কেবিন নাম্বার ৩১৮

হাসপাতালের দরজা পার হয়ে ভিতরে ঢোকার পর থেকে আনাম নিজের হার্টবীট অনেক জোরে শুনতে পাচ্ছিলো। দেখলো বাবা শুয়ে আছেন শান্তভাবে। আনামের মনে হল, শব্দে ভরা পৃথিবীটা হঠাৎ নিরব হয়ে গেছে। শব্দটা আচমকা থেমে গিয়ে অদ্ভুত অনুভুতি সৃষ্টি করল আনামের সারা শরীর মনে। মনের ভিতর নি:শব্দ আবেগ সাড়া দিল, ‘ আব্বা! ‘

বাবা কি সেই কথা শুনলেন! চোখ খুললেন। বাচ্চাদেরকে নিয়ে রুমু আনামের আগেই কেবিনে ঢুকেছিল। বাবার পায়ের কাছে বসে ছিল রুমু। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার ঠিক পাশে বাচ্চারা কেবিনের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। আনাম এক পলক স্ত্রী সন্তানের মুখে চোখ বুলিয়ে বাবার দিকে ফিরল। বাবা চোখ খুলে নাতনীদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। আনামের মনে হল বাবা তার অনুভুতি প্রকাশের শক্তি পাচ্ছেন না। শুয়ে থাকা বাবার দুই পাশে পড়ে থাকা হাতগুলি দেখে আনামের পা গুলি ভারী হয়ে গেল। ওই হাতদুটো ধরার জন্য সে এতটা পথ এসেছে! কেবিনের দরজা থেকে বেড পর্যন্ত জায়গাটা কি তার চেয়ে দূর! এতদূর! অসহায় লাগল আনামের। মনে মনে স্রষ্টাকে ডাকল,’ আল্লাহ!! ‘ একটা কিছু প্রচন্ড শক্তি তাকে যেন ঠেলে রুম থেকে বের করে দিতে চাইল! সেই শক্তিটাকে অনেকটা জোর করে দরজা থেকে সরিয়ে আনাম ভিতরে ঢুকল।

এখানে শূন্যতা। নি:সীম। আনাম ওই বুক খালি অনুভুতি নিয়েই খানিকটা যন্ত্রের মতো বাবার কাছে এগিয়ে গেল। বাবার একটা হাত ধরল। বাবা জেদী বাচ্চার মত স্বরে বললেন, ‘ আনাম, আমার জুতাগুলি দে ‘।

আনাম হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল। বাবার শব্দে কিছু অচেনা থাকলেও তার ভালো লাগল। সে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করবেন!’
বাবা বললেন, ‘বাসায় যাব!’
আনামের কষ্ট হল। সে তার বোধ দিয়ে বাবার অনুভুতিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল।
কি দুর্দান্ত মানুষটি আজ কেমন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন! তাঁকে খাইয়ে দিতে হচ্ছে, টয়লেট করিয়ে দিতে হচ্ছে । তিনি এই বদ্ধ কেবিনে একদন্ডও থাকতে চান না। কিন্তু নিরূপায়। কারো কিছু করার নেই! নির্দয় সময়! শুধু এই বেডটা থেকে নেমে জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে কেবিনের দরজার বাইরের ওই বারান্দাটাতে বাবা হেটে যেতে পারছে না! আনাম যদি হাউমাউ করে কাঁদতে পারত!
তার মুখে হাসির মত এক রকম ভংগি হল। বাবার হাতটার ওপর অন্য হাতটাও রেখে দুই হাতে হাতটা আঁকড়ে ধরল। বাবা লক্ষী ছেলের মত ওভাবেই চুপচাপ শুয়ে রইলেন। এক পলক আনামের মনে হল সে বুঝি বাবা! বাবা বুঝি সে নিজে!

সময়টা উড়ে চলে গেল!
বিদায়ের সময় উপস্থিত!!
জীবন কতটুকু সময়!!!

বাচ্চারা দাদার বেডের পাশে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলল। রুমু মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছিল। ওর হাসিতে বিষাদ। বাবা নিস্পৃহ। আনামকে ফিরতে হবে। সে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলো। রাজধানীর জীবন বিশাল অজগরের মত হা করে আছে। তার ভারী শ্বাসে তীব্র টান! আনামের ছুটি শেষ। সে মাথা নিচু করে বাবার পায়ের কাছে বসে ছিল। বাবা কি রাগ করেছে? আনাম চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। বাবার মুখের ওপর থেকে হালকা আনন্দের আলোটা মুছে গেছে। অন্ধকার। বাবার মুখের সেই অন্ধকার তীরের মত তীব্র গতিতে বিঁধল ছেলের মনে।

ঐ মুহুর্তটাতে সময় যেন ছেলের চোখে থমকে গেল… সময়? কোন সময়? সেই বাবার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখার সময়? কাঁধে চড়ে বিশ্বভ্রমনে বের হবার সময়? সকল আনন্দঘন সময়ে এই দৃঢ় হাতটি কত নিশ্চয়তা দিয়েছে, সেই সময়? সকল বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করার সময়ে মানসপটে যে মানুষটির ‘থাকাটা’ ভেসে উঠেছে, মনোবল অক্ষুন্ন রেখেছে- সেই সময়?
অথচ আজ আরো একটু থাকতে চেয়েও কেন থাকতে পারলো না? পারছে না? বাসের টিকেট চারটা পনেরোতে… চাইলেও কেন কিছু করা যায় না? কেন বাবার কাছে আরো একটু বেশী সময় থাকা যায় না?

বিদায় নিতে গিয়ে রুমুর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। চোখে জল বের হবে হবে এই অবস্থায় শ্বশুরকে বিদায় জানিয়ে সে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। বাচ্চারা মাকে অনুসরণ করে। ছোট ভাইয়ের পাশে শুয়ে থাকা বাবা… বাবার হাতটা ধরে আনামের মনে হয় বাবা যেন একটু নিশ্চয়তা পেতে চায় ছেলের কাছে! সে মনে মনে বলে,’ বাবা! তোমার কিছু হবেনা, সব ঠিক হয়ে যাবে’… ঠিক যেভাবে বাবা জীবনের প্রতিটি পরাজিত সময়ে ছেলেকে বলতেন…বাবার সেই আত্মবিশ্বাসী ভরসা, আশ্বাস সবই আনামের মনে প্রতিধ্বনি তুলল, নিরবে। সেই স্বর, সেই আশ্বাস বাবাকে দেবে বলেই কি সে এতটা পথ ভেংগে আসেনি? আনাম অনুভব করল, বাবার ব্যক্তিত্বের শক্তিটা সে এখনো অর্জন করতে পারেনি! কেন মুখে কথা ফুটছে না!
মাথা নিচু করেই অস্ফুট উচ্চারণে আনাম বাবাকে কী যে বলল- সে নিজেই ভালো করে শুনতে পেল না। তার সমস্ত মন আক্ষেপে ভরে গেল, আজ কেন বাবাকে বাবার মত সে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলতে পারলো না?

ঢাকার বাসে উঠে আনাম তার পাশের বউ বাচ্চা সব বেমালুম ভুলে নিজের মনের ভিতর ডুব দিয়ে রইল।… বাবার চোখে কি জল ছিল বের হয়ে আসার সময়ে? না হলে কেন চোখে চোখ রাখতে পারলেন না? নিজেকে সে স্পষ্ট দেখছিল। বাবার দিকে পিছন না ফিরে কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে একজন অক্ষম সন্তান, যে তার বাবার কাছে আরো কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিল!

বাবা! যার অনেক চাওয়া-পাওয়া এই ছেলে পূরণ করতে পারেনি। হয়তো পেরেছে। কিন্তু শেষবার চোখে চোখ কেন রাখলেন না বাবা?? আমার কষ্টগুলি বাবাকে কে বলবে? একজন সন্তানের অক্ষমতা, বৃত্তাবদ্ধ কর্পোরেট জীবন, অভাব, পারিবারিক সম্পর্কগুলোর টানাপোড়েন, অসুস্থ প্রতিযোগিতা এসব কিছু- বাস্তবে সবটুকু কি গুছিয়ে বোঝানো যায়? স্মৃতিগুলি স্পষ্ট। ঘুরেফিরে মূহুর্ত গুলি কখনো শব্দ, কখনো ছবি হয়ে সামনে এসে চলে যাচ্ছিল। আনাম ঠিকভাবে চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে সব ঝাপসা করে দিয়েছে! তার মন শ্রবণাতীত চিৎকারে জগৎ সংসার শতচ্ছিন্ন করল-

‘পৃথিবী!
কেন তুমি সন্তানদের বাসযোগ্য হচ্ছো না!!!’

রুমু স্বামীর মুখের দিকে বিষন্ন মমতা নিয়ে তাকিয়ে ছিল। আনামের চোখে তা ধরা পড়ল না। তার স্মৃতির সমান্তরালে সমান গতিতে বাস ছুটছিল। বাসের গতি সামনে, আনামের মন ছুটছিল কখনো শৈশবে, কখনো বর্তমানে , কখনো নিজের অনাগত বার্ধক্যে! যেখানে এখন বাবা শুয়ে আছে! কেবিন নাম্বার ৩১৮ তে..
৩১৮ নাম্বার একটা নাম্বার হতে পারে… একটা নিছকই নাম্বার। কিন্তু সেখানে একজন বাবা শুয়ে আছেন…

৯৯২ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “কেবিন নাম্বার ৩১৮”

মওন্তব্য করুন : মামুন

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।