শুভ জন্মদিন, ১৯৯৯ ইনটেক

আজ থেকে ১৩ বছর আগে (03/06/1999) আমার জন্ম হয়েছিল, ক্যাডেট হিসেবে। ক্যাডেট কলেজে চান্স পাবার পর যেই বাবা সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন, তিনি কাঁদলেন। চোখের  জলে আমাকে বিদায় দিলেন মা। আমি বুঝলাম, আমার এতদিনের সাজানো জীবন থেকে আামাকে সরিয়ে দেয়া হল। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে আমি কাঁদলাম না। কিন্তু সেই রাতে সীমাহীন শূণ্যতা আমায়  জাপটে ধরল। আমি কেঁদে বালিশ ভিজালাম। আমার  বিগত জীবনের মূত্যু হল। নতুন এক অনাকাঙ্খিত  জীবন লাভ করলাম। যে জীবন ক্যাডেট নম্বর ১১০৭, কক্ষ নং ৩২৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাউস, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের জীবন।

সাতদিন পরে ছুটিতে গেলাম। ঘোষণা করলাম, আর ক্যাডেট কলেজে ফিরে যাব না। আমাকে জোর করে আবার পাঠানো হল। আমি এইবার টিকে গেলাম। অলস আমি নানা রকমের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে ক্যাডেট জীবন সহজ করে ফেললাম।

সেই গল্প  থাক। আজ আমাদের বন্ধুত্বের জয়গান গাই। দুষ্ট প্রকৃতির আমি সবসময় বেঁচে যেতাম আমার প্রথম রুমমেট  আদনানের কারনে। ভদ্র প্রকৃতির এই ছেলেটার চেহারাটা ছিল  এমন যে আমাকে শাস্তি দিতে এসেও অনেক সিনিয়র ওকে শাস্তি দিয়ে চলে যেত। আমি বেঁচে যেতাম। অলস আমি কোন কাজ করতে চাইতাম না, সবসময় ফাঁকি দিতাম। বন্ধুটি সব কাজ করত, কোনদিন অভিযোগ করেনি। আদনান আজ কিন্চিৎ অসামাজিক, খুব একটা যোগাযোগ করেনা। তবুও যখন দেখা হয় তখন বুঝি আমাদের বন্ধুত্বে একটুও ফাটল ধরেনি।

এরপর থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করেছি খারাপ চেহারার  রুমমেট নিতে। এজন্য আমার হাউসের জনৈক ক্যাডেট একাদশ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় আমার রুমমেট ছিল। সিনিয়রদের মাধ্যমে আমি জোর করেই তাকে নিতাম, যদিও সে চাইত না। আমি তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

কথায় কথা এসে যায়। আজও আমরা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সূর্যসেন হলে আড্ডা দেই। প্রধান বিষয়বস্তু থাকে ক্যাডেট কলেজের ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতিচারণ। রায়হান আজ অবিশ্বাসী; মাহমুদ প্রচন্ড বিশ্বাসী, দাড়ি রেখেছে, পাঁচ  ওয়াক্ত নামাজ পড়ে; ইমরান দর্জি, টেক্সটাইলে চাকরি করে; আমি এখনো বেকার, পড়াশুনা করি; সাজ্জাদ ডাক্তার, এখনো কাজে ফাঁকি দেয়; ইন্জিনিয়ার রহমান ডক্ শ্রমিক, শুধু ছুটি কাটায়; জাহিদ সদ্য পরীক্ষা শেষ করে নিজেকে ইন্জিনিয়ার দাবি করে; সাইফ ডাক্তার, খ্যাপ মারার গল্প শোনায়; আমাদের পঞ্চাশভাগ  বন্ধু সামরিক বাহিনীতে, আমরা আছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে; তবুও বেশিদিন এই বন্ধুদের না দেখে থাকতে পারি না। ইচ্ছে হলেই আড্ডায় বসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল আমাদের অস্থায়ী ঠিকানা।

শুধু  আমরাই না। বাকি ৯ ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরাও এমন। সবাই মিলি এক বিন্দুতে। ফয়েজ, জাহিদ, জিহাদ, তাজওয়ার, জহির, মুন্নী, লিজা, সামিয়া, নাবিলা, ইমতিয়াজ, রিজওয়ান, কাউসার, ইকবাল, নাসির, ইশহাদ, আমজাদ, তানিম, মুনতাসির,  মাজহার আর কার কার কথা বলব… লিখতে গেলে এই ব্লগ শেষ হবে না। ক্যাডেট বড়ই আজব চিড়িয়ার নাম, অন্যরা এই প্রজাতির মর্ম বিপদে না পড়লে বুঝবে না।

কঠোর নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকেও আমরা একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলাম। একই সাথে সকল কলেজের ক্যাডেটদের, এমনকি ক্যাডেট জাতির। আজ জীবনের প্রয়োজনে কেউ সামরিক, কেউ বেসামরিক; কেউ সামাজিক, কেউ অসামাজিক; কেউ বিবাহিত, কেউ অবিবাহিত; কেউ হতাশ, কেউ উজ্জীবীত… তাতে বন্ধুত্বের কি আসে যায়! এই বন্ধুদের ছাড়া জীবন আসলেই কল্পনা করা অসম্ভব। আমরা ক্যাডেট ছিলাম, আছি, থাকবো।

শুভ জন্মদিন, ১৯৯৯ ইনটেক। জয় হোক সমগ্র ক্যাডেট জাতির।

১,১১২ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “শুভ জন্মদিন, ১৯৯৯ ইনটেক”

মওন্তব্য করুন : আলী ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।