ছেলেপেলে কিছু তো ছিলই আর অন্যান্য ছেলেদের সাথে পরিচয় হতে বেশি সময় লাগল না আলমের সৌজন্যে।আলম আমাকে ফিরিস্তি দিতে লাগল ঐ মোটা ছেলেটা ফারাবী,ফর্সা সুন্দর ছেলেটা হাসনাইন,তার পাশের ছেলেটা তাজ,এই ছেলেটা আন্দালিব।জাকির আর মিথুন নামে আরো দুটো ছেলে এল আমার মত নতুন ।ওদের সাথে পরিচিত হলাম।

আরেকটা মজার ঘটনা ঘটল পরিচয়ে।আমদের সামনে একটা ন্যাড়া মাথার ছেলে বসে ছিল।আমি আর আলম পরিচিত হতে গেলাম।আমরা আমাদের নাম বলে ওর নাম জানতে চাইলাম।সে আমাদের অবাক করে দিয়ে বলে ওঠেছিল,ভারী মুশকিলে ফেলে দিলে।আর যায় কোথায়।সেই ছেলের নাম ছিল জাহিদ।তো আমরা ওর নাম মুশকিল জাহিদ সংক্ষেপে মুজা বলে ডাকা শুরু করলাম।জাহিদ পরে বুয়েটে এসে আমার ভালো বন্ধু হয়।কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি সেদিনের মুশকিল ঘটনার কোন সদ ব্যাখ্যা ওর থেকে আদায় করতে পারি নি।

ম্যাবসে যে শুধু ছেলেরাই ছিল তা নয়।বরং মুল আকর্ষন ছিল গার্লস ক্যাডেটের মেয়েরা।সেই মেয়েগুলোর বাচ্চা বাচ্চা মুখ এখন ও আমার চোখে ভাসে।তা আমি বরাবরই মেয়েদের সাথে কথা বলতে একটু বিব্রত বোধ করতাম।কেমন যেন এক টা জড়তা কাজ করত(অবশ্যি আজও করে)তাই আমি মেয়েদের সাথে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাতাম না।তারপরও আলম একরকম জোর করেই আমাকে শাখরুনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।(অবশ্যি পরেও আমাকে শাখরুনার সাথে অনেকবার নতুন করে পরিচিত হতে হয়েছে।নামে সে আমাকে চিনত কিন্তু চেহারা মনে রাখতে পারত না এবং এখনও চিনবে না)।সে যাই হোক সেবার ঈদ উপলক্ষে কার্ড দেয়াদেয়ি হলো।শাখরুনাকে দেয়ার জন্য আলম সব মেয়েকেই ঈদের কার্ড দিল।বিপরীতক্রমে শাখরুনাও আলমকে দেয়ার জন্য আমাদএর সবাইকে কার্ড দিল।সেই কার্ড খুজলে আমার ড্রয়ারে আজও পাওয়া যাবে।

যাই হোক ম্যাবসে এভাবে খুনসুটি চলতে লাগল আলম শাখরুনার।তাদের সম্পর্ক আরো প্রগাঢ় হতে থাকে।আলমের কাছের মানুষ হিসাবে আমি এটা মর্মে মর্মে অনুভব করতে থাকি।আলম অদ্ভুত কিছু কাজ করত অবসর সময়ে।নামে নামে মিল বের করে ভালবাসার হার বের করত।পদ্ধতিটি এখন ভুলে গেছি।কিভাবে যেন নামের অক্ষর কাটাকাটি করে করতে হয়।সে নিজের বিভিন্ন নাম আর শাখরুনার বিভিন্ন নাম(বুড়ি বাবুএই জাতীয় নিক) মিলাত।আর কখনো ৮০% এর নিচে নামলে তার মুখ চোখ আধারে ঢেকে যেত।আমি তখন হিসাবে চুরি করে সিস্টেম বদলিয়ে ৮০ এর উপর করে দিতাম।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলে এল।তা আলম নিয়ে এল রেডিও।এই রেডিও নিয়ে মজার ঘটনাও ঘটল।সেদিন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ।আলমের রেডিও এসেছে আমাদের ক্লাশরুমে।আলম কানে দিয়ে স্কোর শুনে আর তার দিকে ধেয়ে আসে অনেকগুলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।আবার স্যার এলে সব চুপ হয়ে বসে।তা ইতিহাস সাইফুল (ড্রামা সোসাইটির স্যার এবং রাইসুল ইসলাম আসাদের সথে মিল থাকয় যার নাম ছিল লেকু) এলেন এবং কোন হিন্টস ছাড়া আলমকে বললেন কী স্কোর কত?আলম থতমত খেয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই স্যার ওর রেডিও সিজ করলেন ।মজা হল স্যার নিজেও খেলার স্কোরে মজে গেলেন।তা খেলা শুনতে পারার খুশিতেই কিনা স্যার প্রেপ শেষে আলমকে রেডিও দিয়ে গেলেন।

আরেকদিনের কথা।সেদিন দুইটা খেলা হচ্ছে।তা তখন ডিশের সুবিধা না থাকায় একটা খেলাই দেখছি সবাই।আমরা অবশ্য একটু এগিয়ে ।আমরা বলতে আমি আর আলম -আমরা কিছুক্ষন পর পর রেডিওতে স্কোর শুনে আসি।বড় ভাইরা ঐ খেলার আলোচনা করতে আলম আড় আমি বলে দিলাম সর্বশেষ স্কোর।এইবার আর বাচা গেল না।রেডিও সিজ করে হাউস লিডার রায়হান ভাই আলমকে বলে দিলেন টার্ম শেষে হাউস মাস্টার অফিস থেকে নিয়ে যেতে।

আমাদের খেলা শুনা আর আলমের মিথ্যার ভংগিতে স্কোর বলে বাজিজেতা বন্ধ হয়ে গেল।ক্রিকেটের জোয়ারে আমরা নিজেরাও খেলতে লেগে গেলাম।পাকিস্তান সমর্থক বনাম এন্টি পাকিস্তান।তা আমদের ব্যাচের একজন ভালো ক্রিকেটার বাদ পড়ে গেল কোনটা না করাতে।এবং সেই ম্যাচ ফলাও করে আমরা পত্রিকা বের করলাম “রাতের আধারে”।তার সম্পাদক ছিল রেজওয়ান।আমি ছিলাম তার সহকারী ।তা ক্লাশে এইটা নিয়ে হৈ চৈ করে রেজওয়ান খেয়ে গেল এক্সট্রা ড্রিল।তাতেও আমরা থামিনি।তা এন্টি পাকদের অধিনায়ক হিসাবে আলম আমাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিল।সেটা দেয়ার সময় তার মুখের আকর্ন বিস্তৃত হাসি আজও আমার চোখে ভাসে কেবলই।

ক্লাশ টেনের সুন্দর দিন গুলি ক্রমেই শেষ হয়ে যায় সামনে চলে আসে এস এস সি পরীক্ষা।আর তার আগে হঠাৎ হ্যা হঠাৎ করেই আলমের সাথে আমার ঝগড়া হয়।কার দোষ ছিল মনে নেই কিন্তু সেই ঝগড়ার জের চলে এস এস সি পরীক্ষা পর্যন্ত।সেই কৈশোরের চাপল্যে যদি তোমার মনে বেশি আঘাত হেনে থাকি আলম তুমি ভুলে যেও তা চিরদিনের জন্য।

সাত…….

কখনও কখনও সেই দিন গুলিকে মনে হয় স্বপ্ন কিংবা বলা চলে ঘোর। ঘোর লাগা আমাদের সময়- সেই ক্লাশ ইলেভেন।যে সময়ের প্রতীক্ষা সকল ক্যাডেট করে থাকে তার ক্যাডেট জীবনের প্রথম দিন থেকে।সেই সময়টার দিকে যখন ফিরে তাকাই তখন আমার কাছে মনে হয় যেন কোন সোনালি সুখ স্মৃতি।সেই সোনালি দিন গুলিকে রবি ঠাকুরের সেই নানা রঙের দিন গুলির চেয়েও বেশি রঙিন মনে হয়।ক্লাশ ইলেভেনে আসতেই আমার বন্ধুগুলো বদলে যায়।বাল্যকাল পেরিয়ে কৈশোরের দুয়ারে ঢোকার জন্যই যেন এই পরিবর্তন।আগের সেই সময় আমাদের সাথে থাকে।কিন্তু আমরা যেন একটু একটু করে পরিপক্ক হতে শুরু করি।তাই এসময়কার দুষ্টামি গুলোতে যেন আরো বেশি মুন্সিয়ানার ছাপ।

পরিবর্তনের হাওয়া টের পাই নিজের মাঝেও।এখন আমরা আগের মত তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে ঝগড়ায় মেতে উঠি না ।সিনিয়র হয়েছি এই বোধ কাজ করে সবসময়।এই বোধ থেকেই হোক কিংবা অজানা কোন ঝোকেই হোক আমাদের ক্লাশমেটদের ব্যাক্তিগত ক্ল্যাশগুলো মিটে যেতে থাকল অতি দ্রুত।এমনি কোন ভাবেই আমাদের কয়েকজনের সাথে আলমের দ্বন্দ্বের অবসান হলো।এরপর মনে হলো আমাদের মধ্যকার সেই দ্বন্দ্ব সেই ঝগড়া আমাদের মাঝের অদৃশ্য সুতাটাকে অনেক শক্ত করে ফেলেছে।আর আলম আমার কাছে আগের চেয়ে অনেক অনেক কাছের মানুষ বলে মনে হতে লাগলো।

ইলেভেন টুয়েলভের সেইদিন গুলো আমার কাছে খুবই মোহময় মনে হয়।তার যেন কোন শুরু নেই কিংবা শেষ নেই কিংবা আছে যা আমরা বুঝি শেষ হওয়ার পর।সেই দিন গুলি মনের ফ্রেমে সদা উজ্জল। আর সেই দিন গুলিকে আমার কাছে মনে হয় কেমন যেন অখন্ডতায় মোড়ানো।সেই দিন গুলোকে আমি শুধু ছুতে পারি আমার অনুভবে কিন্তু ভাষায় আসে না কিংবা আসে কিন্তু প্রকাশিত হবার আগেই হারিয়ে যায় ক্ষনজীবি শিশিরের মত।সেই দিন সেই ক্ষন ভাসে -ভাসে আমার সমস্ত অনুভুতিতে,ছুয়ে আমার সম্পূর্ন সত্তাকে।সেই দিন এসেছে চলেও গিয়েছে কিংবা যায়নি।সে রয়ে গেছে আমাদের সব কয়তি হৃদয়ে এক নিবিড় আনন্দাধার হিসাবে।

বিশেষভাবে মনে পড়ে সেই সাতদিনের শিক্ষাসফর।সেই স্বপ্ন যাত্রা সেই ছুটে চলা-একটি ক্ষুদ্র বাস ধারণ করে নিয়ে গেছে ৩৮ জন তুচ্ছ মানব সন্তানের অসীম স্বপ্ন গুলোকে।সেই স্বপ্ন দিন স্বপ্ন যাত্রায় আমার সাথে আলমও ছিল।ছিল না বলে বলি,ঐ সময় ঘুরা নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয়েছিল আর আলম আমার সাথে সেই গ্রুপে ছিল।মনে পড়ে সেই ফৌজদারহাটের রেস্ট হাউস কিংবা সেই মোটেল লাবনীকে।মনে পড়ে সেই সাতটি দিনে ৩৮ টি প্রানের উচ্ছল দুরন্ত ছোটাছুটি।অতি আপাত তুচ্ছ বিষয়গুলোও যেন শুভ্র আনন্দ হয়ে রূপালি উচ্ছাসের ঢেউ তুলছিল।মনে পড়ে হিমছড়িতে যেতে না পেরে আমি আর আলম প্ল্যান করলাম নতুন কিছু করার।সী বিচে সিগারেট খোজ করে ভালো কোন সিগারেট না পেয়ে অতি নিম্ন সানমুন একসাথে খাওয়ার স্মৃতিও মনে পড়ে।আরও মনে পড়ে হিমছড়িতে না গিয়ে কক্সবাজার সার্কিট হাউস আর বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে আমরা এসে ধরা খেলাম এডজুট্যান্ট এর কাছে।সেই সময় কার স্মৃতি গুলোকে এতটা কাছে মনে হয় যেন ধরতে চাইলে সে এসে ধরা দেবে আমার কাছে।

মনে পড়ে সেই ইলেভেনের দিনটির কথা।সেই দিনটি আমি কখনও ভুলিনি।সেদিন আমাদের সেকেন্ড টার্ন জুনিয়র প্রিফেক্ট দেয়ার কথা।তো আমাদের হাউসে সম্ভাব্যদের মধ্যে যে দুজনের নাম ছিল তাদের মধ্যে আলমও ছিল।আমরা অপেক্ষা করছিলাম মোটা আলম কখন তার গগন বিদারী চিৎকারে হাউসের জুনিয়রদের তটস্থ করব।কিন্তু বিধিবাম। সেদিন নোটিশ এল।আলম জুনিয়র প্রিফেক্ট হয়নি।হয়েছে আরেকজন। এর বিরুদ্ধে জোর কিছু বলতে যাব তার আগেই লক্ষ্য করলাম সেই আরেকজনটি হচ্ছি আমি।অসম্ভব মন খারাপ হলো আমার।কিন্তু সেই মন খারাপ কেটে গেল যখন আমি প্রথম অভিনন্দন বার্তাটি পেলাম আমার প্রিয় বন্ধু আলমের কাছ থেকে।

সেই সোন ঝরা দিন আজো আমার মনে ঝড় তোলে ।আমার মধ্যে বয়ে যায় তোলপাড়।আলমের আরেকটি গল্প মনে এল।কোন এক প্র‌্যাকটিকাল পরীক্ষায় আলম সেভ ছাড়া গিয়েছিল।তা দেখে আমাদের এক স্যার বললেন,তোমাকে কেমন লাগছে জান?আলম সবিনয়ে জানতে চাইল কেমন?স্যার উত্তর দিলেন বাংলা সিনেমার বিরহী নায়ক জসীমের মত।সেই থেকে ওর নাম হলো জসীম।এই নামটিও যথেষ্টই জনপ্রিয় ছইল।এর বদৌলতে আমরা প্রতি শুক্রবার অলস দুপুর কাটাতে লাগলাম জসীমের বস্তাপচা বাংলা সিনেমা দেখে।আর তার ডায়লগে আলমের কান যে ঝালাপালা হত তা বলাই বাহুল্য।

এভাবে সময় গড়ায়।পেরিয়ে যেতে থাকে একেকটি সোনালি দিন।সেই প্রেপ ফাকি দিয়ে টয়লেটের কোনে আড্ডা, সেই স্যারদের সাথে খুনসুটি।কখনও নিজেরা আন্ত ফর্ম চক ছুড়াছুড়ি বিবাদে জড়ানো -সবই ভাসে আমার অন্তর্নয়নে।হাউসের সামনে দাড়িয়ে চিয়ার্স দেয়া কিংবা খেলায় ঝিতে ট্রফি নিয়ে উল্লাস এসবও অতীত হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।স্যারের হাতে ধরা খাওয়া কোন হতবুদ্ধি সময় কিংবা প্যারেডে বেল্ট লুজে ইডি খাওয়া এসবও ভীড় জমায় স্মৃতি পটে।কোন অলস দুপুরের অনর্থক আড্ডা কিংবা স্নিগ্ধ সন্ধ্যার রোমান্টিক আলোচনা, গেমস শেষে ক্যান্টিনে খাবার নিয়ে কাপঝাপ করা,শুক্রবার সকালে ক্রিকেট খেলার আশায় গেমস স্টোরে ভিড় জমানো কিংবা ক্লাশে ঘুমিয়ে স্যারের হাতে ধরা খেয়ে সলজ্জ নয়নে হাসা-এমনি আরো অনেক অনেক মধুময় স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ।

ক্যাডেট কলেজ আমার ভালো লাগে কারণ সে ধারণ করে আছে আমার মধুময় কিছু সময়কে।সেই সময়টা সময়ের আবর্তে আরো মধুময় হয়ে উঠেছে আমার হৃদয় পটে।এমনিভাবে একসময় শেষ হয়ে যায় আমাদের ক্যাডেট জীবন।অনেক ভালো লাগা অনেক ভালো লাগার এম সি সি কে আমরা বিদায় জানাই।বিদায় জানাই ক্যাডেট হিসাবে চিরতরে।

ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার সময় আলম আমাকে বলেছিলো, ক্যাডেট কলেজে আমরা থাকব না কিন্তু আমাদের নাম্বার গুলো রয়ে যাবে আর এ জনমে আমরা সমসময়ই থাকব একে অন্যের মাঝে।সেই কথা তার হ্য়তো বৃথা হয়নি কিংবা কে জানে হয়েছে ?সেই ক্যাডেট কলেজ হতে আমরা বেরিয়েছিলাম ২০০২ সালে কিন্তু আজও সেই দিন গুলোকে খুব কাছে ধরা দূরত্বে মনে হয়।এত কাছে তবুও এত দূরে……আমার ক্যাডেট কলেজের সোনার দিন গুলি।

(ক্যাডেট কলেজের কথা এখানেই শেষ কিন্তু ক্যাডেট নম্বর ১৮৬২ এর আরো কিছু গল্প রয়ে যায়। সেই গল্প টুকুর জন্য এই লেখা চলবে)

৩,৮৬৯ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট নম্বর ১৮৬২-অসময়ে হারিয়ে যাওয়া অতি আপনজন (পর্ব ২)”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    অসম্ভব সুখপাঠ্য একটি লেখা।কলেজ জীবন যেন বায়োস্কোপে ভেসে উঠছে চোখের সামনে।আমিন ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।বাকিটুকু পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      অনেক ভালো লাগলো`জেনে।বাকিটুকুতে`কলেজ লাইফ থাকবে না কিন্তু ক্যাডেট নম্বর 1862 থাকবে।লেখা লিখতে গিয়ে অনেক ঘটনা মনে এসেছে।তার কোনটা লিখব আর`কোনটা লিখব না বাছাই করা কষ্ট হয়ে গেছে।
      আমার দীর্ঘ লেখা ধৈর্য`ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

      জবাব দিন
  2. সাব্বির (৯৫-০১)

    খুব সুন্দর লেখা। বেশ ভাল লাগল।
    আলমের অনেক কথা শুনেছি তোমাদের ব্যাচের ইমরান খান এবং মাহমুদুল হাসানের কাছে। ব্রিসবেনে থাকার সুবাদে এই দু জনের সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা।
    পরবর্তী পর্ব পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

    জবাব দিন
  3. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    very well written..thanx amin...purono diner onek kotha mone pore jasse...tomar baki part gulor opekhai thaklam..sajid vai khubi mojar manush silo...amar akta assistant thakle take diye type korano jaito..tomar chehara man vule gesilam..hothat gotokal mone porse..tomar current chobi upload koro..nyway all the best..
    disclaimer>>office e asi so bangla type korte parchina..kindly adjust

    জবাব দিন
  4. ত্রিমিতা (৯৬-০০)
    গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে আসা চিঠিগুলো অবশ্যি দেখলেই বুঝা যেত। কেননা ওদের হাতের লেখা গুলো যেন একই রকম ছিলো।

    এক্কেবারে হক কথা। :thumbup:
    যখন যেই স্টাইল পপুলার হত আমরা পুরা কলেজ সেই স্টাইল ফলো করতাম।

    তা আলমের কাছে যে চিঠি আসত তা দেখার সুযোগ হতো আমার।শাহরুখ নামধারী কোন মেয়ের কাছ থেকে আসত চিঠিগুলো।আর আলমের চিঠি গার্লস কলেজে যেত রুশি নামের মেয়ের পক্ষ থেকে।

    🙂 তোমার আর আমার ব্লগের রেফারেন্স হয়ে গেল।

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      হাতের লেখার ব্যাপারটা বরাবরই আমার কাছে ধোয়াশা ছিলো। এমনকি সামুতে যখন এটা নিয়ে লিখি এক ক্যাডেট আপুর সাথে এটা নিয়ে তর্কও হয়েছে। তোমার স্বঈকারোক্তি আপাতত কনফিউসন দূর করল।

      তোমার আর আমার ব্লগের রেফারেন্স হয়ে গেল।

      এটা মনে করেই কালকে এই লেখার লিংক দিলাম।

      জবাব দিন
  5. মুহিব (৯৬-০২)

    রুশো যেদিন মারা যায় আমি তখন ধানমন্ডি আর্মি ক্যম্পে ছিলাম। ঘটনার পর আমাদের একটা পেট্রোল পাঠানো হয়েছিল সেখানে। কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম যেতে পারি নি। তখনও জানি না এটা যে রুশো। পরে তৌফিকের(এম সি সি ৯৬-০২) আম্মা বলল এরকম ঘটনা। তখন খুব আফসোস হচ্ছিল। সেই পেট্রোলে গেলে হয়ত ওকে শেষ দেখাটা দেখতে পেতাম। ওর সাথে আমার পরিচয় ১১ এ থাকতে এফ সি সি তে ফুটবল মিট এ। খুব মজার সময় কাটিয়েছিলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফুয়াদ'৯৯

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।