খাদু দাদু, চিল, অমল কান্তি, বেঞ্জামিন মূলায়েস ও অন্যান্য

কবিতা ও গানের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তারা শুধু তার মাঝেকার অন্তর্নিহিত ভাবের মাঝে সীমবদ্ধ থাকে না। মাঝে মাঝে তারা ধারণ করে পাঠক অথবা শ্রোতার হারিয়ে যাওয়া সময়কে। যে সময় খুঁজে পাওয়া যায় না শুধু নিজের স্মৃতিকোঠা ছাড়া সেই সময়ই হাপুস করে বেরিয়ে আসে কবিতা ও গানের কোল থেকে। প্রতি পাঠেই পূর্ব চর্চিত কোন এক সময় ফিরে আসে শ্রোতার মাঝে। তখন সেই প্রিয় সময়ের মতো কবিতাও আপন হয়ে যায়। আর সেই সম্পর্কের অনন্যতা নিজের হারিয়ে যাওয়া কথা খুঁজে পাওয়ায় যা ঐ কবিতা বা গান সেই পাঠক বা শ্রোতাকেই ফিরিয়ে দেয় ভালোবাসার বিনিময় হিসাবে। আমার প্রেমিকা কবিতাগুলোও তাই আমার কাছে সময়ের মতই আপন। আমার সেই প্রেমিকাদের কথা বলতেই এই ব্লগ।

প্রেমের শুরু বুড়ি খাদু দাদুকে দিয়ে। বাংলা বুঝতে শিখার পর থেকেই আমার মিতাপুর মুখে ক্রমাগত শোনা এই কবিতা। দুর্মুখেরা অবশ্য আমার কাজিনের অভিপ্রায় নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন তুলে। ছেলেবেলায় আমার নাক নাকি চাইনিজ টাইপ বোঁচা ( এখন আমাকে যারা দেখবেন তাদের জন্য বিশ্বাস করা কঠিন) ছিলো। আর খাদু দাদুর সেই বোচা নাকির ছন্দ আমার সামনে বলার কারণও নাকি এইটাই। কারণ যাই হোক “খাদু দাদুর নাকী হবেন , নাক ড্যাং আ ড্যাং ড্যাং” এই লাইন গুলোর মাঝে আমার শান্ত শৈশব লুকিয়ে আছে। আপু আমাকে আবৃত্তি করে শোনাতেন। যতবারই এই কবিতা (নাকি ছড়া) পড়ি বা শুনি আজ থেকে চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আপুর শৈশবের দুষ্টুমি মাখা হাসিমুখ কেবলই ফিরে আসে মনের মাঝে।

আমার জীবনে কবি ও কবিতার প্রতি ভালো লাগার পিছনে যার অবদান বলতেই হবে তিনি আমার মমতাময়ী মা। আমার শৈশবের সময়টিতেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। কবি ও কবিতার কথা আমার শোনা আমার মায়ের মুখেই। কোন এক সন্ধ্যায় পড়া শেষ করে ছুটি নিতে মায়ের কাছে গিয়ে দেখেছি তাকে আবৃত্তি করতে ” আমরা কি তিমির বিলাসী, আমরা তো তিমির বিনাশী হতে চাই, আমরা তো তিমির বলাসী”। তিমির হননের হানের মাঝেই কবিতার প্রতি বোধের জন্ম। তাই এই কবিতাও আামর কাছের প্রেমিকা। তিমির বিলাসী অথবা তিমির বিনাশী শব্দ দুটোর মাঝে আটকে পরে থাকে কৈশোরের চাঁপা ঘ্রাণ। আমার মায়ের আরেকটি প্রিয় কবিতা “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” — এই কবিতাটি আমার মা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। অনেক অনুরোধ করেও রাজি করাতে পারিনি তার আবৃত্তি রেকর্ড করতে। বহু জায়গায় বহবার শোনবার পড়েও মায়ের কন্ঠে এই কবিতা শোনবার সাধ জাগে আমার প্রতিনিয়তই।

উপেন আর কেষ্টার কথাও চলে আসবে আমার এক ভাইয়ের কথা গিয়ে। তিনি খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমাদের ছোটদের সাথে খুব একটা কথা বলতেন না। রাশভারী চেহারার বলে আমরা একটু ভয়ও পেতাম তাকে। একটা ব্যাপারেই আসলে আমরা তার মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারতাম। সেটা হলো কবিতা। আর তার কবিতা ছিলো দুটো। কেষ্টাকে নিয়ে পুরনো ভৃত্য আর উপেনকে নিয়ে দু বিঘে জমি। এই কবিতা শুনে উপেন বা কেষ্টার কষ্টে আমাদের মন কেঁদে উঠতো না। বরং রাশভারী বড় ভাইকে কথা বলানোর বিশ্বজয়ী আনন্দে আমাদের মুখের হাসির রেখা ভাইয়ের চোখের আড়াল হতে হতে ক্মশ আকর্ণ বিস্তৃত হতো। সেই বড় ভাই এখন জীবন জীবিকার ঘানি টেনে এত ক্লান্ত , আমরা জানি তার আবেগঘন উপেন খেষ্টা আর ফেরত আসবে না। তাই উপেন কেষ্টারা নিজেদের কষ্টে যেমন ভাস্বর তেমনি আমার কাছে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি খুলে দেয়া দুই সুপারহিরোও বটে।

জীবনানন্দের “হায় চিল” কবিতাটি সবারই পড়া। এই কবিতার অর্থ আমার কাছে যেমন বিমুগ্ধতা ছড়ায় তেমনি এই কবিতা আমাকে করে তোলে আবেগঘন এবং গর্বিত। সময়টা সম্ভবত ১৯৯০ অথবা ৯১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পিকনিক। সেবার আমার মায়ের সাথে সেই পিকনিকে অংশগ্রহণ করা হয়। হাঠৎ করেই নিজেকে আবিষ্কার করি মাইকের সামনে। বয়সে ছোট ছিলাম। এই জন্যই বোধ হয় জড়তা ছিলো না। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে গত কয়েকদিনে মায়ের মুখে শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলা হায় চিল কবিতাটি অবলীলায় হায় বলে ফেললাম। মুখস্থ বলছি এ কারণে আবৃত্তি করতে হলে কবিতার ভিতরে গিয়ে যে আবেগ ধরতে হয় তা বোঝার বুদ্ধি বা বয়স কোনটাই আমার ছিল না। আমার মুখস্থ বলা শুনে সেখানে উপস্থিত শিক্ষক ছাত্রছাত্রী সবাই হাততালি দিয়েছিলেন। আজ জানি সেই হাততালি আমার কবিতা বলার মুন্সিয়ানার জন্য নয় বরং একজন মায়ের ছেলের মাঝে কবিতা সঞ্চরণের মত এক সুন্দর বিষয়কে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তারা। আজ বিশ বছর পরে ছবি দেখে যখন আবিষ্কার করি সেদিন আমাকে আশীবার্দ করা লোকদের মাঝে শ্রদ্ধেয় ড. মণিরুজ্জামান, ড.আনিসুজ্জামান, ড. হুমায়ুন আজাদ রা ছিলেন নিজের অজান্তেই নিজের মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যাই। হায় চিল কবিতাটি তাই আমার কাছে কবিতার চেয়েও বিশেষ কিছু। অনেক আবেগের অনেক অনেক গর্বের অনেক ভালোলাগার ।

সময় এগিয়ে যায়। আমি বড় হই। পাঠ্য বইয়ের কবিতার ছন্দ আমাকে আকৃষ্ট করে। ছন্দ আমাকে টানে একদম শৈশবের প্রথম সময় থেকেই। সেই ছন্দের টানেই কবিতাগুলো মাথায় গেথে যায়। লাইনে লাইনে মিলিয়ে ছড়া কিংবা কবিতার বাইরে নতুন জগতের সন্ধান পাই আমার এক ভাইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ারে। রফিক আজাদের ” ভাত দে হারামজাদা” কবিতাটা শোনা সেখান থেকেই। সেই সময়ে আরো কিছু কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে। তার মাঝে একজন অমল কান্তি। যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো। এই কবিতার প্রভাব আমার জীবনে অনেক। অমল কান্তির কবিতাটা মনে নেই পুরো। কিন্তু এটুকু মনে আছে সে ছিলো সাধারণ। কোন উচ্চাশা ছিলো না। শুধু রোদ্দুর হয়ে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলো নিজেকে সবার জন্য। আমার নিজের করে নেয়া এই অর্থই আমাকে অমল কান্তি হবার প্রেরণা যোগায়।অমল কান্তির কবিতা আর শোনা হয়নি। কিন্তু নামটি গেঁথে আছে মনে। সেই কবিতার আসল ভাব ভুলে গিয়ে নিজের গড়ে নেয়া অমল কান্তির কথাই ভাবি সব সময়।।

“যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে,
সেই বয়সে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার প্রিয়তম মাতৃভূমিকে……”

জাদুকরী এই দুই লাইন আমাকে ভালো বাসিয়েছে একজন বেঞ্জামিন মূলায়েস কে। বেঞ্জামিন মূলায়েসকে নিয়ে লেখা এই কবিতা কার লেখা কবিতার কী নাম কিচ্ছু মনে নাই …. শুধু মনের মাঝে গেঁথে গেছে একটি নাম বেঞ্জামিন মূলায়েস। যাকে লাশ হতে হয়েছিলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। যিনি একজন কবি ছিলেন। তিনি একজন আপোষহীন ছিলেন। লোকটার ব্যাপারে সম্প্রতি উইকিতে খোঁজ করে যা দেখি তা অবশ্য খুব বেশি সুখপ্রদ নয়। আমি অবশ্য পুরোটা পড়তে চাইনি উইকিতে। হারাতে চাইনি শৈশবের ভালো লাগার বিপ্লবী বেঞ্জামিন মূলায়েসকে।

বকবক করতে করতে অনেক কথা বলে ফেললাম। শুরু করেছিলাম নজরুলের খাদু দাদু দিয়ে। শেষ করবে নজরুলের আরেকটি কবিতা দিয়ে। যে কবিতার জন্য আমার কাছে নজরুলকে অনন্য মনে হয়। আমার অলটাইম ফেভারিট কবিতা এটি।আমার সবচেয়ে কাছের প্রেমিকা। সবাই এটি পড়েছেন তারপরেও আরেকবার শেয়ার করলাম সবার পড়ার জন্য। সেই কবিতা হলো “সাম্যবাদী”।
নজরুলের এই কবিতাটি মনে প্রাণে ধারণ করা সব বাঙালির জন্য খুবই দরকার আজ এবং আগামী সবসময়র জন্য।

সাম্যবাদী

কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান ।
গাহি সাম্যের গান !
কে তুমি ?-পার্সী ? জৈন ? ইহুদী ? সাঁওতাল, ভীল, গারো ?
কনফুসিয়াস ? চার্বাক-চেলা ? বলে যাও, বল আরো !
বন্ধু যা খুশি হও
পেটে-পিঠে, কাঁধে-মগজে যা-খুশী পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা গ্রন্থ সাহেব পড়ে যাও যত সখ,-
কিন্তু কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল ?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি ? -পথে ফুটে তাজা ফুল !
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ !
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার ।
কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে ?
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে !
বন্ধু বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট ।
এই হৃদয়ই সে নীলচল, কাশী, মথুরা বৃন্দাবন,
বন্ধু-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন
মসজিদ এই মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয় ।

এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা ।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি ।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান !
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই ।

৩,৩৮২ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “খাদু দাদু, চিল, অমল কান্তি, বেঞ্জামিন মূলায়েস ও অন্যান্য”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    কবিতার সাথে আমার লতায় পাতায় জাইলেম ফ্লোয়েমেও কোন সম্পর্ক নেই 🙁
    তারপরও লেখাটা দারুন লাগলো :thumbup:

    (বেজ্‌ড ওন আ ট্রু কমেন্ট... B-) )


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. সামিয়া (৯৯-০৫)

    বেঞ্জামিন মূলায়েস সাহেবের পরিচয়টা ঠিক... :-B
    কবিতার জন্য ভালোবাসা দেখে ভাল লাগলো, আমারও নাক প্রচন্ড পরিমাণে বোঁচা। যদিও কেউ আমাকে নিয়ে এই ছড়াটা পড়েনি 🙂

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      আপনার মন্তব্যে খুবই অণুপ্রাণিত বোধ করলাম রাব্বী ভাই।
      একটু ডিসক্লেইমার দেয়া প্রয়োজন, আপনার ব্লগের মাথার উপরে অমল কান্তির প্রথম কয়েক লাইন দেখে এই লেখাটা লিখার প্রেরণা পাই।

      বাংলা বিভাগে পড়ি নাই ভেবে আমার আফসোস নাই বরং ভালৈ বোধ করি। কারণ কোন পড়া পাঠ্য হলেই আমি আবার তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি 🙁

      জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    খাদু দাদু আমি পড়িনি। অন্য সবগুলো ছুঁয়ে গেল একেবারে। কবিতা নিয়ে এত সুন্দর করে কেউ লেখে না রে। তোর মত লেখতে পারলে আমিও আমার কিছু প্রিয়দের কে নিয়।
    অট কেমন আছিস রে?

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      এহসান ভাই, পুরা বিশ্বকাপের সময়টা নেটে খেলা দেখছি আর মিরপুরে আমাদের একসাথে খেলা দেখার কথা মনে করছি।
      লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
      জুনাদার কমেন্টের ব্যাপারে শুধু একটা কথাই বলি, জুনাদা ইজ দ্যা অনলি অন.... ইন ফর্ম রিয়েল জুনা.... আমিও খুব মজা পাইছি।

      জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আমিন,
    তোমার উদ্ধৃত সব কবিতা আমারো অসম্ভব প্রিয়। আর তুমি লিখেছোও খুব সুন্দর করে। প্রাণটা ভরে গেলো।
    প্রেমিকা যদি বলো তো এমন প্রেমিকার সংখ্যা আমার অগণিত।
    একটার কথা না বললেই নয়, আবুল হাসানের ঝিনুক নীরবে সহো
    ঝিনুক নীরবে সহো
    ঝিনুক নীরবে সহে যাও
    মুখ বুজে মুক্তা ফলাও

    কি জানি ঠিক লিখলাম কিনা...
    ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।