টুকরো কবিতা ও গান অথবা জীবন থেকে কেঁটে নেয়া ফ্রেম

আমি তোমার দূরে থাকি কাছে আসবো বলে

অনেকবারের চেষ্টাতেও কখনও তার কথা বলা যায় নি। হয়তো আসলে বলবার মত তেমন কিছু ছিলও না। তার মৃদু সঞ্চারণের পাশে বিকেলের বয়ে চলা দেখেছি প্রতিনিয়তই। এর বেশি কখনও বলতে পারতাম? রবীন্দ্রনাথের গল্পের নায়িকাদের মত বিশেষত্ব তার নেই এই কথা অবশ্য বলা যায়। তারপরেও সে আমার নজরে এসেছিল মূলত তার নির্লিপ্ততার জন্য। তার মধ্যে এক ধরণের পাগলামি ছিল। তবে সেই পাগলামি তার বয়সী অন্য দশটি কিশোরীর মত নয়। সেই পাগলামির ধরণটাও ছিল আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত। ভয়ঙ্কর বরষার দিনের কথাই ধরা যাক। নাহ, চিরায়ত চপল চঞ্চল রূপ নিয়ে জল অবগাহনে সে মেতে উঠে নি। অথবা বৃষ্টিতে ভিজে মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়ে নিজের ঘরের কোণে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে নি। বরং তার মাঝে ছিল উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাস বৃষ্টিতে ভেজা চপল চঞ্চল কিশোরীর মত রোদেলা নয়, বরং জোছনার মত স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধতা তার মায়াময় রূপটিকে আড়াল করে রাখে মেঘলা দিনের পূর্ণিমার মত। বৃষ্টির দিনে তাকে দেখা তার বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই সে বারান্দার গারদ গলে হাত ছড়িয়ে দেয়। আমি তাকিয়ে থাকি। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। সেই ছোট হাত গলে বেরিয়ে যাওয়া সময়ের তীব্র ভাবনা আর অবাক স্বপ্ন গুলো কী অবলীলায় ছড়িয়ে পড়ে তা বুঝার চেষ্টা করি। তারপরে, অনেক সময় চলে যায়। কখনও কাছে গিয়ে বলা হয় না অনুভূতি গুলোকে। বলার সুযোগ হয় না পরবর্তী সুযোগ হারিয়ে যাবার ভয়ে। দূর থেকে দেখতে থাকি একরাশ উদাসীনতা আর সাদামাটা স্নিগ্ধতাকে সাথে নিয়ে বেড়ে উঠা মায়াবতীকে।

আমিও তোমার মত বুড়ো হব

সময়ের চেয়ে নিষ্ঠুর আর কিছু নেই। সে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। পাঠ্য বইয়ে যতই সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না জাতীয় কথা পরে আসি না কেন, সময়ের নিষ্ঠুরতার উপলব্ধি আসল নিজের বিবর্তনে, আপন সময়ের বিবর্তনে। কোন দিন ঘুম থেকে উঠে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারায় ভালো মত তাকালে আমরা বুঝতে পারতাম যে আমরা সরে গেছি আগের দিনটি থেকে। ধীরে অথচ অবিরত সে আমাদেরকে সমানে এগিয়ে নিয়ে চলে। বদলের অনুভব সহসাই হয় না। তবে দীর্ঘ দিন পরে কারো সাথে দেখা হলে আমরা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যাই তার সাথে কাঁটানো সময়ে। মহাকালের ভাজবিহীন পাতা থেকে টুপ করে বেরিয়ে পড়ে সে আসলে আমাদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সেই সময়ের আমি’র সামনে। এই অনুভূতি কষ্টের। আমরা পরিবর্তনকে মানতে পারি না। অথচ মহাবিশ্বের এনট্রপি বাড়িয়ে আমরা সকলেই বদলে যাচ্ছি। প্রতিদিন বদল হই। কোনদিন চোখের সামনে কিশোরকে দেখলে আমরা শিউরে উঠি। আমাদের কৈশোরের মৃত্যুসংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছায়। আমার সামনের কিশোরটির মত আমাদেরও একটা কৈশোর ছিল। অথচ সে কতটা অগুরুত্বপূর্ণ মহাকালের মাঝে ! মুদ্রার উল্টোপিঠও পড়ে ফেলা হয় সাথে সাথেই। অতীত দেখার মত ভবিষ্যতও দেখতে পাই সহসাই। আমার সামনে জেগে উঠে বয়সের ভারে ন্যুব্জ কেউ। তারও হয়তো সময় ছিলো। সেই সময়ে সে হয়তো আমার মতোই ছিল। তার সে সময় চুরি হয়ে গেছে। এখন সে বৃদ্ধ থেকে অতিবৃদ্ধ হয়েছে। তার সময়কে সে অনুভব করতে চায়। হয়তো তার চুরি হওয়া সময়ের কুশীলবরা একে হারিয়ে গেছে কখনো তার জীবন থেকে কখনো হয়তো মহাকালের পাতা থেকেই। আমার চোখের সামনে বৃদ্ধের আবছা অবয়ব স্পষ্ট হয় না কখনোই। সেই মুখের দিকে সেই চোখের দিকে তাকাবার সাহস করি না কখনোই। তাকালে হয়তো দেখতে পেতাম সেই চোখ যাপিত জীবনের হতাশা অসহায়ত্ব বেদনা ছাপিয়ে সময়ের মৃত্যুর কান্নায় অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।

দুর্গার মৃত্যুর পরে

দুর্গাকে আমরা সবাই চিনি। পথের পাঁচালী উপন্যাসের দুর্গা। উপন্যাসের চরিত্রের এক ধরণের অদ্ভুত আকর্ষণ থাকে। নিজের আবেদনের বাইরেও পাঠকের কাছে কল্পনায় সেজে যাওয়া এক রূপ নিয়ে মনে থেকে যায় সবসময়। তবে কল্পনায় দূর্গার রূপ ব্যাক্তি কালভেদে হয়তো একই থাকে। দুর্গা জীবনের প্রতীক। জীবনের ন্যায় সে বয়ে চলে চলে উপন্যাস জুড়ে। কখনো সে চঞ্চল, কখননো মানবিক, কখনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন আবার কখনো বা বিষণ্ণ। অথচ এমন সম্ভাবনাময় জীবনের পরিসমাপ্তি জীবনের মতোই নিষ্ঠুর। দুর্গার হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি কষ্টের চাইতেও অনেক বেশি বিস্ময়ের। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যাওয়া কিশোরীর কথা আমরা যখন জানতে পারি, তার চোখকে আমাদের কাছে বিস্মিত মনে হয়। জীবনের ছলনা দেখে সে হতবাক। কিংবা জীবন থেকে মৃত্যুপুরীতে যাবার আগেও আকাশ পানে চোখ মেলে জীবনের অর্থই হয়তো সে বুঝতে চেয়েছে। দূর্গার বিদায়ের বিষণ্ণতা জীবনের চিরন্তন সত্য। প্রতিটি দুর্গা অন্তর্ধানেই আমরা বিষণ্ণ হই। তবে তারচেয়েও বেশি বিস্মিত হই অন্তর্ধানের আকস্মিকতায়। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই সময়ের ক্রমাগত বিরামহীম ধাক্কায় আমরা এগিয়ে যাই সামনে। পথের পাঁচালীর শেষ লাইন “চলো এগিয়ে যাই” — মনে আসে কেবল। অথচ দুর্গার হারানোর বেদনার কষ্টকে নিজের মাঝে ধারণ করতে পারলেও দুর্গার জন্য মন প্রাণ উজাড় করে কান্নার সুযোগ হয়ে উঠে না আমাদের।

হয়তো কোথাও পাবে আমাকে

গল্পটি দুটো জীবন একটি মৃত্যু অথবা কোনটিরই নয়। হয়তো আসলে এটি কোন গল্পই নয়। কিছু অব্যাখ্যেয় অনুভূতি। কিংবা এটা আসলে ভালোবাসার গল্প। ভালোবাসা আসলে কী খুঁজতে গিয়ে মানুষ দিকভ্রম হয়েছে। পুরুষ ও নারীদের প্রকাশের আতিশয্যে হয়তো বা ভালোবাসা তার মূল আবেদন হারিয়ে ফেলেছে সময়ে অসময়ে। অতি:প্রকাশে আরোপিত হয়ে হয়তো হারিয়েছে শুদ্ধতা। সেই সব ছাপিয়ে আসলে হারানোর অনুভূতিতেই ভালোবাসার পূর্ণতা। হারানো সময়ে ভালোবাসা কাছে আনে দুটো জীবনকে। এক ধরণের অপার্থিব কাছে আসা যার প্রকাশের আসলে কোন ভাষা নেই। শুধুই অনুভূতির। এই ‘শুদ্ধ’ ভালোবাসার দেখা মেলে না বললেই চলে। শুধু শুদ্ধতম ভালোবাসার কথা ভেবে আমাদের ভানাড়ু সময় বয়ে চলে ভালোবাসার ভণিতা নিয়ে। আর তাতেও ভাবনার অনুভূতিতে নিজেদের কাছেই অতি:প্রকাশের তোড়ে ভালোবাসার দূষণ অনুভব করি ক্রমাগত।

তখনো বুঝি কেঁদে কেঁদে যাবো

মৃত্যু নিয়ে আমাদের অনুভূতি ভয়ের। জীবনের শেষের এই কানাগলিকে আমরা সহজভাবে মেনে নিতে পারি না কখনোই। মৃত্যু নিয়ে ভাবালুতাও মনে হয় সবার মধ্যেই কম বেশি কাজ করে। মৃত্যুর অনুভূতি জানবার চেষ্টা না করলেও অন্তত কল্পনা করবার চেষ্টা করি কম বেশি। মৃত্যু নিয়ে বিভিন্নজনের ভাবনায় বিভিন্ন রকম স্যুরিয়েল ঘটনার গল্প শোনা যাবে। সেই ভাবনা গুলো জড়ো করলেও একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে বলেই মনে হয়। জীবনের প্রদীপ নিভে যাবার আগে শেষভাবে মত জ্বলে উঠবে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে। আর সেই সময়ে মুহূর্তের জন্য পেছনে ফেলে আসা জীবনের ছবিগুলো বায়োস্কোপের মত ঘুরতে থাকবে চোখের সামনে। বাঁচার তীব্র আকুতিতে ঘাস পাখি ফুল বাতাস আর মানুষের পৃথিবীকে খুঁজব। চোখের সামনের ছবি গুলো অস্পষ্ট হয়ে ঘুরতে থাকবে ক্রমাগত। জীবনের হারানোর অনুভূতি প্রাপ্তির অনুভূতি কষ্টের অনুভূতি বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতিগুলোতে ছবিটা হয়তো একটু গাঢ় হয়ে উঠবে। হারানো সময়ের জন্য হারানো সময়ের মানুষের জন্য হাহাকার করে উঠবো। তারচেয়ে বড় কথা হলো ভালো লাগা মন্দ লাগা কষ্ট আনন্দ বেদনা উল্লাস সব কিছু একাকার হয়ে কেবল কান্নার জন্ম দিবে। সেই কান্নার কষ্টের নয়, ব্যাথার নয়, বরং সেই কান্না হারানো সময়ের জন্য, ভালোবাসার, মানুষের জন্য।

নক্ষত্র সরিয়া যায়

সামনের এই নির্জন রাস্তার শেষ মাথার ওপারে সূর্য হারিয়ে গেলে আরেকটি ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার শেষ হয়। এমনিভাবে দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর। রাস্তার এগিয়ে গিয়ে দূরে ক্রমশ সরু হয়ে যায়। অথচ রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে সে একঘেঁয়ে গতিতে ক্রমাগত প্রশস্ত দেখাতে শুরু করে। রাস্তার দুই প্রান্ত যেন জীবনের প্রতীক হয়ে এগিয়ে যায়। মিলনের স্বপ্ন দেখিয়ে জীবন এগিয়ে যায় রাস্তার মত। আর রাস্তার প্রান্তের মতই থেকে যাই আমরা। তারপরে, তারও অনেক পরে আমরা আমাদের অর্থহীন চেষ্টার তাৎপর্য উপলব্ধি করি। তবে তা জীবনকে থামিয়ে দেয় না। সম্ভাবনা আর প্রত্যাশায় আমরা বেঁচে থাকি জীবনের জন্য। যাপিত জীবনের ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে আমরা রাস্তায় হেঁটে যাই। রাস্তার চারধারের রূপ রঙ বদলায়। সেই সাথে বদলায় সময়ের গন্ধ। বদলে যাওয়া সময়ে আমরা এগিয়ে যাই। এগিয়ে যাবার সময়েই হয়তো পেছনে ফিরে তাকাই সময়ে সময়ে কোন এক মায়াবতীর আগমনের প্রত্যাশায়।

তুমি হও যমুনা রাধে আমি ডুইবা মরি

কবিতা ও গানের এক ধরণের জীবন থাকে। নিজের অর্থ ছাপিয়ে সে পাঠক শ্রোতার কাছে সময়ের প্রতিনিধি হয়ে যায় প্রায়শই। সেই অর্থেই এই ব্লগ লেখার সময়কালের প্রতিনিধি হয়ে যাওয়া গানটিকে রেখে দিলাম লেখাটার সাথে। এই গানটা নিয়ে দুই তিন কথা বলটে পারলে ভালো লাগতো। তবে আন্তর্জালে এর বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা আছে সেগুলো পুনরায় না বলে শুধু গানের লিংকটা রেখে গেলাম। গানটির মাঝে এক ধরণের দ্ব্যর্থবোধকতা আছে বলেও মনে হয়। গানটির মাধ্যমে মফ:স্বল থেকে উঠে আসা ব্যান্ডের সাথে পরিচয় ঘটলো।

২,১৩৯ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “টুকরো কবিতা ও গান অথবা জীবন থেকে কেঁটে নেয়া ফ্রেম”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    অনেকদিন পর লিখলে। জার্ণালটুকু বেশ লাগলো। সবচে' ভালো লাগল শিরোনাম সমূহ।
    প্রথম অনুচ্ছেদে কৈশোরের মুগ্ধতাজনিত-জড়তাজনিত-দূরত্বজনিত-অপরিচয়জনিত অপচয় আমাদের বহুর জীবনে একেকটা না-খোলা তোরঙ্গ হয়ে আছে। খোলাই হয়না আর। ন্যাপথালিনের গোলা কেবল মিলইয়ে যেতে থাকে একটু একটু করে।

    আরেকটা শব্দ --- দ্ব্যর্থতা বলে কি কোন শব্দ আছে? অর্থতা যদি না থাকে, তাহলে এটাও নেই। মনে হয় দ্ব্যর্থবোধকতা হবে।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দূর্দান্ত, এর চেয়ে বেশি ব্যাখ্যা করে বলার ক্ষমতা নাই 😉

    এবার আস্ল কথাই আসি, অনেক দিন পরে লিখলি, হোম পেজে তোর নাম দেখেই মন ভরে গেছে 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।