ছোটগল্প : ব্যস্ত শহরের অনিঃশেষ গল্প

রাত যৌবনবতী হবার অনেক আগেই শহরের আলোকবিন্দুগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে। উপর থেকে তাকালে আকাশের তারার মতোই অসীম মনে হবে ছোট ছোট বিন্দুগুলোকে। এই তারকাসম আলোকে ঘিরে সতত সঞ্চারণমান মানুষগুলো আবর্তিত হয় আপন নিয়মে। ব্যস্ত শহরের মানুষগুলো বয়ে চলে নিজেদের পেছনে একেকটি গল্প। মানুষগুলোর সাথে গল্পগুলো ছুটে চলে,হেঁটে বেড়ায় ক্রমাগত। তাই শত গল্পের মাঝেকার ছোট সাবসেট এই গল্পের আরিফের নেশায় টলায়মান হয়ে বাসে উঠা, শারমিনের সার্জারি শেষে মোবাইল সঞ্চালন , লতিফের অনির্দিষ্ট ছোটাছুটি কিংবা জামালের নিজের দোকানে বসে গাঁজা তৈরির আয়োজন কোন বিশেষ ঘটনার জন্ম দিতে পারে না কিংবা বলা যায় কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে তা ঘটেছে এমন কোন চিহ্ন আমরা পাই না।শহরের বয়ে চলা মানুষদের অন্যান্য দশটা রাতের চেয়ে এই রাতটিকে কোনভাবে বিশেষায়িত করা যায় না তাই।ব্যস্ত শহরের স্বাভাবিক দিনগুলোর মাঝেই আমরা চলে যাই চরিত্রগুলোর খুব কাছে।আমরা চরিত্রগুলোকে জানতে পারি গল্পের ছুটে চলার মাঝে।
এই মুহূর্তে আরিফ গাদাগাদি করে জনাকীর্ণ বাসে উঠছে।শেষ ট্রিপের বাস বলেই হয়তো বাসের ভিতরকার ভিড় সাধারণ সময়ের চাইতে বেশি।সদ্যই পানশালা ফেরত আরিফ তার ঢুলু ঢুলু চোখেও সজাগ দৃষ্টি রেখেই পদক্ষেপ ফেলছে । পানজনিত বমনেচ্ছা এবং বাসের গাদাগাদিতে ঘামে ভেজা মানুষের শরীরের বোটকা গন্ধ তার অবস্থানকে কষ্টকর করে তুলছে ক্রমাগত।প্রকৃত লেখক হবার রোমান্টিক যন্ত্রণা গ্রহণের দায়ে আরিফ তবুও নির্বিকার।তার আধোচেতন ইন্দ্রিয় খুব স্থির হয়ে ভাববার অবকাশ দিচ্ছে না।তার চোখের সামনে সময়ে সময়ে উঠে আসছে খণ্ড খণ্ড দৃশ্যচিত্র।সেই চিত্রগুলোকে এক করতে সে পারছে না অথবা এক করাটা এই মুহূর্তে তার কাছে খুব জরুরিও নয় হয়তো বা। আরিফকে পুরো আমরা চিনতে পারবো না গল্পের মাঝে। তবে তার মাথায় বয়ে চলা চিত্র গুলো খণ্ডায়িত ভাবে আসবে আমাদের সামনে।সুরাখানার ভেতরকার হতাশ মানুষগুলোর জীবন খুঁজতে তার যাবার উদ্দেশ্যও হয়তো আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না পুরোপুরি।সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যে সব যুবকদের সে দেখতে পায় প্রতিনিয়ত বারের মাঝে,তাদের মাঝে জীবনের একটা সুর তার কাছে পরিষ্কার হয় শুধু — ভোগবাদ। ভোগবাদী ভাবনায় নিমজ্জিত ছেলেগুলোর জন্য করুণার দীর্ঘশ্বাসও পড়তে দেখবো আমরা হয়তো ।মাথার ভেতরে একধরণের আলোড়ন বোধ করছে আরিফ।আজ মাঝবয়সী ভদ্রলোকের কাছ থেকে জোটা কথাগুলোও হয়তো তাকে একটু একটু করে আঘাত করে চলেছে।হঠাৎ করেই আরিফের মাঝেকার লেখক সত্ত্বা উবে যায়।নিশার মায়াময় চেহারা তাকে হঠাৎ করেই প্রেমিকপ্রবর করে তোলে।নিশাকে নিজের কাছে রহস্যময় নারী তৈরির ভাবালুতা এবং নিশার মনকে দাবার ছকের মতো পড়ে ফেলার পরস্পরবিরোধী দুই ক্রিয়ার সমন্বয়ও তার মাঝেকার অস্বস্তিকে কমায় কিনা তা আমরা গল্পে জানতে পারি না । অথচ নেশাগ্রস্ত ইতস্তত বিচরণে ফুল বেচতে আসা তরুণী অথবা কোন নিশিকন্যার সাথে আরিফের সংঘর্ষ এবং তৎপরবর্তী আরিফের তীব্র প্রতিক্রিয়া আরিফের নেশাতুর মন থেকে মুছে গেলেও গল্প তা ধরে রাখে হয়তো কোন অপ্রয়োজনীয় কারণেই।টলতে টলতেই আরিফ একসময় বাসের সীট দখল করে। তার মাঝে জমা হতে হতে থাকা অস্বস্তিগুলোকে ঝেড়ে মোবাইলে নিশার পাঠানো বহুপঠিত মেসেজগুলোর চর্বিত চর্বণ শুরু করে।
সেই সময়ই হয়তো শহরের অন্যপ্রান্তে অবৈধ সিজার অপারেশন শেষ করে উপরি আয় নিশ্চিত করা শারমিনের কপালে বিরক্তির রেখা দেখা যায়।কষ্ট শেষ হবার কষ্টে সে মুষড়ে পড়ে সেটাও আমরা জানতে পারি এই গল্পের হাত ধরেই।প্রায় প্রাক্তন হয়ে যাওয়া বর্তমান বর রোমেলের এই যন্ত্রণা ক্ষণিকের জন্য তার কাছে খুব ভারী মনে হয়। নিজের অজান্তেই সে হয়তো চলে যায় গত কয়েকমাসের ঘটনায়। ফায়জুল আলমের সাথে কয়েকমাসের পরিচয় কী অদ্ভুতভাবেই না তার জীবনকে বদলে দিলো। একদিকে দূরে থাকা দায়িত্বহীন রোমেলের উদাসীনতা অন্যদিকে তার প্রতি ফায়জুলের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা তার মনে প্রথম বপন করেছিলো নিষিদ্ধ ইচ্ছাকে।পনের বছর নামে মাত্র গড়ে তোলা সংসারকে হয়তো এই জন্যই তার কাছে ঠুনকো মনে হয়েছিলো।তার সন্তানদের মুখে তাকিয়ে নিজেকে অসুখী পরাধীন রাখবার ইচ্ছা তার মাঝে জেগেছিলো হয়তো, কিন্তু পেশাগত স্বনির্ভরতা কিংবা অর্থের দাপট তাকে সাহস জুগিয়ে গিয়েছিলো প্রতিনিয়ত।ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। আর সেই সাথেই হয়তো তার মনোজগতে পরিবর্তনগুলো হয় দ্রুত এবং তীব্র। তাই হয়তো বিছানায় রোমেলের সাথে মিলনের সময় যখন সে ফায়জুলের চেহারা দেখতে পায় তার মাঝে ভীতির জন্ম দেয় না। বরং স্বাভাবিকভাবেই সে মেনে নিতে শুরু করে।রোমেলের সাথে তার ঠাণ্ডা যুদ্ধ তার প্রকৃত রূপ নিতে থাকে প্রবলভাবে রোমেল এবং তার পারস্পরিক অসহনশীলতার মাঝেই।রোমেলের সাথে কাটানো রোমান্টিক সুন্দর সময় হয়তো হঠাৎ হঠাৎ করে হানা দেয় তার মানসিক বদলের স্রোতে বাধা হয়ে। কিন্তু ততোদিনে সেই সম্পর্ক রক্ষার শেষ বাঁধ ভেঙে গেছে। রোমেলের প্রতি তার বিশ্বস্ততার শেষ ঘোষণা করে ফায়জুলের সাথে রাতযাপন অতঃপর তা রোমেলের কাছে প্রকাশিত হবার সুযোগ করে সেই বাঁধের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানার পরেও সে ছিল সৌম্য স্থির শান্ত স্বাধীন।সার্জারি শেষে মোবাইল তুলে ইনিয়ে বিনিয়ে রোমেলের পুরনো সম্পর্ক জোড়া লাগাবার করুণ প্রচেষ্টা তাই হয়তো তার কাছে রোমেলের পৌরুষ্যত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই তার মাঝে কেমন যেন ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি হয়। তারও কিছু পরে হাসপাতালের নিচে রাখা গাড়িকে ছুটে চলতে দেখা যায় উদভ্রান্ত চালিকার স্টিয়ারিং ভর করে।
সন্ধ্যার পর থেকেই লতিফকে অনির্দিষ্টভাবে পায়চারি করতে দেখা যায় শহরের ফুটপাতে। তার পরিচয় হয়তো গল্পের এগিয়ে যাওয়ার সাথেই আরো পরিষ্কার হবে। সাধারণ নিয়মে সব চললে হয়তো তাকে কিছুক্ষণ পরে জামালের টং দোকানের নিয়মিত গাঁজার আড্ডায় দেখা যাবে।জামালের টং দোকানের পিছেই রাতের আঁধারে তার অথবা তার মতো অনেককে নিয়ে নিত্যদিনের মতোই বসবে আসর। সেই আসর যা কিনা এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন বিনোদনের একমাত্র খোরাক।অনেক অসুস্থ বিনোদন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বৈধ হলেও তাদের নির্দোষ বিনোদন বাঁধা পায় পুলিশ অথবা কানা বাবুর স্বার্থজড়িত আনাগোনায়।তাই হয়তো সেই আয়োজনে গোপনীয়তা থাকে। অথচ গোপনীয় এই আয়োজনে এতগুলো মানুষের মাঝেকার বেশিরভাগ কথাই আর গোপন থাকে না।টং দোকানদার জামালের নিষ্ঠাবান উপস্থিতি তাদের প্রেরণা জুগিয়ে চলে।ঘরের ভিতর হতে জামালের রুগ্ন শীর্ণকায় স্ত্রীর রিনরিনে বাঁধার আওয়াজকে হাস্যকরভাবেই তারা উড়িয়ে দেয়।বিরক্ত জামালকে হয়তোবা কখনো উঠে যেতে দেখা দায়িত্ব পালনের জন্য। তার মুখে হয়তো দেখা যায় বিরক্তির রেখা।সেই আড্ডার মানুষগুলোর মাঝেকার আন্তরিকতা গল্পে জায়গা দখল করে চুপিসারেই। তারা আমি হতে আমরা হয়, নিজেদের মাঝেকার পাপের দাহ ঘটে গাঁজার ধোঁয়ায়।যেই রাতকে ঘিরে গল্পটি গড়ে উঠে সেই রাতেও নেশার আয়োজন করে চলতে থাকে জামাল আর রাস্তায় ভ্রমনরত লতিফও মনের কোণে দিনের বিশুদ্ধতম সময়ের প্রতীক্ষা করে।
শেষ বেলার সুযোগের জন্য রাস্তায় চলতে থাকা লতিফ যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকে তার দৃষ্টি আটকে যায় কোন নির্দিষ্ট শিকারের আশায়।ছিনতাইকারী হবার সুপ্ত স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো লতিফ স্বপ্নপূরণ নিয়ে নিজেই আশাবাদী হতে পারে না খুব। তার মাঝে লুকিয়ে থাকা ভীরু সত্ত্বার আবির্ভাবে এই মুহূর্তে তার বুক ঢিপ ঢিপ করে কাঁপছে। গাঁজার ভাবাতুর সময়ের ভাবনার স্বপ্নকে পুঁজি করে অপারেশনের জন্য এগিয়ে যায়।যাত্রী নামানোর জন্য ক্রমশ ধীর হয়ে আসা বাস বরাবর এগিয়ে যেতে দেখা যায় তাকে।নিজের কাছে নিজের সাহসের পরীক্ষা দিতেই ক্ষনিকের তরে শূন্যে লাফিয়ে উঠে, উপরে আরো উপরে !!!
আরিফের ভাবালু সময় মুখ থুবড়ে পরে হঠাৎ করেই।তার নেশাতুর শরীরের সবটুকু দিয়ে নিশার ভালোবাসার মেসেজগুলো ধরতে চায়।তার আগেই প্রস্তুত হাতের নিপুন কারিশমায় তা সরে যায়, এবং অন্ধকারের সাথে মানানসই কোন ছায়ামূর্তির উপর ভর করে তার ভালোবাসা দৌড়াতে থাকে মোবাইলকে মুঠোবন্দী করে।বাস জুড়ে কোলাহল উঠে। উৎসাহী কেউ হয়তো বা আরিফকে সান্তনা দেবার জন্য অথবা নিজেদের মহানুভবতা দেখাতেই কপট দৌড়ের ভান করে। যাত্রীরা একে অপরকে সতর্ক করতে থাকে ঘাপটি মেরে থাকা পকেটমারদের ব্যাপারে।
শারমিনের গাড়ি সঞ্চালন দ্রুত হয়। নিজের মাঝে গা গুলানো ঘিনঘিনে অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরেছে।তার দ্রুত বাসায় ফেরা দরকার। উহ কী নীচতা!! কী ভরঙ্কর নোংরা বিড়বিড় করেই বলে যেনো। অন্ধকারের মাঝে তার গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে চলে যায় দ্রুত। তার হেডলাইটের আলোতে অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ করেই ছায়ামূর্তি হাজির হয় তার গাড়ির একেবারেই সামনে।মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শারমিন হঠাৎ মূর্তির আবির্ভাবে চমকিত হয়। তার পা ব্রেক চাপতে গিয়ে চেপে দেয় এক্সিলেটর। মূর্তিকে অতিক্রম করে গলার ভেতরকার মৃদু চিৎকারকে চেপে শারমিন চালিয়ে যায় গাড়ি নিজের বাসার দিকে। নিজেকে এই মুহূর্তে খুব খুব অপবিত্র বোধ করতে থাকে গাড়ির চালক আসনে বসে থাকা একজন বিভ্রান্ত নারী।
বিশুদ্ধতম আনন্দের মুহূর্তে জামালের টং দোকানের পিছনকার একফালি জায়গা সেদিনও মুখরিত হয়। গোপন আড্ডায় নিজেদের গোপনীয়তা উজাড় হয় সেদিনও।নোংরা নর্দমার গন্ধ মুখরিত করে সেই আড্ডার আসরকে। হয়তো জামালের বউয়ের রিনরিনে কন্ঠের উপস্থিতিও সেখানে শোনা যায়।তখন হয়তো শারমিনের বেডরুমে ফায়জুলকে দেখা যায় অথবা একাকী শারমিনকে মোহগ্রস্থ মনে হয়। মোবাইল হারানো আরিফ নিশার কথা ভেবে কিংবা গল্প তৈরির মোহে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়।ব্যস্ত শহরের গল্প আবর্তনের মাঝে লতিফের অনুপস্থিতি নতুন গল্পের জন্ম দেয় না। শুধু জামালের টং দোকানের পিছনের সময়ে আবর্তিত হওয়া মানুষগুলোর সংখ্যার হ্রাস ঘটে পূরণের প্রত্যাশায়।

১,১০৮ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “ছোটগল্প : ব্যস্ত শহরের অনিঃশেষ গল্প”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    মাঝখানে একটা ঝুলে গেল মনে হয়েছে। শুরুটা অসাধারন। শারমিনের ব্যাপারটা আরও রিয়েস্টিক করা যেত, তাড়াহুড়া হয়েছে এখানে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      ফয়েজ ভাই আছেন ক্যামন? দেরিতে রিপ্লাই দিলাম, সরি।

      মজাটা কী জানেন, এইখানের রিয়েল ঘটনা শুধু শারমিনেরটাই বাকি সব কাল্পনিক 😀 😀 । এইজন্যই জ্ঞানী জনরা বলেন বাস্তব কল্পনার চেয়ে নাটকীয় !!!

      যা হোক পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। (সম্পাদিত)

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।