প্রসঙ্গ: জঙ্গীবাদ, ক্যাডেটীয় ভ্রাতৃত্ববোধ এবং কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা

[শিরোনাম দেখে যদি কেউ ধরে নেন ক্যাডেট কলেজ এবং এক্স ক্যাডেটদের বিষোদাগার করবার জন্য লিখছি, তাহলে অনুরোধ করব দয়া করে লেখাটা নির্মোহভাবে পড়ুন। আমার পুরো লেখাটার উদ্দেশ্যই সমস্যাটার মূল বোঝার চেষ্টা করা এবং সমাধানের পথ খোঁজা]

এক

আমাকে যদি সত্যিকার অর্থে আমার জীবনের সবচাইতে বড় সৌভাগ্যগুলোর মধ্যে পাঁচটা বেছে নিতে বলে, তাহলে সম্ভবত আমি প্রথমেই বলব ক্যাডেট কলেজের কথা। কথাটার মাঝে আবেগ যতটুকু তারচেয়ে নির্মোহভাবে প্রাপ্তির হিসাব নিকাশ কোন অংশে কম নয়। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে ক্যাডেট কলেজে না ঢুকলে আমি আজকে যতটুকুই এসেছি তার কাছাকাছি যেতে পারতাম কিনা সন্দেহ। কলেজের বড় প্রাপ্তি হলো পিয়ার ফিলিংস, যার ব্যাপ্তি প্রথমে ক্লাশমেট ফিলিংসে শুরু হয়, পরে হাউস ফিলিং কলেজ ফিলিংস ছাপিয়ে দিন শেষে ক্যাডেট ফিলিংসেই পরিণত হয়। আজও পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে একজন এক্স ক্যাডেটের সাথে দেখা হলেই এক ধরণের আপন টান অনুভব করি। এই অনুভূতিটা আসলেই আলাদা। কেননা এ জিনিস আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে, সময় স্থান ভেদে ক্যাডেটরা সব সময়েই একই রকম। হয়তো তাদের মাঝে রকম ফের থাকে, তবে দিন শেষে আমরা নিজেদের মাঝে এক ধরণের সাধারণ স্বত্তা বয়ে চলি। সেই স্বত্ত্বার সংযোগেই হয়তো ক্যাডেট ফিলিংস। সেই কারনেই দশজনের মাঝে একজন ক্যাডেট বড় ভাই, বন্ধু আমাদের কাছে বাকি সবার চাইতে আলাদা হয়ে উঠে। সত্যিকার অর্থে প্রত্যেকটি ক্যাডেট পিছনেই রয়েছে সংগ্রামের গল্প, যুদ্ধের গল্প, লড়াই করবার গৌরব। আমাদের প্রত্যেকের পিছনেই হয়তো আছে প্রেপ শেষে হাউসে ফিরবার সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা হাউসের সামনে অলস আড্ডা, সবার পিছনেই আছে সাত দিনের শিক্ষাসফরের মধুরতম স্মৃতি, প্রত্যেকের পিছনেই আছে হয়তো সিনিয়র-জুনিয়র ক্লেশের ঘনঘটা, প্রত্যেকের পিছনেই আছে জয় শেষে হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে চিয়ার করবার অথবা পরাজয় শেষে কান্নায় ভেঙে পড়বার স্মৃতি। অল্প বয়সে দাগ কেঁটে যাওয়া সেই সময়ের বায়োস্কোপ আমাদের সামনে ভেসে চলে যখন যে কোন জায়গায় একজন ক্যাডেটকে দেখি। তাই ব্যাক্তি পেশাভেদেও ক্যাডেটরা জায়গায় জায়গায় নিজেদের জোট গড়ে রাখে এই অভিজ্ঞতাও খুবই সাধারণ। একই সাথে ক্যাডেটরা একজনকে আরেকজনকে ইনসপায়ার করে। এই জায়গাতেই অন্য সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাডেটরা আলাদা। এখানে আমারা একে অপরের সহযোগী, প্রতিযোগী নই। তাই কারো সাফল্য অন্য দশটি ক্যাডেটকে উদ্বুদ্ধ করে তাকে অনুসরণ করবার, তাদেরকে পথ দেখায় নতুন কিছু করবার। এই স্পিরিটের জন্যই ক্যাডেটদের জয়জয়কার সবখানে।

দুই

প্রদীপের নিচে যেমন অন্ধকার থাকে তেমনি আমাদের সবচেয়ে নাজুক জায়গা দুর্বলতাও এই স্পিরিট যখন তা বিপদজনক লোকের ভুল ইশারায় চালিত হয়ে যায়। বদঅভ্যাস সংক্রমণের প্রক্রিয়া ক্যাডেটদের মাঝে যে পরিমান দেখা যায় তার তুলনা খুঁজে পাওয়া বিরল। সবকিছুকে দূরে ঠেলে সামান্য ধূমপানের উদাহরন দিয়েই বলি। এই বদঅভ্যাস একটু আধটু আমারও ছিল। তো বছরখানেক আগে এক মহিলা কলিগ বেশ কড়া সুরেই বললেন, ক্যাডেটদের মাঝে ধূমপায়ী হবার প্রবণতা বেশি কারন এরা দলবেঁধে সব করে। উনার সাথে তর্ক করতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ আমি জানতাম উনার বরও আমার কলেজেরই বড় ভাই। তাই ক্যাডেটদের এই ঝাঁক বেঁধে সব করার প্রবণতা উনার অজানা নয়। পরবর্তীতে নির্মোহভাবে চিন্তা করে এই ব্যাপারটা আমার অস্বীকার করবার উপায় রইলো না যে, ক্যাডেটদের ধূমপানের হাতেখড়ি হয় ঝাঁক বেঁধে চলার জন্যই। এমনকি আমার যেই বন্ধুটি বাইরে থাকলে কখনও ধূমপান করত না, ক্যাডেট কলেজে থাকবার ফলে সে এই বদঅভ্যাসটি বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছে। এই পর্যন্ত বলবার জন্য যারা আমাকে আঁতেল, প্রপার ক্যাডেট ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছেন তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। একেবারেই প্রবণতাটুকু বুঝাবার জন্য উদাহরণটি টানা। তবে মূল ব্যাপার হলো আমাদের দল বেঁধে চলবার ফলে ভালো অভ্যাসের সাথে সাথে অনেক খারাপ অভ্যাসও সমানভাবে সংক্রমিত হতে পারে এই ব্যাপারটা অস্বীকার করবার জো নেই। এখন এই খারাপের মাপকাঠি ব্যাক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আমাদের ক্যাডেটদের কাছে বেশিরভাগ জিনিসই অন্তত দশজন ক্যাডেটকে করতে দেখলে জায়েজ মনে হয়, আমি অন্তত এমনটিই মনে করি।

তিন

আইসিস নামক জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম বোধ করি কারো কাছে অজানা নয়। যারা মনে করেন আইসিসে যোগ দেয়া অপরাধ নয় অথবা যারা আমাকে কারণ দেখাতে বলবেন যে আইসিসে যোগ দেয়া কেন ক্ষতিকর তাদের জন্য আমার লেখা নয়। যারা তেমনটি মনে করেন এবং এ পর্যন্ত পড়েছেন তাদের কাছে আমি বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কয়েকদিন আগে আইসিস এর সাথে কিছু বাঙালির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে একটি সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়। ঘটনাক্রমে সেই দলের নাটের গুরুর সাথে আমার নাম মিলে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসি। সেই সাথে দেখি সে পেশায়ও প্রকৌশলী আমার মতনই। তার উপরে এক্স ক্যাডেট। দেশে থাকলে ভদ্রলোকের বদৌলতে পুলিশ আমাকে ঝামেলায় ফেলত কিনা সেটা পরের বিষয়, কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করবার পরেই আমি টের পাই ভদ্রলোকের কার্যবিধি না হোক গতিবিধি কিছু নজরে পড়েছিল। সেই সাথে তার সাথে আরও যাদের নাম এসেছে তাদের অনেকেই বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজের এক্স ক্যাডেট। এবং তাদের মাঝে দুইজন আমার কলেজের আমার হাউজের কয়েক ব্যাচ জুনিয়র। এই বেলায় যারা মনে করেন যে সাংবাদিক মশায় ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে না পেরে বিষেদাগার চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যও আমার এই লেখা না। তবে তাদেরকে অনুরোধ করব লেখার বাকিটুকু পড়তে।

আমিন বেগ সাহেব সিসিবিতে এক দুইটা পোস্ট দিয়েছিলেন। তবে এখানে তেমন সুবিধা না করতে পেরে ফেসবুকে তিনি তার নেটওয়ার্ক বিস্তারে নামেন এমন অনুমান করতে পারি। কুরআন হাদীসের আলোকে সবকিছু ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা চট করে যে কারো মনে পজেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলতে বাধ্য। দেশে থাকতে নেভীতে জব করা আমার বৈবাহিক সম্পর্কীয় এক ভদ্রলোকেরসাথে কথা বলছিলাম। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ছিল যেহেতু এই নামে ইসলাম আছে আমাদের উচিত হবে না এই বিষয়ে খারাপ কিছু বলা। এই যখন দেশের বুদ্ধিমান প্রজাতির লোকজনের চিন্তাভাবনা সেখানে কুরআন হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যামূলক পোস্ট আলোড়ন ফেলবেই। আমি নিজেও ধর্ম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখি না। বেগ সাহেব মোটামুটি তার বিশ্লেষণমূলক লেখা দিয়ে ভালোই আলোড়ন ফেলে দেন। এমনকি আমার ব্যাচমেট এক্স ক্যাডেট এক্স বুয়েট একজনকেও বেগ সাহেবের পোস্ট সকাল বিকাল শেয়ার করতে দেখি। ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু বাঁধ সাধে যখন বেগ সাহেব তার ব্লক কীর্তি শুরু করেন। পাবলিক ফোরামে তার পোস্ট কমেন্টে কেউ ডাউট দিলেই তাকে ব্লক করতে থাকেন। তার সম্পর্কে এতটুকুই জানা ছিলো। এরপরই জানা তার গ্রেপ্তার হবার সংবাদ।

চার

লিস্টে থাকা লোকদের অনেকে এক্সক্যাডেট হওয়াটা কোন কাকতালীয় ঘটনা বলে আমার মনে হয় না। তবে, প্রথমেই এই কথা পরিষ্কার করে নেয়া দরকার যে জঙ্গীদের অনেকে এক্স ক্যাডেট মানেই যে ক্যাডেট কলেজে জঙ্গীর চাষ হয় এমনটা খুব বেশি সরলীকরণ। সেই আঙুল যদি কেউ দেয় তাকে নির্বোধও বলতে হবে। তবে আমি মনে করি ক্যাডেট কলেজের দায় না থাকলেও ক্যাডেটশীপের পরোক্ষ দায় আছেই। সেই দায় আমাদের দলবদ্ধতার দায়। সেই দায় আমাদের আরেকজন এক্সক্যাডেটকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবার দায়। এই মুহূর্তে অনুমান করা হয়তো বৃথা, তবে আমিন বেগের পিছন পিছন এতগুলো এক্স ক্যাডেট থাকার কারণ শুধু ধর্মের প্রতি অন্ধ অনুরাগ মনে হয় না। বরং ক্যাডেট কলেজের যেই বড়ভাইকে আমি শ্রদ্ধা করি তার দেখানো পথ খারাপ হতে পারেই না– এই ভাবনা গুলোই হয়তো মোটিভেট করে থাকবে। আমি এখানে হয়তো টার্মটা ব্যবহার করবার কারন হলো সেই লোকজনও প্রত্যেকেই প্রাপ্ত বয়স্ক। তাই তাদের দায়মুক্তি দেয়ার কথা আসছে না। তবে আমাদের এই ক্যাডেটশীপের ট্রাস্ট নিয়ে খেলেই এরকম কাজ ঘটেছে এমন সন্দেহ করা খুব বেশি অমূলক হয়ত হবে না।

পাঁচ

অনেকেই হয়ত ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিল্টি– এই কথা বলে বেগ সাহেব এবং তার অনুসারীদের বেনিফিট অফ ডাউট দেবার চেষ্টা করবেন। খুব সম্ভবত এই বোধটাও আমাদের ক্যাডেটীয় ভ্রাতৃত্ববোধ থেকেই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ক্যাডেটদের মাঝেই যেমন সজ্জন আছেন তেমন দুর্জনও যে নেই তা কিন্তু নয়। আর এই ব্যাপারে বেনিফিট দেয়া যাচ্ছে না এই জন্য যে, অভিযোগটা খুবই শক্ত অভিযোগ। এই জাতীয় অভিযোগ একেবারেই ট্যাবলয়েড আকারে কোন পত্রিকা ছাড়বার কথা না। যদি ঘটনাক্রমে ধরেও নেই পুরো ব্যাপারটা ষড়যন্ত্র তাহলেও অভিযুক্তদের কেউ এটা অস্বীকার করলেও হত। গোপন বা প্রকাশ্য কোন স্থান থেকেই তাদের কোন খোঁজ মেলেনি। এমনকি যে ছেলেটি সিরিয়া যুদ্ধ করছে এমন দাবি করছে সংবাদপত্র, তার পরিচিত কেউ এই দাবি অস্বীকার করলেও ষড়যন্ত্রের ভিত্তি মিলত।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে হয়ত হত। পারসোনাল এটাক করে সাংবাদিকের গুষ্ঠী উদ্ধার করবার প্রক্রিয়াটা আমাদের জন্য খুব বেশি গৌরবের না। নিজেদের সমস্যা বুঝবার চেয়ে অভিযোগকারীকে পারসোনাল এটাকে বিপাকে ফেলে দেয়াটাকে সমাধানের পথ হিসাবে নেয়া বিপজ্জনক। সমান বিপজ্জনক দুর্নীতি, নাস্তিকতা ইত্যাদির সাথে একে মিলিয়ে লঘুকরণের প্রচেষ্টাও। সেই সাথে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনার নেগেটিভিটি পাশে এনে বেগ সাহেব এন্ড গংদের নূরানী চেহারা দেবার চেষ্টাও খুব বেশি কল্যান বয়ে আনে না আমাদের ক্যাডেট কমিউনিটির জন্য।

ছয়

একটা সমস্যা তখনই সমাধানের পথে যায় যখন সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে গন্য করা হয়। এইখানে আমাদের ক্যাডেট ভ্রাতৃত্ববোধ বেশ ভালোভাবেই ব্যর্থ। তারা সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে এটাকে কীভাবে ধামাচাপা দেয়া যায় সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। এতে করে হয়তো একজন দুজনকে শাস্তির হাত থেকে আপাত বাঁচানো যাবে কিন্তু ব্রেইনওয়াশড ছেলেগুলোর যুদ্ধ করতে যাওয়া কী ঠেকানো যাবে? ক্যাডেটীয় ভাবমূর্তি বলে নিজে চোখ বন্ধ করে থাকলে প্রলয় বন্ধ হয় না। বরং এই লোকগুলোর চেহারায় নূরানী রূপ না দিয়ে সমস্যা তলিয়ে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজাটা জরুরি।

উত্তরণের পথ হিসাবে প্রথমত আমি মনে করি আমাদের এই ধারনা পরিত্যাগ করতে হবে যে ক্যাডেট মাত্রই সকল ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে। ক্যাডেটদের মাঝে সোর্ড অফ অনার পাওয়া লোক যেমন আছেন, যেমন আছেন একজন আতিয়ার রহমান উল্টোক্রমে একজন সাকা চৌধুরিও আছেন। হ্যা ক্যাডেটরা নিজেদের কাছে আপন, এই ভাবনাতে কোনই বাঁধা নেই তবে এই ভক্তি যেন অন্ধবিশ্বাসে না যায় সেটাও জরুরি।

দ্বিতীয়ত, আমাদের সোসাইটিতে বিপদ উত্তরণের পথ হলো ধর্মের আশ্রয়। যে ছেলেটিকে কখনো নামাজ পড়তে দেখিনি সেও পরীক্ষার আগে নামাজ পড়তে সবার আগে প্রেয়ার রুমে চলে যায়। এই ইনসিকিউরিটির কারণে আমাদের অভিভাবকরা যুবক বয়সীদের নামাজ পড়তে দেখলে স্বস্তি খুঁজে পান। কেননা, নামাজ পড়ুয়া একটা ছেলে অনেক খারাপ সঙ্গ হতে বেঁচে যায়। তবে এই সঙ্গ থেকে বেঁচে সে কোন ভয়ঙ্কর ব্রেইনওয়াশার এর পাল্লায় পড়ছে কিনা সেটা বুঝাও জরুরি। এটা অত্যন্ত দুঃখের যে ধর্মপালন নামক একান্ত ব্যাক্তি চর্চার উপর অভিভাবকের চোখ রাখতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এর চেয়ে সদুপায় আর খুঁজে পাই না।

জঙ্গীবাদের কুফল নিয়ে ক্যাডেট কলেজে আলোচনা হওয়া দরকার। সত্যিকার অর্থে ক্যাডেট কলেজের মসজিদে এমন অনেক আলোচনাই শুনেছি যেটা না হলে খুব বেশি ক্ষতি বৃদ্ধি হত না। সেই সময় হতে একটা টাইম ক্যাডেটদেরকে ‘প্রকৃত’ ধর্ম আর ‘অপ্রকৃত’ (জঙ্গীবাদ) ধর্মের বিভেদ দেয়াল বোঝানো যেতে পারে। যদিও আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশের ধর্মিকরা জঙ্গীবাদ ‘প্রকৃত’ ধর্ম না বলে ধর্মের পিঠ বাঁচিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করে।

শেষত ধর্মের লেবাস দিয়ে সব ধরনের কুকাম জায়েজ করবার যে কালচার এখন চলে তার মূল কারণ হলো ধর্ম বিষয়ে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা। আমার যেই বন্ধুকে উইকএন্ডে গলা ডুবিয়ে মদ গিলতে দেখি, যেই বন্ধুকে কোন মেয়েকে বিছানায় নিতে আপত্তি দেখি না (কনসেনসুয়াল হলে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু ধর্মের আছে), তারেই আবার দেখি নাস্তিকের ফাঁসি চাই বইলা আকাশ বাতাস কাঁপাইতে। পায়াস আর রিলিজিয়াসের সীমারেখাটা এখানেই আসে। আমার আসে পাশে ধর্মপালনকারী পায়াস মানুষের চেয়ে ধর্মানুভূতি সম্পন্ন রিলিজিয়াস লোক অনেক বেশি। মাঝে মাঝে মনে হয়, যেই নাস্তিকদের ফাঁসি এইসব রিলিজিয়াস লোকজন চায় তার, সেই নাস্তিকদের চাইতে এরাই বেশি ক্ষতিকর ধর্মের ভাবমূর্তির জন্য।

সাত

কথা বলতে বলতে অনেক লম্বা হয়ে গেল। শেষতক ফলাফল কী? ফলাফল আসলে আসবে না যতক্ষণ না আমরা সমস্যাটার মূল ধরতে পারি। প্রিন্সিপাল হাউস ইনশপেকশনের শেষ সময়ে রুমের কোথাও ময়লা পড়ে থাকতে দেখলে সেটাকে চাপিয়ে লুকিয়ে ফেলতাম আমরা। তাতে সেটা পরিষ্কার হত না বরং সময়মত সে মেলে ধরত আপন চেহারায়। আমার এক্স ক্যাডেটরা এই সমস্যাকে সেই ময়লার মত যদি লুকিয়ে ফেলতে চাই তা আমাদের জন্য বৃহত্তর কল্যান বয়ে আনবে না। বরং সকল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাদ দিয়ে কীভাবে এই ব্যাপারগুলোর মূলে যেতে পারি তা বুঝাটাই অনেক বেশি দরকার।

[ আমার নিজের ভাবনার সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছি। সেটা স্বীকার করেই এই বিষয়ের মূল সমস্যা এবং তাকে সমাধানের ব্যাপারে সকলের মতামত জানতে চাইছি। ধন্যবাদ।]

৩,৪৯০ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “প্রসঙ্গ: জঙ্গীবাদ, ক্যাডেটীয় ভ্রাতৃত্ববোধ এবং কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    যেকোন ধরনের কেলেংকারী, অপ্রীতিকর ঘটনা, নির্যাতন (এখন যোগ হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা ও জঙ্গীবাদ) এইসব যেকোন পরিস্থিতিতে আমি এখন পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজের কাউকে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন,কারণ নির্ণয় ও সমাধানের চেষ্টা করতে দেখিনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে ধামাচাপা, কার্পেট চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, বা কাউকে ধামাচাপা দিতে বাধ্য করা হয়েছে (এবং সফল হয়েছে)। এর জটিল কোন কারণ নেইঃ ঐ ঘুরেফিরে ভাতৃত্ববোধ।তবে এখানে মেয়েরা বাদ। ওরা কিন্তু ভিক্টিমের খাতায়। পৃথিবীর যেকোন দেশের এরকম কমিউনিটি বেইজড প্রতিষ্ঠানে যান মোটামুটি একই ধরনের লুকোচুরি পাবেন। এখান থেকে আমি পরিত্রাণের কোন আশা দেখি না।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    আমিন বেগের ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া খানিকটা দূর থেকে দেখেছি। ক্যাডেট কলেজে থাকা এবং বের হবার পর পর্যন্ত সে একটা চিজ ছিল। মজার, অশ্লীল কথায় সেরা এবং দুষ্টুদের রিং লিডার। তারপর মালয়েশিয়া থেকে পড়ে ফেরত আসার পর পরিবর্তন। দাড়ি এবং জোব্বা। ২০০৭ সালের কথা। একদিন রাস্তায় দেখা হল। তখনও আল্লাহর পথ, একটেলের চাকরি, এবং টাকা কামানো (রিয়েল এস্টেট ব্যবসা) ধান্ধা তার। তারপর আর খোঁজ জানিনা। এরপর সেদিন পত্রিকান্তরে ... এই প্রবণতা নিয়ে লেখাটা জরুরি ছিল।

    অফটপিক, তুমিই যে সহী আমিন তার কি প্রমাণ?


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আমি এই বিষয়টাই কিঞ্চিত ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে তুলে আনবার প্রয়াসে লেখা পোস্ট করতে শুরু করেছিলাম সিসিবিতে।
    দুটা জিনিস আমার কাছে খুব গুরুত্বের দাবীদার বলে মনে হয়। সেটা হলো পরিবার ও পারিপার্শ্বিক সখ্যতার ভেতর দিয়ে পিওর উইসডমের দীক্ষা।
    দ্বিতীয়ত একজন মানুষের মাঝে যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ধর্ম বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা। যা কিনা অবশ্যই 'গুলি করে মানুষ হত্যার চাইতে চাপাতির কোপে মানুষ হত্যায় সওয়াব বেশী' এমন ধারণার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মতো মনস্তাত্বিক সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করবার মতোন বিচার বিবেক নির্মাণ কিরে দিতে পারে।
    আমি সব কিছুর পাশাপাশি আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিবেক কিংবা জ্ঞানের দৈন্যতাকে বেশী দায়ী করবো।
    আর এই লেখার শেষাংশে সার কথা বলা হয়েছে।
    ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।

    জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    হঠাৎ চোখে পড়লো নিচের লিখাটি। কমেন্ট সেকশানেও বেশ কিছু চমৎকার প্রশ্ন করা হয়েছে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং পরিস্থিতি সৃষ্টি প্রতিরোধ করতে আমার মনে হয় সব ধরনের রিসোর্সের দিকে হাত বাড়ানো উচিৎ।

    The conversations between a young Sunday school teacher in rural Washington State and a British man with ties to radical...

    Posted by The New York Times on Monday, June 29, 2015


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  5. আদর্শের কারণে কেউ যদি জঙ্গী হতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি: কোন আদর্শই পরিপূর্ণ নয়, ফাঁক ফোঁকর থাকবেই । সবই অপূর্ণ আদর্শ। অপূর্ণতা মেনে নিয়েই কাজ করুন, জঙ্গী হওয়ার মত কোন আদর্শই নাই।

    জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ওরা আইএস (ইসলামিক স্টেট) প্রতিষ্ঠার জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে। এজন্য ফেসবুক ও ই-মেইলে যোগাযোগ করে যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষিত, আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আইটি এক্সপার্ট ও উগ্রপন্থীর ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী এমন মানুষের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছে। এ পর্যন্ত আইএসে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ২০ জন ইতোমধ্যে রাজি হয়েছেন। তারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার আইএসের সদস্য সংগ্রহকারী দুই ব্যক্তি আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব-বিন-কামালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনই তথ্য পেয়েছেন।

    ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো: শাহজাহান বলেন, আমিনুল ইসলাম বেগ ও তার সহযোগী সাকিব জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।

    গত রবিবার রাতে উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে আমিনুল ইসলাম বেগ ও মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোড এলাকা থেকে সাকিব-বিন-কামালকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, চার্জার, ডায়েরি ও তিনটি দামি মোবাইল সেটসহ কিছু জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার তাদের তিন দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে।

    ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তারা আইএসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন ২০ জনের নাম জানিয়েছে। এদের মধ্যে জাপানে অবস্থানকারী সাইফুল্লাহ নামে একজন বাংলাদেশি রয়েছেন, যিনি সেখানে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা করছেন। সাইফুল্লাহ ইতোমধ্যে আইএসে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন।

    ডিবির ঐ কর্মকর্তা আরো জানান, আমিনুল ও শাকিবের সঙ্গে ফেসবুকে অন্তত ৫শ’ জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এদের বেশিরভাগই বুয়েট, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। ঐসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষতা সম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তাদের প্রধান টার্গেট। এর পাশাপাশি তারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহরীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।

    ডিবির একটি সূত্র জানায়, আইএসে যোগ দিতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১১ জন মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এদের মধ্যে পাকিস্তানে বন্দুকযুদ্ধে দুইজন নিহত হয়। তারা হলেন সাখাওয়াতুল কবিরের ভায়রা শামীম আহম্মেদ ও বাতেনের ভগ্নিপতি মুহম্মদ সায়েম। গত ২৯ জানুয়ারি ডিবি খিলক্ষেত ও যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে সাখাওয়াতুল কবির, আনোয়ার হোসেন ওরফে বাতেন, রবিউল ইসলাম ও নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে সাখাওয়াতুল কবির বাংলাদেশে আইএসের প্রধান সমন্বয়ক। বাকি তিনজন তার সহকারী। সাখাওয়াতুল কবিরের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব-বিন-কামালের যোগাযোগ ছিল।

    ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, যারা আইএসে যুক্ত হচ্ছেন তারা প্রত্যেকেই সচ্ছল পরিবার থেকে আসা। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের সমন্বয়ক আমিনুল মূলত অনলাইনে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। - ইত্তেফাক ৩০ মে ২০১৫


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  7. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    প্রথম আলোতে এসেছে। এখানে আমাদের সময় এর লিঙ্ক, ওরা প্রথম আলোর রেফারেন্স দিয়েছে। লিঙ্ক


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  8. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অন্য লিখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এইটা পড়তে দেরী হয়ে গেল বলে দুঃখিত।
    খুব ভাল একটি বিশ্লেষন আর এই ডায়াগোনেস্টিক এপ্রোচটাও খুব পছন্দ হয়েছে।
    যা যা বলেছো, সবই ঠিক।
    কিন্তু হলে কি হবে, যাদের জন্য পড়াটা জরুরী, তাড়া তো আর এটা পড়বে না।

    তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
    অন্তত একারনে যেন একদিন বলতে পারি, "আমার চেষ্টা আমি তো করেছিলাম, না শুনলে কি করার?

    ঐ যে কথায় বলে না, "ইউ ক্যান টেক দ্যা ডংকি টু ওয়াটার বাট ইউ কান্ট মেক ইট টু ড্রিংক......"


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  9. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    সরল স্বীকারোক্তি সবার প্রতি। কেউ ব্লগে আমার কমেন্টের রিপ্লাই না দিলে আগে খুব মেজাজ খারাপ হত তার উপর। এই লেখায় আগি নিজেও কিছুটা তেমনই করে ফেললাম মনে হয়। বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। দ্বিমতের জায়গা তেমন চোখে না পরায় আলসেমি করে আর রিপ্লাই করা হয় নি। আশা করি যারা এখানে কমেন্ট রেখেছেন তারা আমার এই আচরণ টুকু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।