অপরিচিত কিংবা অর্ধ পরিচিত মানুষ ও জীবনের গল্প – ২

[ ডিসক্লেইমার : আগে একই নামে আবজাব কিছু লেখবার চেষ্টা করেছিলাম। ইচ্ছা করলো সেটাকে আরো বাড়াতে। তবে এটা সিরিজে রূপ নেবার সম্ভাবনা কম ]

কলেজ থেকে বিদায় নেয়ার সময় এক স্যার আবেগ থেকে কিছু কথা বলেছিলেন। সেই কথা গুলো মনের পর্দায় আটকে থাকে না চাইলেও। সেই কথাগুলোর সাথে আরো কিছু কথা যোগ হয়ে বরাবরই চলে আসে যে কোন বিদায় বেলায়। কথাগুলি মনে মনে আউড়াই সময়ে অসময়ে। আমরা আমাদের জীবনকে নিয়ে বয়ে চলি গন্তব্য না জানা জাহাজের মত। ছুটে বেড়াই এ কূল থেকে ও কূলে। তারপরে কোন এককূলে নোঙর করি। সেখানেও জীবন বয়ে চলা জাহাজেরা জড়ো হয়। খানিক পরিচয়ে হয়তো কাছে আসি, তারপরে পরস্পরকে দূরে ফেলে ছুটে যাই নিজ নিজ পথে। কারো কারো সাথে আর কখনোই দেখা হয় না আবার কারো কারো সাথে অনেকটা পথ একসাথে চলা হয়। তারপরে, তারও আরো পরে আবারও ছড়িয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য কাছে আসা জীবন গুলো। পারস্পরিক বোঝাপড়ার সকল সুন্দর সম্পর্কেরই একটি সমাপ্তি থাকে। তবে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখা সময়গুলো তার মিষ্টি টক অনুভূতি গুলো নিয়ে কাছে থেকে যায় সব সময়। মানুষগুলো জীবন গুলো তাই চোখের আড়াল হলেও মন থেকে একদম মুছে যায় না কখনও। মানুষগুলো হাজির হয় ফেলে আসা আনন্দ বেদনা হাসি কান্নাকে সাথে নিয়ে সময়ের পিঠে চড়ে।

সেই শৈশবের দিকে ফিরে তাকালে খুব বেশি আবেগাক্রান্ত হই আমার প্রথম স্কুলের কথা ভেবে। ছোট খাটো টিন শেডের বিল্ডিং। মেঝের উপর ইট বিছানো। টিনের চালে থেকে থেকে ফুটো। মাঝে মাঝে ঘোর বর্ষায় ক্লাশের ভিতর পানি পড়ে অচলাবস্থা তৈরি হতো। সাময়িক ছুটির সম্ভাবনায় বৃষ্টির প্রার্থনায় মেতে উঠতাম আমরা। সেই স্কুল আছে তার স্বনামে এখনও, তবে আগের জায়গায় নেই, সেই টিন শেড বিল্ডিং ও নেই, আর নেই সেই স্কুলের তখনকার স্থূল দেহের মায়াময় হেড স্যার। হেড স্যার মায়াময় হলেও সব শিক্ষকরা যে মায়াময় ছিলেন না একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেই সময়ে যেই দুজনকে সবচেয়ে ভয় পেতাম তাদের একজন ছিলেন সালমা আপা আরেকজন মিতালী আপা। মিতালী আপার কাছ থেকে জুটেছিলো প্রথম প্রহারের স্মৃতি। সেই সময়ে সেটা এতটাই ছাপ ফেলেছিলো মনে মিতালী আপাকে দেখলে পড়া ভুলে যেতাম। খুব সম্ভবত আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো বাঘকে বেশি ভয় পাও না মিতালী আপাকে বেশি, তাহলে হয়তো আমি মিতালী আপার নামটাই বলতাম। সেদিন গিয়েছে ; সেই দিন নাই, সেই সময়ও নাই। দেশে থাকতে রাস্তায় হাঁটার মাঝে কেউ একজন হঠাৎ করে যখন আমার নাম ধরে ডেকে জানতে চাইলো কেমন আছো, আমি হকচকিয়ে গেলাম। কারণ প্রশ্নকত্রী আর কেউ না, সেই মিতালী আপা। শৈশবের ভয়ের ছিটা এসে লাগে গায়ে, যদিও জীবনের চাপে পিষ্ট আপার চেহারা দেখে ভয়ের চাইতে মায়াই বেশি লাগার কথা ছিলো। এখনো আর তিনি সেই স্কুলেও নেই, তবে হয়তো সেই স্কুলের ছাত্রদের জন্য মিতালী আপার মতো কেউ আতঙ্ক হয়ে অপেক্ষা করছে। সময়ের সাথে হয়তো তারাও একদিন বুড়ো হবেন, রুক্ষ্ম মূর্তির আড়ালের মায়াময় মানুষটিকে জানিয়ে দিবেন ছাত্রদের কাছে কোনদিন মিতালী আপার মতো করেই। সালমা আপা মিতালীর আপার মতো প্রহার আতঙ্ক তৈরি করেন নি। অথচ তার উপস্থিতি আমাদের জন্য ভয়ের ছিলো। তার ব্যাক্তিত্বের মাঝেকার রাশভারী ভাবটাই যথেষ্ট ছিলো আমাদের ভয় পাবার জন্য। সালমা আপাকে আমার ভালো লাগতো অথচ তিনি কোনদিন হেসে আমাদের সাথে কোন কথা বলেন নি। তার নিজের মেয়েও আমাদের দুই ক্লাশ নিচে পড়তো। তার সাথেও আপার আচরণ একই রকম ছিলো। হয়তো বা তার আদর প্রকাশের ভঙ্গিটিই রুক্ষ্ম ছিলো। আমি ক্লাশ ফোরে স্কুল ছেড়ে যাই। তার বছর দুই পরে জানতে পারি সালমা আপার অসুস্থতার কথা। ক্যান্সার তখন তার জীবনী শক্তিকে অল্প অল্প করে শেষ করে দিচ্ছিলো। এই কথায় কষ্ট পেয়েছিলাম। কষ্টের হয়তো আরো বাকি ছিলো। কেমোর প্রভাবে আপার চুল ঝরে যাওয়ার পরে এলাকার লোকদের মুখরোচক আলোচনায় বাকহারা হয়েছিলাম। মাথায় কাপড় না দেওয়ার পরিণতি যে চুল ঝরা এমন ইসলামিক জ্ঞানে সেই সময়ের ছোট্র আমিও বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপরে, একদিন সমাজের পূন্যবাণদের খুশি করে সালমা আপা হারিয়ে যান এই পৃথিবী থেকে। তারপরে আর কখনো কিছু জানতে চাই নি। সব কষ্ট প্রকাশ করতে নেই — এই বোধটাই হয়তো কাজ করতো সেই সময় খুব করে।

সেই টিন শেড স্কুল সেই মায়াময় জায়গা ছেড়ে যখন আমি এলিট আইডিয়াল স্কুলে আসি কেমন যেন একটা হাঁস ফাঁস ভাব কাজ করতো। আমার সহপাঠীদের তুলনায় আমি ছিলাম বেমানান রকমের ক্ষ্যাত। খুব বন্ধুত্ব হলেও খুব বেশি গাঢ় হয় নি অনেকের সাথেই। তবে এই স্কুলে পড়বার সময়ে জীবনকে জানবার সুযোগ করে দিয়েছিলো সম্পূর্ণই ভিন্ন একটি ব্যাপার। স্কুল বাসা থেকে অনেক দূর হওয়ার যাতায়াতের জন্য ভ্যান গাড়ি ঠিক করে দেয়া হয়। ভ্যান গাড়ি জিনিসটা আমার মোটেই পছন্দের জিনিস না। গাদাগাদি করে বসতে হয়, আর ভ্যান গাড়িটা মুরগি খাঁচা সদৃশ হওয়ায় বসার পরেই নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা মুরগি মুরগি ভাব কাজ করে। অথচ সেই ভ্যান গাড়ির সূত্র ধরেই চমৎকার কিছু মায়াময় লোকের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। ভ্যান গাড়ি যারা চালাতেন তাদের আমরা বলতাম ভাইয়া। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা অদ্ভুত রকম আন্তরিক ছিলো। শহরের বেমাক্কা জায়গায় বাসা হওয়ার কারণে আমাকে কোন ভ্যান গাড়ি ওয়ালা নিতে রাজি হয় না। এমন সময়ই মমিন ভাই নামে একজন লোক এগিয়ে আসেন আমার জন্য। আমার পিতামহের আবার আমার বিদ্যাভ্যাস নিয়ে তুমুল আগ্রহ ছিলো। তাই আমার ভালোর কথা ভেবে অবরে সবরে ভ্যানভাইয়াদের চা নাস্তা খাওয়া থেকে শুরু করে কিঞ্চিত বখশিস দিতেন এমনও মনে করতে পারি। মমিন ভাইয়ার সাথে বিদায়ের স্মৃতিটা কষ্টের। তার বোনের বিয়ের জন্য তিনি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ছুটি থেকে ফিরতে দুইদিন দেরি হওয়ার কারণে তার চাকুরি চলে যায়। মমিন ভাইয়ের দুঃখ বোঝার বয়স তখনও সেইভাবে হয় নি। তবে এমন চমৎকার মানুষকে আর দেখবো না ভেবেই খারাপ লাগতো। পরের ভাইয়া যিনি ছিলেন তার পিছনের গল্পটা মর্মান্তিক। নদীর ভাঙনে সর্ব হারা হয়ে জীবন সংগ্রামে তিনি নেমেছিলেন রিকশার হাত ধরে। সেখান থেকে তুলনামূলক আরামদায়ক ভ্যান গাড়ির চাকুরি নিয়েই চলে আসেন আমাদের সাথে। তবে তার মর্মান্তিক গল্পে আমরা খুব ব্যথিত হতে পারি নি, কারণ তার আগেই দুবার ভ্যান রাস্তায় চিৎপটাং করে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাথিত আগেই হয়ে গিয়েছিলাম। আনাড়ি হাতের কারিশমায় আমাদের তৃতীয়বার ভূমিতে ফেলবার পরে তার চাকুরি নট হয়। পরের জন যিনি ছিলেন তিনি খুবই সতর্ক আর অনেক কেয়ারিং। এদিক ওদিক টাকা বাঁচিয়ে আমাদের এটা ওটা খাওয়াতেন। সেই খাওয়ার খবর বাসায় ভুলেও জানাতাম না আমরা পাছে আবার এটা বন্ধ হয়ে যায়। মনে পড়ে একবার পরীক্ষার পরে সবার পরীক্ষার কুশলাদি জানতে চান, এবং সবার খারাপ পরীক্ষা দেবার কথা শুনে অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতেই রেগে উঠেন। সেই সময়ের মানুষগুলোর আন্তরিকতাকে অনুভব করে এখন বিস্মিত হই। সেইদিনটার কথা খুব মনে পড়ে। একদিন সকালে ভ্যান গাড়ি ওয়ালা আমাদের বাসার সামনে এসে আমার দাদার নাম ধরে ডাকলো “দাদু দাদু”। তাকে ঘরে এনে বসানো হলো। চা দেওয়া হলো (এটাই নিয়ম ছিলো তখন)। তারপরে যখন জানানো হলো তার আগের দিন আমার দাদা মারা গেছে সেই অর্ধ চেনা মানুষটির চেহারার বিষণ্ণতা আমি ভুলতে পারি না। চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখে অশ্রুবিন্দুও দেখা যায়। এমনিভাবে আপাতভাবে সম্পর্কহীন মানুষটিকেও হঠাৎ করেই পরিবারের কেউ বলে বোধ হয়।

বয়স বাড়লে ভ্যান গাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় যাওয়া শুরু করি। আমি এবং আমাদের পাড়ার একটি ছেলে মিলে একসাথে স্কুলে যেতাম। রিকশা ওয়ালা বিষয়ক ঝামেলা এড়াতেই আমাদের ঠিক করে দেওয়া হয় পার্মানেন্ট রিকশাওয়ালা। তাকে অবশ্য রিকশাওয়ালা আমি কখনোই বলতামনা। তাকে বলতাম মেম্বার চাচা। ব্যাপার হলো তিনি আসলেই গ্রামের মেম্বার ছিলেন। ক্ষমতা থেকে নেমে যাওয়ার পরে রাজনৈতিক রেষারেষির ফলে তার জীবন বিপন্ন হয়। আর তিনি পাড়ি জমান ঢাকায়। আমার বাবাও তাকে মেম্বার বলেই ডাকতেন। সেই সময়ের বুদ্ধিতেই আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারতাম এই লোকটি কোনভাবেই আমাদের ভ্যানভাইয়াদের মত মায়াময় নয়। বরং তার পিছনে রয়েছে দুর্দান্ত অতীত, দুর্ধর্ষ সব ঘটনা। কিছু কিছু যখন তিনই আমাদের বলতেন আমরা ভয় পেতাম। এমন লোকের সাহচর্যে বেশি থাকাতেও অনিরাপদ বোধ করতাম। স্কুল ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যাওয়ার পরে মেম্বার চাচাকে আমি আর দেখি নি। শুনেছি তিনি পরে গ্রামে ফিরে গিয়ে আবার মেম্বার হয়েছিলেন।

মেম্বার চাচার কারণে যদি রিকশাওয়ালাদের ব্যাপারে ভীতি তৈরি হয় , তবে সেটা বিদ্বেষের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন অন্য আরেকজন। যদিও জীবনের এই জায়গাতে এসে জানি ভালো খারাপ মোটা দাগে কোথাও সরলীকৃত করা ঠিক না, কিন্তু আমার রিকশাওয়ালা বিষয়ক এলার্জি ছিলো বেশ একটা দীর্ঘ সময় ধরেই। দ্বিতীয় যে রিকশাওয়ালার কথা বলছিলাম তার আসল নাম আমি জানি না। আমাকে দেখলে বিনা ভাড়ায় এদিক ওদিক নিয়ে যেতেন, হেসে খোঁজ খবরও নিতেন। তিনি ছিলেন আসলে আমার চাচার বাসায় ছোটবেলা থেকে কাজ করা ফরিদা আপার হাসব্যান্ড। ফরিদা আপার গল্পটা আরো মর্মান্তিক। আমাদের বাসার পাশের পোকার বস্তিতে তিনি থাকতেন। পোকার বস্তি শুনলে যেমন পোকামাকড়ে ভরা কিছু মনে হয় জায়গাটা আসলে তেমন কিছু নয়; এই বস্তির মালিকের নাম পোকা। জগতে এতো নাম থাকতে তিনি কেন এই উদ্ভট উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন (নাকি নামই) তা আমি আজও জানি না। সে যাই হোক, বলছিলাম ফরিদা আপার কথা। তাকে যদিও আপা বলি আসলে তার বড় মেয়ে আমার চেয়ে বড় ছিলো। ছিলো বলছি এজন্য, কর্মবিমুখ স্বামীর অকর্মণ্যতায় অতিষ্ট হয়ে ফরিদা আপা মেয়েকে বাসায় রেখেই বাড়ি বাড়ি কাজ করতেন। আর তেমনি কোন একদিন বাড়ির সামনের ডোবায় ডুবে গিয়ে মেয়েটি হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। বস্তিতে এখনও ফরিদা আপাকে সবাই সুমির আম্মা নামে ডাকে। হয়তো না জেনেও সাধারণ লোকজন তার মনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে যান। তার রিকশাওয়ালা স্বামীর বর্ণনা আমরা যা জানতে পারি তাতে বিভিন্ন নাটকে দেখা অত্যাচারী স্বামীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। স্ত্রী এবং মেয়েরা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করলে তার আপত্তি, অথচ তাদের রোজগারের টাকাটা খরচের বেলায় তিনি সবার আগে। এমনিভাবে আরও অনেক কথায় জানা হয় সময়ে অসময়ে। অতিষ্ঠ জীবনকে তাৎপর্যময় করবার জন্য ফরিদা আপার সংগ্রাম সকলের অগোচরেও চলে আজও, এখনও।

বল্লালী বালাই নামে চিহ্নিত পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুণকে আমি দেখতে পেতাম আামর গ্রামের এক আত্মীয়ার মাঝে। আমার গ্রামতোতো ফুফু। তার গল্প সেই ইন্দির ঠাকরুণের মতোই। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে নিজের দুটো মেয়েকে নিয়ে একটু একটু যন্ত্রণা শুষে তিনি জীবন যাপন করেছেন। তার সেই সংগ্রাম আমি দেখি নি। তবে তাকে দেখলে তার পিছনের গল্পটা পড়া হয়ে যায় হুট করেই। আসল ইন্দির ঠাকরুণের কেউ না থাকলেও তার দুই মেয়ে ছিলো। ছিলো বলার কারণ তার বড় মেয়ে দশ বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে চলে গেছেন সেও আজ দশ বছর হলো। আর বড় মেয়ের চলে যাওয়ার কিছুদিনের মাঝেই তার ছোটমেয়েও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। গল্পটা করুণ এই জন্য সেই আপু যখন দুই কন্যা নিজের মা আর ক্যান্সারে পিষ্ঠ হয়ে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজছেন তার স্বামী তখন মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে মৌজ মাস্তিতে গা ভাসিয়ে আছেন। আর তাই এক প্রজন্ম পরেও তার মায়ের জীবনের প্রতিরূপ তৈরি করে সেই আপু তার দুই মেয়েকে নিয়ে খুঁজেন আশ্রয়ের। বল্লালী বালাইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ নির্মিত হয়। আর সেই সময়েই হয়তো অন্য কোন মানুষের উপর দাঁড়িয়ে তিনি শুরু করেন বাঁচার জন্য সংগ্রামের।

গ্রামের কথা বললে ঝিকঝিকা ফুফার কথাও মনে পড়ে খুব। তিনি আমার বাবার দিক থেকে লতায় পাতায় ফুফা হলেও আসলে তিনি হলেন আমার দাদীর আপন খালাতো বোনের বর। এই মানুষটির কথা অবরে সবরে অনেক মনে পড়ে কারণ শৈশব স্মৃতির সাথে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে গেছেন তিনি। আমার শৈশবে একটা টিনশেডের বাড়ি ছিলো, সেই বাড়ির সামনে ছোট বারান্দা আর খোলা উঠান ছিলো। সপ্তাহান্তে সেখানে কেরাম খেলার আসর বসতো। আমার বাবা চাচা মামারা ছাড়াও ঝিকঝিকা ফুফা ছিলেন তার রেগুলার খেলোয়াড়। ঝিকঝিকা তার আসল নাম না। তার আসল নামটা আমি আসলে কখনোই জানতাম না। কেরাম খেলার সময় স্ট্রাইক করার আগে তিনি ঝিকঝিক জাতীয় একটা কিছু বলতেন । সেখান থেকে তিনি সবার কাছে ঝিকঝিকা নামে পরিচিত হন। তার প্রাণ চঞ্চল উপস্থিতিতে পুরো কেরাম খেলার আসর মাতিয়ে রাখতেন। তারপরে তিনি মাঝে মাঝেই আসতেন আমাদের বাসায়। বয়সের ভারে সেই প্রাণ আর নেই। সময়ের সাথে সাথে মানুষ হারিয়ে ফেলে অনেক কিছুই। খেলাধূলার ব্যাপার ছাড়া আর কোন বিষয়ে তেমন আগ্রহ তার ছিলো না। এই তো বছর খানেক আগে আমার স্ত্রীর জোর অভিযোগ শুনলাম উনি কাউকে কিছু না বলে বাসায় ঢুকে টিভি অন করেন। আমার স্ত্রী অবশ্য অভিযোগটা তুলে নিয়েছে তার কিছুদিন পরেই। মৃত মানুষের উপর অভিযোগ করা চলে না। উনার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগেই ফোন করি আমি একেবারেই অন্যকারণে। হঠাৎ এই খবরে উনার সাথে কথা বলতে চাই অথবা দেখতে চাই। অথচ আসলে তিনি তখন অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর জন্য।

কষ্টে জীর্ণ এইসব জীবন সম্ভাবনা তৈরির আগেই ঝরে পড়ে আবার উল্টো পিঠে সম্ভাবনাময় প্রতিভার মৃত্যুও ঘটে পরিবেশে। ছোট বেলায় মামার বাড়ি বেড়াতে গেলেই আমার মায়ের ফুফাত খালাতো ভাইদের অনেকের সাথেই কথা হতো। কেউ কেউ কাছেই থাকতেন। এমনি একজন লোক ছিলেন আমার আর্টিষ্ট মামা। তাকে আমি এই নামেই ডাকতাম, বলা যায় এখনো ডাকি। এবং এই নামে ডাকার মাঝে কোন শ্লেষ কিংবা বিদ্রুপ নয় বরং জড়িয়ে আছে আক্ষরিক অর্থেই সম্মান। চিত্রকলার অ আ ক খ না বুঝেও আমার কাছে মনে হয় আমার এই মামার প্রতিভা ছিলো বড় কিছু হবার। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার একটা কাগজ আর পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, তোমার সাথে খেলা খেলবো। তুমি যে কোন টাইপ দাগ দাও আমি টা থেকে ছবি বানাবো। আমি হিজিবিজি দাগ দিলাম। অল্প সময় পরে তিনি তার মাঝ থেকে ছবি বের করে আনলেন। তারপরে বললেন, তোমার ইচ্ছামত ছবি নষ্ট করো। আমি করলাম। সেখান থেকেও চমৎকার ছবি বেরিয়ে এলো। তার তৈরি করা বকের ভাস্কর্য এখনও আমাদের বাসায় থাকার কথা। হাঁসের একটা চমৎকার ভাস্কর্য ছিলো। তার তৈরি একটা মূর্তিকে ফিচার করে আমার মামা ” দ্রাবিড়'” নামে পত্রিকাও বের করেছিলেন। তিনি হার্ড বোর্ডে কিংবা কাপড়ের উপর ছবি আকতেন। তার আঁকা চমৎকার সব ছবিও মামার বাসায় শোভা পেত। এমনি যে শিল্পী তার গুণ কোনদিন বিকশিত হয় নি। বিকশিত হবেও না। সাংসারিক জীবনে তিনি অসুখী ছিলেন। তাকে ‘ ভাদাইম্যা ‘ উপাধি দিয়ে তার স্ত্রী ঘর ছাড়েন। দ্বিতীয় বিয়ের পরে তিনি হঠাৎ করেই তার শিল্পকেই অভিশাপ মনে করা শুরু করেন তিনি। তার জীবন ধারা পরিবর্তিত হয়। তার ভাস্কর্য গুলো ভেঙে পরে একে একে। তার মাথায় টুপি উঠে, মুখে শ্মশ্রু। আগুনে পুড়তে থাকে একের পর এক চিত্রকর্মগুলো। শুধু তার হাতে আঁকা আমার নানার একটা পোট্রেট অক্ষত থেকে যায় তার প্রতিভার স্মৃতি বহন করে। জীবনের চাপে সৃষ্টি হারিয়ে যায় শিল্প হারিয়ে যায়।

শেষ করবো একজন হুজুরের কথা বলে। হুজুর শব্দটার ভেতরে আমাদের মাঝে যে ধরণের নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তাকে দেখলে কেটে যেত অনেকাংশে। তিনি আমার বাবা চাচা সবারই শিক্ষক। জীবন ও জীবিকার তাগিদে কোন এক দূর কালে আমাদের গ্রামে এসেছিলেন। তারপরে এখানের মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেই সারাজীবন পার করে দিয়েছেন। সমাজের মাথায় চড়ে চলবার যে প্রবণতা সাধারণত হুজুরদের মাঝে দেখা যায় তা তার মাঝে ছিলো না বললেই চলে। আমার বাব একরকম জোর করেই মাঝে মাঝে নিয়ে আসতেন তাকে। সেই সূত্র ধরেই তার সাথে আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। তার জীবন আচরি দেখে বিরক্তি কাজ করলেও একই সাথে তা শ্রদ্ধা করার মতোও। তাকে কিছুটা অবসেসড মনে হতো ধর্মের ব্যাপারে, তবে তার মাঝে কোন ভণ্ডামি ছিলো না, ছিলো না ধর্মকে সুযোগ নেয়ার কোন ব্যাপারও। তিনি এতটাই সাধারণ জীবন যাপন করতেন যে রাতে শোয়ার সময় মাথার নিচে বালিশও দিতেন না। হুজুরকে শেষ দেখি ১৯৯৯ সালে। তখন তিনি বলে গেছিলেন হয়তো এটাই শেষ দেখা আর দেখা হবে না। তার পরে তার খোঁজ জানতে পারি নি কখনও। অনেক বছর পরে জানতে পারি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই তিনি চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।

প্রত্যেক মানুষকে নিয়েই হয়তো গল্প হয়। অজানা গল্প সময়ের স্রোতে ভেসেও যায়। কোন কোন জীবন স্বল্প সময়েই কাছে এসে আপন করে নেয় কোন জীবন ; হারিয়েও যায় হঠাৎ করে। আবার দূর থেকে শ্রদ্ধা জাগিয়ে কখনও কষ্টের আঁচ বুলিয়ে আপন নিয়মে বয়ে চলে কোন কোন জীবন।

১,২৭৭ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “অপরিচিত কিংবা অর্ধ পরিচিত মানুষ ও জীবনের গল্প – ২”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    সিরিজ করতে পারো কিন্তু।
    লেখাটা পুরো পড়া হলোনা এখনো, তার কারণ অবশ্য এর দৈর্ঘ্য নয়। কারণ এ লেখাটির শব্দ বাক্য প্যারাগুলো উসকে দিচ্ছে নানান ভাবনা, নস্টালজিক আরো কিছু কথা -তোমার এসব শব্দের পিঠে আরো কিছু শব্দ।তখন পড়া থামিয়ে সেসব ভাবনা ভেবে যাওয়াটাই প্রধান হয়ে পড়...
    এই যে গল্পগুলো, সেখানকার মানুষ বা মুহূর্তগুলো -- এদের নিয়ে এমন বুনন শুধু ভালো বা মন্দ লেগেছে বললে কিছুই বলা হয়না।বারে বারে ফিরে পড়তে হয়, কিছু বলে ওঠা হোক কি না হোক। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      নূপুরদা, আপনার মন্তব্য সবসময়েই বিশেষভাবে অণুপ্রাণিত করে। সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া জীবন গুলিকে নিয়ে আমি ভাবি; জীবনকে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করি। মনের কোণে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর পরিচয় মনে অস্পষ্ট হয়ে যাবার আগে তাদেরকে ধরে রাখতেই আসলে এই লেখাগুলি লেখা। অনেক গুলো মানুষের কথা এক সাথে জড়ো হলেই লিখে ফেলতে ইচ্ছা করে। লেখাটা লিখে আনন্দটা তখনই আসে যখন কেউ পড়ে তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজে নিতে পারে। তাদের জন্য নস্টালজিক হয়। সেই জন্যই আপনার মন্তব্য অনেক প্রেরণাদায়ী। আবজাব লিখেও আপনার মতো লোকদের প্রশ্রয়েই আবার লেখার সাহস পাই।

      ভালো থাকুন অনেক। আর দেরিতে রিপ্লাই দেয়ার জন্য :frontroll: (সম্পাদিত)

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।