বুক রিভিউ : ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট

[*** অনেক সাহস সঞ্চয় করে লিখাটা লিখতে বসলাম। আমির নিজের সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের গল্প কবিতা বুঝার মাঝেই সীমাবদ্ধ। এমনিতে আমি সাহিত্যের বই পড়ে লিটারেল দিকগুলো বুঝলেও অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ধরতে পারি না। তাই আমার এই পোস্ট লেখার উদ্দেশ্য প্রথমত বইয়ের প্রতি আমার ভালোলাগাটা শেয়ার করা ; দ্বিতীয়ত সূক্ষ্ম যে জিনিসগুলো হয়তো আমি চিন্তাও করিনি সেই বিষয়গুলো যারা আগে বইটি পড়েছেন তাদের আলোচনা থেকে বোঝার চেষ্টা করা এবং সর্বোপরি যারা বইটি পড়েননি তাদেরকে বইটি পড়তে অনুপ্রাণিত করা।]

বুয়েট পড়াকালীন সময়ে টার্ম বন্ধগুলো আমার বেশ কাটত। ঈর্ষণীয় রকমের অলস জীবন যাপন করতাম। খাওয়া ঘুম টিভিতে খেলা দেখা, খবরের কাগজে চোখ বুলানো আর মাঝে মাঝে আম্মার শেলফে হানা দেয়া। এমনি একদিন নাস্তার পর আমার প্রাতকালীন ঘুমের আয়োজনের ব্যাঘাত ঘটল বালিশের পাশের একটা বইয়ের গুতায়। নিতান্ত বিরক্তির সাথে বইটা তুলে নিলাম। বইটার নাম ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট। ফিওদর দস্তয়ভস্কির কালজয়ী উপন্যাস। বাঙলা সাহিত্যের বেশিরভাগ উপন্যাস অপঠিত থাকায় বিদেশি লেখা পড়ার তেমন সৌভাগ্য আমার তখন (এখনও) তেমন একটা হয়নি। তারপরেও বইটার মুখবন্ধের কিছুটা পড়ে বইটা পাঠ করার তাগিদ বোধ করলাম। শুরু করলাম পড়া। এক ঘন্টায় তিন পৃষ্ঠা এগুলো। মনে মনে অনুবাদকের পিণ্ডি চটকিয়ে আমি নিদ্রায় মন দিলাম। সেদিনই আবার কী ভেবে বইটা পড়া শুরু করলাম । আবারও প্রথম থেকে । এইবার বুঝার গতি দ্রুততর হলো কিছুটা ভালো লাগাও আসতে শুরু করল। তারপরেও বেশিক্ষণ না পড়ে খ্যামা দিলাম। পরের দিন আবার সকালে পড়া শুরু করলাম। এইবার বইটির প্রেমে পড়ে গেলাম সত্যি সত্যি। তারপর , হ্যা তারপর দশ দিন লাগিয়ে খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে পড়ে ফেললাম অসাধারণ এই উপন্যাসটি।

এই উপন্যাসটি আমার কাছে ভালো লেগেছে এর প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। উপন্যাসে ঢুকে যেতে আমাকে অজানা অচেনা কোন জগতে যেতে হয়নি ( যে কারণে বিদেশি সাহিত্য আমার মাথার উপর দিয়ে যায়), বরং তৎকালীন রাশিয়ার প্রেক্ষাপটকে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই আজকের আমার সামনের বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার মধ্যে। গল্পের নায়ক রাসকোলনিকভ কে আমি দেখতে পাই আমার খুব কাছের এক বন্ধুর মাঝে। শুধু সে কেন উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র খুব চমৎকারভাবে আমার চারপাশের মানুষগুলোর মাঝেই খুঁজে পাই। এ উপন্যাসের পট এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দারিদ্র পিষ্ট সমসয়া জর্জরিত এক যুবককে নিয়ে। সে তার এবং তার চারপাশের মানুষের জীবনের অভিশাপ দেখে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। আর যুবকের মাঝে থাকে কিছুটা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স। সে নিজেকে ভাবতে শুরু করে সমাজ উদ্ধারে পথিকৃৎ হিসাবে। আর সেই তাড়না থেকে সে খুন করে সম্ভাবনাহীন জীবনকে যাপিত করা এক পুজিপতি বুড়িকে। এবং খুব অলৌকিকভাবে সে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে সমর্থ হয়। তারপর শুরু হয় তার আত্মদ্বন্দ্ব। সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে যায়। এসময় তার বন্ধু রাজুমিখিন ঢুকে পড়ে উপন্যাসে তার সমর্থনদাতা উপকারী বন্ধু হিসাবে।

উপন্যাসের অন্যপিঠে আছে সোনিয়া নামক একজন যৌন কর্মী। পরিবারকে ক্লিষ্ট করে তোলা মাতাল বাবার অথর্বতা আর পরিবারের বেহাল অবস্থায় সে জীবন সংগ্রামে নামে যৌন কর্মীর অন্ধকার জীবনকে বেছে নিয়ে।
সুরাখানায় সোনিয়ার বাবার সাথে পরিচয় ঘটে রাসকোলনিকভের। সেই সূত্র ধরেই সোনিয়ার সাথে রাসকোলনিকভের পরিচয় আর কাহিনীর অগ্রসরতা। উপন্যাসের আরেকভাগে আছে রাসকোলনিকভের বোন দুনিয়া। আর তার সাথে উপন্যাসে এসেছে সলভদ্রিগাইলভ নামে এক স্থানীয় জমিদার। সেখান থেকে আরো বেশ কিছু ব্যাপার যার অনেক কিছু আমি বুঝেছি আর অনেককিছুই এন্টেনার উপর দিয়ে গেছে। এবং সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার ছিল উপন্যাসে জেরাকারী পুলিশের সাথে রাসকোলনিকভের মানসিক যুদ্ধ। যে যুদ্ধ জিতে গিয়েও সে তার নিজের অপরাধবোধের কাছে হেরে যায়।

এই উপন্যাসটির বিশিষ্টতা আমার কাছে লেগেছে এর বিষয়ের ব্যতিক্রমতা আর দস্তয়ভস্কির চরিত্র রূপায়নের অসাধারণত্ব। প্রতিটি চরিত্রের মাঝে লেখক ঢুকে গেছেন এবং পাঠককে তার মত করে ভাবাবার প্রয়াস পেয়েছেন। রাসকোলনিকভের মনের বিভিন্ন চিন্তার দ্বন্দ্ব অসাধারণ ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে এই উপন্যাসটিতে। উপন্যাসের শেষের দিকে যে অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার অদ্ভুত এক অনুভূতি পাঠকের মাঝে ছুয়ে গেছে অপূর্বভাবে।

শুরুতেই বলেছি আমি কোন বোদ্ধা পাঠক না। কিন্তু আমার নিজের ভালোলাগা ছুয়ে যাওয়া কিছুটা শেয়ার করলাম সিসিবির সাথে। সবাই নিশ্চয় অতটুকু বুঝবেন দস্তয়ভস্কির নখের যোগ্যতাও আমার নেই, তাই তার সমালোচনা করার বিষয়টিই হাস্যকর। বইয়ের মর্ম আরো ভালোভাবে বুঝতে বইটা যারা পড়েছেন তাদের কাছে থেকে আলোচনা শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

৫,১৭১ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “বুক রিভিউ : ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট”

  1. তারেক (৯৪ - ০০)

    আমি পড়িনি বইটা। যখন হাতের কাছে ছিল তখন মর্ম বুঝিনি, এখন হয়ত বুঝবো কিন্তু বইটা হাতের কাছে নেই।
    তোমার আলোচনা ভাল লাগলো। কিন্তু শুরুতে আর শেষে বিনয়বশত এত এত ডিসক্লেইমার না দিলেও চলে। সবার বুঝ যার যার নিজের কাছে, সুতরাং নিজের বক্তব্যটা অকপটে বলে ফেলাই উচিৎ।
    আরও লিখো। 🙂


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমিন : ব্লগটা তো এইজন্যই। যার মনে যা আসে ইচ্ছেমতো লিখে ফেলার খাতা।

    ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট আমারো পড়া হয়নি। অনেকদিন বেঁচে থাকলে আর কাজ থেকে ছুটি নিলে নিশ্চয়ই একদিন পড়ে ফেলতে পারবো। তবে সোভিয়েত আমলের করা ভালো কিছু অনুবাদ পেয়েছিলাম বলে টলস্টয়ের আনা ক্যারেনিনা গোর্কির মা পড়েছিলাম। যুবক বয়সে পেয়েছিলাম নাজিম হিকমত, মায়াকোভস্কি কবিতার অসাধারণ অনুবাদ। হায়, আরো কতো কিছু জীবনে পড়াই হলো না!!


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      আন্না কারেনিনা পড়ছি। সেই সোভিয়েত আমলে অনুবাদকৃত সংস্করণ। অসাধারণ লেখনী টলস্টয়ের। এখনো শেষ হয়নি পড়া। এর মাঝেই আমি মুগ্ধ। মা এখনো পড়া হয়নি। সময় করে পড়বো। আর ওয়ার এন্ড পীস পড়ার জন্য অবসর জীবনের প্রথম বছর (যদি বেঁচে থাকি) কোরবানী করে রেখেছি।

      জবাব দিন
  3. ফজল (১৯৮৮-৯৪)

    রুশ ওনুবাড এর জওনো বেসট হৈলো রাডুগা ও পরোগোটি। জোডিও এখোন এই পরোকাশোনি ডুইটা বোনঢো। আমার খুব ফাভৌরিট এই পরোকাশোনি ডুইটা। ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট এর ওনুবাড ও ওকান টেকে হোয়েছে।

    ..... আমার বাংলা টয়পে এর জেই ওবোসটা 😮 লাপটোপ এর কেয়বোআরড ভাইংা জাইটা পারে আজকের মোটো বিডেয়

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    তোর লেখা পড়ে বইটা পড়ার ইচ্ছা হচ্ছে তবে জানি না পড়া হবে কিনা... লেখা ভাল লেগেছে...

    আর সেই তাড়না থেকে সে এক পুজিপতি সম্ভাবনাহীন জীবনকে যাপিত করা এক বুড়িকে।...... এই লাইনটা কি ঠিক আছে?


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    অনেকদিন পর আজ সিসিবিতে আসলাম। প্রথমেই তোর লেখাটা পড়লাম। ভাল লাগলো, কিন্তু বইটা পড়তে পারবো কিনা জানি না। সময় নিয়ে পড়ার সময় আপাতত নেই। আর তোর লেখা পড়ে মনে হল সময় নিয়ে না পড়লে ভিতরে যাওয়া যাবে না। সেরকম সময় পেলে অবশ্যই পড়বো। :thumbup:

    জবাব দিন
  6. রকিব (০১-০৭)

    কাকতালীয়!!! দু'দিন হলো বইটা হাতে পেয়েছি, শুরু করার আগেই মচৎকার একটা প্রিভিউ। আমিন ভাইকে থ্যাঙ্কুউউউউউ 😀


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • ফজল (১৯৮৮-৯৪)

      আমার মটে কোনো বৈ পোরার আগে প্রিভিউ পোরা বা জানা আভৈড কোরা উচিট কারোন এটা বৈ পোরার মোজাটা ৫০% ঢোংসো কোরে ডিবে
      let us consider an example:: suppose u dont know what is Anna Karenina and you read that book compare its test with the taste of reading the same book after knowing a summary or preview of the book, can be weighted as 100 versus 20.

      I took almost two years to finish Anna Karenina(from progoti). At that time I just knew that it is a very special book nothing more than that and during reading, some times my feelings were so extreme and I felt fortunate that those were not known to me earlier.

      I don’t like to share any book preview with someone who is planning to read that book (of course non academic 🙂 ) I also try to avoid that even for me. But anyway that is only my own understanding.

      My personal advice for those who wants to get the full taste of reading a book, Try to avoid any detailed info about that book. That will destroy the awaiting taste 🙁

      Thanks to Amin for cheering me up with my bangla type struggling

      জবাব দিন
      • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

        বস, বেয়াদবি না নিলে একটু আত্মপক্ষ সমর্থন করি। আমি প্রিভি্উ লিখি নাই। লিখছি রিভিউ। যারা পড়ছে তাদের কাছে আমার বোধ টুকু তুলে ধরা এবং এর বাইরের ভালো লাগা গুলোকে শেয়ার করা। আর যারা পড়ে নাই তাদেরকে পড়তে আগ্রহী করা। দেখেন লক্ষ্য করে ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট বইটার মূল রসের কিছুর মাঝ দিয়েই আমি যাইনি শুধু এর পটভূমিটা একটু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আর আমার ভালোলাগার কথাটুকুকে ব্যাখ্যা করেছি মাত্র। ব্যাক্তিগত ভাবে প্রিভিউ পড়ার আমিও বিপক্ষে। কিন্তু পড়ার পর বই নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
        সর্বোপরি, আমি বুঝতে পারছি কমেন্ট দুইটা করতে আপ্নের কত কষ্ট হইছে। এজন্য আপনাকে অনেক অনেক সাধুবাদ।

        জবাব দিন
        • ফজল (১৯৮৮-৯৪)

          ভাই জান এটো উপসেট হৈলা কেন টোমারে টো কিছু কৈ নাই । আমার এক্সপেরিএনছ সেআর কোরলাম । আমি ও বৈ শেস কোরার পোর আলোচহোনা খোওব এনজোয় কোরি । পোঠিটো বৈ নিআ আডডা ডেওা আমার সোব চআটেও পিরেও ।

          I have been reading this blog for last ten months but in this discussion I cant stop replying 🙂 so you see.. how much i like this discussion.

          no worries.. keep on rolling

          জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।