ছোটগল্প : ডায়েরির ছেঁড়া কোন নিশ্চুপ পাতায়

এক
শেষ বিকেলের রোদের তীর্যক রেখা অফিসের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে আমার পাশের টেবিলে কর্মরত বীথির নগ্ন বাহুরর উপর পড়লে আমি সচকিত হই। রোদের এই আগমন হয়তো অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিংবা বলা যায় এমন ঘটনা যে আগে ঘটে নি তাও হয়তো নয় তবে এই আলোকের হঠাৎ ঝলকানিতে আমার মাথা ব্যথার উদয় ঘটল আবার নতুন করে। ব্যথার অনুভূতিটা অদ্ভুত। এক ধরণের নেশাভাব কাজ করে এই ব্যথার মাঝেই। ক্রমশ হেলে পড়া সূর্যের আলোতে বীথির উম্মুক্ত বাহু উজ্জ্বল হয়। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে প্রগাঢ় হয় আমার মাথার যন্ত্রণা। ব্যথা অসহনীয় জায়গায় যাবার আগেই আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে, অথচ আমি কিছুটা মোহগ্রস্থ যেন। উজ্জ্বল বাহুর দিকে তাকিয়ে নেশা ভরা ব্যথাকে জাগিয়ে তুলি আরো। মাথা ব্যথার প্রভাব বাড়তে শুরু করে সময়ের ব্যাপ্তি আর বীথির বাহুর ঔজ্জ্বল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে। ঝাঁ ঝাঁ মাথা ব্যথার মাঝেই বীথিকে কাজ করতে দেখি। গতকালের ঘুম ভাঙা স্বপ্নের মত করে তার বাহু কামড়ানোর সাধ জাগে এক মুহূর্তের জন্য। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করি। গতকালকের স্বপ্নের অণু পরমাণু ভাবনা গুলো আমার মাথায় জড়ো হতে থাকে এক এক করে। বীথির বাহু কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলার বীভৎস দৃশ্যে গা গুলাতে শুরু করে। তারপরে রক্তমাখা দাঁতকে বন্যার আঁচলে মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করার মাঝেই ঝাঁ ঝাঁ করে এক ধরণের অদ্ভুত শব্দের মোহে আমি গ্রাসিত হই। তারপরে আমি কুকড়ে উঠি। হাজার বছরের চেনা তীব্র শান্ত অথচ পাগল করা কিছু অনুভূতির তীক্ষ্মতায় আমি বিদ্ধ হই। সেই তীব্র অনুভূতিগুলো রোদের উপরে ভর করে আমার উপরে পড়ছে। আমি বিদ্ধ হচ্ছি আবার। উম্মুক্ত বীথির বাহু কিংবা অফিসের কর্মক্লান্ত সময়কে ছাপিয়ে আমি গ্রাসিত হয়েছি অন্য কোন সময়ে। আমার অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমাকে বিদ্ধ করছে। সেই সাথে প্রবল হচ্ছে মাথা ব্যথা। অনুভূতি শূন্য টলায়মান আমি বোধে আক্রান্ত হয়ে নিজের অজান্তেই পালিয়ে যেতে চাই সূর্যের থেকে, বীথির নগ্ন আকর্ষণীয় বাহুর ঝলকানি থেকে, সর্বোপরি আমার সেই ভয়াবহ অনুভূতির থেকে।
আমার বোধের একদম গভীরে নাড়া দেওয়া অনুভূতি আর সেই সাথে তার দংশনে কুকড়ে যাওয়া মাথাকে কাঁধের উপর বয়ে নিয়ে আমি পায়চারি করি। বীথির বাহু আর আমার মাথা ব্যথা যে ভাবনার দ্বারা তাড়িত হয় সেটা ক্রমশ বিস্তার লাভ করে আমার চেতনাজুড়ে। নিজের মাঝেকার অন্তর্দহন আড়াল হয় শেষ বিকালের জণাকীর্ণ ব্যস্ত রাস্তায়। আমার মনের মাঝে বাস করা সদা চেপে রাখা দৈত্য বের হয়ে আমাকে গ্রাস করতে চায়। বন্যার গভীরতায় সে দৈত্য হারায় না। শুধু খানিকের জন্যে লুকায় মনের ঘুপটি ঘরে। এই অনুভূতিকে আমি চিনি। এই অনুভূতির তীব্রতায় আচ্ছন্ন হই। এই অনুভূতির হাত থেকে বাঁচতে আমি দ্রুত বন্যার কাছে যেতে চাই। বন্যা আমাকে ধারণ করে। ধারণ করে তার নিজস্ব গভীরতায়। তার গভীর চোখের কোমল প্রলেপে আমার জ্বালা কমে। অথচ এই জ্বলুনিকে আমি আড়াল রাখতে চাই শুধু বন্যার এই প্রলেপ হারিয়ে ফেলবার ভয়ে। আমার চারপাশকে ভুলে যাই। কিংবা ভুলে যাই আমার চারপাশের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনে সময়ের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। আমার মাঝের দৈত্যকে ভুলে থাকবার জন্যই হয়তো আমি জনাকীর্ন বাসের মাঝে মানুষজনের কাজ কর্ম গভীর মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবার চেষ্টা করি। বাসটি ধীর লয়ে এগুচ্ছে। জায়গায় জায়গায় থামছে। আমার পাশে দাঁড়ানো যাত্রীর ধমকে উঠায় আমি থমকে যাই। তার অশ্রাব্য কথাগুলির মাঝখান থেকেই কথার মূলসুরগুলো ধরবার চেষ্টা করি। বাসের ভেতর থেকে তার চিৎকারে বেশ একটা সরগরম অবস্থা তৈরি হয়েছে।লোকজন বাসওয়ালাকে তাড়া করছে বাস না দাঁড় করিয়ে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার। সেই সুরে অনুযোগের চাইতেও আদেশ হয়েই কানে বাজে বেশি। সন্তর্পনে চোরা চাহনিতে আমি বাসের বাইরে অপেক্ষমান মানুষ গুলোর দিকে তাকাই। বাস থামানোর আকুতি তাদের চোখে মুখে। কে জানে বড় কোন কাজ হয়তো আটকে পরে আছে, কিংবা হয়তো দিন শেষে বাড়ি ফিরে নিজের একান্ত সময়গুলোর এভাবে অপসারিত হওয়ার এমন প্রক্রিয়া তাদের মাঝেকার শেষ আনন্দ রসকে শুষে নিয়ে ম্রিয়মান করেছে। হয়তো এই লোকগুলোই বাসের ভেতরে ঢুকলে আমার পাশের যাত্রীটির মত ঝাঁঝালো রসে টইটম্বুর হবে। তার অনুযোগ পাল্টে আদেশ হবে। মজা লাগতে শুরু করে। মানুষগুলোকে পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আর এর মাঝেই হঠাৎ করে আমার বাসার শেলফে জমে থাকা ডায়েরির কথা মনে হয়। হঠাৎ করে পাওয়া সেই ডায়েরি। সেই ডায়েরিতে মিশে আছে কত অজানা মানুষের হাসি কান্না আনন্দ আবেগের গল্প। আর ডায়েরির সাথে সাথে মনের দৈত্য বের হতে চায়। মনের দৈত্যের জন্ম হয়েছিলো ডায়েরির আগমনের পরে ডায়েরির বুকে বন্দি হয়ে যাবার জন্য। মানুষের মন পড়া আর মনের দৈত্যকে ডায়েরির পাতায় বন্দি করবার প্রস্তুতি নিতে থাকি জনাকীর্ণ বাসে বসে বসেই। বাসের ভেতরে এবং বাইরে বসা মানুষগুলো সেই প্রস্তুতি সময়ে হালকা হয়ে মিশে যায় ভাবনা বলয় তৈরির প্রক্রিয়ার মাঝে।
দুই
সন্ধ্যাবেলায় বন্যা যখন আটপৌরে দিনের হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা দেখা শোনায় ব্রতী হয় সবার অলক্ষ্যে আমি একা হয়ে যাই আমার রিডিং রুমে। অতিরিক্ত একটা বালবের আগমনে রুম ধাঁধিয়ে আছে তীব্র আলোতে। তীব্র আলোকের মাঝে আমার নিজের মাঝেকার অজানা ধূসর অনুভূতিকে বের করবার প্রক্রিয়া বিলাসী এবং স্থূল মনে হয় নিজের কাছেই। আমার রুমের ধাঁধানো আলো আর মাথার উপরে ঘুরে চলা ক্লান্ত ফ্যান সাক্ষী হয়ে থাকে আমার দৈত্য বের করবার প্রক্রিয়ায়। দৈত্য বেরিয়ে এলেও অবয়ব লাভ করে না। একই সাথে ডায়েরি টেবিলের উপর নিরাপদ স্থান নিলেও তার ভেতরকার মানুষগুলোকে কিংবা বলা চলে মানুষগুলোর বয়ে চলা অজানা অথচ স্বাভাবিক গল্পকে আড়াল করে চলে প্রতিনিয়ত। ডায়েরিকে খুলে পড়বার আগে নাম না জানা ডায়েরির মালিকের চেহারা ভাসে চোখের সামনে। আমার অস্তিত্বকে ধারণ করা আলোকময় রুম কিংবা ঘূর্ণায়মান পাখা অথবা দেয়ালে পরিশ্রান্ত শিকার অপেক্ষমান টিকটিকি সহ আমার চারপাশ হঠাৎ করে বদলে যাতে থাকে। সেই ছেলেটার সাথে দেখা হয় সেই রেস্টুরেন্টের মাঝে। বেশ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়েই ছেলেটি আসে আমার পাশে যেভাবে সে সেদিন দাড়িয়েছিল।সেদিন সে ডায়েরিটি দিয়েছিল। বলেছিল নিজের আনন্দ অথবা বেদনা কিংবা বিস্ময় কিংবা যে কোন মানবীয় অনুভূতি জাগানিয়া কোন ঘটনা লিখতে। আমার আগেও অনেকে লিখেছে। তবে তারা লিখে ফেরত দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ফেরত দিতে হবে না। অনেক কথাই হয়েছিল। সেই কথাগুলো মনে না থাকলেও হয়তো মাথায় আছে। আচ্ছা, আমি কী একই সময়ের পুণর্মঞ্চায়ন দেখছি!! আমার মনের ভাবনার জবাব ছেলেটি দিয়ে দেয়
– ভাই, খবর নিতে এলাম। ডায়েরিতে কিছু লিখেছেন?
ছোকরার কথায় বেশ বিরক্ত হলাম। তার চালিয়াতিকে প্রশ্রয় দেবার কোন কারণ নেই। বেশ স্পষ্ট ভাবেই কড়া সুরে বলি,
– ভেবেছো কী তুমি বলো তো। জোর করে ডায়েরি ধরালে। আমি তো বলেছি এই সব ছাইপাশ আমি লিখি না। আমার লেখার মত তেমন কিছু নাই। আমি একজন সুখী মানুষ। তুমি যেমন সস্তা আবেগ ভালো বাসা কিংবা নাটকীয় ক্লিশে দুঃখ বেদনার কথা জানতে চাইছ সেসব কিছু আমার নাই।
ছেলেটি রহস্যময় হাসি হাসে। সে কী দেখতে পারছে আমার পাশে অবয়বহীন দৈত্যকে। আমি বিভ্রান্ত হই। চুপ করে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করি। দৈত্য আর তার সাথে আমার কামড়ে রক্তাক্ত বীথির নগ্নবাহু আমার দুই পাশে দাঁড়িয়ে যায়। আমি আমার অবয়বের সবটুকু দিয়ে ছেলেটির কাছ থেকে তাদের আড়াল করতে চাই। মনে হয় সফলও হই। ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমাকে পড়ে ফেলবার মতো প্রখর দৃষ্টি এখন নেই।
– আপনি এখনো ডায়েরি খুলেন নি। খুললে দেখতে পাবেন এখানে যারা লিখে গেছেন তারা আপনার মতই সাধারণ মানুষ যারা মনে করে তাদের জীবনে কোন অসাধারণ কাহিনী নেই। অথচ তারা জানতো না সাধারণ বলে কিছু নেই। প্রতিটি জীবনের সমষ্ট মৌলিক কিছু হাসি কান্না আনন্দ বেদনার কম্বিনেশন। অথচ সেই কম্বিনেশনগুলো এক হয় না। আর তাতেই হয় অসাধারণ। ডায়েরি পড়তে থাকেন। কোন লোকের সুখের ঘটনা বিস্ময়ের ঘটনা কষ্টের ঘটনা একদম মিলে যায় নি। যাবেও না।
এইবার মেজাজ খারাপ হয় আমার। ব্যাটা সেদিনের ছোকরার এমন ভাবের ডায়লগ আর কাহাতক সহ্য হয়। ইচ্ছে করে ব্যাটার ডায়েরিটা ছুড়ে দেই ওর মুখে। ছুড়ে দেবার চেষ্টা হয়তো আসলেই ছিলো। কিন্তু দৈত্যের আবির্ভাবে সেই ছোড়ার গতি কমে যায়। আর তারপরে রেস্টুরেন্টের আবহের জায়গায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার রিডিং রুমের চেয়ারে। কী তাজ্জব ব্যাপার আমার সামনে ডায়েরিটা খোলা। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো সেদিনের পুরান কথা টেনে আনা ছেলেটি কিংবা দৈত্য আর বীথির বাহুর উপস্থিতি বিলীন হয়েছে। ডায়েরির খোলা পাতায় তাচ্ছিল্যভরেই চোখ বুলাই। এক দুই তিন করে আমি আস্তে আস্তে ডায়েরির পাতায় বুদ হই,
“আমার কষ্টের স্মৃতি হলো চড়ুই। চড়ুইটিকে আমি মেরে ফেলছি। এখনও মনে হলে খারাপ লাগে। রিতাপু জন্য নাকি চড়ুইয়ের জন্য নাকি দুইয়ের জন্যই। আমার রিতাপু অনেক দয়ালু ছিলেন। তার কোন কিছুর কষ্ট দেখলে মন ছোট হয়ে যেত। রাস্তায় ভিখিরি দেখলে টিফিন বাঁচানো টাকা থেকে তাদের দিত। আমি দেখে ফেললে আমারে চকলেট দিত কাউকে বলব না এই শর্তে। যাই হোক, কথা অন্যদিকে চলে যাইতেসে। বৃষ্টির দিন ছিলো সেদিন। বৃষ্টি হলে বারান্দার সামনে ছোট উঠোনে একটু পানি জমতো। সেই পানিতে নৌকা ভাসাভাসি করবো আমরা। এমন সময় রিতাপুর চোখে পরে চড়ুইয়ের বাচ্চাটাকে। তিনি সেটাকে কোলে করে আনেন। তারপরে তার পুতুল খেলার ঘরে চুপ করে রেখে দেন বাচ্চাটাকে। আপু স্কুলে গেলে আমার চোখে পরে। পুতুল ঘরে অযথা মরা পাখি পরে আছে দেখে ভালো লাগে না। আমি সেটাকে তুলে নেই। তারপরে উঠোনের এক কোণায় মাটি সরিয়ে তারভিতরে ওটাকে রেখে চাপা দেই। চাপা দেবার সময় মৃদু আওয়াজ ছিলো হয়তো কিছুর। সমস্যা লাগলো বিকালে রিতা আপুর কান্নায়। কেমন করে যেন মরা পাখির দেহটা পানিতে ভেসে তার পায়ের কাছে পরে। আহারে!! আপুর সে কী কান্না। সেই কান্না আর পাখির মৃদু চি চি আমার কানে লাগে সব সময়। তার কয়েকদিন পরেই রিতাপুরা চলে যান আমাদের পাশের বাসা থেকে। আর কোনদিন দেখা হয় নাই। রিতাপুর জন্য আর তার চড়ুইয়ের জন্য রিতাপুর চেয়েও যে আমি বেশি কাঁদি এখনও তা কি তিনি জানেন !!!”
লেখাগুলো থামলেও ভাবনা থামে না। লেখক ছেলে না মেয়ে জানবার ফুরসত নাই। তবে তার ভাবনার স্বচ্ছতায় অবাক হই। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। কত পরিচিত মানুষকেই বিদায় জানানো হলো এদিন সেদিন কতদিন করে। সেই মানুষগুলোকে কখনো জানা হয় নি। অনেকের নামও ভুলে গেছি। চেহারাও। মিশুর কথা মনে পড়ে হঠাৎ করেই। দুই দিনে পরিচয় তিনদিনে বন্ধুত্ব আর বারো দিনে বিরহ। ছেলেটিকে দেখলে আমার চেয়ে ছোট মনে হতো। অথচ ও ছিলও আমার বছর পাঁচেকের বড়। মামার কর্মক্ষেত্রে ঘুরতে গিয়ে বেড়ানোর জন্য যাওয়া। মফস্বলের ছেলেদের একটা চমৎকার নির্মল শৈশবের ছবি দেখেছিলাম মিশুর হাত ধরে। মাত্র বারোদিনের পরিচয়। অথচ মনে হয় তাকে কতকাল ধরে চিনি। কত চমৎকার কিছু দুরন্ত সময়ের সাক্ষী সে। তারপরে, তারপরে আর কথা হয় নি কখনো। দেখা হবেও না কখনো কিংবা কে জানে হয়তো দেখা হলেও কখনো কথা হবে না, হবে না চেনা সাক্ষাত। কৈশোরের চপলতার ক্ষুদ্র অথবা তীব্র সময়ের সাক্ষী মিশুকে অনুভব করি হঠাৎ করে। মিশু ভাবনা বিদায় হয় হঠাৎ মাথা ব্যথার আগমনে। আবার ডায়েরি আবার চ্যালেঞ্জ আর আবার ভয়ে আমি তীব্র আলোর মাঝেও আঁধার হাতড়ে বন্যার আশ্রয়ের জন্য ছুটি।
তিন
সময়ের সাথে সাথে ডায়েরিটা আমার সহচর হয়ে গেছে যেন। আমি আমার দৈত্য আর ডায়েরির পারস্পরিক সহাবস্থান ঘটে আমার কোন এক নির্জন মুহূর্তে। ছুটির দিনের ঘুম পালানো অলস দুপুরে নিজের অজান্তেই আমি চঞ্চল হই। আমার মাথার কাছে থাকা ডায়েরি আমাকে বিদ্ধ করে স্পর্শ ব্যতিরেকেই। তাই নিজের অজান্তেই ডায়েরির মাঝে আমি তলিয়ে যেতে থাকি ক্রমাগত। স্বপ্নহীন ঘুমের মাঝেও অন্য জগতে ঢুকে পড়বার আহবান উপেক্ষা করা হয় না। ডারেয়ির মায়াজালে আটকা পড়ি আবার ক্রমাগত। ডায়েরিকে নয় যেন তার মাঝে জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে মানুষের জীবন গুলো মিশ্রিত হয় আমার বোধে আমার সত্ত্বায়। ঘুমহীন কল্পনায় আচ্ছন্ন হতে হতে আমার মাথায় টোকা শুনি ডায়েরির পাতার
” মানুষকে অবাক হতে দেখার ইচ্ছা আমার বরাবরই ছিলো। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে এটা সেটা করে ফেলার মতন সাহসী আমি ছিলাম। আমার কাছে সবচেয়ে প্রার্থিত ছিলো মানুষের অবাক হয়ে যাওয়া একজোড়া চোখ। অথচ সেই চোখের সাক্ষাত মেলেনি কোথাও। আমি যেন প্রেডিক্টেবলি আনপ্রেডিকটেবল। অথচ আমি তা হতে চাই না। আমি মানুষকে বিস্মিত হতে দেখতে চাই। অথচ সেই প্রার্থিত সময় ধরা না দিয়েও বিস্মিত চোখ আমি দেখেছিলাম। না দেখলেই হয়তো ভালো হতো। আনোয়ারের বিস্মিত চোখ আমাকে বিস্মিত করেছল কেননা সে চোখের বিস্মিত হবার কথা ছিলো না। সে চোখে থাকতে পারতো রাগ ক্রোধ ঘৃণা কিংবা আমাকে পুড়িয়ে ফেলবার মত প্রতিশোধপ্রবণ কোন দৃষ্টি। অথচ আনোয়ারের সেই চোখ বিস্মিত হয়েছিলো আমার বিশ্বাসঘাতকতায়। অথচ বিস্মিত করতে চাইনি তাকে। নিজের প্রয়োজনের কাছে বন্ধুত্বকে বলি দিয়েছিলাম। সে রাগ হতে পারতো , ঘৃণা করতে পারতো কিন্তু আমার কাজ তাকে বিস্মিত করেছিলো।আশা হত করেছিলো। সেই আশাভঙ্গেরর বেদনাতুর বিস্ময়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। অথচ আমি বিস্মিত হতে চাই নি।”
লেখা এখানে শেষ হয়ে যায়। নিজের মাঝেকার গ্লানি লেখক ছড়িয়ে দেন আমার মাঝে। সেই লেখক আর তার বন্ধু আনোয়ারের মাঝেকার গল্পটা তাই পরিষ্কার হয় না। তবে সেখানে বিশ্বাস ভঙ্গের গান শুনি। মানুষের মাঝে মানুষের সম্পর্ক ভেঙে পড়বার নিষ্ঠুর কাব্য রচনাকে অনুভব করি। আর সেই সময়ে আমার অফিসের জুয়েলের অনুভূতিহীন দৃষ্টিকে মনে পড়ে। তার প্রেমিক সত্ত্বাকে আমি হিংসা করেছিলাম অথবা তার গোছানো জীবনকে আমি ঈর্ষা করেছিলাম। আমার ক্ষমতায় আমি তছনছ করতে চেয়েছিলাম সেই সুন্দর জীবনকে। জুয়েলের সাথে বীথির সম্পর্ককে আমি হিংসা করেছিলাম অথচ বীথির সাথে আমার কোন রকম মানবিক কিংবা অমানবিক সম্পর্ক ছিলো না। আমি পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলাম জুয়েলকে। বসের রুম থেকে বেরুনো জুয়েলের অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে আমার জন্য কিছু ছিলো না। নিজের জন্য জমিয়ে রাখা অসহায়ত্বের অনুবাদ ঘটেছিল কেবল সেদিন। সেদিন বীথির সাথে তার কথা হয় নি। অথবা তার পরেও না। ধ্বংসের আনন্দে আমি সেদিন ক্রুর উল্লাস করেছিলাম। সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদে তার অগভীরতার উম্মোচনে আমি পুলকিত হয়েছিলাম। তারপরে বীথির হাতকে রক্তাক্ত করতে চেয়েছিলাম হয়তো নিজের সমস্ত আঁধারে নিজেকে গ্রাস করে। সেই আঁধারের খোঁজে আত্মবিশ্লিষ্ট হবার আগেই দৈত্য হানা দেয়। আঁধার আর দৈত্য পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রমাগত। আঁধারগুলি ডায়েরিতে গ্রাসিত হতে চায় দৈত্যকে সঙ্গী করে। অলস দুপুরের শেষের অনেক আগে দৈত্যকে ছাপিয়ে বন্যা আসে।
বন্যাকে ভালোবাসতে চাই নিজের মত করে। বন্যার মাঝে খুব করে ভাসিয়ে দিতে চাই আমার আঁধারকে। বন্যা আমার পাশে নীরবে বসে। তআর মুখে কোন কথা থাকে না। চোখের মাঝে থাকে স্নিগ্ধতা। বন্যার হাত আমার হাতকে স্পর্শ করে। আমাদের পারস্পরিক সময়ানুভবের মাঝে দৈত্য এসে বসে। আমি বন্যাকে অনুভব করতে চাই হাতের ছোঁয়ায়।পাশাপাশি নীরব সময় যাপনে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে চাই। আমার মাথায় ব্যথা শুরু হয় আবার। মাথা ব্যথা দৈত্য ,বন্যা আর সেই সাথে নিস্তরঙ্গ মায়াময় দুপুর। আমার মাথার ভেতর বাজতে থাকে গল্প কিংবা ডায়েরির বুকে বেঁধে রাখা কোন মানুষের সময়ের প্লেব্যাক
” আনন্দের স্মৃতি কীভাবে প্রকাশ করতে হয়? আনন্দ প্রকাশ করা হয় না হয়তো কখনো। শুধু অনুভব করে নিতে হয়। আমার আনন্দ এসেছিলো ভালোবাসার মানুষটিকে পরমভাবে কাছে পাওয়ার মাধ্যমে। তার স্পর্শে আমি পূর্ন হয়েছিলাম। তার আগে আমার জন্য কোন পুরুষ ছিলো না। তারপরেও কেউ না। শুধু তার জন্যই আমি অপেক্ষায় ছিলাম চিরদিনের। সেই সময়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সে আমার কাছে এসেছিলো আমার হয়ে। আমি তার পরী হয়ে উড়তে চেয়েছিলাম নিজের মাঝেকার সকল ভালোবাসার ডানাকে ভাসিয়ে দিয়ে। পূর্ণ হয়েছিলাম পূর্ণ করছিলাম একে অপরকে। অনুভূতির কোন প্রকাশ নাই। শুধু ভাবনার ব্যাপ্তি আছে। এর নামই মনে হয় ভালোবাসা। এর নামই হয়তো নিজের মানুষটিকে নিজের মত করে পাওয়া।”
ডায়েরির অনুভূতি গুলো মাথায় বাজার সাথে সাথে আমার পরীকেও আমি ধরতে চাই। আমাদের ভালোবাসার ডানা একদিকে বাধাগ্রস্ত হয়। আমার নিজের প্রাণপণ প্রচেষ্টায় তার উড্ডীয়ন চেষ্ট চলে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিষ্ফল প্রচেষ্টায় দৈত্য বেদম হাসছে। তার হাসি আমাকে দুর্বল করে দেয়। অথচ বন্যার ভালোবাসা ছিলো আমার জন্য বাঁধহীন। নাহ ভুল বললাম, আমার ভালোবাসাই হয়তো বাঁধ হয়ে গিয়েছিলো বন্যার জন্য। মাথা ব্যথা প্রবল হয় আর ভালোবাসার মুহূর্ত গুলো ক্লেদাক্ত হয় আপন ধূসরে, আপন কদর্যে। তারপরেও ভালোবাসার পাখা উড়াবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলে বোধ হীন হয়ে যাবার শেষ পর্যন্ত।
চার
আবারো মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। সেই দুঃস্বপ্নের হানা দেবার সাথে সাথে দৈত্যকে আমি দেখতে পাই। সাথে বীথির রক্তাক্ত বাহু। নিজের রক্তাক্ত দাঁতকে আমি আজ বন্যার আঁচলে ঢাকতে চাই না। বন্যার মাঝেও আশ্রয় খুঁজি না। আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকা পরীকে না জাগিয়ে আমি ডায়েরির কাছে চলে আসি। আজকে ডায়েরির বিশাল বুকে দৈত্য আটকা পড়বে। হঠাৎ করেই সেই নাম না জানা ছেলে আগমন ঘটে। আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি হাসছে সে। আমার পাশেকার দৈত্যকে আর লুকাই না আমি। তাকে ছিড়ে খুঁড়ে ডায়েরির পাতায় আবদ্ধ করতে থাকি। সেই সাথে বীথির বাহুর রক্ত আমার দাঁত থেকে সরে যেতে থাকে কিংবা বলা যায় শুকিয়ে যেতে থাকে। আমার মাঝেকার সত্ত্বাকে আমি ধরতে পারি নতুন করেই। নাম না জানা ছেলেটার গল্প রহস্য হয়ে থাকে। ডায়েরিতে লুকানো কোন গল্পটি তার সেটা ভাববার চেষ্টা করি। অথচ ডায়েরির কোন লেখকের নাম নেই।
– আপনি কী ভাবছেন আমি তা জানি। কী দরকার আছে জানার। হয়তো এমন সবগুলো জীবনের কিছুটা কিছুটা নিয়েই আমার জীবন। সবকিছুর শেষে জীবন তো জীবনই।
তার কথাগুলো আগের মত অসহ্য মনে হয় না। কিংবা সেই ছেলেটিও এই মুহূর্তে আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠে না। আমি ক্রমাগত খুন করে ফেলতে থাকি দৈত্যকে। আর ডায়েরির পাতা জমে লেখা হতে থাকে মৌসুমীর কথা। মৌসুমীর নগ্ন বাহুর কথা। আমার মাথা ব্যথার ভার লাঘব হতে থাকে দৈত্যের ক্রমাগত ব্যবচ্ছেদে। এক সময়ে হয়তো নিজের অজান্তেই আমি চলে আসি একদম ঘোরে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হতে থাকে
” কাউকে কাউকে কখনো কেউ কেউ স্পর্শ করতে পারে না। সে ছিলো আমার কাছে তেমনই হয়তো। তাকে আমি চেয়েছিলাম। সে আমার কাছে ধরা দিয়েছিলো। হয়তো ধরা দিতে চেয়েছিলো। তার প্রতি আমি অন্ধ ছিলাম। তাই তার দূরে সরে যাওয়াগুলোকে অনুভব করেও দূরে সরিয়ে দিতাম। আমার পছন্দ ছিলো নীল শাড়িতে তাকে দেখবো। অথচ সে বলতো তার কাছে স্লিভলেস জামা পড়তে বেশি ভালো লাগে। আমাদের দেখা কম হতে থাকে ক্রমাগত। কিন্তু আমার ভাবনায় ছিলো হয়তো মনের ভালোবাসার কাছে বাস্তবে দেখা হওয়া জরুরি কিছু নয়। অথচ আমি ভুল ছিলাম। প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশ হয়তো থাকতে হয় কখনো। মৌসুমীর জন্য আমার কেনা গিফটগুলো আমার ঘরেই জমা হতো। ওর কোন জন্মদিনে একবারে দিয়ে চমকে দেবো বলে। অথচ সেটা দেবার চিন্তার আগেই তাকে রিকশায় দেখি আরেক ছেলের সাথে। সেই সময় তার পরনে স্লিভলেস জামা ছিলো। আর তার নগ্ন বাহুর উপর ছেলেটির হাতের অনৈচ্ছিক অথচ অবিরত সঞ্চালনে আমি নিজেকে হারাই। তারও পরে মৌসুমীর সাথে যখন কথা হয় তখন নিজের ভালোবাসটুকু দেখাবার জায়গা থাকে না। স্লিভলেসে বের হয়ে থাকা বাহুযুগলকে কামড়ানোর ইচ্ছা জাগে ক্রমাগত। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় ধূলোবালির মানুষদের হয়তো আকাশের দেবীদের ছোঁয়ার চেষ্টা করতে নেই। ”
এই পর্যন্ত লেখার পরে ক্লান্ত বোধ করি। আমার পাশে দৈত্য নেই নগ্ন বাহু নেই। বরং পানি নিয়ে দাড়িয়ে আছে আমার বন্যা। ডায়েরিতে বন্দি দৈত্যের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমি উঠে দাঁড়াই। মাথার ভিতরকার ব্যথা উবে গেছে যেন। আমার নিজের মাঝেকার আঁধার ও ভার লাঘব করে দাড়াবার আগেই কৌতুহল বশত ডায়েরির শেষ পাতায় একবার চোখ বুলাই। শেষপাতার শেষ লাইনে চোখ আটকে যায় প্রবলভাবে
“নিঃসীম রাত্রির অন্ধকার কখনো জীবনকে গ্রাস করে। সেই গ্রাস হতে বের হতে না পারার কষ্টকে ভুলে গিয়ে তবু মানুষের জীবনের মাঝে মিশে যেতে চাই। শেষ হয়ে যাবার পরেও আমার জীবনের ছোট ছোট কষ্ট হাসি কান্না বিস্ময় আনন্দ গুলো মিশে কোন এক জীবনের মাঝে। আমরা মরবার জন্য জন্মাই আর জীবন ব্যাপী মৃত্যুর জন্যই ছুটতে থাকি। শেষ হয়ে যাবার আগে নিজের এই জীবনের গল্পগুলো থেকে যাক কোন এক জীবনের জন্য।”
বিস্ময় আর বেদনার চোখ নিয়ে আমি হঠাৎ করেই বন্যার দিকে তাকাই। সেই দৃষ্টির অর্থ বন্যা বুঝতে পারে না।
[ শিরোনাম কৃতজ্ঞতা : আইয়ুব বাচ্চুর ‘হয়তো কোথাও পাবে আমাকে ‘ গানের মাঝের একটি লাইন শিরোনাম হিসাবে নেয়া হয়েছে। যদিও ঐ গানের সাথে এই গল্পের ডাল পালা লতা পাতা শিরা উপশিরায় কোন সম্পর্ক নাই।]

১,২৭২ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “ছোটগল্প : ডায়েরির ছেঁড়া কোন নিশ্চুপ পাতায়”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    'গ্রাসিত' বলে কি কোন শব্দ আছে?যা গ্রাস হয়েছে তা কি গ্রস্ত?
    লেখায় যে গল্পটা আছে সেটা বেশ আকর্ষক, আকর্ষক বলবার স্টাইলও।
    কিন্তু আবারো 'আমি'/'আমার' সর্বনামের ব্যবহার পাঠে বাধার সৃষ্টি করছে।
    যৌন অবদমনের বিষয়টি স্পষ্টবাদিতার রূপে এসেছে, কিন্তু (একারণে) মূলচরিত্রটির অন্তর্গত সংকটের ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়।
    উদ্ধৃত কমার ভেতরে ডায়রির কথাগুলো বেশ ভালো লেগেছে, নির্মেদ মনে হয়েছে। কিন্তু ডায়রির বাইরে যে ডায়রি, চরিত্রটি যেখানে পাঠকের সংগে (বা নিজের সংগেই) কথা বলছে সেখানে অনেক কাটছাঁট করার দরকার আছে বলে মনে করছি।

    বাহু কামড়ানোর প্রসংগটিকে বীভৎস মনে হচ্ছে শুধু (অবদনমনের যথার্থ প্রকাশ বলেও), কিন্তু তাতে যেন প্রাণ নেই, একটা আপেল খেতে গিয়ে যদি রক্ত গড়িয়ে পড়ে তাহলে যেমনটা দেখাবে আর কি। পাশাপাশি কোন ভায়োলেন্স না থেকেও আনোয়ারের বিস্মিত হবার ঘটনা অনেক বেশি ক্রুর মনে হয়।

    .... এই হলো আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া, চটজলদি এবং আগোছালো।
    তুমি একটা স্টাইলকে ধরতে চাইছো বলে মনে হলো, তোমার নিজস্ব স্টাইল। সংগ্রাম জারি থাক।

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      "গ্রাসিত" শব্দার্থ গ্রাস হয়েছে যা। আমি শিউর না হয়েই লিখেছিলাম। আপনার প্রশ্নের পরে আবার চেক করলাম অনলাইন ডিকশেনারীতে।

      আমি/ আমার ব্যাপারটা সমস্যা হতে পারে এই বিবেচনায় ঠিক করেছিলাম মূল চরিত্রকে তৃতীয় পুরুষে রেখে গল্পটি লিখবো। পরে আবার নিজেকে চেখে দেখার চিন্তাতেই প্রথম পুরুষে লেখার আইডিয়া আসে। প্রথম পুরুষে লেখার সুবিধা হলো ঘল্পের কথক নিজের গল্পে মিশে আছে তাকে আলাদা করে ঢোকাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তৃতীয় পুরুষে সেটা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়।

      এবার গল্প প্রসঙ্গে বলি। গল্পটি মূলত অবদমিত কামনা অবমূল্যায়িত ভালোবাসা ও মানবীয় প্রতিশোধপরায়ণতার সমষ্টি। শেষোক্ত ব্যাপারটি গল্পে খুব সুষ্পষ্টভাবে ফুটে উঠে নি মনে হয়। উদ্ধৃত কমার ভিতরের থেকে বাইরের অংশ গুলোকে সচেতনতাবশতই আলাদা ফ্লেভারে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বাহু কামড়ানো আর অন্তর্গত সংকট এক সুরে বাঁধা আসলে। শেষের প্যারাটা রি রাইটের দরকার আছে বলে মনে হয়। অন্তর্গত সংকট বলতে মৌসুমী বিষয়ক কম্প্লেকসিটিটাকেই বুঝাতে চেয়েছি। একদিকে তার জন্য অবমূল্যায়িত হবার পরেও সেই ভালোবাসা দামি, আবার অবমূল্যায়িত হবার মানবিক ঈর্ষা এবং ঈর্সা থেকে বিকৃতি এবং খোলা বাহুর উপর আনরিজনড জেনারালাইজড জিঘাংসা। বাহু কামড়ানো একদিকে তাই অবদমিত কামনা অন্য দিকে খোলা বাহুর উপর তার প্রিডিটাইমাইনড হেট্রেড। আবার বন্যা তার জন্য আরেক সংকট। কারণ সে প্রতি পদে বুঝে সে বন্যার ভালো বাসাকে অবমূল্যায়িত করছে।
      আনোয়ার ও তার বন্ধুর কথাগুলো আসলে ডায়েরিতে আসা কথাটুকুই। একানে ডায়েরির থিমটা কিন্তু আসলে এমন নিজের জন্য লেখা। আর ডায়েরিটা অনেকটা এখানে এমন যে নিজে মানউষের ভেতরকার তিক্ততা শুষে নেয় দুঃখকে লঘু করে। তাই আনোয়ারের বন্ধু ততোটাই লিখেছে যতটা তার ভার লাঘব করে। একই কথা গল্পের কথকের মৌসুমী বয়ানেও। পুরা গল্পের মাঝে রিতাপু আর মিশু মোটামুটি বাইরের কেউ। তবে তারা গল্পের অন্যতম চরিত্র ডায়েরিকে গল্পের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। আর বাসের ভেতরের মানুষ বাইরের মানুষের এনালোজিটা ছিলো আসলে গল্পের কথকের দুই রূপ। একদিকে তা মৌসুমীর হাতে অবমূল্যায়িত অন্যদিকে তা বন্যার প্রতি অবমূল্যায়নকারী। এই এনালোজিটাও আসলে ফুটে উঠে নি।

      লেখা নিয়ে কাটাছেঁড়া এখনও চলছে। ভুল থাকবেই। তবে ভুলগুলো শুধরে নিতে চাই। নিজের মৌলিকতায় নিজের আনন্দের জন্য লিখতে চাই।

      আপনার মন্তব্য সব সময়ই বড় প্রেরণা। এই দীর্ঘ গল্প মনযোগ দিয়ে পাঠ এবং তার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা।

      ভালো থাকুন অনেক।

      জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        আমিন,
        গ্রাসিত শব্দটি আমিও খুঁজে পেলাম। কখনো ব্যবহার করিনি বলে অন্যরকম লাগছিলো প্রথমে।
        আবু বকর সিদ্দিকের লেখা পড়েছো?চরবিনাশকাল নামের গল্পটা?
        ছোটগল্প নিয়ে তোমার একটা অবসেশন মত আছে মনে হলো, যেটা খুব আশার কথা।
        চরিত্রগুলোর ডিটেইলে যাবারো একটা প্রবণতা দেখি তোমার মধ্যে। টিপিক্যাল ব্ল্যাক অ্যন্ড হোয়াইট চরিত্র না এঁকে একের ভেতরেই শুভাশুভের সহাবস্থান দেখানোর প্রয়াস দেখে মনে হয় বড়মাপের গল্প লিখিয়ে হবার উচ্চকাঙ্খা রয়েছে তোমার।একদিন অমন একটা জায়গায় যাবে নিশ্চয়ই লেখালেখিটা নিয়মিত করলে।

        'আমি/আমার' গুলো বেশ কয়েক জায়গায় কেটে দিতে পারো। বেশ রিপিটিটিভ শোনাচ্ছে, পড়তে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। দেখবে কিছু কিছু বাক্যে 'আমি' না থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সেটি প্রথম পুরুষেরই বয়ান।যেমন:

        ধ্বংসের আনন্দে আমি সেদিন ক্রুর উল্লাস করেছিলাম। সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদে তার অগভীরতার উম্মোচনে আমি পুলকিত হয়েছিলাম।

        এখানে করেছিলাম আর হয়েছিলাম শব্দগুলোই কিন্তু যথেষ্ট।

        গল্প নিয়ে আরো বহুকিছু মনে আসছে, লিখতে গিয়ে আবার ফ্লো-টা থাকেনা। সামনাসামনি কথা বলা গেলে ভালো হতো মনে হয়, আড্ডা দিতে দিতে।

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।