আকাশ তবুও সুনীল থাকে……….

এক

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই তার মনে অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে।কেননা আজ তার জীবনের শেষ দিন।মনে মনে একটু চাপা অস্বস্তিও কাজ করছে।অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার ।আর মাত্র ২৪ ঘন্টা তারপর সে চলে যাবে অজানার দেশে।সকল মানুষের যে অমোঘ নিয়তি মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে চলছে সে।সে চলে যাচ্ছে সব পাওয়ার এই পৃথিবী ছেড়ে।কী যেন অপূর্ণতা রয়ে গেল তার মাঝে।

যে জীবন দোয়েলের,ফড়িংয়ের,
মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা…..

নিজের অজান্তেই তার খুব প্রিয় জীবনানন্দের লাইন গুলোকে আউড়ে উঠল সে।হ্যা সে ও তো সেই পরিতৃপ্ত যুবকের ন্যায় অতৃপ্ত।আর তাই তো সেও সেই যুবকের মতো বেছে নিয়েছে একই পথ।যে জীবনে তার সেই বিপন্ন বিস্ময় এসে ধরা দিল না সেই জীবন ছেড়ে অন্য কোন ভুবনে গিয়ে সে বিপন্ন বিস্ময়ের খোজ করবে।তাইতো সে সাত দিন আগে এক অদ্ভুত ঔষধ শরীরে প্রয়োগ করেছে যা ধীরে ধীরে তার জীবনীশক্তিকে ক্ষয় করে মৃত্যু ঘটাবে আগামীকালের মধ্যে।

খাবার টেবিলে তার মা আর ছোট বোনটির সাথে কথা বলতে বলতে তার বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠল।তার জীবনের উপর অধিকার যে শুধু তার একার নয় সেই সত্য হঠাৎ করে তার কাছে খুব বেশি করে প্রতিভাত হতে লাগল।এই প্রথম তার মনে তৈরি হলো দ্বিধা।সে কী তবে ভুল করল।তার চোখে ভেসে উঠল সেই লাশকাটা ঘর সেই জীবনানন্দ।দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল তার মনের গোপন কুঠুরিতে।কিন্তু এখন তার সামনে বাচার কোন পথা আর খোলা নেই।সেই ঔষধের অনু পরমাণু তার রক্তে মিশে গেছে।এই মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য প্রশান্ত (নাকি অশান্ত) অপেক্ষা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই।

বের হবার আগে মা তাকে বলল ,বাবা তোর কী হয়েছে বল?

কিছু না মা।আমি ভালো আছি।তুমি আমাকে আশীর্বাদ দাও ।আমি ভালো থাকব।মা তবু যেতে দিতে চান না ।তিনি তার ছেলের চোখে কিছু একটা দেখতে পেয়েছেন।তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেকে বিদায় দিলেন।তার বোনটিকে বলল সে কী চাস তুই বলতো, আজ বেতন পাবো?

বোনটি তার কাছে নুপূর আব্দার করল।সে বলল ,ঠিক আছে।বাড়ি থেকে বের হবার সময় সে তার মা বোনের দিকে শেষ বারের মতো তাকাল।তার বুক যেন কেউ চেপে ধরে আছে।তার খুব কষ্ট হচ্ছে।বিদায়।এ জীবনে আর তাদের সাথে দেখা হবে না।

আহ ! আহা।আজই তার জীবনের শেষ দিন।ভাবতে যেন তার হৃদয় শুকিয়ে যাচ্ছে।সে সারা দুপুর ধরে হাটছে তার ভারসিটির পথ ধরে।এই পথে সে তার বন্ধুদের সাথে কত হেটেছে।তার অতীত সেই মধুময় সোনালি অতীত তার কাছে ফিরে ফিরে আসছে।সেই ভারসিটি লাইফ।সেই রাত জাগা।সেই তর্ক।সেই সোনাঝরা দিন।সেই দিন গুলোর মধুর স্মৃতি আজ তার চোখে ভাসছে।তার মন বিতৃষ্ণার তিক্ত রসে ছেয়ে গেল।সে আসলেই স্বার্থপর।সে শুধু নিজের জন্য বাচতে চেয়েছে।তার আশেপাশের মানুষের জন্য কিছুই রাখেনি।কেন?সে এমন কেন?

তার মায়ের জন্য একটা শড়ি আর বোনের জন্য একটা রূপার নুপুর কিনল সে।চাকরির থেকে পাওয়া এককালীন বাকি অর্থ সে তার এক বন্ধুকে দিয়ে যাবে জনসেবার জন্য।সেই বন্ধু এখন তার সামনে বসে আছে।তকে কী সব খুলে বলবে।ভাবতে থাকে সে।হুমম।বলা যায়।অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তার বন্ধুকে সে সব বলল।এবং কোন ধরনের হৈচৈ না করে শাড়ি আর নুপুর তার মা বোনকে পৌছে দিতে বলে সে চলে গেল শহরের সেই প্রান্তে যেখানে নীলিমার বসবাস।

ভাদ্র মাসের গরম তাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না।সে এগিয়ে যেতে থাকে তার প্রেমিকাকে শেষ দিনে শেষ উপহার দিতে………….

দুই

রিক্সায় সে নীলিমার হাত ধরে বসে আছে।সে জানে এটাই তাদের শেষ দেখা।তার বুকের ভিতরে বয়ে চলা কষ্টের চোরা স্রোতের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে আকাশ যেন কেদে উঠল।শরতের খেয়ালী বৃষ্টিতে রিক্সার হুট খুলে তারা অবগাহন করছে।তার কাছে মনে হতে থাকে যেন তারা অসীম সময় ধরে বসে আছে।কারো মুখে কোন কথা নেই।
নীলা ,নীরবতা ভাঙল সে।আজকের পর তুমি আর কখনও আমাকে খুজে পাবে না।আমি হারিয়ে যাব মহাকালের অজানা স্রোতের তীব্র ধারায় যেভাবে খড়কুটো হারিয়ে বর্ষার উম্মত্ত স্রোতস্বিনীর উম্মাতাল স্রোতে।
ভড়ং ছাড়ো কী বলবে বলো।ভুমিকা করো না।তার হেয়ালিতে বিরক্ত হয়ে নীলিমা বলে উঠে।

সে নীলিমার হাত ধরে জড়িয়ে ধরল।তারপর বলল,অদ্ভুত এক ঔষধ এখন আমার রক্তধারার মাঝে বয়ে চলছে।আমার জীবনীশক্তিকে সে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।আগামীকালের মধ্যে তা সবটুকুকে শেষ করে দিবে।বলে একটু দম নিয়ে সময় নিতে চাইল।
হঠাৎ করে নীলিমা আৎকে উঠল।সে ভালো করে লক্ষ্য করলো তার প্রিয় মানুষটির চেহারা।কেমন ফ্যাকাশে আর নিষ্প্রান।সে বুঝতে চাইল কী হচ্ছে?
জানিনা তুমি আমাকে ক্ষমা করবে কিনা কিন্তু সকল প্রাপ্তির প্রাচুর্যে আমি হাপিয়ে উঠেছিলাম।আমার মাঝে বাসা বেধেছিল অর্থহীন বিষন্নতা। যে খোজ করেছে কোন নতুন নতুন অপ্রাপ্তির।তাইতো আমি এই ভুবন ছেড়ে অন্য কোন ভুবনে কোন দূর দেশে সেই অপ্রাপ্তি অর্জনের সন্ধানে যেতে চাই।

নীলিমা কাদছে।বৃষ্টির ফোটা তার কান্নাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত ছেলেটির দিকে।
নীলা, আমি তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি নীল বেদনা।এটাই তোমাকে দেয়া আমার শেষ উপহার।আমাকে যদি ভালোবাসো একে আকড়ে ধরে থাকো।আর আমি তো জীবনে মরনে তোমার হয়েই থাকবো।তোমার দুঃখে কালো মেঘ হয়ে কাদবো।তোমার সুখে জোছনা রাতের চাদ হয়ে হাসবো।অপরাহ্নের সূর্য হয়ে তোমার জন্য আমার ভালবাসার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দেবো ভুবনময়……………

তার পরের কথাগুলো নীলিমার শোনা হলো না আর।সে যেন বধির হয়ে গেছে।রিক্সা থেকে নেমে চিরবিদায় জানালো তার অতি কাছের চির অপরিচিত এই খেয়ালি ছেলেটাকে।

রাত নেমে আসছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে শরতের নির্মেঘ আকাশের চাদ বর্ষন করে যাচ্ছে তার জোছনা ধারা। চন্দ্রাহত দুঃখবিলাসী আজ তাকিয়ে আছে চাদের দিকে আজই শেষ।পরিত্যক্ত এই জংলা বাড়ি ধরে রেখেছে তার শৈশবকে।
আহা শৈশব।প্রিয় শৈশব।স্মৃতিগুলো যেন ফিরে ফিরে আসছে।তার জীবনী শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।সে হারিয়ে যাচ্ছে কালের সর্বনাশা স্রোতে।ঐ তো সে দেখতে পাচ্ছে সেই জংগল যার মাঝে তারা লুকোচুরি খেলত।সেই ডোবা যেখানে বাজি ধরে লাফ দিয়ে সে হাস্যম্পাদ হয়েছিল।তার মস্তিষ্ক তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতিগুলোকে নিয়ে আসছে তার চোখের সামনে।সে হারিয়ে যাচ্ছে।চাদের আলোয় চিরচেনা এই জায়গাটাকে বড়ই অচেনা বড়ই অদ্ভুত মনে হচ্ছে।রাত বাড়ছে আরো বাড়ছে।সে আর কিছু যেন দেখতে পাচ্ছে না।
চাদ ডুবে যাচ্ছে।সেই সাথে নিভু নিভু তার জীবন প্রদীপ।সে দেখতে পাচ্ছে না কিছুই।ভোর হয়ে আসছে।গরুর ডাক শোনা যাচ্ছে।যেন তার কানে বহুদুর থেকে ভেসে আসছে।এই গরু দেখার জন্য সে কাদত ছেলেবেলায়।আহারে আর দেখা হবে না কিছুই।মাটির পৃথিবী ঘাসের পৃথিবী দোয়েলের কীটের আহা।বেচে থাকার প্রচন্ড ইচ্ছা জেগে উঠছে তার মাঝে কিন্তু সে হারিয়ে যাচ্ছে অতলে।সূর্যের তীব্র আলোকচ্ছটা তার গায়ে আঘাত করল যেন…………….

জানালার ফাক গলে সুর্যের আলো তার মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল তার।ধড়ফড় করে উঠল সে।নাহ মরেনি সে।সবই স্বপ্ন।উহহ। কী দুঃস্বপ্নই না সে দেখল।ধ্যাৎ । নাকি নাহ ! মাথা টা ঝেড়ে উঠার চেষ্টা করল সে। পারল না। মনে মনে বিড় বিড় করে উঠল রবিঠাকুরের লাইন…..

আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাচাই ভালো ……..

ভোরের বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস ত্যাগ করল সে।

২,৮৬৯ বার দেখা হয়েছে

৩২ টি মন্তব্য : “আকাশ তবুও সুনীল থাকে……….”

  1. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    চমৎকার লেখনী তোমার। শেষের চমকটা সুন্দর এবং আলোকিত হয়ে উঠেছে।
    :thumbup:

    আর আকাশ-নীলিমা নাম দুটি আমার খুব প্রিয়।
    অনেক লেখায় ব্যবহার করেছি আগে।

    তাই হয়তো আর বেশী ভালো লাগলো।

    শুভেচ্ছা নিও।


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    দুর্দান্ত প্লট...সুন্দর প্রকাশ... :thumbup:

    কিন্তু লেখক হিসাবে তুমি কোন ফিনিশিংটা দিতে চাইস? দীর্ঘ নিঃশ্বাস নাকি শেষ নিঃশ্বাস?


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      যেভাবে ভাবেন ভাইয়া। প্রথম যখন আমি লিখি তখন শেষ লাইন ছিল বুক ভরে শ্বাস নিল জাতীয় কিছু অর্থাৎ পুরো একটা দুঃস্বপ্ন দেখাতে চাইছিলাম কিন্তু পরে একটু চেঞ্জ করে দ্ব্যর্থকতায় পড়ি।
      ব্যাপারটা এমন হতে পারে মরার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে বেঁচে থাকার তীব্র আকুতিতে তার চোখের সামনে তীব্র আলোর উন্মেষ ঘটেছে। এই আইডিয়াটা আমার কাছে বেশি পছন্দ হওয়ায় আমি মরে যাওয়ার আগে তীব্রভাবে বাঁচার আকুতি হিসাবেই এই লেখাটাকে দেখি।
      ধন্যবাদ ভাইয়া।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : বারিক

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।