★★ধূসর পান্ডুলিপি★★

জানালার পাশ ঘেষে দু’সারি গ্রিল। মাঝখানে এক চিলতে ব্যালকনি। তার ওপাশে আয়তাকার জমাট আঁধার বুকে নিয়ে এক মহানগর। তবে নাগরিক জীবনের পথ চলায় যাতে ছন্দপতন না ঘটে, দিগন্তব্যাপী ‘সুপারস্ট্রাকচার’ গুলো বিভিন্ন বর্ণচ্ছটায় মায়াবী নরম আলোয় মোমের মতন রুপালী তরল!
ক্যানাবিসের মিষ্টি অনুভবে চিন্তাভাবনার জগতে সুস্থির শিহাবের সবসময় এমনই মনে হয়।

আজ বিকেলে লেকের পাড় ধরে হেঁটে আসার সময় ওদেরকে দেখেছে সে। এই সময়ে প্রতিদিন এই গ্রুপটিকে দেখা যায়। অতি সাধারণ একদল ছেলেমেয়ে। অসাধারণ!
সামনে প্রাণের উৎসব বইমেলা। নতুন বই বের করা নিয়ে ওদের ভিতরের উত্তেজনা পথচারীদের মাঝেও কেমন উৎসবের আমেজ এনে দেয়।
একঝলক তাজা হাওয়ার আলতো ছোঁয়ায় শিহাব জানালার গ্লাসে দৃশ্যমান নিজের অবয়বকে দেখতে পায়।

কি দেখে সে?
নিজেকে দেখা কি খুবই সহজ?
একরোখা, জেদী, চরম অসামাজিক একজন মধ্যবয়ষ্ক সুপুরুষকে দেখা যায়। জীবনের প্রতিটি ধাপে বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত একজন একা মানুষ।

ছেলেগুলোর কথার চিন্তাসূত্র ধরে, নিজের একসময়ের এই লেখালেখির কথা মনে পড়ে শিহাবের।
একটু কি বিষন্ন হয় সে? বুকটা পুড়ে যায়? কিংবা স্মৃতিরা বকুলের বুকের বাসি বেদনার মত গুমরে মরে?
শিহাব নিজের চিন্তাজগতে সময়ের পেছনে আরো কিছু ধাপ পিছিয়ে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রবেশ করে।
সময়ের ঘ্রাণে সুক্ষ্ণ অনুভবে কম্পমান এক বিশেষ সময় ছিল.. সেই সময়!

আর এই সময়?
নিজের মনের খোরাক মিটানোর জন্য অনুভূতিগুলোকে ওদের নিজেদের মত ছেড়ে দিতো। নিজের মত হও – অনুভূতিদের ভিতরেও এমন অনুভব এনে দিতে চাইতো কি? এই সময়টুকু ঝিনুকের বুকে মুখ লুকানো মুক্তোর মত পরম নির্ভরতায়, একান্ত নিজের – এমন অনুভূতিতে থেকে থেকে প্রগলভ হয়ে উঠতে ভালো লাগে শিহাবের। তখন অপরিণত ওর ভিতর একজন পরিণত লেখক সত্তার জন্ম হয়েছিল।
যখন সহস্র নক্ষত্র দিকভ্রান্ত হয়ে বিভ্রান্তির ভ্রান্তিবিলাসে নিমজ্জিত হয়, একজন লেখকের তখন জন্ম হয়।
কিন্তু সময় তখন এমনই দু:সময় ছিল, জন্ম নেয়া লেখক সত্তা, অনুভবে অন্তরীণ এক অপরিণত ‘হা-বালক’কে ঘিরে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
এই ই… সব… পরম পাওয়া?

একজন লেখক পাঠকের গল্প বলেন। তার দু:খকে তুলে ধরেন, পাঠককে ঘিরে হাসি-আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচনা করেন।
একজন পাঠক কি লেখকের দু:খ অনুভব করেন? মানুষের জীবন- সুখ দুঃখের মহাসম্মেলন। একজন পাঠক কি একজন লেখকের না একজন মানুষের লেখা পড়েন? লেখকের ভেতরের মানুষ কি পাঠকের বুঝে আসে?
ভেবে ভেবে ক্লান্ত শিহাব।

আজ শিহাবের পান্ডুলিপিগুলোর ওপর এখন ধুলার দৃষ্টিকটু প্রলেপ!
ছ’তলার এই নির্জন ব্যালকনিতে দাড়িয়ে থাকা ওর ভিতরে জেগে উঠা নীরব এক দিগন্ত প্রসারিত নীলাকাশ , হঠাৎ কিছু মেঘবালিকাদের মন খারাপের কারণে, গালফোলানো গম্ভীরতায় শিহাবকে বিষন্ন করে তোলে।
যদিও এখন সেই অসময় কেটে গেছে; কিন্তু এখন তাঁর সর্বত্র এক মৃত লেখকের অপচ্ছায়া!
হায় সময়!
সময় একজন লেখককে নিয়ন্ত্রণ করে, না লেখক সময়কে?
শিহাব জানে না।
দর্পণে নিজের অপচ্ছায়ার পিছনে থাকা একজন শিহাব আজ নিজের ধূসর পান্ডুলিপি গুলোর মতই বিবর্ণ প্রায়।।

৪,৩৪৯ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “★★ধূসর পান্ডুলিপি★★”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    লেখকসত্বাটি প্রত্যেক মানুষের ভেতরই আছে। কারো মাঝে তা প্রকাশিত আর কারো মাঝে প্রস্তরীভূত।
    কারো হয়তো বিষয় এক কারো অন্য।
    তবে এ লেখায় যে অন্তর্দহন দর্পিত হয়েছে তা প্রবল শব্দের কারুকাজ নির্মাণমুখী।
    আরো লেখার প্রত্যাশা থাকলো তাই।

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বিভিন্ন বর্ণচ্ছটায় মায়াবী নরম আলোয় মোমের মতন রুপালী তরল- চমৎকার কথা!
    একজন লেখক পাঠকের গল্প বলেন। তার দু:খকে তুলে ধরেন, পাঠককে ঘিরে হাসি-আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচনা করেন। একজন পাঠক কি লেখকের দু:খ অনুভব করেন? - সংবেদনশীল পাঠকেরা করেন।
    বক্তব্য উপস্থাপনা ভালো হয়েছে। এত অল্প কথায় একটা গল্পের কাঠামো দাঁড় করানো সহজ কথা নয়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।