উর্ধতন কর্মকর্তার পাইপজীবন: উপন্যাস

এক.
মধ্য আষাঢ় । ঝুম বৃষ্টি। বাইরে আঁধার। যদিও শিহাব যেখানে এখন শুয়ে আছে, সেটার দুই প্রান্ত ছালার চট দিয়ে ঘেরা, তাই ভেতরে সবসময়েই অন্ধকার থাকে। তারপরও ভেতরের অন্ধকার ছাপিয়েও কিছুটা আলো থেকেই যায়। আজ বাইরে আকাশের মন খারাপ। তাই আঁধারের মাঝে আরো কিছুটা আঁধারে ঢেকে আছে এক অন্ধকারের মানুষ, যার ভেতরটা আলোয় ভরা।

এখন দিন-রাত্রির কোনো প্রভেদ নাই। সবকিছু-ই একইরকম। কালো। রেললাইন সংলগ্ন এই পাইপজীবন তেমন খারাপ লাগছে না ওর কাছে। এখানে কোনো কাজ নেই। অখন্ড অবসর। সময়টা কাটে তাই চিন্তায় চিন্তায়। তবে এই চিন্তা কিছুদিন আগের চিন্তার মত না। তখন চিন্তার সাথে সাথে থাকত কিছু দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, একটু আনন্দ। এখন চিন্তার সাথে শ্রেফ প্রশান্তি বিরাজ করে। আসলে কাছের সম্পর্কগুলো থেকে সরে আসায়, কাউকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করতে হয় না শিহাবকে। যখন একজন মানুষ ছিল, তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা ছিল।

‘এখন কি তবে তুমি মানুষ নও?’
নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটু ভাবে। ইদানিং নিজেকে নিয়েই চিন্তা-ভাবনায় মশগুল শিহাব। মানুষ কে? এর কি কোনো সর্বজন স্বীকৃত নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা আছে? না থাকারই কথা।
যখন মানুষ ছিল তখন সবাইকে নিয়ে চিন্তা করত। এই সবাই কি মানুষ ছিল?
প্রশ্নের উত্তর আরো প্রশ্ন নিয়ে আসে.. সেগুলো আরো। এভাবে মুহুর্তগুলি কেটে যায় দুপুরের খাবার নিয়ে যখন পাশের ‘পাইপের’ ঝর্ণা ছালার ওপারে গলাখাকারি দিয়ে বলে,
‘মামু, জাইগা আছ? তোমার লাগি খানা লিয়ে আইছি।’

ঝর্ণা শিহাবের দখল করা পাইপটির পাশের পাইপ-পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্য। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলীর দুই মেয়ে। লিলি আর ঝর্ণা। লিলি-ঝর্ণার মা বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে। সেই থেকে ওরা এই পাইপে পাইপে জীবন কাটাচ্ছে। তবে ওদের জীবনের শুরুটা ঠিক এমন ছিল না। গ্রামের বাড়িতে সবাই মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিল। আজমত আলী তখন সুস্থ। নিজের জমিজমা চাষ করে দিনগুলি ভাল-ই কেটে যেত। নদী-ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এই পরিবারটি আরো কিছু পরিবারের মত পথে বসে গেল। উপায় না দেখে আজমত আলী ঢাকা এলো। শুরু হল রিক্সাওয়ালা আজমত আলীর বস্তিজীবন। ঝর্ণার মা ছালেহা ঠিকা ঝির কাজ নেয় মানুষের বাসায়। নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে এই পরিবারটি।

একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় আজমত আলীর রিক্সাটি দুমরে মুচরে গেল। শরীরের নিচের অঙ্গ থেতলে যায়। একটা পা কেটে বাদ দিলে উপহার স্বরূপ ক্রাচ পায় আজমত আলী। বিধাতার উপহার?
তখন পুরো পরিবারটির দায়িত্ব ছালেহা বেগমের ওপর পড়ে। দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে সে। শ্রেফ স্বামী ও দুই মেয়ের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড়ের জন্য। বড় মেয়ে লিলি মায়ের সাথে কাজে যায়। কিন্তু মানুষের অমানুষ সুলভ আচরণে সে বাসায় কাজ করতে পারে না। নারী লোভী বেশ কিছু জানোয়ার আমাদের সমাজে মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ায়। এরাই লিলিদেরকে খেয়ে-পরে বাচার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।

একদিন সকালবেলা ছালেহা বেগম কাজে যায় না। আজমত আলী ডাকতে গিয়ে দেখে, আর কখনো সে কাজে যাবে না। বিধাতার থেকে দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করে আজমত আলী। ভিক্ষুক জীবনের শুরুটা সেদিন থেকেই। এবার বাপের সাথে ভিক্ষুকের সহকারী হিসেবে লিলি কাজে নামে। ঝর্ণা বাসায় থাকে। কিছুদিন বস্তিতে থাকলেও পরে এই পরিবারটি পাইপে শিফট হয়ে আসে। বাপ আর বড় বোন সারাদিন ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসে, ঝর্ণা সেগুলো রান্না করে। এ ছাড়াও সে টুকটাক কাজ করে। কাজের তো আর শেষ নেই কোনো পরিবারে। হোক না সেটা পাইপ-পরিবার।

এই হল এক নজরে ভিক্ষুক আজমত আলীর পরিবারের গল্প। এরকম অনেকগুলি পরিবার এই রেললাইন সংলগ্ন পাইপে বাস করছে। এদের সবার-ই যার যার মত করে আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে। একজন উর্ধতন কর্মকর্তা শিহাব, এদের মত না হয়েও এদের সাথে থাকছে। পঙ্গু ভিক্ষুক আজমত আলীর একটা পাইপ ওর জন্য ছেড়ে দিয়েছে সে। কেন দিলো কিংবা শিহাব এখানে কেন, সে আরেক গল্প। ওটাও আমরা জানব, তবে যে শিহাবকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করছে, তাঁর অনুভবেই একজন উর্ধতন কর্মকর্তার গল্পটি আমরা শুনব।

#উপন্যাসঃ_উর্ধতন_কর্মকর্তার_পাইপজীবন

৪,২১৩ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “উর্ধতন কর্মকর্তার পাইপজীবন: উপন্যাস”

মওন্তব্য করুন : মামুন

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।