স্মৃতির পাতায় বিশ্বকাপ অথবা বিশ্বকাপের স্মৃতি : ইটলিয়া ৯০

টানটা কিছুটা রক্তের আর কিছুটা পরিবেশগত ভাবে পাওয়া। তবে সেই টানের রেশ রক্তের স্রোতে সব সময় টের পাই সময়ে কিংবা অসময়ে। সেই টান খেলাধূলার প্রতি টান এবং আমাদের জেনারেশনের জন্য বললে আরো স্পেসিফিক হয়ে যায় ফুটবলের প্রতি টান। যেই সময়ে এই টানের শুরু সেটা প্রায় দুই যুগ আগের গল্প। যখন ঢাকা শহর কিংবা তার পাশ ঘেষে শহরতলীর যে জায়গাতে আমার বাড়ি, এখনকার মত পুরো মাত্রায় ধূলো ধোঁয়ায় ধূসরিত হয়ে উঠে নি। প্রত্যেকটি বাসার সাথেই হয়তো অল্প বিস্তর খোলা জায়গা থাকতো আর সেই জায়গাতে বিকেলে বালকরা বল লাথি দিয়ে নির্মল বিনোদনে মেতে উঠতো। তাই সেই সময়ের শৈশবে খেলাধূলায় বরফ পানি কিংবা গোল্লাছুটের সাথে সাথে এক চর্মগোলকও অল্প অল্প করে জায়গা করে নিয়েছিল। এটা সেই সময়ের গল্প, যখন আতাহার নান্নু নোবেল মাসুম ফারুকদের চাইতে মুন্না সাব্বির কায়সার আসলাম নামগুলো অনেক বেশি জনশ্রুত ছিল। ক্রিকেট উম্মাদনা দূরে থাক, নিয়মের জটিলতা আর উপকরণের প্রাচুর্যতায় তা তখনও সীমিত পরিসরে চালু ছিল। বরং, তুলনামূলক সহজ “বল খেলা”ই অনেক গ্রহণযোগ্য ছিলো। সেই সময়ের গল্পেই আমার ছোট চাচাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সত্তর এবং আশির দশকের একটা বড় সময়ে যিনি স্টেডিয়ামকে ‘আবাহনী আবাহনী’ স্লোগানে প্রকম্পিত করেছেন, কিংবা আমার বড় চাচাত ভাইকেও পাওয়া যাবে যিনি ছিলেন স্থানীয় গিয়াসউদ্দিন মাঠের তারকা স্ট্রাইকার। তাই পারিবারিক টানেই বলে লাথি মারতে শিখতে খুব বেশি দেরি করতে হয় নি। আমার অবশ্য বলে লাথি মারার সুযোগ হত না। আমার চেয়ে বয়সে বড় কাজিনরা পায়ে বল নিয়ে নিজেদের ম্যারাডোনা মনে করতেন আর আমাকে বলির পাঠা ডিফেন্ডারের ডামি সেজে তাদেরকে ম্যারাডোনা বানাতে হত। তাদের মুখে ক্রমশ ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা নাম শুনে মনে করতাম গোলের মত ম্যারাডোনাও বুঝি ফুটবলের কোন এচিভমেন্টের নাম। সেই ম্যারাডোনার সাথে পরিচয় ঘটে অবশ্য আরো পরে; তার আগেই আরেকটি জিনিসের সাথে পরিচয় হয়ে যায়, যার নাম বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ প্রথমবার যখন এসে এমন চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, তার প্রতি প্রগাঢ় ভালো লাগা রেখে যায়, যে চার বছর পর পর জুন-জুলাই সময়টা এক রকম ঘোরে কাটে। এত এত বছর পার হলেও প্রথম বারের অপেক্ষা উত্তেজনা ভালো লাগা আর আশেপাশের মানুষগুলোর উচ্ছাসের স্মৃতিগুলো অনেক বেশি মধুর। সম্ভবত সেই স্মৃতির জন্য সেই মানুষের জন্যই, ইটালিয়া নব্বই আমার কাছে শুধু বিশ্বকাপ হিসাবে আঁটকে থাকে না, বরং শুধু খেলা বা ইভেন্টের সীমা ছাড়িয়ে পরিণত হয় মহাকাল থেকে কেটে নেয়া কিছু আনন্দময় মুহূর্তের চলমান বায়োস্কোপ।

সেই বায়োস্কোপের প্রথম দৃশ্য জায়গা করে নেন অবশ্য আমার মামা। আমার মামা তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বিশ্বকাপের উম্মাদনায় এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। আর সেই খুশিতেই কিনা মামা তার দলভারী করবার মিশন শুরু করে দিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন দল? আমি উত্তর দিলাম, ম্যারাডোনা। মামা বেজায় চটে গেলেন। এবং আমাকে বুঝালেন ম্যারাডোনা কোন দল না, এবং তার দল আর্জেন্টিনাও সাপোর্ট করবার মত কিছু না। সাপোর্ট করতে হবে, ভিয়ালির ইটালীকে। সেই থেকে শুরু। আমরা ছোটরা কিছু না বুঝেই স্লোগান তললাম, “ঝিয়ালুকা ভিয়ালি, ইটালি ইটালি।” আমার মামার মতই আমার আরেক পরীক্ষার্থী চাচাত ভাইও ছিলেন ইটালি সমর্থক। আমার ইটালি সমর্থনে খুশি হয়ে বড়দের বলে আমার ফুটবল জ্ঞান বৃদ্ধিতে আমাকে বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন উপহার দেবার ব্যবস্থা করেন। বিশ্বকাপের তাত্ত্বিক জ্ঞানের শুরু সেখানেই। ঝকঝকে তকতকে পরিপাটি একটা ম্যাগাজিন, কভার পেজ প্লাস্টিকে মোড়ানো। সেখানে অংশগ্রহণকারী চব্বিশ দলের পতাকা বর্ডার করে মাঝখানে বিশ্বকাপের ছবি। প্রথম পাতায় ইতালির গ্রুপ ছবি ছিল। ছিল ইটালির দুই তারকা জেংগা আর ভিয়ালির ছবি। তারপরে ইটালির উপর ফিচার শুরু হয় ” সম্ভাব্য বিজয়ী ও স্বাগতিক দেশ। ইতালির মেক্সিকো বিশ্বকাপের পরে তাদের কোচ হন এঞ্জেগলো ভিসিনি”। এটুকু পড়ে ইটালী প্রেম সুদৃঢ় হয় আর ম্যাগাজিনের প্রতি ভালো লাগা প্রগাঢ় হয়। সেই ম্যাগাজিনের প্রতি ভালো লাগা আমি আজও টের পাই। মনে পড়ে, আমি সময়ে অসময়ে সেই ম্যাগাজিনের পাতার ঘ্রাণ শোঁকতাম। এমনকি বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ারও অনেক পর পর্যন্তও সেটিকে আমি আগলে রেখেছিলাম সেই সময়ের স্মৃতি হিসাবে। ম্যাগাজিনের প্রাপ্তির প্রাথমিক উল্লাস অবশ্য কেটে যায়। কারণ আমার কাজিনরা (তিন চারজন ছিলেন) সেটার উপর আমার পরীক্ষা নিতেন রেগুলার। তাদের ঠেলায় সব দলের জার্সি তাদের তারকা খেলোয়াড়দের নাম জানা হয়ে যায়। তাই বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আন্ড্রিয়াস উর্গিস, স্কুরভি, হ্যাজি, ম্যারাডোনা, টমাস এনকোনা, ক্যারেকা, ক্লিন্সম্যান, লিনেকার, এমিলিও বুত্রাগুয়েনো, রুড খুলিত, এনজো সিফো, ফ্রান্সেস কলি সহ অনেক খেলোয়ড়কেই চেনা হয়ে যায়। মনে পড়ে সেই ম্যাগাজিনে কলম্বিয়া দলের ছবিতে সোনালি চুলো ভালদেরামা আর ঝাকরা চুলো রেনে হিগুয়িতাকে দেখে এক ধরণের আতঙ্ক তৈরি হয় তাদের নিয়ে। ম্যাগাজিনটা আসলে পড়তাম আমরা কাছাকাছি বয়সী তিন কাজিন মিলে। ক্যামেরুন দলের ছবিতে সজারু সদৃশ চুল দেখে আমার এক কাজিন তার নাম দেয় ‘সজারু মিয়া’।

দেখতে দেখতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত হয় প্রায়। প্রথমদিনে সজারু মিয়া’দের সাথে আর্জেন্টিনার খেলা দেকার জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকি। তখনকার দিনগুলোর কথা বিশেষভাবে মনে পরে খেলা দেখার আবহের জন্য। তখনকার দিনে সবার বাসায় টিভি না থাকায়, মোটামুটি আমাদের বাসায় অনেকে মিলে সন্ধ্যা রাতের খেলাটা দেখত। আর এইচএসসি থেকে নিস্তার পাওয়া সকল কাজিনরা এক সাথে বসে রাতের খেলাটা দেখত বেশ জমিয়ে গ্যালারির আদলে। সেইখানে আর্জেন্টিনা ব্রাজিল ইটালী পশ্চিম জার্মানি সব দলেরই সমর্থক ছিল। তাই কাদা ছোড়াছুড়ি ও কথার লড়াইও জমত বেশ ভালো মতই। বলছিলাম প্রথম খেলার কথা। আর্জেন্টিনা সমর্থক বাদে বাকি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্যামেরুণের সমর্থক। এতদিন যার নাম শুনেছি সেই ম্যারাডোনাকে টিভি সেটে দেখবো এই ভাবনায় উৎসাহিত হই। শুরুর পরে অবশ্য ম্যারাডোনাকে আলাদাভাবে চেনা যায়, কারণ একটু পর পর বিপক্ষের লাথি আর ল্যাং খেয়ে তিনি চ্যাংদোলা হয়ে মাটিতে পড়ে যান। নব্বইয়ের বিশ্বকাপ কুখ্যাত হয়ে আছে তার ডিফেন্সিভ এবং গা জোয়ারি খেলার জন্য। এসব তো আর তখন বুঝার সাধ্য নেই। আমি শুধু দেখে যাই। খেলা ফুটবল না রেসলিং বুঝা দায় হয়ে যায়। লাল কার্ডে ক্যামেরুনের খেলোয়াড় বের হয়ে যায় কিন্তু তাতে তাদের মারপিট কমে না। অতপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্যামেরুন গোল দিয়ে বসলে আমাদের এন্টি আর্জেন্টিনা সমর্থকগন উল্লাসে ফেটে পড়ে। অথচ এমন বর্বরোচিত খেলে একটা দল জিতায় আমার মনে এক ধরণের খচখচানি কাজ করে।

আলাদা করে প্রথম খেলাটার কথা বললাম কারণ প্রথম যে কোন জিনিসই স্মরণীয় হয়ে থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে অল্প বিস্তর খেলা দেখতে থাকি। খেলা দেখা আসলে তো খেলা দেখা না। এক ধরণের উৎসব যজ্ঞ। দুই খেলার বিরতিতে যখন নাটক গান হত তখন মুড়ি চানাচুর খাওয়াও হত তুমুলভাবেই। সেইসময় অবশ্য আমাদের ছোটদের কপালে জুটত ঘুমাতে যাবার কড়া নির্দেশ। এতে হতাশ হতাম বটে। তবে, অবাক হয়ে দেখতে পাই, আমাদের দুঃখ বুঝেই হয়তো বিটিভি আগের দিনের রাতের খেলা পরের দিন বিকালে প্রচারের ব্যবস্থা করে। খেলার শুরুতে একটা ভিডিও দেখাতো। তাতে বিশ্বকাপ বল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মাঠের একটা পোস্টে ঢুকত আর পোস্টের উপর ভেন্যুর নাম লিখা থাকত। এভাবে প্রতিদিনই অল্প অল্প করে জমা হয় স্মৃতি যা আজও বেজে চলে সময় থেকে কেটে নেয়া ছোট্ট ফ্রেমে। মনে পড়ে, ইটালির খেলা প্রথম দেখতে বসে ভিয়ালিকে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে অখ্যাত শিলাচির মাঝে ভালো লাগা আবিষ্কারের স্মৃতি। মনে পড়ে ভীতি জাগানিয়া রেনে হিগুয়িতার পাগলাটে ভুল আর রজাল মিলার ছন্দময় নাচ। মনে পড়ে ম্যারাডোনের জাদুকরী পাসে ব্রাজিলের বিদায় এবং তা নিয়ে আমাদের বাসায় মিশ্র প্রতিক্রয়া ও কথার লড়াই। টুকরো টুকরো আরো কিছু অগুরুত্বপূর্ণ খেলাও স্মৃতিকে ভারী করে তুলে। যেমন মনে পড়ে, আমার প্রথম রাত জেগে দেখা খেলায় টমাস স্কুরভির হ্যাটট্রিক। তার সব গুলো গোলই ছিলো হেডে। তখন তাই আমি ভাবতাম হ্যাটট্রিক বুঝি আসলে হেডট্রিক মানে মাথা দিয়ে ট্রিক দেখানোর সম্মাননা। খেলার ভিতরের দিক না বুঝার কারণে খেলা বহির্ভূত ঘটনা মনে দাগ কাটে। নেদারল্যান্ড জার্মানি ম্যাচে থুথু ছোড়াছুড়িও তেমনি একটি ঘটনা। তেমনি মনে করতে পারি চেকস্লোভাকিয়া অস্ট্রিয়া ম্যাচে এক খেলোয়াড় মারাত্মক ট্যাকেলের শিকার হয়ে বাইয়ে যায়। সেই ফাউল থেকে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল হওয়ার পরে চেকোস্লাভাকিয়ার সবাই সেই ইনজুরড খেলোয়াড়ের উপর হামলে পড়ে উচ্ছাস করে। মনে পড়ে ক্যামেরুণের বিদায়ের ম্যাচটিও। ততদিনে তারা রীতিমত বাংলাদেশের সবার কমন সাপোর্টিং দল হয়ে গেছে। সেই কেলাটে দুই পেনাল্টিতে ক্যামেরুন হারলে সবাই র পিছনে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজে সেটাও ভালোমত মনে পড়ে। অনেকদিন পর্যন্তই আমরা বলতাম ক্যামেরুনকে চুরি করে হারানো হয়েছে। রোমানিয়া আয়ারল্যান্ডের ম্যাচে প্রথ টাইব্রেকার দেখা। টাইব্রেকারের উত্তেজনা প্রথম টের পাই সেই খেলা দেখেই। এমন আরেক টাই ব্রেকার হিরো আর্জেন্টিনার গায়কোচিয়া। সম্ভবত আমার ছোট মনে গভীর আঘাত দেয়া খেলোয়াড়ও সে। মনে করতে পারি টাইব্রেকারে হেরে যাওয়ার পরে ডোনাডুনি জিয়ানিনিদের চেহারা। অথচ আমি আবিষ্কার করি, আমার বাড়ির ইটালি সমর্থক বাদে বাকি সবাই গলায় গলা মিলিয়ে আর্জেন্টিনা সমর্থন করছেন। সেই শেষবারের মত আর্জেন্টিনার প্রতি বিতৃষ্ণা। যা আজও আর্জেন্টিনার যে কোন খেলার আগে কাজ করে।

স্মৃতির ঝাপি ভারি করে বিশ্বকাপ শেষ পথে এসে দাঁড়ায়। আসে সেই ফাইনালের মুহূর্ত। আমাদের বাসায় অবশ্য আর্জেন্টিনা ব্রাজিল সাপোর্টাররা সবাই গলা গলা মিলিয়ে আর্জেন্টিনা সাপোর্টার। তারা সবাই ল্যাটিন ফুটবলে নাকি মুগ্ধ। শুরু ইটালি সাপোর্টাররা জার্মানদের সাথে যোগ দেয়। কথার যুদ্ধে ইতালি সমর্থক আমার চাচাত ভাই আরেক কাজিনকে প্রতিনিয়ত উসকে দিতে থাকেন। আর্জেন্টিনা ভুয়া দল, ম্যারাডোনা অভিনয় করে, টাইব্রেকারে খেলে উঠছে, ফাইনালে পারবে না ইত্যাদি কথার বহর ছুটতে থাকে। আর্জেন্টিনার সেই কাজিন থেমে যান না। তিনি আর্জেন্টিনার পক্ষে নগদে একশত টাকা বাজি ফেলেন। এই অবস্থায় বেশ একটা চাপা উত্তেজনা আর বরুদের আবহ থাকে আমাদের বাসার টিভির রুমে। বাজির কথা শুনে আমার পিতামহও খেলা দেখায় যোগ দেন। তিনি খেলার কিছু না বুঝেও নিজের নাতিকে বাজিতে জিতাতে পশ্চিম জার্মানির সমর্থক বনে যান। খেলা শুরু হবার অনেক আগেই আমি ঘুমের দেশে চলে যাই। আমার পিতামহের ডাকে ঘুম ভাঙে। তিনি জোরে ডাকেন, অপুর (আর্জেন্টিনা সাপোর্টার কাজিন) একশত টাকা গেছে। চোখ কচলে টিভি সেটের দিেক তাকাই। স্ক্রীনে ম্যারাডোনাকে দেখতে পাই। বিশ্বকাপ হারানোর (নাকি জোর করে হারিয়ে দেওয়ার) কষ্টে অঝোরে কাঁদছেন। আমি আর্জেন্টিনা অপছন্দ করি। কিন্তু ফুটবল ঈশ্বরের কান্না ভেজা চোখ দেখে কেমন যেন কষ্ট লাগে নিজের অজান্তেই। অত:পর লোথার ম্যাথিউসের কাপ উচিয়ে ধরার মাঝে প্রথম বিশ্বকাপ দেখার স্মৃতি পূর্ণতা পায়।

বিশ্বকাপের সময় যেসব বিজ্ঞাপন প্রচার হত সেগুলো মনের অজান্তে আপন হয়ে যায়। ইনকিলাব ভবন, জেট, জীবন বীমা, লিভার ব্রাদার্স সহ আরও অনেক বিজ্ঞাপন বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার অনেক পর পর্যন্তও বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিযরিয়ে নিয়ে আসতো। আরেকটা মজার ব্যাপার ছিলো তালিবাবাদ ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র নিয়ে। “তালিবাবা” শব্দটা কানে পৌঁছালে অনেক কষ্ট করে এর সাথে ফুটবল খেলার তালি রিলেট করবার চেষ্টা করেও সফল হয়ে উঠতে পারি নি।

প্রায় দুই যুগ আগের সেই গল্প গুলো এখনো চোখের কোণায় ভাসে। সেই সময়ের মানুষগুলোর উচ্ছাস আর আনন্দের মাঝে খেলা দেখাটা আসলে ফুটবলের সীমা ছাড়িয়ে এক ধরণের পারিবারিক উৎসব হয়ে যায়। তারপরে আরো পাঁচটি বিশ্বকাপ দেখেছি। প্রত্যেকটি ফুটবলীয় স্মৃতিতে ইটালিয়া নাইন্টিজের চেয়ে অনেক ঘটনা বহুল হলেও সেই পারিবারিক আবহ অনেক অনেক করে স্মৃতিকাতর করে তুলে। আমার পিতামহ আজ নেই। বেঁচে নেই সেই আর্জেন্টিনা ক্রেজি অপু ভাই কিংবা ‘সজারু মিয়া’ উপাধিদাতা আপুও। অথচ ইটালিয়া নব্বইয়ের স্মৃতির সাথে তারা কেমন করে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে আছে চলমান বায়োস্কোপের মাঝে একাকার হয়ে। শৈশবের প্রথম বিশ্বকাপ প্রেম ইটালিয়া নব্বইয়ের সকল চরিত্রগুলোকে আমি আজও হাঁরিয়ে খুঁজি। সময়ে অসময়ে ইটালিয়া ৯০ এর খেলার হাইলাইটস দেখলে সেি মুখগুলো আবার ফিরে আসে স্মৃতির পাতায়।

পুনশ্চ:

১) সেই সময় ভিউ কার্ডের প্রচলন ছিল। বিশ্কাপের চব্বিশটি দলের টিম ফটোর ভিউ কার্ড আমার সংগ্রহে ছিলো। প্রতি আটটি একটা আর্ট পেপারে আঠা দিয়ে লাগিয়ে প্রত্যেকটার নিচে কমেন্ট লিখে দিয়েছিলেন আমার ইটালি সাপোর্টার চাচাত ভাই তুষার ভাইয়া। সেগুলো ছিল এমন ” ইটালি থেকে বলছি, শিমুল”; “ঘুরে এলাম ইটালি”; “বিদায় ইটালি ৯০”। এর বাইরে আরেকটা আর্ট পেপারে ইনডিভিজুয়াল কিছু খেলোয়াড়ের ভিউ কার্ডও ছিল। মনে করতে পারি তার প্রথম রো এর দুটি কার্ড রেনে হিগুয়িতা আর সালভাদর টোটো শিলাচির ছিলো।

২) “সজারু মিয়া” যেই ক্যামেরুনের খেলোয়াড়ের নাম দিয়েছিলাম তার আসল নাম সাইরাল মাকানাকি। উল্লেখ্য কলম্বিয়ার সাথে যে ম্যাচে সুপার সাব হিসাবে নেমে রজার মিলা হিরো হয়ে গিয়েছিলেন, সেই ম্যাচে তিনি মাকানাকির বদলি হিসাবে নেমেছিলেন।

৩) টমাস স্কুরভির হ্যাটট্রিকটা ছিলো টুর্নামেন্টে দ্বিতীয়। তার আগে স্পেনের মিশেল কোরিয়ার সাথে হ্যাটট্রিক করেছিল।

৪) কোন এক কারনে আমাদের মাঝে প্রচলিত ছিলো কোন দল এগারো গোল খেলে তাকে জার্সি খুলে খেলতে হবে। আরব আমিরাত তৃতীয় ম্যাচে চার গোল খেয়ে এগারো পূর্ণ হলে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম কখন তারা জার্সি খুলে। তারা না খুলায় আমরা ধরে নেই যে এগারো গোল এক খেলায় খেতে হবে। পরে অবশ্য এই বিভ্রান্তি দূর হয়।

৫) এখন খেলার পারসপেকটিভে থেকে মনে করি জার্মানি যোগ্য দল হিসাবে কাপ জিতেছিল। যদিও ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে অন্যায়ভাবে হারানো হয়েছিল। তবে আর্জেন্টিনা পুরো টুর্নামেন্টে খুব বাজে খেলেছিলো, এবং সৌভাগ্য বশতই এতদূর গিয়েছিলো।

৬) ১৯৯১ সালে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে আমার আর আমার আব্বার সাথে কিছু ক্যামেরুনের লোকের সাথে দেখা হয়। আমি মাকানিকি মিলা আর এনকোনার নাম জানি দেখে তারা ব্যাপাক বিস্মিত হয়।

১০ টি মন্তব্য : “স্মৃতির পাতায় বিশ্বকাপ অথবা বিশ্বকাপের স্মৃতি : ইটলিয়া ৯০”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    অদ্ভুত সুন্দর স্মৃতিচারণ। '৯০ এর বিশ্বকাপ অনেক কারণেই আমাদের ব্যাচের জন্যে বিশিষ্ট হয়ে থাকবে। তোমার লেখা পড়ে মনে পড়লো, '৯০ এ বাইরের পোলাপান আন্দোলন করে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে ছিলো বটে। কিন্তু তাহলেও আমাদের কেন ওই সময়টা সংক্ষিপ্ত ভ্যাকেশন করে সবার আগে কলেজেই ফিরে আসতে হয়েছিলো আর মনে নেই। বোধ হয়, পরীক্ষার আমেজ ধরে রেখে প্রস্তুতি নেয়াবার জন্যেই।

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      এই পোস্ট লেখার এক ফাঁকে আপনার কমেন্ট দেখে কনফিউসড হয়ে গেছিলাম। কারণ স্মৃতি সব সময় সত্য হয় না। তবে ঐ সময়ের স্মৃতি ভুল হবার কথা না এত স্পষ্ট আমার কাছে। আবার আপনি ঐ সময়ের পরীক্ষার্থী।

      লেখালেখি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখেছি জ্ঞাতসারেই। তবুও এখানে এত এত পোস্ট আর কমেন্ট পড়ে লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। ইচ্ছা ছিল অন্যান্য বিশ্বকাপ নিয়েও লিখব। সময় করে উঠতে পারি না ইদানিং।

      পড়বার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

      জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    স্মৃতি জাগানিয়া একটা স্মৃতিচারন।
    ভাল লাগলো।
    সাবমিশন টাইমটা (জুন ১১, ২০১৪ – ৫:৪৭ পূর্বাহ্ন) ডেড লাইনের সামান্য পরে হলেও ওটা মার্জনা করার জন্য জোর সুপারিশ করছি।
    হ্যাট্রিক আর হেডট্রিকের ঐ ভুলটা আমাদেরও এক সময়য়ে ছিল। 🙂


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন :thumbup:

    ৯০ এর বেশ কিছু খেলার কথাই মনে আছে কিন্তু কোনভাবেই বিস্তারিত নয়। ওপেনিং ভিডিওটা দারুন লাগতো। ভিউকার্ড তখন দারুন ক্রেজ ছিলো, ভিউকার্ড বাজি রেখে ফুটবল ম্যাচও খেলতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল গুলিতের একটা কার্ড।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ভাল লাগলো ভাই। ৯৪ পূর্ব বিশ্বকাপের ঘটনাগুলো লেখার জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ! চমৎকার! :hatsoff:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  5. রকিব (০১-০৭)

    ৯৪ এর টা নিয়েও লেখেন। ৯০ এর টা একেবারেই দেখি নাই। ৯৪ এর খুব অল্প স্মৃতি আছে, বেশি ছোট ছিলাম- তারপরও পেনাল্টি শুট আউটটুকু মনে আছে। মামা ঘুম থেকে জাগিয়ে দেখিয়েছিল।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রানা (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।