অপরিচিত কিংবা অর্ধ পরিচিত মানুষ ও জীবনের গল্প

গল্প লিখতে বসলে গল্পের চরিত্র নিয়ে কাহিনী ও নাম সংকটে পরে যেতাম প্রথম প্রথম। বাস্তব আর গল্পের অসমতায় প্রভাবিত হয়ে গল্পের প্লট নিয়েই সন্দেহাতুর হয়ে যেতাম। বাস্তবের ঘটনাগুলো গল্পের মতো অভিনব হয় না নাকি গল্প বাস্তবের মত জীবন্ত হয় না এ নিয়েই দ্বিধা কাজ করতো মনে। কাহিনী তাই গড়ে উঠে বয়ে চলা জীবনগুলোর একটার সাথে আরেকটার কাহিনীর যোগ বিয়োগে। অদেখা জীবন গল্পে চলে এলে সেই জীবনের বাস্তবতার চেয়ে সেই জীবন নিয়ে রোমান্টিক ভাবনায় স্টেরিও টাইপ কাহিনী গড়ে উঠে। জীবন বোধের অভাবে ভুগে অর্ধ সমাপ্ত থেকে যায় অদেখা অথবা স্বল্প দেখা জীবনগুলোর কথা – কখনো গল্পের পাতায় উঠে আসে না। নাম সংকটের ব্যাপারটা আরো তীব্র। কারণ সব গল্পে একই নাম ব্যবহার করলে একঘেঁয়ে উঠে আবার নতুন নতুন নামের জন্ম দেয়াটাও খুব বেশি সহজ না।সংকটের সমাধান হয়ে যায় পাশে বয়ে চলা জীবন গুলোর প্রকৃত নামগুলোকে বেছে নিয়ে। কখনো বা পরিচিত জীবনের গল্পকে আড়াল করি পরিচিত অন্য কোন নামের ছায়ায়। গল্পে ব্যবহৃত নামগুলোতে প্রাধান্য করে নেয় অর্ধ পরিচিত অদেখা জীবন বয়ে চলা মানুষগুলো। সেই নামের আড়ালের গল্পগুলো পরিচিত মানুষের জীবনের হলেও চরিত্রের নামগুলো বয়ে নিয়ে বেড়ানো বাস্তবের মানুষগুলো থেকে যায় আমার ভাবনা কিংবা দৃষ্টি বলয়ের বাইরে। সেই নামগুলোর সাথে পরিচয়গুলোই শুধু মনে থাকে – কাটা সময়ের ফ্রেমে।

শৈশবের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীদের নামগুলোতে আমি খুব আকৃষ্ট হই। আর তাই গল্পে মৌসুমী সৈকত দীপা অপর্ণা লাবিবেরা ঢুকে পড়ে নিজের অজান্তেই। দীপার সাথে পরিচয় হয়েছিল প্রথম স্কুলের প্রথম ক্লাশেই। পরিচয়ের সূত্র ধরে ঘনিষ্টতা কখনোই হয়নি। আরো ভালো করে বললে নিজে কিছুটা অমিশুক বলেই কখনো সেইভাবে জানা হয়ে উঠেনি অনেককেই। দীপা স্কুলে আসতো তার বাবার সাথে। দীপার বাবার চেহারাতে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিলো না হয়তো। তবে আমাদের বাসার কয়েক গলি পরে একটা দোকানে তাকে বসে থাকতে দেখার পরেই তিনি অচেনা কেউ রয়ে যান না। স্কুলে দীপাকে নিয়ে যাবার সময় কিংবা দোকানে বসে থাকার সময়ও আগে পরে কখনো দীপার বাবার সাথে কথা হয় নি। শুধু তার বিমর্ষ বিরক্ত মুখে বসে থাকা এবং নিরাসক্তভাবে স্কুলে যাওয়া আসাই চোখে ভাসতো কেবল। সময় বয়ে চলে। সেই স্কুল ত্যাগ করি আমি চার বছর পরেই। অথচ দীপার বাবার সাথে কখনো কথা হয় না শুধু তার চেহারা দেখা ছাড়া।পনের বিশ বছর পরে দীপার খোঁজ খবর না রাখা হলেও রাস্তায় হেঁটে যাবার পথে দীপার বাবার দোকান চোখে পড়ে। দীপার বাবার সেই পুরনো নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা সেই বিরক্ত দৃষ্টি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে। অথচ তারপরেও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারি না দীপার কথা। দীপা কেমন আছে কোথায় আছে জানা হয় না কখনো। এতো কাছে তবুও এতো দূরে। শুধু দীপার বাবার দোকানের চিত্রায়নটুকু রেখেই আমার এক গল্পে দীপা নামটি চলে আসে। চলে আসে ভিন্নভাবে। গল্পের দীপা আমার মনের মতো সেজে যায় যদিও সত্যিকারের দীপা রয়ে যায় চোখের আড়ালে ভাবনা বলয়ের বাইরে।

দীপার গল্পে আরেক চরিত্র হিসাবে উঠে আসে আমার শৈশবের আরেক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু সৈকতের নাম। ব্যাক্তিগতভাবে পুতুপুতু ছেলেদের প্রতি আমার বিরাগের জন্ম দিয়েছিলো এই সৈকত। সৈকত স্কুলে আসলে সবাই টের পেত। কারণ ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে সে ভ্যা করে কেঁদে উঠতো। ক্লাশের দরজার ওপাশে বসে থাকা সৈকতের বাবা তার খোমা দর্শন করিয়ে সৈকতকে শান্ত করতো। ব্যাপারটা কেন জানি আমার বিরক্তিকর লাগতো। সময় এগিয়ে যায়। তার সাথে ব্যস্তানুপাতে সৈকতের পুতুপুতু ভাব কমে আসে। একসময় তার বাবাকে ছাড়াই একদিন পুরো স্কুল সময় পার করে দেয়। সৈকতের সাথে বন্ধুত্ব হয়। স্কুল ছেড়ে আসার পরেও সৈকতকে সৈকতের বাবাকে দেখেছি কালে ভদ্রে। তবে সময়ের সাথে সৈকত নামটি ছাড়া খুব বেশি জমা নেই স্মৃতির ঝুলিতে। সৈকত নাম আর তার ছিচকাঁদুনেপনা শুধু মাথায় থাকে। এমনি সময় দীপার গল্পে ব্যর্থ প্রেমিক টাইপ চরিত্রে কারণ ছাড়াই সৈকতকে বসিয়ে দেই। লম্বা সময়ে অন্তত আরো চার পাঁচ জন সৈকতের সাথে পরিচয় হয়েছে। তবে শৈশবের ছিচকাঁদুনে সৈকতকে জানা হয় নি কখনোই আর ; জানা হয় নি সে কেমন আছে কোথায় আছে কীভাবে আছে।

আমার প্রথম স্কুলের প্রথম ফার্স্টবয় লাবিব ইয়াসামি মল্লিক। পুরা নামটাই এখনো মনে আছে অথচ তার সাথে আমার পরিচয় মাত্র একবছরের। এই বয়সে এসে ভালো ছাত্রদের ব্যাপারে এলার্জি কাজ করলেও তার উদ্ভব হয়েছে লাবিবের সাথে পরিচয় হবার অনেক পরে। ভালো ছাত্রদের মাঝে স্বভাব সুলভ যে ‘নাক উচা’ ভাব সেটা লাবিবের মাঝে ছিলো না। এই জিনিসটার মাহাত্ম্য বুঝেছি অনেক পরে এসে। তবে শৈশবের খুব ক্ষুদ্র সময়ের পরিচয়ে শ্রদ্ধার জায়গা নিয়েই লাবিব নামটি আমার কাছে থেকে যায় চিরদিনের জন্যে। বন্ধু বৎসল অমায়িক ছেলেটি আজ ২৩ বছর পরে কোথায় কেমন আছে জানি না ; কে জানে হয়তো সে আমার দেখা লাবিব নেই মোটেই, বদলে গেছে সময়ের স্রোতে । তার প্রখর মেধার প্রয়োগ হয়েছে কিনা তাও জানতে পারি নি। যেখানেই থাকুক আমার বন্ধুটি ভালো থাকুক। লাবিব আমার গল্পে এসেছে তার নাম নিয়ে। প্রত্যেকটা গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রগুলোকেই তার নামের আড়ালে ঢেকে দিয়েছি।

অপর্ণাকে নিয়ে অনেকবার লেখার চেষ্টা করেছি। আমার ড্রাফটের ঘরে অনেকবার থেকে আটকে গেছে অপর্ণার গল্প। অপর্ণা মজুমদার আমার স্কুলের আরেক সহপাঠী। দুই বছর একসাথে পড়বার সুবাদে পরিচয় কিংবা হৃদ্যতা হালকা পাতলা হয়েছিলো। অপর্ণার আম্মা খুবই মিশুক ছিলেন। কোলে ফুটফুটে এক মেয়েকে নিয়ে আরেক হাতে অপর্ণাকে ধরে স্কুলে আসতেন। স্কুলে আসলে আমাদের সাথে সব সময় দু’তিন কথা বলে যেতেন। তারপরে একদিন হঠাৎ অপর্ণা স্কুলে আসা বন্ধ করলো। আরো কয়েকদিন যাওয়ার পরে জানতে পারলাম অপর্ণা আর আসবে না আমাদের সাথে ক্লাশ করতে। হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন অপর্ণার মা। আর তার পরিবারে নানাবিধ ঝামেলা তৈরি হয়েছে। অপর্ণার বাবা আবার বিয়ে করেছেন এমন উড়ো খবরও শুনতে পারি। তারপরে আমরা আর কখনো জানতে পারি নি অপর্ণা আর পরিবারের কথা। জানতে পারি না অপর্ণা আর তার ছোটবোন কীভাবে কোথায় বড় হয়েছে; তারা এখন কোথায় আছে কেমন আছে। শুধু অপর্ণা নামটির মাঝে শৈশবের একরাশ কষ্টের ছোঁয়া লেগে রয়েছে মনের গোপন কোন কুঠুরীতে।

মৌসুমীকে গল্পে সময়ের সাথে হারানো প্রেমিকা দেখালেও মোসুমীর সাথে আমার যখন পরিচয় সেটা আসলে প্রেম বোঝার বয়স না। তার সাথে আমার সম্পর্কে এক ধরণের দেয়াল ছিলো। তবে সেই দেয়াল বৈরীতার না একথা ভালো ভাবেই বলতে পারি। মৌসুমীকে আমাদের ক্লাশের ছেলেরা মশা বলে ক্ষ্যাপাতো। এই কথা কেউ বললে কেন জানি না আমার বেশ মেজাজ খারাপ লাগতো। অথচ সামনা সামনি মোসুমীর সাথে কথা বলতে আমি নার্ভাস হতাম। আগেই বলেছি সেটা প্রেম বুঝার বয়স না তবে এই মেয়েটি আমার প্রথম ভালো লাগা এটা মাঝে মাঝেই মনে হয়। কথা তেমন না হওয়ার কারণেই মৌসুমীর সাথে বন্ধুত্বের স্মৃতি খুব বেশি আছে এমন বলতে পারি না। তবে তার ন্যাড়া হবার পরে স্কুল ক্যাপ খুলে মাথা হাত দিতে বেশ মজা পেতাম এটা বেশ ভালোভাবেই মনে পরে। নিজেদের শৈশবের নিরর্থক আনন্দের কথা ভেবে নিজের অজান্তেই সরল ভালো লাগায় মন ভরে উঠে।

নাম জানা অজানা জীবনের গল্প করতেই নাম না জানা অর্ধ জানা জীবনের কথাও চোখে ভাসে বেশ। আমার মায়ের কাছে এলাকার অনেক মহিলা আসতো। তাদের আসা আমার জন্য নতুন কোন ঘটনার জন্ম দিতো না তবে আমি বেশ বিরক্ত হতাম। কেননা, আমার ধারণা ছিলো আমার মায়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে আসে। রূপালির মায়ের গল্প জেনে আমার সেই ভাবনায় ছেদ পরে। রূপালির মা বলছি এই জন্যে ঐ মহিলার সঠিক নাম আমার জানা নেই। খুব সম্ভবত বিয়ের পরে আমাদের দেশের মেয়েদের একটা বড় অংশের নাম হারিয়ে যায় শ্বশুরবাড়ির এবং সমাজের চাপে পিষ্ট হয়ে। সেই আলোচনা আরেকদিন হোক তার চেয়ে রূপালির মায়ের কথা বলি। ঠিক কী কারণে আমার মায়ের সাথে ঐ মহিলার কথোপকথনের মাঝে আমি আশেপাশে ছিলাম মনে করতে পারি না। তবে তাদের কথোপকথনের ছিটে ফোঁটা অনিচ্ছাতেও আমার কানে আসছিলো। আর তাতে আমি হঠাৎ করেই সজাগ হই। সেই মহিলার পেছনেও যে গল্প আছে সেটা আমি জানতাম না কিংবা তখনো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি যে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনই এক বা একাধিক চলমান গল্প। রূপালির মায়ের গল্পটা চমকপ্রদ। তার চেয়ে বড় চমকপ্রদ ব্যাপার হলো তিনি আসলে রূপালির মা নন। গল্পটা হতে পারে অনেক কিছুরই , সবটা যেহেতু জানা নেই সেই অংশ বাদই যাক। জানা অংশ হলো রূপালির আসল মা মারা যাবার পরে রূপালির বাবা ‘রূপালির মা’কে বিয়ে করেন। তার কিছুদিন পরে নাটকীয়ভাবে রূপালির বাবাও মারা যান। তারপরের অংশ সংগ্রামের। সৎমা বিষয়ক সমাজের যাবতীয় স্টেরিও টাইপ ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেলাই কাজ টিউশনি, পার্ট টাইম পড়ানো এই সব মধ্য দিয়ে তিনি রূপালি ও মিতু নামক দুই ‘মেয়ে’কে আগলে রাখেন পরম মমতায়। পড়ানোর সময় রূপালিকে চড় থাপ্পড় দিলে মেয়ে যখন ফুঁপিয়ে কাঁদে সেই সময়ে তার হৃদয় ছেড়া অনুভূতির কথা জানতে পারি। এইটুকু জানার পরে সবসময়ে দেখা একটা পরিচিত দৃশ্যও আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। আমাদের বাসার সামনে ‘মা’য়ের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা মিতু আপা আর রূপালি আপার উচ্ছল ছোটাছুটি আমার কাছে স্বর্গীয় মনে হতো।

আমার মায়ের শাড়ির শখ ছিলো খুব। তবে রঙচঙা দামি শাড়ির চেয়ে আটপৌরে শাড়ি তিনি পছন্দ করতেন বেশি। তাই সময়ে অসময়ে মহল্লায় শাড়ি বিক্রি করে বেড়ানো মহিলাদের বাসায় প্রবেশ হতো বিপুল। সেই সব মহিলাদের কাউকেই হতাশ না করে শাড়ি কিনতেন বলে আমি কিছুটা বিরক্তও হতাম। তবে মায়ের কাছে সেই সব মহিলাদের সংগ্রামী জীবনের কথা জানবার পরে সেই বিরক্তি কমে যায়। সেই শাড়িওয়ালিদের কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কেউ বা গ্রাম থেকে সর্বস্ব হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে শহরে আসা, কেউ না মদ্যপ অকর্মন্য স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে জীবন সংগ্রামে নামা। তাদের অসৎ লোক ঠকানো চেহারার পিছনে মানবীয় সংগ্রামী চেহারা একটু চোখে পড়াতেই হয়তো জীবনকে সাদাকালো ভাবে দেখার চোখ বদলে যায় আমার। সেই মহিলাদের দেখি না অনেকদিন হলো। তাদের জীবনের গল্প আমার কাছে তাই অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। শুধু তাদের সংগ্রামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যাই নিজের অজান্তেই।

অর্ধ পরিচিত না হলেও পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত দিক জানা হয় সময়ে সময়ে। এমনি অনেক আছেন যারা খুব পরিচিত হয়েও অপরিচিত ছিলো। অথচ সময়ের সাথে সাথে আমি আবিষ্কার করি তাদের সংগ্রামকে। একজন ভদ্রলোকের কথা বলবো যিনি একটি ফ্যান কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। এক সময় হুট করেই ফ্যান কোম্পানী বন্ধ হয়ে যায়। সেটা ৮০ এর দশকের শেষের দিকে। বেকারত্ব তখন আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে এই দেশকে। বেকারত্বের অভিশাপে তিনি দিশেহারা। তার ছেলে সেভেনে পড়ে মেয়ে টু’তে। তাদের মুখ চেয়ে তিনি গ্রামে ফিরে যান না। শুরু করেন সংগ্রাম। শুধু মাত্র প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের জীবিকা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। তার জ্ঞান খারাপ না থাকলেও সীলের অভাবে ব্যবসায়িক শিক্ষকদের মতো ব্যাচ পড়াবার সুযোগ পান না। তার নিজস্ব পদ্ধতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি পড়ানো শুরু করেন তাদেরই যাদের পিছনে টিচারের পর টিচার ঢেলে অভিভাবকেরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ফাঁকিবাজ ছাত্রদের কঠোর শাসনে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান। আমার জানা মতেই তিনি চার থেকে পাঁচজন এমন ছাত্র ছাত্রীকে এইচএসসির গণ্ডি পার করিয়েছেন যাদের বাবা মা এইসএসসি দূরে থাক তাদের সন্তানকে এসএসসি পার করবার ব্যাপারেই সন্দিহান ছিলেন। হয়তো জ্ঞানদানে পূর্নাঙ্গ না, তবে ছাত্রকে ট্র্যাকে রাখার পিছনে তার আন্তরিকতাটুকু অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। আর সেই কাজ ২২ বছর ধরে চালিয়ে আজ তিনি তার ছেলে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমার কাছে তাই তিনি একজন বিজয়ী সংগ্রামী।

শেষ করবো পরিচিত এক মায়ের কথা বলে। তার ত্যাগ আমি হুট করেই উপলব্ধি করতাম না। তার গল্পটি আসলে বিষাদের। নতুন দাম্পত্যের রেশ তখনো মিলিয়ে যায় নি। তাদের কোলজুড়ে ফুটফুটে ছেলে এসেছে। এরই মাঝে একদিন তাদের বাসায় ডাকাত পড়লো। তার স্বামী ছিলেন খুবই সাহসী। তিনি হেরে যাবার লোক নন বলেই ডাকাতদের সাথে সংঘর্ষে গেলেন। আর কয়েক মিনিটের মাঝে কপালে বুলেট বিদ্ধ হয়ে থেমে যায় জীবন স্পন্দন। শোকের প্রাথমি্ক ধাক্কা কাটিয়ে উঠার পরে সেই মা সেই পথে গেলেন যে পথে সাধারণেরা যেতে সাহস পায় না। নিজের সন্তানের দিকে চেয়ে তিনি আর বিয়ে করেন নি। আর নিজের স্কুলের চাকুরি বজার রেখে চালিয়ে গেছেন জীবন সংগ্রাম। বাবা ছাড়া ছেলের জন্য তিনি নিজেই মা বাবা দুই হয়ে ছিলেন। এই সংগ্রাম চালিয়ে আজ পয়ত্রিশ বছর পরে তিনি জয়ী। তার ছেলেকে তিনি দাঁড় করিয়েছেন নিজের পায়ে। বিদেশে আজ প্রতিষ্ঠিত সেই ছেলে তার ছেলের বউ আর নাতিকে নিয়ে। স্যালুট এই মায়ের সংগ্রামী ত্যাগকে।

পৃথিবীর গলি ঘুপচিতে জীবনকে খুঁজে ফেরা কিংবা জীবনের মাঝ থেকে নিংড়ানো বিরস অবশেষকে তাৎপর্যমণ্ডিত করা মানুষগুলোর জন্য অনেক শ্রদ্ধা, আর শৈশবে কাছে এসে হারিয়ে যাওয়া নামের পিছনে বয়ে চলা জীবনগুলোর জন্য অনেক ভালোবাসা।

১,২৭৮ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “অপরিচিত কিংবা অর্ধ পরিচিত মানুষ ও জীবনের গল্প”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    ছোটবেলার যে কোনো কিছুই আমাকে প্রচন্ড নস্টালজিয়াতে আক্রান্ত করে. তাই এই ২০১২ তে এসেও হাতড়ে ফিরি নব্বই এর দশকে ফেলে আশা অতীতটুকু, স্কুলের বন্ধু ও তাদের হারিয়ে ফেলা মুখ কিংবা  স্মৃতিগুলোকে . সেই নস্টালজিয়াটুকুই আবার উস্কে দিলেন , আমিন ভাই 


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমার ছেলেবেলায় নিজের বন্ধুদের চেয়ে ভাই এবং ছোটমামার বন্ধুদের সাথেই বেশি সময় কেটেছে। এছাড়া বন্ধু সুলভ বাপ-মা'র কারনেও বাইরে কম যেতে হত। প্রায়ই আমরা রাতের বেলায় বা ছুটির দিনে সবাই মিলে ক্যারাম খেলতাম। আমি আর বাপ এক দলে, ভাইয়া আর মামা আরেক দলে। প্রথম দিকে টুল বা চেয়ারে দাঁড়িয়ে খেলতাম, পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি... 😛 কোক বাজি রেখে খেলা হত। যেই পার্টিই জিতুক টাকা অবশ্য বাপই দিতেন... 😀

    বাপের বদলির চাকুরিও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনে হাল্কা অন্তরায় ছিল। তবুও কিছু বন্ধু ছিল, কিন্তু কলেজে যাবার পর বেশিরভাগই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে। শুধুমাত্র একজন ছিল জানে-জিগার টাইপ। দোস্ত আমার এখন বউ বাচ্ছা সহ ভালোই আছে...


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    প্রথম যে স্কুলে পড়েছিলাম তার নামও মনে নেই। ৪ বছর বয়সে মাত্র সাড়ে তিন মাস ওই স্কুলে গিয়েছিলাম। অনেকটা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলা যায়। তাই ওই স্কুল কিংবা স্কুলের অন্যান্য সহপাঠীরা কখনো সেভাবে আমার স্মৃতিতে আসে না।তবে বেনাপোলের ওই স্কুল সেভাবে মনে না থাকলেও বেনাপোল অতটুকু সময়ের মধ্যেই খুব ভালভাবেই আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।

    আমি মংলা বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়কেই আমার প্রথম স্কুল মনে করি।সেই নার্সারি থেকে ক্যাডেট কলেজে যাবার আগ পর্যন্ত এই স্কুলেই আমার পড়ালেখা। তবে আমি ভাগ্যবান আমার তখনকার যারা ভাল বন্ধু, প্রিয় বড় ভাই, বড় আপু, স্যার, ম্যাডাম, প্রতিবেশী চাচাচাচী প্রায় সবার সাথেই এখনো যোগাযোগ আছে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত কিছু মেয়ের সাথে সখ্যতা ছিল। তারপর ৫-৬ বছরের বিরতি।এসএসসির পর আবার দুই একজনের সাথে নতুন করে পরিচয়।আসলে এতদিন কথা না হলেও কলেজ থেকে আসার পর ঠিকই সব খবরই পেতাম।ভার্সিটিতে আসার পর এখন আরো বেশি করে যোগাযোগ হচ্ছে।আমাদের স্কুলের ক্লাসমেটদের মধ্যে প্রায় ২০-২৫ জন ঢাকাতেই আছে।

    মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেক মেয়ে সহপাঠীর বিয়েতো হয়েই গেছে, ৫-৬ ছেলে সহপাঠী বিয়ে করে এখনি ছেলেমেয়ের গর্বিত পিতা হয়ে গেছে।

    স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটির এত ভাল ভাল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কিভাবে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে টেরই পাই না।

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সব মানুষের নিজস্ব গল্প আছে। আর এই গল্পগুলো প্রতিটিই আলাদা, অসাধারণ।

    আমিন, তোমার অতীত ভ্রমণ কিম্বা মানুষ হাঁতড়ে বেরানো ভালো লাগলো। :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।