গুরুকে জুতা মেরে তারপর গরু দান

লাউফুল চৌধুরী । একে তো লাউগাছের ফুল তারসাথে আবার চৌধুরী। নামটা নিয়ে সুযোগ পেলেই রসিকতায় মেতে ওঠে ছাত্ররা। নতুনদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে বলা হয়, নামটা শুনে সুন্দরের যত সুবাস পাওয়া যায় নামটা আসলে ততই দূর্গন্ধ ছড়ায়। পোলাপান আড়ালে আবডালে কেউ ডাকে খ্যাক, কেউ ডাকে খ্যাত ।

তিনি আবার শিক্ষক মানুষ। সে সুবাদে স্যার শব্দটাও যোগ হয়েছে সাথে। ইশকুলে তার নাম হয়েছে খ্যাক সাহেব, খ্যাত স্যার.. অনেকে তাকে চুম্বক বলেও ডাকে। সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তিনি একটু ঝুকে যান বলে তার সম্পর্কে একটা অপপ্রচার আছে দুষ্ট ছেলে মহলে। তবে সুধী মহলেও নাকি এসব ব্যাপার গোপন নেই। তারাও নাকি অনেকে প্রত্যক্ষদর্শী।

কিছুদিন আগে তার সাবজেক্টের পরীক্ষার নম্বর জানানোর পর তো সবাই অবাক! ফারহানা হাইষ্ট পেয়েছে। আহমেদের সাথে ফারহানার আবার বেশ ঘন সম্পর্ক। আহমেদকে ফারহানা পরীক্ষার পরেও মন খারাপ করে পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কথা বলেছে। নম্বর শোনার পর আহমেদ ফারহানাকে সেকথা মনে করিয়ে দিল। ফারহানা তখনও বলল বিশ্বাস কর দোস্ত আমার খাতায় কিছুই নাই। আমি নিজেও অবাক এই নম্বর শুনে।

আহমেদও মনে করে দেখল ফারহানা আসলেই মিথ্যে বলেনি। পাশাপাশি পরীক্ষা দেয়ার সময় ফারহানার খাতার দিকে চোখ গিয়েছিল কয়েকবার। আসলেও খাতায় তেমন কিছু দেখেনি সে। বেরসিক আহমেদ হঠ্যাৎ বলে উঠল, স্যার ফারহানা তো নিজেই বলতেছে ওর খাতায় কিছু নাই। আপনি হাইষ্ট মার্ক দিলেন কিভাবে? স্যারকে একটু বিব্রত মনে হল। তারপর সামলে নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, আমি খাতা দেখেই নাম্বার দেই।

তরুন বয়সেই তিনবার বিয়ে হওয়া এক সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করার জন্য দোকানের আড্ডাতেও ছাত্ররা তার বউ ভাগ্য নিয়ে খুব আফসোস করে। এক দুষ্ট ছেলে নাকি সেদিন বলেই ফেলেছিল লাউফুল কিন্তু এখানেও চতুর্থ। প্রথম, দ্বিতীয় , তৃতীয় শ্রেণীর আশেপাশেও নাই। হালায় তো ফেল মারা ছাত্র। কি আর পড়াইব। অরে কিছু কইয়া লাভ নাই। সার্টিফিকেটটা তুইলা লই। তারপর সুযোগমত শীতের রাইতে একবার শালারে ধইরা আইনা নেংটা কইরা পতাকার খুটির সাথে বাইন্দা রাখমু।

সকালে যখন সবাই দেখবো লাউফুল নেংটা , তার উপর সারা রাতের ঠান্ডায় কুকরাইয়া কাঁপতে কাঁপতে কাঁনতেছে কেমন হবে ব্যাপারটা! জন্মের মতো শিক্ষা হবে না শালার?-তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে লাউফুলকে নিয়ে আড্ডাটা শেষ হয় সেদিন।

মির্জার মাথাটা আজ প্রচন্ড গরম। সন্ধ্যায় নিজের রুমে বসে একা একা গজগজ করছে। এমন সময় রুমে ঢুকেই প্রেজেনটেশন কেমন হয়েছে আজ তা জানতে চাইল নক্ষত্র। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মির্জা বলল, ভাই লাউফুল আসলেই একটা খ্যাত। লাউফুলের পিন্ডি চটকিয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মির্জা বলল, ভাই জানেন আজকে খ্যাক কি করছে?

-নক্ষত্র বিস্মিত হয়ে বলল, আজ না প্রেজেনটেশন ছিল তোমাদের? -আরে প্রেজেনটেশনের মধ্যেই তো… একটু পরপর মনে করেন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে :এই কোন কথা হবে না। আমি কোন শব্দ শুনতে চাই না। কথা বললে তাকে জিরো দিব..। একদম বাজে অবস্থা। -বড়ভাই সুলভ গাম্বীর্য বজায় রেখে নক্ষত্র বলল , প্রেজেনটেশন এর সময় কথা বলার কি দরকার? -মেরিনাদের গ্রুপ প্রেজেনটেশনের সময় কি একটা ব্যাপার যেনো হেলাল বুঝতে পারেনি। সেটা ফিসফিস করে জানতে চেয়েছিল হাসানের কাছে। ব্যাস হয়ে গেল। সাথে সাথে ষাঁড়ের মতো চেচিয়ে উঠল খ্যাত। এসে রোল নিয়ে গেল। আর বলে গেল দুই জনকেই নাকি জিরো দিবে। তারপর হেলাল স্যারকে অনেক অনুরোধ করে বললো স্যার জিরো দিলে আমাকে দেন শুধু। হাসান শুনতেও পায়নি আমি ওকে কি বলেছি। তখনতো বোঝেনই খ্যাকের অবস্থা । ব্যাপক ভাব নিয়ে যা তা বকল আর কি !

-চিন্তিত মুখে নক্ষত্র বলল, কি আর করার । গাইগরু দিয়া হাল চাষ করাইতে গেলে এমনই হয়। গাইয়ের কাজ দুধ দেয়া, জমি চাষ করা নয়। আর এখনতো কাক-শুয়োর এরাও শিক্ষক হয়। আসলে এরা শিক্ষক হয় না। শিক্ষকের সুবিধাভোগী হয়। মির্জার চোখের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র বলল, শিক্ষক পদবীটা বিক্রি করে দারুন ব্যবসা হয় জানোতো। এনজিও, মিডিয়া সব জায়গাতেই কদর বেড়ে যায়। এজন্যই এরা শিক্ষক হওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করে। তাছাড়া নির্লজ্জ্বের মতো কিভাবে তারা ক্লাসে বলে : আমি যদি শিক্ষক না হয়ে ওটা হতাম তাহলে আমার বেতন হতো একলক্ষ আশি হাজার টাকা। চোখেমুখে রাগ আর ক্ষোভ ঝড়িয়ে নক্ষত্র জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল , অথচ খোঁজ নিয়ে দেখ অন্য চাকরি ছেড়ে এই শিক্ষকতায় আসার জন্য কত জায়গায় যে ফুয়েল খরচ করেছে তারা। কেউ নাকি চেয়ারম্যানের রুমে সুন্দরী বউকেও বসিয়ে রাখত ঘন্টার পর ঘন্টা। লজ্জ্বা ! লবিংয়ের চাকরি.. বোঝোইতো.. আর দশ বছর পর সবগুলার অবস্খাই এই রকম হবে। সার্টিফিকেটটা নিতে চাই শুধুমাত্র সামাজিক স্বীকৃতির জন্য। তাছাড়া কবে থুথু দিয়ে চলে যেতাম এদের মুখে।

সুন্দরী বউ চালানোর জন্য অনেক টাকা দরকার। এখন টাকার নেশায় পেয়েছে খ্যাক সাহেবকে। ইদানিং সে টাকার পিছনে দৌড়াতে এত ব্যস্ত যে কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠেছে। এমনকি মাঝে মাঝে স্মৃতিভ্রমও হচ্ছে নাকি তার। এইতো কয়েকদিন আগে গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল একটা।এটা অবশ্য অন্য ক্লাসে। নক্ষত্র , সুমি ও বিশ্বাস- তিনজনার একগ্রুপ। জমা দেয়ার বেশ কিছুদি পরে একদিন নোটিশবোর্ডে দেখা গেল খ্যাত সাহেব নম্বর ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সুমি ও বিশ্বাস ১৫ নম্বরের অ্যাসাইমেন্টে ১২ করে পেলেও নক্ষত্র পেয়েছে ০. কারণ জানার জন্য নক্ষত্র ফোন দিল স্যারের কাছে। স্যার প্রথমে অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেবার কথা অস্বীকার করলেন। নক্ষত্র তো অবাক হয়ে স্যারকে বোঝাতে লাগল। শুধু অ্যাসাইমেন্ট নয় এটার উপর ক্লাসে প্রেজেনটেশন ও করতে হয়েছে আমাকে। এটা ক্লাসের সবাই দেখেছে। এসব বলার পর খ্যাত সাহেব নক্ষত্রের রোল জানতে চাইল। নক্ষত্র রোল বলার পর ঠিক আছে আমি চেক করে দেখব বলে মহামূল্যবান সময় বাঁচানোর জন্য খট করে ফোনের লাইন কেটে দিলেন স্যার।কয়েকদিন অপেক্ষার পর অবস্থার কোন উন্নতি না দেখে নক্ষত্র আবার ফোন দিল স্যারকে। স্যার শুনেই বলল, তুমি তো অ্যাসাইনমেন্ট করো নাই। তোমার নাম নাই ওখানে। স্যারের মুখে এই ডাহা মিথ্যা কথাটা শুনে মাথায় আগুন ধরে গেল নক্ষত্রর। মনে মনে খ্যাকের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা শেষ করে খুব শান্ত ভাবে নক্ষত্র স্যারকে বলল, -স্যার, আমি নিজের হাতে কম্পোজ করেছি ওটা। তারপর সকাল বেলা নীলক্ষেত থেকে প্রিন্ট করে এনেছি। জমা দেয়ার আগেও আমি আমার নাম দেখেছি ওখানে। -না না। তোমার নাম নাই। -স্যার দেখেন, আপনি আমাকে নম্বর না দিলে দিবেন না । সমস্যা নাই। কিন্তু আপনি স্বীকার করেন আমার নাম আছে। খ্যাক তো পড়ছে মহা ঝামেলায়। সে এখন কি করে। সে আবার চেক করে দেখবে বলে ফোন রেখে দিল। কয়েকদিন পর নোটিশবোর্ডে নম্বরলিষ্টে ৮ নম্বর যোগ হয়েছে দেখে হেসে ফেলল নক্ষত্র। আরো কয়েকটি হিসাব মেলানোর চেষ্টা করল নক্ষত্র। প্রখমত, অন্য দুজন ১২ করে পেলেও আমাকে কেন ৮ দেয়া হল?একই অ্যাসাইনমেন্ট কিন্তু নাম্বার আলাদা কেন? দ্বিতীয়ত, ঠিক সময়ে সব কাজ করার পরেও আমার নাম্বার কেন প্রথমে দেয়া হলো না। তৃতীয়ত, প্রথমবার চেক করার কথা বলে সে যদি চেক করে দেখত তাহলেই সে ভূল সংশোধন করতে পারত। তারমানে সে চেক করে দেখে নাই। সে কেন মিথ্যা কথা বলল? কারণটা কি ?? বিদ্যুতের মতো নক্ষত্রের মাথার ভিতর চক্কর দিয়ে গেল কফি হাউসের কথা। ছবির মতো ভেসে উঠল সেই ক্লাস লেকচার। সার্ক কে কফি হাউস মনে করা হয় কিনা? এমন একটা প্রশ্নের উত্তরে স্যার সবার উপর নিজের মত চাপানোর চেষ্টা করছিলেন। তার মতে , বিনা দ্বিধায় সার্ককে কফিহাউস বলা যায়। আর আমি এটার বিরোদ্ধে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলাম। আমার যুক্তিগুলো খারাপ ছিল না। বাস্তবসম্মত কথাই বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, জাতিসংঘকে যদি কফি হাউস বলা যায় তাহলে সার্ক কেও বলা যাবে। জাতিসংঘকে কফি হাউস মনে না করলে সার্ককেও মনে করার কোন কারণ নাই। সেদিন স্যার ক্লাস শেষ করে দিয়েছেন। তবে তার ফলটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন অন্যভাবে। উচ্চস্বরে হেসে উঠল নক্ষত্র। শালা ছোটলোক!! আর কিছু বলতেও ইচ্ছে হলো না তার।

খোঁজ নিয়ে নক্ষত্র জানতে পারল খ্যাক সাহেব শিক্ষকতার সাথে সাথে অনেকগুলো সাইড বিজনেস নিয়ে খুবই ব্যস্ত। টাকা অগ্রিম নিয়ে বসে আছেন কয়েকটি পত্রিকার কাছ থেকে। অথচ লেখা এখনো শেষ হয়ে ওঠেনি। তারউপর বউ নাকি আবার আউট অব কন্ট্রোল! সব মিলিয়ে খ্যাত সাহেবের এখন লেজে-গোবরে অবস্থা। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পিছনে ব্যয করার মতো সময় কই তার!!এসব ভেবেই মনে মনে খ্যাকের গোষ্ঠি উদ্ধার করে প্রায় মাফই করে দিল তাকে নক্ষত্র। চলবে-

১,৭৮৪ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “গুরুকে জুতা মেরে তারপর গরু দান”

মওন্তব্য করুন : আলীম (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।