দিনাজপুর

হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উতপন্ন হয়ে নানা চড়াই – উতরাই ঠেলে প্রায় ১৬০ কি.মি. দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, প্রাচীন জনপদের নানা ইতিহাস রচনার মাধ্যমে; প্রাকৃতিক কারণে উrসমুখ হারিয়ে নির্জীব-ক্ষীন স্রোতধারায় আজও বহমান যে পুর্নভবা নদী, তারই তীর ঘেঁষে পৌরানিক কালে গড়ে উঠা এক সম্মৃদ্ধ জনপদ – দিনাজপুর। ‘পরশুরাম’ যিনি ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসাবে স্বীকৃত তার রাজ্যের অধীন ছিল দিনাজপুর। মৌর্য্য যুগে বগুড়ার পুন্ড্রবর্ধনে ছিল রাজা পরশুরামের রাজধানী। পুন্ড্রবর্ধন ভূক্তির বরেন্দ্র মন্ডলের অন্তর্গত দিনাজপুর – মহাভারতের মrস্য দেশের রাজা বিরাটের কান্তনগরের ‘বিরাট রাজার দূর্গ/গো-শালা’ কিংবা ঘোড়াঘাটের ‘অশ্ব-শালা’ সে সব পৌরানিক দলিল হিসাবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। এছাড়াও অসুর রাজ মহাবীর বান, বাল্মীকি, পঞ্চ-পান্ডবের ভীম কিংবা চাঁদ সওদাগরের পৌরানিক কাহিনীও যথাক্রমে গঙ্গারামপুর (বর্তমান ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত), নওয়াবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও বীরগঞ্জ উপজেলার সাথে সম্পৃক্ত এবং তা আজও কিংবদন্তীর মত প্রচলিত।

`দিনাজপুর’ নামকরণ নিয়ে নানা মত চালু আছে। কারো মতে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যাক্তি দিনাজ/দিনরাজ/দানুজ রায়/রাজা দানুজ মর্দন দেবের নামানুসারে দিনাজপুর নামকরণ করা হয়েছে। দিনাজ নামের এক ব্যাক্তি প্রথম এখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন বিধায় এলাকার নাম হয় দিনাজপুর – এমন মতও চালু আছে। ইতিহাসে বহু বিতর্কিত-আলোচিত ও রহস্যময় রাজা গনেশের এক উপপত্নীর পুত্রের নাম দিনরাজ খাঁ। কারো কারো দাবী দিনরাজ খাঁ‘র নাম থেকে দিনাজপুর নামের উrপত্তি। এ কথাও শোনা যায় যে, রাজা গনেশের রাজকীয় উপাধি ছিল ‘রাজদনুজমর্দনদেব’ আর সেখান থেকে দিনাজপুর নামের প্রচলন। আবার অনেকের বিশ্বাস, দিনা/দিনওয়াজ নামক এক রাখাল/মুসলিম দরবেশ/ফকিরের নাম থেকে স্থানের এমন নাম হয়েছে। দানৌজা নামক রাজার রাজধানী ছিল দিনাজপুর, সেখান থেকে এ নামের উদ্ভব – এমনটাও মনে করেন অনেকে।

বৃহত্তর রংপুর-গাঁইবান্ধা অঞ্চলের বর্ধনকোটি/বর্ধনকুঠীর জমিদার ইতিহাসখ্যাত। জনশ্রূতি আছে যে, দিনাজপুর রাজবংশের আদি পুরুষ ছিলেন বর্ধনকুঠী জমিদারের চাকর। সে অনেক অনেক কাল আগের কথা, প্রাচীন অখন্ড বাংলার এক উত্তর রাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ ভদ্রলোক, নাম ‘দেবকী নন্দন ঘোষ’ বর্ধনকুঠী জমিদার গণেশ নারায়ণের কর্মচারী ছিলেন। গণেশ নারায়ণ গত হলে তার পুত্র যদু নারায়ণ জমিদারি লাভ করে। ইত্য বrসরে দেবকী নন্দন ঘোষও গত হলে তার পুত্র হরিরাম ঘোষ বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। হরিরাম ঘোষের অপর নাম ‘দিনরাজ’। বাবার মত হরিরাম ঘোষও অচিরেই জমিদার যদু নারায়ণের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন।

এদিকে জমিদার যদু নারায়ণ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়। দিনরাজ তার কৌলিন্য বজায় রাখতে অকস্ম্যাত রাজকাজ থেকে ইস্তফা চেয়ে বসেন। অগত্যা যদু নারায়ণ দিনরাজের ভাল কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার হিসাবে উত্তর বাঙলার নবাবীসহ তাকে রাজকাজ থেকে অব্যহতি দেন। সদলবলে দিনরাজ দ্রূত তার নতুন ঠিকানায় আগমন করে। সবাই জানেন যে, উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে এ অঞ্চলের মানুষেরা ‘র’ কে ‘অ’ উচ্চারন করে থাকেন। ফলে তাদের কাছে দিনরাজ হয়ে যায় দিন-আজ > দিনাজ, আর দিনাজ যে স্থানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন তা হয়ে গেল ‘দিনাজপুর’।

মধ্যযুগে দিনাজের বাড়িকে কেন্দ্র করে দিনাজপুর মৌজার সৃষ্টি, দিনাজপুর মৌজা থেকে দিনাজপুর জেলার নামকরণ। বাংলার মুঘল দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানের সময় থেকে দিনাজপুর জমিদার ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত হন। যেহেতু পরবর্তীতে রাজবাড়িকে কেন্দ্র করেই শহরের বিস্তৃতি ঘটেছে সেহেতু এ রাজ পরিবারকে সম্মান দেখিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ কর্তৃক জেলার নাম রাখা হয় দিনাজপুর। যদিও ১৭৬৫ খ্রীঃ বৃটিশ দ্বারা ঘোড়াঘাট পতনের মধ্য দিয়ে দিনাজপুর বৃটিশ অধিকারে আসে, তথাপি ১৭৯৩ খ্রীঃ পূর্বে প্রশাসনিকভাবে দিনাজপুর জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

পরবর্তী সময়ে নানভাবে এ জেলা বিন্যাস্ত হয়েছে। আধুনিক দিনাজপুর আয়তন বিবেচনায় দেশের ১২তম বৃহত্তম জেলা। এ জেলা মোট ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। পৌরানিক উপাখ্যান-সমৃদ্ধ জনপদ, কোটিবর্ষ, পুন্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্র, পেন্টাপলিস, সুলতানি, মুঘল, বৃটিশ নৃপতিদের দ্বারা জবর-দখলকৃত দিনাজপুরে এখনো কমপক্ষে ২৬টি দূর্গ/গড়’র ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির কাল নির্দেশক। সভ্যতার অগনিত যে সব দ্রষ্টব্য মাটির নীচে এখনো রক্ষিত তা আগামী বিশ্বকে কেবল বিস্মিত করার অপেক্ষায়…।

২৪ মে ২০১৬/খোলাহাটি

তথ্যসূত্রঃ

১. দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি, এ.বি.এম. আব্দুস সাত্তার, পৃঃ ৯৭/

২. আলোকচিত্রে ইতিহাস, পৃঃ ১/

৩. দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র-৫, মেহরাব আলী, পৃঃ ১৫/১৯/২০/

৪. দিনাজপুরের ইতিহাস, ড. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান, পৃঃ ১৯/২৫৬-২৫৭/২৬৪/২৯৭/

৫. বাংলাদেশের মন্দির, ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, পৃঃ /

৬. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ৪১৬-৪১৭/

৭. বাংলায় ভ্রমণ, ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে(১৯৪০), পৃঃ ২২১/

১১ টি মন্তব্য : “দিনাজপুর”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো কথা ভাইয়া আপনি টাইপ করেন কোন সফটওয়্যার দিয়ে।
    বানান এর ব্যাপারে সাহায্য করতে পারতাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    রাজীব, আমি বিজয় ইউনিকোড ব্যবহার করি। লেখার সাথে ছবি যুক্ত করতে চাই, কিন্তু উপায় খুঁজে পাই নাই। আমি এ বিষয়ে একেবারে ‘ওরে নবীন, ওরে কাঁচা’ টাইপ, একটু বিস্তারিত না বলে দিলে ধরতে অসুবিধা হয়। ভাল থেকো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।