নটখানা – নীলফামারী

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তৎকালীন নীলফামারীর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অর্থাৎ সাকামাছাবন্দরকে কেন্দ্র করে নীল বাণিজ্যের বেসাতি গড়ে তুলেছিল বৃটিশ উপনিবেশকারীরা। বাণিজ্যের লক্ষী ভেবে অন্যান্য ভাগ্যান্বষণীদের মতই ইংরেজ ‘নট’ নামের এক ব্যাক্তি এখানে নীলের পসার সাজিয়ে বসে। নীলফামারী – ডোমার সড়কের যেখানে Danish Bangladesh Leprosy Mission অবস্থিত তার দক্ষিণ সীমানার প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্থাপনা আজও মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত সেই অধ্যায়ের স্বাক্ষী বহন করে চলছে। তার নামেই মৌজা ও গ্রামের নাম হয়েছে নটখানা। ভিন্ন মতও আছে, বিদ্রোহী আর অবাধ্য নীল চাষীদের এখানে লটকিয়ে কঠিন অত্যাচার করা হতো বলে স্থানের নাম প্রথমে লটখানা ও পরে নটখানা হয়েছে। ভারতের দক্ষিণাংশ থেকে আগত দূর্ধর্ষ এক জাতি নট। স্বভাবে হিংস্র, বেটে-খাটো সুঠাম দেহের অধিকারী, নিজ ভাষায় কথোকথনকারী তথাকথিত অসভ্য মানুষগুলো সব সময় মেতে থাকতো ডাকাতি-খুন-খারাবি-আহাজারি-মারপিট নিয়ে। সভ্য(?) ইংরেজরা আদিম নট জাতিকে তাদের সভ্য জগতে বরদাস্ত করতে পারলো না স্বাভাবিকভাবেই। অচিরেই দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে তাদেরকে কয়েদ করা হলো, আর যেখানে কয়েদখানা বানানো হলো তা আজ ‘নটখানা’ নামে পরিচিত – এমন তথ্যও পাওয়া যায়।

আনুমানিক ১৮৪৫-৭৬ খ্রীঃ দিকে আলোচ্য ইমারত তৈরী করা হয়েছিল। একতলা বিশিষ্ট স্থাপনাটি ভূমি থেকে প্রায় ৪.২৭ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। উত্তর ও পশ্চিম দিকের সিঁড়ি দিয়ে এই স্থাপনায় প্রবেশ করতে হয়। সাকুল্যে ৩টি কক্ষ রয়েছে যার মাঝেরটি আকারে অন্য ২টি থেকে বড়। প্রতিটি কক্ষে ৪টি করে দরজা আছে। মাঝের দরজা দিয়ে অন্য কক্ষে প্রবেশ করা যায়। প্রতিটি কক্ষেই ২ বা ততোধিক জানালা রয়েছে। ছাদের নীচেই ঘুলঘুলিও আছে। আই বীমের সাহায্যে বক্রাকারে ইটের গাঁথুনী দিয়ে ছাদ তৈরী করা হয়েছে। চুন-সুরকীর মশলা ব্যবহার করা হয়েছে নির্মাণ উপকরণ হিসাবে। ঘরের দেওয়াল ০.৫১ মিটার পুরু ও মেঝে পাকা। চারিদিক জুড়েই বারান্দা আছে। বারান্দার ছাদ ঘরের ছাদের থেকে খানিকটা নীচু। পশ্চিমের বারান্দার দক্ষিণ কোনায় আর একটি ছোট ঘর রয়েছে।

এই স্থাপনার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে মাটির নীচে একটি আয়তকার স্থাপনার ভিত্তি লক্ষ্য করা যায়। খামার চালু হলে পর যারা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হত তাদেরকে এইখানে রেখে চিকিৎসা করা হতো। যারা মারা যেত তাদেরকে পাশেই কবর দেওয়া হতো, অনেক বৃটিশদেরও নাকি কবর ছিল এখানে। এই স্থানের পাশেই আছে একটি কুয়া। কুয়াটি পাকা করা এবং এর দক্ষিন দিকে অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি পাঁচিল রয়েছে, সম্ভবতঃ গোসলের সময় আড়াল তৈরীর জন্য এমনটা করা হয়েছিল।

নীলকররা এই ইমারতটি কি কাজে ব্যবহার করতো তা আজ আর জানার উপায় নেই। তবে স্বাধীনতার পর এটি রক্ষীবাহিনীর শিবির হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। স্থানীয়রা পরিত্যাক্ত ইমারতটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি ক্লাব করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় সে উদ্যোগ ব্যার্থ হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয়রা। নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়নের নটখানা গ্রামে ‘নটখানা নীলকুঠি’ অবস্থিত।

স্থাপনার উত্তরে কুষ্ঠ রোগের জন্য নির্মিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর দক্ষিণে সরকারি কুষ্ঠ ও যক্ষা হাসপাতাল রয়েছে। ডেনমার্কের আর্থিক সহায়তায় এটি পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যে কয়টি কুষ্ঠ হাসপাতাল আছে সেগুলো মধ্যে এটিই প্রথম কুষ্ঠ হাসপাতাল – জানলাম স্থানীয়দের কাছ থেকে।

জানালা-দরজাবিহীন সম্পূর্ণ স্থাপনাটি এখন পরিত্যক্ত। এখানে আরো বেশ কিছু ইমারত ছিল বলে জানা যায়, সে সবের অস্তিত্ব এখন আর নেই। বড় বড়, উঁচু উঁচু পুরোনো আম, কাঁঠালের গাছ-গাছালির মাঝে একটি কারাগারও ছিল, আসলে সেটা ছিল নির্যাতনশালা। যে সব বীর চাষীরা নীল চাষ করতে চাইত না বা অগ্রাহ্য করত তাদেরকে কারাগারে শিকল বেঁধে কয়েদ করা হতো। চাষীদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠতো দিনের বাতাস আর রাতের অপার্থিব নির্জনতা। হায়!!! সভ্যতার মোড়কে কলংকিত মানবতা এখানে নির্লজ্জতার রক্তে সিক্ত।

————————————————————————————————————————————————

১৮ মে ২০১৭/খোলাহাটি

তথ্যসূত্রঃ

১. রঙ্গপুরের প্রত্নসম্পদ, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ, পৃঃ ১০৪/১২০/

২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পৃঃ ১২৮/

৩. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪০৫/

৪. নীল বেদনার নীল (নীলফামারী), পাভেল চৌধুরী/

৫. নীলফামারীর নীলকুঠি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০১৫/

৬. বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস, মোস্তফা তোফায়েল হোসেন, পৃঃ ৮৬/

৭. স্মৃতিবিজড়িত নীলকুঠি, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জুন ২০১৫/

৪ টি মন্তব্য : “নটখানা – নীলফামারী”

  1. সৈয়দ কামাল মোহাম্মাদ মুকুল !

    ইতিহাস ! ভাল লাগলো ! মডারেটর কে বলছি ,এই ব্লগে কি ক্যাডেট অভিভাবকদের লেখার সুযোগ দেওয়া যায় কি না ? কারন অনেক অভিভাবকের ই ক্যাডেট কলেজে র অনেক ভাল মন্দ অভিজতা আছে যা শেয়ার করা গেলে ভাল হত ! আর ছাপানর ক্ষমতা তো মদারেট এর হাতেই থাকছে তা হলে আর সমস্যা কি ! দেখুন অভিভাবকদের কে লিখতে দেওয়া যায় কি না - মংগল কামনায়অএক্স ক্যাডেট অভিভাবক !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদুল (২০০০-০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।