দ্য লাস্ট পেইন্টিং

আজিজ মিসির আর রেবেকার ডিভোর্স হয়েছিল পনের বছর আগে । সেটার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ ও ছিল।দেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হিসেবে মিসির নিজের ছবি, আর্ট কম্পিটিশন নিয়ে এতোটা ব্যস্ত থাকত। বড় লোকের মেয়ে রেবেকা যদিও ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, কিন্তু ওর ওকে সময় না দেয়াতে সে ধীরে ধীরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে মিসিরের উপরে।
রেবেকার বাবা-মা যদিও মেয়ের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেম, কিন্তু তাঁরা চাইতেন ভার্সিটি থেকে চারুকলায় গ্রাজুয়েট মিসির ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে একটা সরকারি জবে ঢুকে যাক। রেবেকা আর মিসিরের মাঝখানে বসে তারা দর কষাকষি করতে লাগলেন। রেবেকা আর মিসির একে অন্যের কাছ থেকে মনে মনে হাজার মাইল দূরে সরে গেলেন। ওদের বারো বছরের সাজানো সংসার যেদিন ভেঙ্গে গেল, সেদিনটার কথা আজ মিসিরের তেমন পরিষ্কার ভাবে মনে নেই। অনেক বছর ভুলে থাকা দিনটা!
সবই কি ভুলে গেছে?
আজিজ মিসির কি নিজেকে ভুলেছে?

আজিজ মিসির। একজন স্বনামধন্য, ধনাঢ্য চিত্রশিল্পী। অয়েল পেইন্টিং এর কাজ তার পছন্দ। এই মাধ্যম নিয়ে তার কাজের সুনাম দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেশের বাহিরেও ছড়িয়ে পড়েছে। যখন দেশে ছিলেন, তখনো দেশের মানুষের কাছে তার পেইন্টিঙয়ের কদর ছিল। তবু যখন দেশের মানুষদের ভিতরে শুধুমাত্র একজন মানুষের কাছে তার কদর কমে গেল, সোজা দেশের বাইরে চলে গেলেন। গতপরশু পর্যন্ত ফ্রান্সই ছিল তার দেশ। সেখানের শিল্পী সমাজে আজিজ মিসির সমীহ জাগানো একটি নাম। চিত্রকলা এবং সাহিত্যের ভূবনে ফ্রান্স সর্বদাই একটি অন্যরকম আবেদন জাগানিয়া দেশ। সেখানে গত পনেরটি বছর ধরে একরকম নির্বাসনে কাটছিল আজিজ মিসিরের দিনগুলো।
বিষণ্ণ দিনগুলো… ঝরাপাতার মত এদিক সেদিক কেবলি সরে সরে যাওয়া।

রেবেকা ছিল সমগ্র দেশের ভিতরে একমাত্র সেই মানুষ, যার কাছে ওর কদর কমে গিয়েছিল। যার সাথে বিরোধ ওকে দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছিল। মনের ভিতর রাগ অনুভব করলেন আজিজ মিসির।
আশ্চর্য হয়ে মিসির ভাবে। জোর করে নিজেকে এত বছর ধরে ভুলিয়ে রাখার পর ও আজ তবু কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে!
বিদায়ের সেই দিনটিতে হৃদয়ের ভালো লাগার নক্ষত্রগুলো দু:খ বুকে নিয়ে একে একে হৃদি আকাশ থেকে ঝরে পড়ছিল অনবরত। আর মিসির একমাত্র মেয়ে ঝুমুর এর হাত ধরে নিজের বেডরুমে বসেছিল। তখন ঝুমুরের বয়স কত হবে?
দশ বছর?
হ্যা,ঝুমুরের বয়স এরকমই ছিল যখন রেবেকা আর মিসিরের ডিভোর্স হয়ে গেলো।

ঝুমুরকে যখন রেবেকা নিয়ে যেতে এলো ওর রুমে, রেবেকার বাবা-মা তখন গাড়ি বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। কোনো কথা হল না। মেয়ের হাত ধরে নিজের দিকে একটু টেনে নিল রেবেকা। চাইলে সেদিন মিসির জোর করতে পারত। মেয়েকে নিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হতো তাতে। কিন্তু তাতে ওর, ঝুমুরের কিংবা রেবেকার- কারোই কি ভালো হতো তাতে?
সেজন্যই মেয়ের হাত আলতো করে ছেড়ে দিয়েছিল।
একজন বাবার হাত থেকে উষ্ণতার প্রলেপ মাখানো একটি কচি হাত মুহুর্তে একজন অভিমানী মায়ের কাছে ফিরে আসে।
বিছানায় বসে থাকা মিসিরের দিকে পিছু তাকিয়ে সামনে এগিয়ে চলা ঝুমুরের কান্নাভেজা মুখটি-ই ছিল মিসিরের স্মৃতিতে সেদিনের শেষ দৃশ্য। ওখানেই স্থানুর মত বসে ছিল দীর্ঘসময়। একটা গাড়ির স্টার্ট হবার শব্দ… এবং ওর জীবন থেকে রেবেকার চলে যাওয়া…এর কোনোটিই কি সেদিন অনুভব করার মত অবস্থায় ছিল?

আজ দেশে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র একসময় ওর হাত থেকে ছুটে যাওয়া সেই কচি হাতটির কারণে। সেই হাত আগামীকাল অন্য কারো হাত ধরে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে রেবেকা ওকে ফোন করে ঝুমুরের বিয়ের খবর দিয়েছিল। বলেছিল, ‘ তুমি ইচ্ছে হলে তোমার মেয়ের বিয়ে অ্যাটেণ্ড করতে পার।‘
‘তোমার মেয়ে?’ এই দুটি শব্দ কানে বেশ বাজল মিসিরের।
আজ এতোগুলো বছর পরে ঝুমুর কেবলি ‘ওর মেয়ে’ হয়ে গেল? অথচ পনের বছর আগে এই ‘আমাদের মেয়ে ’ বলার জন্য কি জেদটাই না ধরে ছিল রেবেকা।
কেন ঝুমুর ‘আমাদের মেয়ে’ হতে পারল না?
এর জন্য কে দায়ী?

আজ পনের বছর পরে দেশে এসেছে। সাদাকালো অরণ্য- পাহাড়- নদী পার হয়ে মরুর ধুলো উড়িয়ে দুরন্ত ছুটে চলা ভাবনার লাগামহীন এক পাগলাঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা অতীতকে ভাবছিল এতোক্ষণ। কিছু নস্টালজিয়ায় ভোগাবার মত স্মৃতি মুহুর্মুহু রং বদলে হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে কনফিউজড করতে চাচ্ছে।
কিছু অনুভূতি… কিছু স্বপ্নকে সাথে নিয়ে হৃদয়ে বিচরণ করা গভীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশ্বাসগুলো… দুর্দান্ত গতিময় স্বপ্ন – স্থবির বাস্তব – অর্থহীন –সম্ভাবনাহীন?
অথবা কি সম্ভাবনাময়?
কী রং তাদের?

নিজের রুমে ফিরে এলো মিসির। দেশে এসে এখানেই উঠেছে। ওর বন্ধু জহিরের ফ্ল্যাট। সে এখন সপরিবারে দেশের বাইরে। ফোনে কথা হল যখন, মিসির দেশে আসছে শুনে ওর ফ্ল্যাটেই থাকবার জন্য জোর করল। কেয়ারটেকার রয়েছে। সেই ই ওর দেখাশুনা করছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
আজ করার মত কিছু নেই। রাতে একবার রেবেকার সাথে কি দেখা করবে? ঝুমুরের সাথেও এখনো দেখা হল না। অবশ্য মোবাইলে কথা বলতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে হল না। কেমন এক অবসন্ন অনুভূতি!
জেট লেগের অবসন্নতাকে কাটিয়ে উঠলেও কেন এই অবসন্নতা? জীবনের কাছে হার মেনে যাওয়া দুর্বার কিছু অনুভূতির গলা টিপে নিজেকে নিজের ভিতর থেকে তুলে আনতে প্রচন্ড এক ইচ্ছে শক্তি আসা যাওয়া করছে ওর ভিতর। কিন্তু ইচ্ছেটা এক্সিকিউট করার জন্য পর্যাপ্ত মনোবলের অভাবে ফিরে আসতে পারছে না সে।

গতরাতে একটা ছবি আঁকা শুরু করেছিল।
নির্দিষ্ট কিছু নয়। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেয়েছিল। তাই ওর কাজের ক্ষেত্রটাকে বেছে নিল সময় কাটানোর জন্য। রং আর তুলির সমন্বয়ে ওর হৃদয়ে অনেক আগে থেকে প্রচ্ছন্ন একটি মুখচ্ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে চাইল। একটু একটু করে অগ্রসর হল। জীবনের সকল মেধা-দক্ষতা ব্যবহার করে সেই হাসিমুখটিকে তুলে আনতে চাইলো। কিন্তু রাতে কিছুই হল না।
নিজেকে এক বর্ণান্ধ শিল্পী বলে মনে হল। একজন কালার-ব্লাইন্ড! যা কিছুই আঁকে – যে রং এ আঁকে – কিছুই দেখেনা।
গত পনের বছরে আঁকার অসহ্য তাড়না ছবির পর ছবি আঁকিয়ে নিয়েছে মিসিরকে দিয়ে।
আজ মনে হচ্ছে সে বুঝি নিজেই দেখে না কী আঁকে!
আজ জীবনের ক্যানভাসে আঁকা ছবিটায় ও কোন রং নেই।
ছবি জুড়ে শুন্যতা। শুন্যতা যেন হঠাৎ সারা পৃথিবীতে।

ক্যানভাসে অস্পষ্ট মুখচ্ছবিটির দিকে তাকিয়ে মিসির ভাবে। ওর অনুভূতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন বলে যেতে চায়, “ আমি একা! বড্ড একা! … আমাকে নি:সংগ করে রং গুলো সব বারান্দার চড়ুইগুলির মতো পালিয়েছে… আমার আকাশে ইচ্ছে ঘুড়িগুলোরও কোনো রঙ নেই… আকাশটা জানি নীল… সেখানে কষ্টের বিষাক্ত নীলাভ আভা নিয়ে দুঃখগুলো সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়।“
যদিও মিসির জানে পৃথিবী রঙে রঙে ভরা। তারপরও ওর মনে হচ্ছে হরেক রঙের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে এক বর্ণান্ধ শিল্পী। হাতের তুলিটি পাশের কাঠের টুলে রাখা ব্রাশ পটে রেখে দেয়।
নিঃসঙ্গ মিসির ঐ ফ্ল্যাটে বসে একটি প্রিয় মুখ আঁকতে গিয়ে বার বার হোঁচট খায়। সেখানে সঠিক মুখটি ভেসে ওঠেনা।
তখন ওর মনে এই চিন্তা আসে, সে আসলে কাকে আঁকতে চাচ্ছে? রেবেকাকে? সে হলে কোন রেবেকাকে? যাকে সে ভালোবেসেছিল তাঁকে? নাকি যে ওকে ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল, একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি তাকে?
আবারো ভাবে, নাকি ঐ মুখটি ওর মেয়ে ঝুমুরের? কোন ঝুমুরের? কচি হাত ধরে বাবার কাছে থাকতে চেয়েছিল যে বাবুটি, তার? নাকি এখন এতগুলো বছর পরে অন্য কারো হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করতে চাওয়া এক পঁচিশ বছরের তরুনীর? যার কাছে তার বাবার কোনো স্মৃতি নেই। থাকলেও সেখানে তেমন কোনো রং কিংবা উজ্জ্বলতা নেই। তাই যদি ওর মুখটি মিসিরের অবচেতন মনে থেকে থাকে, তবে সেটিকে সে কিভাবে রং দিয়ে ফুটিয়ে তুলবে?
বিক্ষিপ্ত অসংখ্য ঘটনা থেকে জন্মানো অগণিত হ্যা আর না এর মধ্যে পড়ে মিসিরের মন বিশৃংখল হয়ে আছে। এ জন্যই কি ক্যানভাসে নির্দিষ্ট কোনো মুখচ্ছবি আসছে না? রং ও ফুটছে না? রেবেকার দ্বৈত সত্ত্বা এবং ঝুমুরের দ্বৈত সত্ত্বা মিলে ওকে কনফিউজড করছে?

ফ্ল্যাটটা ছোট কিন্তু এটাকে বেশ বড়ই দেখায়। ইন্টেরিওরের বাহাদুরি। মিসিরের ক্লান্ত চোখগুলি বারান্দার রেলিং এর ওপাশে ঝুলানো অর্কিডের সবুজে শান্তি খুঁজছিল। আপনমনেই হাসল মিসির। শান্তি! শান্তি এখন সুদূর অতীত। নিজের অজান্তেই মিসির অনেক আগের এক বিকালে ফিরে গেল। অবেলায় গোসল করে বারান্দায় বসে চুল শুকাচ্ছিল রেবেকা। একটু ঠান্ডা ও লাগিয়ে ফেলেছিল। ওর বসার ভংগিটাতে কী যেন ছিল। মিসির হাতের কাজ ফেলে রেবেকার ছবি আঁকতে বসল। এত দ্রুত আলো বদলাচ্ছিল, মিসিরকে প্রায় পুরো ছবিটাই আঁকতে হয়েছিল স্মৃতি থেকে। ছবিটার এক পাশে, ছায়া যেখানে আলোর সাথে মিলেছিল সেই জায়গাটা অপূর্ব হয়েছিল। সেই ছবিটা থেকেই মিসিরের খ্যাতির শিখর অভিমুখে যাত্রা শুরু। সেই খ্যাতি শেষ পর্যন্ত প্রিয় সেই মুখটাকে আড়াল করে পাহাড়ের মত অটল দাঁড়িয়ে গেল! আচমকা এক গভীর শ্বাস পড়ল মিসিরের। ইচ্ছে থাকলে এক পায়েও লোকে পাহাড় ডিংগায়। মিসিরের যদি ইচ্ছে হতো, এই আড়াল কি সে পার হতে পারতো না? পার হয়ে কার কাছে যেতো? রেবেকা কি সেই রেবেকা ছিল তার?

নিচে কার মোবাইলে রিং হল। বিচিত্র একটা রিংটোন শোনা গেল। স্মৃতির ঘোরে রেবেকার মুখটা ছুঁয়ে দেয়ার জন্যই হয়তো হাতটা বাড়িয়েছিল। খেয়াল হতে বিষন্ন হাসল। নিজেকে সামলে নিল মিসির।
স্মৃতিকে এর বেশি সময় দেয়া যায় না। মিসির ভিতরের রুমে গিয়ে লাগেজ খুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করল। মেয়ের জন্য কিছু গিফট আছে। দেয়ার আগে আরেকবার দেখা দরকার।

বিশাল ক্লাবঘর আর তার সামনে আরো বিশাল সবুজ লনে নানা রং এর আলো। গেইটের সামনে গাড়ি পার্ক করতেই চোখ পড়ল রিসেপশনে দাঁড়ানো রেবেকার ওপর। এত বছর মানুষ এমন একইরকম থাকে! ভালোলাগা মন্দ লাগা বোধের আগে খচ করে একটা শক্ত কাঁটার খোচা লাগল মিসিরের মনে। আজকাল মানুষের বয়স যত বাড়ে তত বোধ হয় কমেই যায়! মিসির ও আগের চেয়ে সুন্দরই হয়েছে। কিছু সৌন্দর্য্য এসেছে বিত্ত, খ্যাতি আর আরামের হাত ধরে, কিছু যুগের ফ্যাশনে। রেবেকাকে দেখে মিসিরের অল্পবয়সীদের মত ঈর্ষা হল হঠাৎ। সবাই দেখে এই রূপ, শুধু মিসির না! অথচ কত মন দিয়েই না দেখতো মিসির! অভিমান হল কি? চোখ রেবেকার চোখে পড়ার আগেই সরিয়ে ছিল, মন ফিরাতে একটু সময় লাগল মিসিরের।

গাড়ি থেকে নামতে নামতে রেবেকার সাথে চোখাচোখি হবার প্রস্তুতি নিল মিসির।
কে যেন ডেকে রেবেকাকে ভিতরে নিয়ে গেল। মিসিরের আসলে পথে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছিল। দুই একজন আত্মীয় এসে এগিয়ে নিল মিসিরকে।

আকদ আগেই হয়ে গিয়েছিল। স্টেজে মেয়েকে বিয়ের সাজ দেখে চিনল মিসির। পাথরের মত লাগল নিজেকে ওর। কত সুন্দর লাগছে ঝুমুরকে! কান্না আসতে কি চাচ্ছে! মিসির অসহায় বোধ করল। কেন এত ভাংচুর হল? আজ সে নিজের মেয়ের বিয়েরে আগন্তুক! আবার মনে হল, কেন সে আসতে গেল? কে যেন ঝুমুরকে ফোন করল। সে রিসিভ করে মাথা নাড়ল, কিছু বলল। মোবাইল অফ করে স্টেজের সামনে কাউকে খুঁজল। মিসিরের উপর তার চোখ এক মুহুর্ত স্থির হল।নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে গেল ঝুমুর। মিসির হঠাৎ বুঝল ঝুমুর স্টেজ ছড়ে বাবার কাছে আসছে! ঝুমুর নেমে আসতেই মিসির, রেবেকা এবং ঝুমুর সামনাসামনি হয়ে গেল।

ঝুমুর বাবাকে ধরে ছোট বাচ্চা মেয়ের মত সমস্ত মেক আপ নষ্ট করে ফেলল কেঁদে কেটে। রেবেকার বিউটি পার্লার ফেরত চোখে পানি টলমল করে উঠল। মেয়ের বিদায়ের কষ্টে, না এক সময়ের গভীর ভালোবাসার মানুষকে এত বছর পর কাছে পেয়ে, মিসির ধাঁধায় রইল।
কথা হল। কিছু ভদ্রতাও হল। কিন্তু মিসির বা রেবেকা কেউ কারো সীমানার বাইরে আসতে পারল না। তবু দুজনেই বুঝল, ঝুমুর তাদের বন্ধন হয়ে রয়ে গেছে! থাকবে। স্বামী-স্ত্রীর ভিতরে ডিভোর্স খুব সীমিত কিছু আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র! বিচ্ছেদ আসলে পরিপূর্ণ হয় না কখনো! মিসিরের সাথে রেবেকার সম্পর্ক এই স্বামী-স্ত্রী বাদ দিয়ে ঝুমুরের বাবা-মার হয়ে থাকবে বাকীটা জীবন। এই অনুভূতি নিয়েই মিসির আবারো ফ্রান্সে ফিরে যায় নিজের নির্বাসিত জীবনে। রেবেকা সামান্য অস্বস্তি বোধ করল। অহংকার যাদের অলংকারের মত প্রিয় তারা একে সহজে হারাতে চায়না। আরেকটা নতুন জীবন এত গুলো বছরে গড়ে উঠেছে, রেবেকার তাকেও ছাড়তে মন চাইল না। সে থেকে যায় যেভাবে এই ক’বছর ছিল। ঝুমুরের নতুন জীবন শুরু হল। ঝুমুর ভাবল , কোন অবস্থায় সে তার বাবা মায়ের করা ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। তাদের সামনের দিনগুলিতে তারা সবাই ভালো থাকবে, হয়তো আরো ভালো থাকবে…

ফ্রান্সে নিজের রুমে আজিজ মিসির। যে দূরে চলে গেছে, তবু এত কাছে,…তবু দূরে… তার মুখ ক্যানভাসে আঁকার চেষ্টা করছে।
শেষ তৈলচিত্রে আঁকছে হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা – ভালো লাগা দিয়ে সেই হাসিমুখ।
এ কি ভালোবাসা! এ কি ভালোলাগা! তীব্র কষ্ট যেন হিমাংকের বহু নিচে নিয়ে যায় ওর আংগুলগুলোকে।
তুলি এঁকে যায়।
সে কি ভুল রেখা ভুল রঙে আনন্দ আঁকে! দিশেহারা লাগে। আনন্দ নেই! ক্যানভাসে শুধুই সাদাকালো কষ্টের ছাপ – তার মুখচ্ছবি! একজন রঙ বিশেষজ্ঞের জীবনের শেষ ছবিটি – অজানা রঙে আঁকা। অতিপরিচিত একদার আনন্দে উদ্ভাসিত হাসিমুখ! সে আজ কষ্টের তীব্রতায় বিবর্ণ, পাংশুটে। রং নেই। রেখাগুলি কথা শুনবে না! ক্যানভাসে আঁকে যেন তার কষ্টভরা মুখ নয়, এক অহংকারী শিল্পীর ব্যর্থতার ছবি!
মূর্ত উপহাস!

(শেষ)

৯৮২ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “দ্য লাস্ট পেইন্টিং”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এত সুন্দর গল্পটা কি কেউ পড়লো না?
    নাকি পড়েও কারো কিছু লিখতে মন চাইলো না?
    তারপরেও যে আবারো গল্প পোস্ট করেছো, তা দেখে, মানে তোমার এই রেজিলিয়েন্স দেখে :
    :boss: :boss: :boss:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    একটু একটু যেন ধরতে পারছি। তোমার গল্পের কাহিনিতে তেমন বিশেষত্ব নেই। তোমার কারবার হচ্ছে আড়ালে, অনুচ্চারে চলতে থাকা ভাবনার স্রোত নিয়ে। বড় কঠিন পথ বেছে নিয়েছ।
    কিছু কিছু কথা যেমন দুর্দান্তঃ

    অহংকার যাদের অলংকারের মত প্রিয় তারা একে সহজে হারাতে চায়না।

    :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন
    • মামুন (১৯৮৪-১৯৮৪)

      তুমি নিজেও লিখা নিয়ে কেবলি অন্যদের মত গতানুগতিক ভাবে পড়না, এটাও বুঝে আসল। অনেকের কাছে তুমি হয়তো একজন 'ভয়ংকর পাঠক' এই গূনের কারনে। কিন্তু তোমার মত এরকম লিখা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে, তীক্ষণ অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে চায়, এরকম পাঠক (যে নিজেও লেখক) খুব কমই পাওয়া যায়।
      আমি তোমাকে লাল সালাম জানালাম ::salute::


      নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।