বিচ্ছিন্ন আবেশ

অনুভূতিহীনতা অথবা তীব্র অনুভূতিপ্রবণতা কিংবা বিচ্ছিন্ন অনুভূতির অসংলগ্ন জালে আটকে গেছি আমি। সাধারণ ভাবনা চিন্তার উর্ধ্বে মনে হচ্ছে নিজেকে। আমার কাছে সময়ের হিসাব নেই ভেবে আমি আৎকে উঠি। আমি কোথায় ছিলাম কেমন করে এখানে আসলাম সে হিসাব গুলো থাকছে না। সেটার দরকার আছে কি এখন- পরিষ্কার হয়না। আমার কানের কাছে ক্রমাগত বোঁ বোঁ শব্দ বেজে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে তাকিয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করছি। একটা বদ্ধ রুমের মাঝে আছি আমি। এদিক ওদিক তাকিয়েও আলো আসার কোন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। অতএব দিন রাত্রির ব্যবধান এখানে অর্থহীন। আমার মাথার পিছনকার দেয়ালটার শেষ মাথাতে ঘুলঘুলি মত কিছু একটা আছে কিন্তু আলো আধারের পার্থক্য সৃষ্টিতে সে খুব সম্ভবত অক্ষম।পাশ ফিরে আমি নিজেকে কুকড়ে ফেলি- আরো কুকড়ে ফেলে শরীরটাকে খুব ছোট জায়গাতে আবদ্ধ করে ফেলতে চাই। গতকালকের মত এক তীব্র আলোকচ্ছটা আমার দিকে ধেয়ে আসে।

এই জায়গাটা আমার খুব পরিচিত ঠেকছে। হ্যা এতো আমার শৈশবের বিছানা। আমার ভীতিবিলাসের সূচনা এখানে। সেসময় আমি খুব করে ভাবতাম আর চিন্তাগুলো সবসময়ই ঘুরিয়ে পেচিয়ে এক ধরণের অনুভূতির কাছে নিয়ে যেত। সে অনুভূতি হলো ভয়। সেই ভয় এসেছে অন্ধকারের হাত ধরে। সেই ভয়ের অনুভূতির প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা আমার। আমি একদম ছোট হয়ে শুয়ে আছি আমার মায়ের জন্য। মায়ের আঁচল তলে চির নির্ভয় স্থান। মায়ের কোলে গা এলিয়ে দিতে যাই।

পাশ ফিরে শুতে গিয়ে বুকের ভিতরে ভারী অনুভব করি। আমার মানসপটে মমতাময়ী মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। তাকে যখন শেষবার দেখি সেই সময়কার হাসিটা যেন এখনও ঠোটের কোণে লেগে আছে। সেই দিনটি যেন আমি খুব পরিষ্কার করে দেখতে পারছি। অথবা মায়ের কোমল আঁচলের ছোয়া আমার মাথায় লাগছে। সেই বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফেরার পরেকারকথা মনে ভাসছে। আঁচল দিয়ে আমার মাথা থেকে পানি সরিয়ে দিচ্ছেন মা। অজান্তেই কি চোখ ভিজে উঠলো? হবে হয়তো।

হঠাৎ করেই মা মিলয়ে গেলেন। আমি আচ্ছন্ন হচ্ছি একদমই ফাঁকা ফাঁকা একধরণের আলগা অনুভূতিতে। আমার সামনে চলে এসেছে আমার নীল নিঃসঙ্গতা। তার আবির্ভাব নিঃশব্দের প্রখর শব্দ দিয়ে। তার পিঠে চড়ে আমি যেন উড়ে যাচ্ছি এক কাল থেকে অন্য কালে,এক স্থান হতে অন্য স্থানে। আমার চারপাশ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে তার রূপ আর রঙ। বিষণ্ণ বিকেলের ভালো লাগা ক্লান্ত সূর্যের দীপ্তি আমার শরীর পানে আসছে যেন। পরমূহুর্তে স্বপ্নময় রাতের স্বপ্নচারী সত্তা আমাকে গ্রাস করে। শুধু আধারের বুকে বেড়ে উঠা সাদাকালো স্বপ্ন গুলো বেড়ে উঠার আগেই তীব্র আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়।

আমার বিছানাটা খুব ভালো মত খেয়াল করি আমি। আমার চারপাশে এমনি অনেক বিছানা। বেশিরভাগই ফাঁকা হয়ে আছে। ভরা থাকলেও বুঝবার উপায় নেই। প্রত্যেকটি আমিই এখানে আমার মত বাকরুদ্ধ। তাদের মাঝেও হয়তো আমার মতো অনুভূতি কাজ করে কিংবা কে জানে অনেকেই হয়তো জড় পদার্থ হয়ে গেছে এর মাঝে। প্রতিদিন আমাদের সংখ্যা বদলায়। সংখ্যা বাড়লে আমরা অনুভব করি না, কিন্তু বিপরীতক্ষত্রে আমরা সচকিত হয়ে যাই আরেকজনের বিদায়ে তাদের আপনজনের প্রান উজার করা আহাজারিতে। বরাবর উপরে তাকাই। সিলিংয়ের উপর ঝুলে থাকা ফ্যানটিকে বড় ক্লান্ত মনে হতে থাকে।

বয়ে আসা জীবনটা ফ্যানের মত ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত অবসন্ন বিষাদগ্রস্ত। আমি অনুভব করি সৃজনার নরম হাতকে তার অধরকে তার স্পর্শকে। তার মাঝেকার নিষ্পাপ সত্তাকে আমার কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে থাকে। তার নীলশুভ্রা সত্তা আমাকে ছেড়ে দিতে থাকে যেনো। এতদিন যে আমাকে জড়িয়ে ছিলো আমি এতদিন যাকে জড়িয়ে ছিলাম। তার মাঝেকার কষ্টগুলোকে নিজের মাঝে ধারণ করে সে দাড়িয়ে আছে। সে কষ্টগুলো সোনালী রোদে শুকায় না বরং রোদ তার কষ্টের গন্ধে নিজেকে মেখে ছড়িয়ে দেয় তার কষ্টগুলোকে।

ব্যাপারটা নেহায়েতই ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি অনুভব করছি ঘুলঘুলির
সছিদ্র পর্দায় রোদ ঢুকছে। সে রোদের অনুভূতি পাওয়া যায় কিন্তু তাকে দেখা যায় না। দিন রাতের হিসাব মেলানো অবান্তর। জীবনের সুন্দর সময়গুলোকে বায়োস্কোপের মত দেখতে চাইছি যেন। ভালো লাগা ভোর ক্লান্ত দুপুর সোনালি সন্ধ্যা কিংবা নিঃস্তব্ধ রাত্রি। তীব্রভাবে অনুভব করতে চাইছি পৃথিবীর আলো বাতাস ঘাস ফুল কে। স্নান করতে মন চাইছে কোন চন্দ্ররাতের জোছনা সাগরে নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দিয়ে। ঘোর লাগা বর্ষার বারির সূচালো তীর যেনো আমার সর্বাঙ্গে বিদ্ধ হচ্ছে। তারপরে হঠাৎ করেই অনুভব করতে থাকি কুয়াশার চাদরের রহস্য ভেদ করা সোডিয়াম আলোতে আলোকিত রাস্তা – ঘোর কেটে যায় এমনি হঠাৎ করেই।

মাথার কাছের বোঁ বোঁ শব্দটা ক্রমে তীব্র হচ্ছে। মানুষগুলোকে খুঁজছে চোখ কিংবা মানুষগুলো নয় ফেলে আসা সময়গুলোকে কাছে পেতে চাইছে যেন। সেই সময়ের সেই মানুষ গুলো খুব করেই টানছে। টানা একঘেয়ে নিঃশব্দ বিশ্রাম চলছে। বাতাসের মাঝে মৃত্যুর গন্ধ অনুভব করছি। আলো আঁধারির মাঝেকার এক ধরণের রহস্যের দোলাচালে দুলছি। স্বপ্নের পৃথিবী মাটির পৃথিবী ঘাসের পৃথিবী কীটের পৃথিবী মানুষের পৃথিবীকে অনুভব করতে চাইছি গভীর করে। আমার মাঝেকার আমির শেষ উচ্চারণটুকু অবশ্য আমি শুনতে পাইনি।

১,৭৫৭ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “বিচ্ছিন্ন আবেশ”

  1. মাথার কাছের বোঁ বোঁ শব্দটা ক্রমে তীব্র হচ্ছে। মানুষগুলোকে খুঁজছে চোখ কিংবা মানুষগুলো নয় ফেলে আসা সময়গুলোকে কাছে পেতে চাইছে যেন। সেই সময়ের সেই মানুষ গুলো খুব করেই টানছে। টানা একঘেয়ে নিঃশব্দ বিশ্রাম চলছে।

    🙁 🙁 🙁

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    সবাই চলে যাবে একদিন না একদিন। মেনে নিতে পারলেই কস্টটা কমে যাবে। তোমার নিজস্ব কিছু কস্ট থাকবে, যেগুলো আসলে কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না, হয়ত অনেকে বিজ্ঞের মত মাথা ঝুলিয়ে বলবে, সে তোমাকে অনুভূব করতে পেরেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আসলে তোমার বিষন্নতা বুঝতে পেরেছে, কিন্তু এর কারন বুঝতে পারেনি মোটেও।
    আমার বাবা মারা যান মাঝ রাতে, সি এম এইচে, বাবাকে সি এম এইচের শীতল গহবরে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা যে যার বাসায় চলে আসি, ভাই বোন যে যার ঘরে ঢুকে দরজার তালা লাগিয়ে দেয় নিজেকে ধাতস্থ করে তুলতে, আমি আর মা এক ঘরে, আমি মা তখন পাগলের মত বাবাকে খুজছেন এ ঘরে ও ঘরে, বাথরুমে।
    মা মারা যাওয়ার আগে সিসিইউ তে ছিলেন অনেকদিন। আমি রাতে পাহাড়া দিতাম। সাড়ে নয়টার দিকে নিঝুম হয়ে যেত সব। নার্স টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমাত। আমি ঘড়ির কাটার দিকে আর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এগার, সাড়ে এগার, বারো, সাড়ে বারো, এভাবে কোন কাজ ছাড়া দীর্ঘ রাত।
    রাত গুলো মাঝে মাঝে অনেক বড় হয়ে যেত।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      ফয়েজ ভাই আপ্নার কমেন্ট টা দেখে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ষত্যি বলছি এই লেখাটা আমার ব্যাক্তিগত অনেক আবেগের সাথে জড়িত না। কিন্তু আপনার কমেন্টের পর আবার পুরোটা পড়লাম। আপনি যেভাবে ভেবেছেন সেটা সম্ভব; এতে করে একটু বিষণ্ণতা এসে গেলো। আমি বরং অন্যভাবে একে বলি---(লেখায় ফুটনোট দিয়ে লেখাটার রিফ্লেকটিভ ভাবটা নষ্ট করতে চাইনি।)
      এই লেখার থিম আসলে কোন এক হাসপাতালের আইসিইউ তে আবদ্ধ কোন রোগীর অবচেতন ভাবনা। আমার মা যখন আ্যাপোলোর আইষিইউ তে গভীর কোমায় তখন আমার সুযোগ হয়েছিল শেষবারের মত তাকে দেখার। সে সময়ে আইসিইউ তে ঢুকে আমার মাথায় এক ঝাটকায় এক যুগ আগের স্মৃতি চলে আসের। ক্লাশ এইটে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হই আমি। আমার জ্বর ১০৫ অতিক্রম করে যায়। আর তখনও ডাক্তাররা আমার রোগ ধরতে পারেন না। কলেজ থেকে সিএমএইচ আর সেখানে একেবারে আইসিইউতে। আমার অসুখ ধরা পড়ে তিনদিন পর। এর মাঝে প্রথম অল্প সময় বাদে পুরো সময় আমার জ্ঞান ছিল আমি সাতদিন ধরে আইষিইউ তে মৃত্যুর গন্ধ শুকেছি। সেখানকার মানুষগুলোর আগমন তাদের আত্মীয়দের আহাজারি সব কিছুই খুব কাছে থেকে দেখা।
      সেই স্মৃতি আর এ্যাপোলোতে দেখা আইসিইউর এই ভাবনা আর তার সাথে মেটাফোরিক্যালি নাগরিক জীবনের বন্দিত্বতে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। ঐ আইসিইউ রোগী গুলোর মতই নিস্তেজ আমাদের মানবীয় অনুভূতি গুলো ........ আরো অনেক কিছু লিখতে চাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো বাংলা পরীক্ষার ব্যাখ্যা লিখছি । তাই থেমে গেলাম।

      জবাব দিন
  3. রাশেদ (৯৯-০৫)

    মানবিক আবগ গুলো কেন যে মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছে মতে চলে, খালি বিপদে ফেলে 🙁
    অপটপিকঃ ভাইয়া আপনার সামুর লিংক টা কি একটূ দেওয়া যায় 🙂


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাশেদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।