হযবরল!

সপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে সপ্তাহখানেক হলো বাসায় এসেছি, যদিও এখনো পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বিছানা বন্দী। আরো প্রায় দু সপ্তাহ এ অবস্থায় থাকতে হবে। তবে সত্যি কথা বলতে আমি খুব সম্ভবত জীবনের অন্যতম সেরা সময় কাটাচ্ছি, কারন প্রায় ২৪ ঘন্টাই আমার পাশে শুয়ে থাকছে নক্ষত্র। ছেলের প্রতিটা নড়াচড়া, অভিব্যক্তি এখন আমার নখদর্পনে। এমন কি এটাও এখন প্রায় বুঝতে পারি কোনটা ওর ক্ষুধার কান্না, কোনটা কাপড় ভিজিয়ে ফেলার, কোনটা কোলে চড়ার আর কোনটা নিছক দৃষ্টি আকর্ষনের। এ কদিনের অভিজ্ঞতায় মাঝেমাঝে খুব আফসোস হয় কোন ভাবে যদি ‘ফুল টাইম প্যারেন্ট’ হতে পারতাম কয়েক বছরের জন্য!

খন সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকার ছুটি পেলাম তখন তা জেনে পরিচিত বেশ কয়েকজন আমার খেলাধূলা নিয়ে পাগলামির কথা মাথায় রেখে মন্তব্য করেছিল বিশ্বকাপটা শান্তি করে দেখতে পাবো। সে সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু বিষয় হলো ক্রিকেট, বিশেষ করে ওয়ানডে আর টি টুয়েন্টি আমাকে একদমই টানে না। শুধু বাংলাদেশের খেলা হলেই দেখা হয়। এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল চলার সময়ও ঐ ম্যাচ থেকে আমি ফর্মূলা ওয়ানের মালয়েশিয়া গ্রান্ড প্রিক্স খুব আগ্রহ সহকারে দেখছিলাম। মালয়েশিয়া হতাশ করেনি, বহুদিন পরে আমার প্রিয় ফেরারি একটা রেস জিতলো তাও আবার ফেরারিতে নতুন যোগ দেয়া আমার আরেক প্রিয় ড্রাইভার ভ্যাটেল এর মাধ্যমে। পরে ফাইনালের স্কোরকার্ড দেখে মনে হলো আসলেই তেমন কিছু মিস করিনি। ক্রিকেটের এই অজনপ্রিয়তা দেখলাম শুধু আমার মাঝেই না, খোদ অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডও। দুই আয়োজক দেশ এর মাঝে ফাইনাল হচ্ছে, দর্শক টানার এর চেয়ে ভাল উপলক্ষ্য আর কি হতে পারে। কিন্তু দর্শক সংখ্যার একটা পরিসংখ্যান দেখে দারুন মজা পেয়েছিলাম। ফাইনালের দিন মাঠে দর্শক ছিল ৯৩,০১৩ জন। সেখানে কিছুদিন আগে একই মাঠে হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব লিভারপুল (যারা এখন নিজেদের লীদের ১ম চার দলের মাঝেও নেই) আর স্থানীয় দল মেলবোর্ণ ভিক্টোরীর মাঝে হয়ে যাওয়া প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের দর্শক সংখ্যা ছিল এইঃ
10371515_939244012774530_7405400261993664077_n

বিছানায় সারাক্ষন পড়ে থাকার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে প্রচুর টিভি দেখা হচ্ছে। সংবাদ আর টক শো বাদ দিয়ে বাংলাদেশী চ্যানেলে বিনোদনমূলক কিছু দেখার ব্যর্থ চেষ্টা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। যার ফলাফল হচ্ছে টীভির প্রায় সব বিজ্ঞাপন মুখস্থ হয়ে যাওয়া। এর মাঝে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনই মেজাজ বিগড়ে দেবার মত আর হাতে গোনা কিছু ভাল লাগার। তবে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে দুটি লুঙ্গির বিজ্ঞাপন। লুঙ্গি নিয়ে কেন কেউ এরকম কিছু করছে না সেটা অনেক আগে থেকেই আমার মাথায় ঘুরছিলো। নিজে যদিও লুঙ্গি তেমন একটা পরি না, তবে যখন পরি তখন বেশ আত্মবিশ্বাষের সাথেই আরাম করে পরি। বেশ পছন্দ হয়েছে বিজ্ঞাপন দুটো।

রীতিমত নির্লজ্জ জচ্চুরী করে বিশ্বকাপে ভারতীয়রা আমাদেরকে হারিয়ে দেবার কারনে আমাদের মাঝে এখন ভারত বিদ্বেশী মনোভাব ব্যাপক ভাবে কাজ করছে। দাবি উঠেছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলসহ তাদের সকল পন্য বর্জনের। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলী পন্য, তাদের সমর্থনকারী দেশ সমূহের পন্য, ডেনমার্কের পন্য বর্জনের জন্য বিভিন্ন মহলে আওয়াজ উঠতে দেখেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও কোন নির্দিষ্ট দেশের পন্য বর্জনের ডাক না দিয়ে সামগ্রিকভাবে বিদেশী পন্য বর্জন করে আমাদের দেশি পন্য ব্যবহারের পক্ষে সেরকম কোন আওয়াজ শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে সবসময় সচেতন থাকার চেষ্টা করি কোন কিছুর দেশি বিকল্প থাকলে সেটাই ব্যবহার করতে। কিন্তু এটাকে কি সরকার বা আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সমাজ অথবা সমাজ সচেতন নাগরিকেরা একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না?

ম্বা একটা সময় ধরে চিন্তা করছিলাম ফেসবুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেব। ফেসবুকে আমি মহোগ্রস্থ বা নেশাগ্রস্থ নই তবে ফেসবুকে সময় কাটানো আমি সাধারনত ভাল ভাবেই উপভোগ করি। দু সপ্তাহ স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার পর ফেসবুকের তিক্ত্য দিকগুলো কিছুটা ভুলে গিয়ে যখন আমি ফুটবল, মুভি, টিভি সিরিজ নিয়ে বা পরিচিত মানুষদের সাথে আবোল তাবোল আড্ডাবাজি হালকা মিস করা শুরু করলাম তখন আমার গেলাম একটু চোখ বুলাতে। কিছুটা সময় ভাল কাটলেও হঠাৎ সামনে চলে এল ভারতবিদ্বেষ জিনিষটা হিন্দু বিদ্বেষে পরিণত হওয়া, লাংগলবন্ধের পূন্যস্নানে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর খবরে মানুষের উল্লাসিত হওয়া আর সবশেষে আজ ওয়াসিকুরের হত্যার ঘটনার পরে ‘যদি’ ‘কিন্তু’ ইত্যাদি শব্দ জুড়ে সেটার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন আর মনে মনে তৃপ্তিলাভের ঘটনা দেখে আবারো ফেসবুকের প্রতি বিতৃষনা চলে আসলো। ভুল বললাম মনে হয়, বিতৃষনা আসলে ফেসবুক নয় এসেছে মানুষদের উপরে। আসলে নিজেই এখনো মানুষ হতে পারলাম না। একসময়ের চরম আশাবাদি আমি আজ আশার কোন আলো দেখি না। এর চেয়ে ফেসবুকের উটপাখির মত বালিতে মুখ ডুবিয়ে মতচোখ কানও বন্ধ করে রেখে মনে মনে ‘এই বেশ ভাল আছি’ জপতে থাকি, সেই ভাল।

!
শেষ প্যারায় এসে কারো ‘এই বেশ ভাল আছি’ মুড নষ্ট করে থাকলে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তাদের উদ্দেশ্যে এই গানটি নিবেদন করলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ যার প্রথম দশ স্তবক আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, তার পরবর্তী তিন স্তবক(যেটুকু জাতীয় সঙ্গীতের অন্তর্ভূক্ত হয়নি) এখানে গাওয়া হয়েছে।

শুভেচ্ছা!

২,৫২৪ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “হযবরল!”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    সেদিন ক্লাবে VB ওরফে Victoria Bitter এর প্রথম অভিজ্ঞতা হইলো! হেনিকেইনের চাইতে ভাল! 😛

    আমানত শাহ লুঙ্গির দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনটা দেইখা আমি সত্যিকার অর্থে অভিভূত। পুরা কট মি বাই সারপ্রাইজ। প্রথমটা দেখতাসি! =)) =))

    ফুল টাইম বাবা হবার ইচ্ছা আমার বহু আগের। যদি বউয়ের ঘাড়ে বইসা খাইতে পারি সেটা করার ইচ্ছাও আছে। বাকিটা সময় বলে দিবে।

    এই বছরটা কেন জানি মনে হচ্ছে প্রচুর ড্রামা হবে। মানে লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে। হ্যামিলটন বাহরাইন পাইলো, মালয়েশিয়ায় ভেটেল জানান দিলো, আমি হারায় যাই নাই। রসবার্গও বসে থাকার কথা না। এদিকে নতুন ছেলে রিকার্ডিওর দিকে তাকিয়ে আছি আমি। তবে ফরমুলা ওয়ানও কিন্তু অনেকটা দুই কান্ডারী রোগে রোগাক্রান্ত। ফেরারী, মার্সিডিজ এর ভাবচক্করে বাকিরা খাবি খাচ্ছে। রেডবুল সম্ভবত ফরমুলা ওয়ান ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে বসেও আছে।

    ওয়াশিক বাবু, ভারত নয় হিন্দু বিদ্বেষ, ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। প্রচুর টাকার চাকুরী, সুন্দরী বউ, ফুটফুটে বাচ্চা = life is beautiful until they come after me.

    আমি একটা দিনলিপি আধা লিখে বসে আছি। দেখি ছেড়ে দিব।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      দিনলিপি বেশিদিন তুলে রাখলে বাসি হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি নামিয়ে ফেল 🙂

      ফেরারি আর ভেটেল এর জয়টা মোটামোটি একটা শক ছিল, কতদূর কন্টিনিউ করে দেখার বিষয়। ফেরারির কার এবার যথেষ্ট ফাস্ট হয়েছে তবে এখনো মার্সিডিজ থেকে পিছিয়ে। রসবার্গ এর কনফিডেন্স লেভেল এবার কেমন জানি ডাউন মনে হচ্ছে। তবে আমি ফেরারির আরেক ড্রাইভার কিমি'র কাছ থেকেও একটা সারপ্রাইজ আশা করছি। রেডবুলের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, মালয়েশিয়ায় ওদের জুনিয়র টিম টোরো রোসোর দুই পুচকা ড্রাইভার রেডবুলেল মূল দুই ড্রাইভার থেকেই ভাল করছে।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আবারো ফুল ফর্মে!

    নক্ষত্রের পাশেই দ্যাখো
    শুয়েছে আকাশ!
    আলোকের ঝর্ণা ছুঁয়েছে
    আলতো হাতে, অবিরল;
    ওর হাসি নিয়ে
    থোকা থোকা
    নিজেকে সাজিয়েছে --
    কখনোবা বিহ্বল
    মৃদু অথবা সোচ্চার
    উঠেছে বলে,
    'খোকা,
    এ তবে আমার খোকা!'

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    তোমার মুচমুচে লেখার সাথে ভিডিও ক্লিপ গুলো খুব ভাল লাগলো। আমানত শাহ লুঙ্গির বিজ্ঞাপন আমার কন্যাকে দেখালাম। ও বলল, ছেলেগুলো স্কারট পরেও কত কনফিডেন্ট দেখো!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।