ক্যাডেট নম্বর 1862- অসময়ে হারিয়ে যাওয়া অতি আপনজন…….

এক…..

অনেক ধরেই ভাবছিলাম ক্যাডেট কলেজের ঘটনা নিয়ে লিখব।ব্যস্ততা আর আলসেমি দুয়ে মিলে তা সম্ভব হচ্ছিল না।তারপরও আজ না বসে পারলাম না। এর কারণ একটি বিয়ের দাওয়াত। অনেকেই চমকে উঠতে পারেন,ক্যাডেট কলেজের সাথে বিয়ের দাওয়াতের আবার সম্পর্ক কি এই ভেবে। সম্পর্ক এজন্য দাওয়াতটি সেনাকুঞ্জে। সেনাকুঞ্জ নামটি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে এই লেখা।কারণ এই সেনাকুঞ্জেই তার বিয়ে হবার কথা ছিল। সে বলতে ক্যাডেট নম্বর ১৮৬২। আমার পরের ক্যাডেট নম্বর আর আমাদের ব্যাচের শেষ ক্যাডেট নম্বর। ক্যাডেট নম্বরে শেষ হলেওকিছু জায়গায় সে আমাদের আগে। সে ছিল আমাদের ব্যাচের প্রান। তাই আমার ক্যাডেট কলেজের গল্প বললেই আসবে তার গল্প আমার গল্প আমাদের গল্প। একজন ক্যাডেটের গল্প একটি ব্যাচের গল্প একটি ক্যাডেট কলেজের গল্প।

ক্যাডেট কলেজ নামক ভয়ানক জায়গায় আমার পদার্পন ১৯৯৬ সালের ৪ঠা জুন। আমার আশৈশবের স্থান ছেড়ে নতুন জায়গায় এসে যাকে দেখে ভরসা পেলাম তিনি সোহেল ভাই। ক্যাডেট কলেজে আমার এসকর্ট। ছোটখাট হাসিখুশি এই মানুষটিকে দেখে ভরসা না পাওয়ার কোন কারণ নেই। তা থার্ড প্রেপের পর তিনি যখন আমাকে কয়াডেট কলেজের প্রপার শান ফল আউট এইসব আদব কায়দা শেখাতে ব্যস্ত তখন, এই পিচ্চি এদিক শোনো। -এমন একটি গলা ভেসে এল আমার পাশের বেড থেকে। সোহেল ভাই হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিলেন এবং কড়া চোখে তাকালেন আমার পাশের বেডের দৈত্যদেহী আমার ক্লাশমেটটির উপর। সোহেল ভাই আর আমার সেই ক্লাশমেটের শারীরিক গড়নের অসামঞ্জস্য দেখে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বিনিময়ে কড়া ঝাড়ি ঝুটল সিনিয়রদের থেকে। প্রথম দিন না হলে নিশ্চয় উত্তম মধ্যমও জুটত।

যাহোক সে দীর্ঘদেহী ছেলেটি ,যাকে দেখে প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তার সরল মনের পরিচয় ঘটল একটু পরেই। ক্লাশ টুয়েলভ অর্থাৎ ক্যাডেট কলেজের অঘোষিত শাসকদের আগমন ঘটল একটু পরে। শাসকদের শাসক কলেজ প্রিফেক্ট আদিল ভাই তার পরিচয় দিলেন।
আমি কলেজ প্রিফেক্ট ,তিনশ ক্যাডেটের রাজা।রসিকাতাচ্ছলে বলছিলেন তিনি। এর মধ্যে দেখি আমার সেই ক্লাশমেট হাসছে। হাসছ কেন? কলেজ প্রিফেক্ট এর জেরার মুখে সে অবলীলায় সে বলে দিল,আপনার চেহারা মি. বিনের মত। আদিল ভাই একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। ক্লাশ টুয়েলভের এক ভাই বলল,তোমার নাম কি?সে বলল, আলম। এই ছেলে একদিন মাল হবে-বলে চলে গেলেন সেই ভাইয়ারা।

আমি পরিচয় পেয়ে গেলাম দৈত্যকৃতি শরীর বহনকারী অসম্ভব সহজ সরল হাসিখুশি এক বন্ধুর খোজ। যার সাথে কাটল আরও দীর্ঘ ১১বছর। তার গল্পের শুরু এখানে।

দুই…..

ছোটবেলায় একেবারে নিজের চেনা গন্ডির মধ্যে বেড়ে ওঠার করনে ক্যাডেট কলেজের প্রথম দিন গুলি অনেক দীর্ঘ মনে হত।সারা দিন ড্রিলের গুতানি আর হাউসে সিনিয়রদের যন্ত্রনা সব মিলে আমি হাপিয়ে উঠছিলাম।
আমার সবচেয়ে ভালো সময় কাটত গেমস টাইম। হৈহৈ করে ফুটবল খেলতাম সবাই। তা আমার আগে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় ফুটবল খেলায় আমার জায়গা হলো ডিফেন্সে। গ্রাম্য ভাষায় বলতে বেগী। তা আমার পার্টনার হলো আলম। তার বিশাল দেহের কারনে তাকে সবাই চীনের প্রাচীর তুল্য জ্ঞান করত। সে হলো মেইন বেগী। আর আমি তার সহবেগী। সেই শুরু। এরপর একে একে পাচটি ফুটবল কম্পিটিশন আমরা কলেজ লাইফে খেলে ফেললাম সহবেগী হিসাবে। শেষ কম্পিটিশনে আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন। আমরা ম্যাচে চার দুই গোলে এগিয়ে। সে উঠে যাচ্ছে বাড় বাড় কর্নারের সময়। আমি মানা করছিলাম। সে শেষবারের জন্য অনুমতি চাইল। বলল,এবার না হলে আর যাব না। অদ্ভুতভাবে ষেই কর্নারকে গোলে পরিনত করল সে। একেবারে স্বপ্নের মত। আমাদের ফুটবল কম্পিটিশনের শেষ গোল।

ফুটবলের কথাই যখন আসল তাকে নিয়ে আরেকটি মজার ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। তখন ১৯৯৮ সাল। বিশ্বকাপ শেষ। টার্ম শুরু হবে হবে। তআ প্রথম দিন কোন কাজ নেই। তো তখনকার ক্লাশ সেভেনের মধ্যে হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। হাউসে ভূমিকম্প হচ্ছে। ছাদ ভেঙ্গে পড়ল বলে। হাউস কাপছে। হাউস মাস্টার ডাকাডাকি সিরিয়াস অবস্থা। তা হাউস মাস্টার উপরের রুমে এসে দেখতে পেলেন আমাদের। পাউডারের কৌটা দিয়ে টাইব্রেকার খেলছিলাম আমরা বেডের মাঝের জায়গা গোল পোস্ট ধরে। তা আলম গোল রক্ষক হয়ে তিন চারবার চিলাভার্ট ডাইভ দেয়াতে এই বিপত্তি। আলমের এই বিশাল শরীর তিনচারবার জোড়ে আছড়ে পড়লে তা যে ভুমিকম্পের মত লাগবে তা আর বিচিত্র কী। হাউস মাস্টার পুরো ব্যাপারটিতে মজা পেলেন তাই তেমন কিছু না বলে হালকা ঝাড়ি দিয়ে আমাদের বিদায় দিলেন।

যা হোক ফিরে যাই ক্লাশ সেভেনের জীবনে। ক্যাডেট কলেজ আমার জীবনে অনেক প্রাপ্তি ঘটিয়েছে। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলতে আমার অকৃত্রিম বন্ধুরা। ক্যাডেট কলেজ এমন জায়গা যেখানে আমাকে আমাদেরকে লড়তে হয়েছে অস্তিত্বের জন্য। আর একে টিকিয়ে রাখতে সহযোদ্ধা সব সময় ক্লাশমেটরা। আর তাই ক্যাডেট কলেজে আমাদের বন্ধুত্ব অনেকটাই আরোপিত। কিন্তু আমি নিঃসংকোচে এই দাবি করতে পারি আমাদের এই আরোপিত বন্ধুত্বের গভীরতা অনেক দিক ছাড়িয়ে গেছে অনেক স্বতঃস্ফুর্ত বন্ধুত্বকে। আমাদের এই বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন আমাদের একত্রে সংগ্রামের ইতিহাস যেটাকে আমি অনেক বড় বলে মানি ,জানি অনেক বোদ্ধাই একে অমানবিক বলবেন। কিন্তু ক্যাডেট কলেজে যে না থেকেছে তার পক্ষে এই সময় কে অনুভব করা অসম্ভব।

এমনি এক ঘটনা ঘটল ক্লাশ সেভেনে। ক্লাশ এইটের ভাইরা আমাদের শাসনে ব্যস্ত সবসময়। আর তাদের কিছু করত বাড়াবাড়ি। ঐ বয়সে যা হয় আমরা অচিরেই সেই ভাইদের বিভিন্ন টিস নাম বের করে ফেললাম। আর তা চলতে লাগল মুখে মুখে। বেশিদিন লাগল না ধরা খেতে। আমার একবন্ধু বেখেয়ালের বশে সিনিয়রের সামনে বলে ফেলল একটি নাম। আর যায় কোথায়। শুরু হল আমাদের উপর জেরা – উদ্দেশ্য নাটের গুরু বের করা। ক্লাশমেট ফিলিংস নামক জিনিসটা আমরা ততোদিনে আমাদের মধ্যে ভালোভাবে বাসা গেড়ে ফেলেছে তাই অস্বীকার করতে লাগলাম। সবাই মার খেলাম গনহারে। আর বেশি পড়ল তার উপর যে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল। তার উপর অত্যাচার এই মাত্রায় উঠল নাটের গুরুরা নিজে থেকে দায়িত্ব স্বীকার করল। আর প্রধান নাটের গুরু আলম ছিল কিনা জানি না,কিন্তু সিনিয়রদের রাগ তার উপর বেশি থাকায় তাকে ধরা হলো নাটের গুরু। তার পর তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল ওরা। সে কী মার। হ্যাংগারের পর হ্যাংগার ভাঙল ওর উপর। একপর্যায়ে যখন থামল তখন ওর ফর্সা শরীর লালে লাল হয়ে গেছে।

সিনিয়রগুলোকে তখন ঘৃণা করেছিলাম কিন্তু এখন তারা সবাই আমার খুব কাছের, মানুষ বন্ধুপ্রতিম। এটাই ক্যাডেট কলেজের সৌন্দর্য।

তিন……

সময় এগিয়ে যেতে থাকে। নিত্যকার নিয়মে সূর্য উঠে হাউসের পিছনের রহস্যময় সুন্দর পুকুরের মাথায়। কিংবা কোমল জোছনা পরশ বুলিয়ে চলে থার্ড প্রেপ শেষ করে হাউসে ফেরা ক্যাডেটদের উপর। সেই সাথে এগিয়ে যেতে থাকি আমরা-মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ৩৪ তম ব্যাচ। সেভেন পেরিয়ে এইটে উঠতে উঠতে ক্রমশই আমি থেকে আমরা তে পরিনত হতে থাকে অবুঝ ৩৮টি প্রান। সেই দুঃসহ সেভেনের দিনগুলিকে মনে হতে থাকে
যেন সূদুর অতীতের ঘটনা। আমরা ৩৮ দেহ এক প্রান হয়ে যেতে থাকি। ক্যাডেট কলেজের সাথে ধাতস্থ হয়ে যাই ক্রমেই। সিনিয়র হয়ে যাচ্ছি আমরা।

অবশেষে একদিন আমাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পদার্পন করল আমাদের পরের ব্যাচ। এবং অদ্ভুত ভাবেই আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়রদের সাথে আমাদের দূরত্ব কমে এল। সেই হ্যাংগার ভাঙা সেই নির্ঘুম অবসর যেন হারিয়ে যেতে থাকল। তারা হয়ে উঠতে থাকল বন্ধু প্রতিম। তাদের চাহারা আর দুগ্রহের মত প্রতিভাত হয় না। কলেজ ট্রেডিশন অনুযায়ী আমাদের পিছু নিল দুই ব্যাচ সিনিয়ররা। কিন্তু এখন খেলা আর একতরফা না। আমরাও লাগি ওরাও লাগে। নতুন যুদ্ধের জন্য যেন আমাদের প্রস্তুত করে দিয়ে গেল আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়ররা।
দুই ব্যাচ সিনিয়রদের সাথে আমাদের লড়াই আর হলো না অবশ্য। তার কারণ ঐ আলম। সে ভালো ক্রিকেট খেলত। তাই সিনিয়রদের সাথে খেলতে ওর ডাক পড়ত মাঝে মাঝে। আর দুই ব্যাচ সিনিয়রদের কাছে ও হয়ে গেল আদরের সাবু। হ্যা,শরীরের গড়নের কারণে চাচা চৌধুরীর সাবুর সাথে মিলিয়ে ওর এই নামকরণ। সেই তার নিক নামের শুরু। আমরা যখন টুয়েলভে আমরা নিকনামের জরিপ করে আলমকেই পেয়েছিলাম। শীর্ষে। তার সব মিলিয়ে মোট ১৬ টা নিক আবিষ্কৃত হয়েছিল। আর মজা হলো এ সহজ সরল ছেলেটি তার নিকগুলো এনজয় করত। তা তার সবচেয়ে জনপ্রিয় নিক ছিল সেলিম(যা আজও আমার মোবাইলে সেভ করা)। সেই গল্প বলি।

নাইনে আমরা। বায়োলজীর কোন পাক্ষিক পরীক্ষার খাতা দিতে এসেছেন নুরুল হক স্যার যিনি আমদের মাঝে হক ব্যাটারি নামে পরিচিত ছিলেন। তা একটা খাতা নিয়ে বিরক্ত ভাবে তিনি বললেন কিছু একটা যে ছবি ভালো হ্যনি বা কিছু জাতীয়। তা কার খাতা খোজ করতে গিয়ে তিনি বলে উঠলেন সেলিম কে?আমরা তো অবাক। সেলিম নামে আমাদের তো কেউ নেই। স্যার আবার মনযোগ দিয়ে নাম পড়ে আবারও বললেন সেলিম। আবার সবাই অবাক।মুখ চাওয়া চায়ি করছি। এমন সময় একজন সাহস করে স্যারের সামনে গিয়ে খাতা নিল। আর নাম না পড়েই সে বুঝে ফেলল খাতা কার। কারন আমন প্যাচানো ছোট বিদঘুটে লেখা একজনেরই আছে। সে আর কেউ নয় আলম। তা তার লেখার প্যাচে কিভাবে যে আলম সেলিম হয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না।

এই নামটি বিখ্যাত হতে বেশি সময় লাগল না। অল্প সময়ে আলম সেলিম নামে পরিচিত হয়ে গেল। আমাদের আড্ডায় তার আগমন ঘোষনা হতো সেলিম নামটি জোরে উচ্চারনের মাধ্যমে। মাঝে মাঝে সে নিজেও যে তাতে অংশ নিত না তা কিন্তু নয়। সেই নাইনের সময়-ক্যাডেট কলেজের মধ্যগগনে উদিত সূর্য যখন আমরা- আমার স্মৃতির ঝাপি খুলে দেয়। কারেন্ট যাওয়া অনেক আড্ডার সন্ধ্যাকে মনে পরে। মনে পরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাকে নিজের মত উপভোগের গল্প। মনে পড়ে কোন অবসরে বাইরে নিজেদের একনকে পালক্রমে গার্ড রেখে ক্যাডেট কলেজ আবিষ্কৃত রুম ক্রিকেটের গল্প। মনে পরে বন্ধুদের অর্থহীন ঝগড়া। আর ঝগড়া শেষে মধুর পরিসমাপ্তি। মনে পরে স্যারদের নিক নাম দেয়া স্যারদের সাথে দুষ্টামির গল্প। আমাদের তারুন্যের উচ্ছাসকে ক্যাডেট কলেজ থামিয়ে দেয়নি বরং তাকে নিয়ন্ত্রন করেছে অদ্ভুত ভাবে।

একদিনকার কথা আমদের এক স্যার সব কথা বলেন প্রথম পুরুষে। তা আমি সেটা জানি না। সেই স্যারের ক্লাশ । আলম দেরিতে ঢুকেই বলতে লাগল আগের দিন ডিনারের গল্প। স্যার ওকে জিজ্ঞেস করেছেন কী আলম মাছ খাই না? আমি শুনে মাথামুন্ডু কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্যার আমাকে আলমকে ডেকে বললেন- কি হল,দেরি করে আসি ক্লাশে আবার কথা বলি। এবার আমি পুরো ব্যাপার বুঝে ফেললাম। হাসি আটকাতে সেদিন বড় কষ্ট হয়েছিল।

স্যারদের নিয়ে আমরা শুধুই হাসি ঠাট্টা করতাম এটা ভাববেন না যেন। ক্যাডেটরা চঞ্চল কিংবা দুষ্টু হতে পারে তাই বলে মানবিক আবেগ নেই একথা বলা ভুল। এক দিনের ঘটনা। আমাদের এক স্যার একদিন ক্লাশে ঢুকলেন । তার চেহারা বিষন্ন। ছাত্রদের সেলফ স্টাডি করতে বলে তিনি পিছনে বসলেন। তার চোখ টলটল তা ছেলেগুলির দৃষ্টি এড়ায় নি। তা পিছনে বসে কী যেন তিনি ছিড়ে ফেলে দিলেন বাইরে। মাথা নিচু করে বসে আছেন। এমনি সময় এক ছেলে বাইরে থেকে ছেড়া কাগজগুলি কুড়িয়ে এনে জড়ো করল। এতে বুঝা গেল স্যার নিঃসন্তান ছিলেন। তার এক পালক পুত্র ছিল তাকে নিয়ে যাবার খবর দিয়ে ঐ ছেলের অভিভাবক চিঠি পাঠিয়েছে। সেই ছেলে চিঠির টুকরো জোড়া দিয়ে স্যারের হাতে তুলে দিয়ে বলল,স্যার কাদবেন না। আমরা কলেজে তিনশ ক্যাডেট সন্তান থাকতে আপনি কেন কাদবেন?

তারপরের কাহিনী আমারা জানা হয়নি কোনদিনও। এই কাহিনী কাহিনীবাজ( আলমের আরেকটি বিখ্যাত নিক)আলমের মুখ থেকে শুনা । আর এ কাহিনী বলার সময় তার সদা হাস্যময় মুখে বিষাদের যে ছায়া পরে ছিল তা দেখে আমি আর জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

চার…..

ক্যাডেট কলেজ থেকে প্রথম যখন বাড়ি ফিরতাম বন্ধের দিনগুলোকে অনেক মধুর মনে হত। আমার বাসায় অবশ্য সঙ্গী বলতে তেমন কেউ ছিল না। সারাদিন টেলিভিশনে খেলা দেখে আমার সময় কেটে যেত। ক্যাডেট কলেজে যাবার আগে এলাকায় বন্ধু বলতেও তেমন কেউ ছিল না। তাই আমার বসবাস ছিল একা একদম একা। ক্যাডেট কলেজ আমাকে শিখিয়েছে বন্ধুত্ব অর্জন করতে। আমার বন্ধু বাৎসল্যের সূচনা ক্যাডেট কলেজেই। আর যতই সিনিয়র হতে থাকি বাড়ির মত ক্যাডেট কলেজও আমার প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করতে শুরু করি। ক্যাডেট কলেজের দিন গুলো আমার ভালো লাগতে শুরু করে।

ক্লাশ নাইন ক্যাডেট কলেজের শ্রেষ্ঠ সময়। সেভেনের মত সিনিয়রদের যন্ত্রনা এসময় থাকে না আবার এইটের মত জুনিয়র নিয়েও মাথা ঘামাতে হয় না।পড়ালেখার চাপ থাকে না টুয়েলভ আর টেনের মত আবার ইলেভেনের মত কলেজ প্রশাসনের নজরে পড়তে হয় না। আর আমার বন্ধুদের সাথে থেকে শান্ত সুবোধ বালক থেকে আমি হতে থাকি দুষ্টু চঞ্চল। কিশোরের চাপল্য আমার মাঝে প্রবেশ করতে থাকে অনেকের চেয়ে দেরিতে কিন্তু অনেক দ্রুত। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ সাক্ষী আমাদের বহু দূরন্ত অতীতের। কলেজের নিয়ম ভাঙার তাগিদে বৃহস্পতিবার অযথা কলেজ থেকে বের হওয়া ডাইনিং হল থেকে খাবার চুরি করে রাত্রে খাওয়া কোন অবসর বিকেলে হাসপাতালের পিছনে আম চুরি করতে যাওয়া এসব নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে যেতে লাগল। তা এমনি একদিনের ঘটনা বলি।

বৃহস্পতিবার সেদিন। স্টেজ কম্পিটিশন না থাকায় আমরা ৫ম পিরিয়ডের পর হাউসে। বৃষ্টি নামে নামে ভাব। তো আমাদের মাথায় জোগালো ভিপির বাসার সামনে থেকে আম চুরি করব। অমনি যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমরা চারজন বৃষ্টি উপেক্ষা করে রওয়ানা হলাম। আমি আলম আরেফিন আর সাদ ভাই-আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র।সাদ ভাই আর আলম দুজনে মিলে একরকম কাধে ধরে আরেফিনকে গাছে তুলে দিল। আর আমার দায়িত্ব থাকল পাহারা দেয়া কেউ আসে কিনা। এক পা সাদ ভাইয়ের কাধে আর এক পা আলমের কাধে রেখে আরেফিন আম পেড়ে যাচ্ছে। এমন সময় আমি হঠাৎ আমাদের এডজুটেন্ট সাহেবের চকচকে টাক দেখতে পেলাম।গেছি এইবার! এডজুটেন্ট বলে আমি সতর্ক করতেই আলম ভয় পেয়ে পালাবার পথ কুজল আর এতে ব্যালেন্স হারিয়ে আরেফিন গেল পড়ে। জগতের সব দৃশ্যের মধ্যে পতনের দৃশ্যই সবচেয়ে মজার । আমি হো হো করে হেসে আরেফিনকে ধরতে গেলাম আলম ও ফিরে এসেছে আরেফিনকে সাহায্য করতে। ওদিকে টাক মাথা এসে পড়েছে ধরাছোয়ার দুরত্বে। আমরা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলাম।

এমন সময়। তোমরা কা…রা?একি এতো আমাদের সোজা সাপ্টা জা.আলম স্যারের গলা। আসলে স্যারের টাক আর এডজুটেন্টের টাক একরকম বলে আমি গরমিল করে ফেলেছি। আলম এ অবস্থায় বলে উঠলো স্যআর আমি আ..লম। আপনার মিতা। আলম স্যারের ভংগি এমন নকল করল যে হাসি আটকানো দায়। সেই ঘটনার পর অবশ্য সে নিজেই তার নাম আলমের পরিবর্তে জালম করে ফেল্লো।

এভাবে হঠাৎ করে চোখ ফুটা মুরগীর মত হয়ে গেল আমার গতিবিধি। তাই বন্ধে আমার দিন আগের মত সুখময় হচ্ছিলো না। আর তখন টেলিফোন না থাকায় আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগও সম্ভব ছিল না। বন্ধে কলেজ ফ্রেন্ডের সান্নিধ্য পেতে কোচিং সেন্টার একমাত্র সমাধান বলে মনে হলো। এবং তা আরো লোভনীয় করে দিল আমাদের ছেলেদের থেকে শোনা ম্যাবস নামক কোচিং এর দিনের কথকতা।মাশরুর নামে আমার এক বন্ধু প্রথম ম্যাবসের খোজ আনল। ফল হিসাবে ওর নাম হয়ে গেল মঞ্জু আংকেল। সবাই এই নামে ওকে খেপাতাম। তা পরের বার আমি একা হয়ে গেলাম। কেননা বন্ধ থেকে এসে আলম সহ আমার আরো কিছু বন্ধু যারা মাশরুরকে খেপাত তারা ঘোষনা দইল সবাই মঞ্জু আংকেল হয়ে গেছে। অর্থাৎ কিনা সবাই ম্যাবসে পড়ে। সেখানে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজের অনেকে পড়ে। সবচেয়ে হাইলাইটেড হলো অবশ্য গার্লস ক্যাডেটই।

এবার আমার কাছে মনে হতে থাকে বন্ধুগুলো একবন্ধে কেমন যেন বদলে গেছে। কি যেন একটা চেঞ্জ। তা নারীর সান্নিধ্যই বদলে দিয়েছে এই চপল ছেলেগুলোকে। এমনি যাদু তার। সবচেয়ে বদলে গেল আলম ই। তার খাতায় পাতায় লেখা হতে থাকল R+S.ওর ডাকনাম রুশোর আর আর এস কে ?জিজ্ঞেস করলে সে কেমন যেন এক রহস্যময় হাসি দেয়। সে আমাকে একটা নাম্বার মনে রাখতে বলল। আমার স্মৃতি শক্তির উপর আস্থা রাখল আর কী? তা এর মাহাত্ম্য টের পেলাম দুইদিন পর। যখন সে চিঠি লিখতে শুরু করল গার্লস ক্যাডেট বরাবর…….।

সে আরেক নতুন গল্পের শুরু।

(চলবে…..)

***আমার এই লেখাটা বাধভাঙার আওয়াজ ওরফে somewhereinblog এ ধারাবাহিকভাবে লিখছি। তার প্রথম কয়েকটি পর্ব একসাথে দিয়ে দিলাম এখানে সকল ক্যাডেটদের জন্য।

২,৬৪৬ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট নম্বর 1862- অসময়ে হারিয়ে যাওয়া অতি আপনজন…….”

মওন্তব্য করুন : সায়েদ উল হাসমত (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।