সবার উপরে মানুষ সত্য *

*শর্ত প্রযোজ্য

ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছি এই নীতি কথা, সবার উপরে মানুষ সত্য। কিন্তু এর সাথে যে একটি তারকা চিহ্ন যুক্ত রয়েছে খালি চোখে সেটা কখনোই নজরে আসেনি। ইদানিং কালে উপলব্ধি হচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ তারকা চিহ্ন আর তার সাথে জুড়ে থাকা শর্তের উপস্থিতি সম্পর্কে।

‘মানুষের’ কাছে আপনাকে মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে হলে আগে পূরণ করে নিতে হবে বেশ কিছু শর্তাবলী। এক কথায় বলতে গেলে ঐ ‘মানুষ’ গোত্রের মানুষ হতে হবে। তার অবস্থান, চিন্তাধারা, মতবাদের বাইরের কেউ হলে আপনি মানুষ হিসেবে গন্য হবার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

নিজেকে ‘মানুষ’ শ্রেনীতে উন্নীত করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ক্ষমতাবান হওয়া। আপনি যদি ক্ষমতাবান ব্যক্তি হন, তাহলে আড়ালে না হলেও সামনা সামনি আপনার ‘মানুষ’ হিসেবে সমাদর পাওয়া মোটামোটি নিশ্চিত। আর ক্ষমতাবান না হলে আপনার সামনে অপেক্ষা করছে বিভিন্ন স্তরের প্রতিবন্ধতা। এর ক্রমধারা তৈরী করা বেশ কষ্টসাধ্য, তাই আপাতত কিছু স্তরের কথা বলে যাই, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে যার ক্রমধারা পরিবর্তনশীল।

মানুষ হবার অন্যতম শর্ত আপনাকে পুরুষ হতে হবে, ভুলক্রমে আপনি মহিলা হয়ে গেলে আপনার জন্য দুঃসংবাদ। মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার সকল যোগ্যতা আপনি ভুমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই হারিয়েছেন। আপনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এখন মানুষদের কাজে, কামে, শোভাবর্ধনে নিবদিত হয়ে তাদের মন যুগিয়ে চলে যতটুকু সম্ভব জাতে ওঠা। এসব কাজে ব্যর্থ হলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে, তার জন্য শারীরিক এবং মানষিক উভয় ভাবেই প্রস্তুত থাকুন। তবে সাবধান, মানুষদেরকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলে তার শাস্তি পেলে ভুলেও প্রতিবাদি হবার চিন্তা করেন না। তাহলে সেখানেই আপনার সমাপ্তি।

পুরুষ বা মহিলা না হয়ে যদি কোন ভাবে আপনি তৃতীয় লিংগের কেউ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি পুরোপুরি হিসাবের বাইরে চলে গিয়েছেন। আপনি মানুষের কাজে, কামে কোন ভাবেই আসতে পারবেন না আর শোভাবর্ধনের তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনার জন্য একমাত্র করনীয় হলো স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আপনার উপস্থিতিই মানুষ মহলে অবাঞ্ছনীয়।

এতটুকু পড়ে যেসব পুরুষ নিজেদের মানুষ মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন তারা সাবধান। নিছক পুরুষ হয়েই আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। আপনাকে হতে হবে ‘আসল পুরুষ’। নিজ লিঙ্গের বাইরের অন্য দুই লিঙ্গের কাউকে যদি আপনার ‘মানুষ’এর মর্যাদা দেবার ইচ্ছে জাগ্রত হয় তাহলে সেখানেই আপনার নিজের ‘মানুষ’ মর্যাদার সমাপ্তি। ‘মানুষ’ মহলে তখন আপনার পরিচিতি হবে ‘লেডিস’ ধরনের পুরুষ বা হিজড়া হিসেবে। ভাগ্য ভাল হলে অনেকে অবশ্য এটাকে ভাবতে পারে আপনার মেয়ে পটানোর কৌশল হিসেবে। তবে সেই ঝুঁকি না নেয়াই ভাল।

লিংগ পরিচয় তো গেল, এবার আপনার ধর্ম পরিচয়। আপনাকে হতে হবে আপনার আশেপাশের ‘মানুষ’ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মের। অন্য কোন ধর্মে বিশ্ব্বাষী হলে ‘মানুষ’ হবার আশা ছেড়ে দেন। এখন আপনার কর্তব্য মুখ বন্ধ রেখে ‘মানুষ’দের সাথে মানিয়ে চলা। আপনাকে তাদের মাঝে অবস্থান করতে দেবার ক্ষতিপূরন হিসেবে আপনাকে কিছুটা ছাড় তো দিতেই হবে, হাজার হোক ‘মানুষ’দের মাঝে বসবাস বলে কথা! তাই যেকোন ধরনের কটু বাক্য, বাঁকা চাহনি আর যেকোন ধরনের বৈষম্য মেনে নিন হাসি মুখে। কারন এর মাঝেই বিষয়টা সীমাবদ্ধ থাকলে আপনি ভাগ্যবান। কারন উপরি হিসেবে হালকা মারধর, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও সবসময়ই আপনার জন্য অপেক্ষায় আছে। তবে শেষ সম্বল আপনার কাছে অবশ্য একটা পথ খোলা আছে। ফিরে যান আপনার ধর্মের ‘মানুষ’দের কাছে। সেখানকার ‘মানুষেরা’ আপনাকে ‘মানুষ’ মর্যাদা দেবে কি না তার নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও আপনার নিজের সমাজের ‘মানুষ’দের সন্তুষ্টির কারন হতে পারবেন এই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।

এবার আপনি যদি অতিশয় চালাক বা বোকা শ্রেনীর কেউ হয়ে সকল ধর্ম থেকেই যদি নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষনা দেন তাহলে আপনার জন্য আমার কিছু বলার নেই। নিজের পায়ে কুড়াল নিজেই মেরেছেন। যত দ্রুত পারুন নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। নিজে না পারলে অবশ্য খুব একটা চিন্তার কিছু নেই, আপনাকে সেই কাজে সাহায্য করার জন্য প্রচুর ‘মানুষ’ প্রস্তুত হয়ে আছে। যেকোন মুহুর্তে আপনার হয়ে তাদের কেউ কাজটা করে দিতে পারেন।

আগের মতই সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মের সবারই খুশি হবার সুযোগ নেই। বিধর্মী, নাধর্মীদের প্রতি আপনার মনোভাব প্রমাণ করবে আপনি ‘মানুষ’ কিনা। মনে রাখবেন, তাদেরকে আপনি যখনই মানুষ হিসেবে মনে করার চেষ্টা করবেন, সেখানেই আপনার ‘মানুষ’ হবার সমাপ্তি।

আপনার পেশাও আপনার ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কোন ভাবে আপনি যদি মেথর, সুইপার, চাকর, রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুক ইত্যাদি হাজারো না মানুষী পেশার কেউ হয়ে থাকেন তাহলে ‘মানুষ’ হবার কথা ভুলে গিয়ে বরং ‘মানুষ’দের সেবায় মনোনিবেশ করেন, ভাল থাকবেন।

‘মানুষ’ হবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো আপনার যৌন আকাঙ্ক্ষা। চুম্বকের ধর্ম মেনে বিপরীত লিঙ্গের দিকে ধাবিত হোন, নতুবা আপনার কখনো ‘মানুষ’ হওয়া হবে না। আর নিজের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকার পরেও যদি আপনি যদি সমলিঙ্গে আকর্ষিতদের প্রতি কোন সুহানুভূতি রাখেন তাহলে আপনিও ‘মানুষ’ হবার স্বপ্ন ভুলে যেতে পারেন।

উপরের শর্তগুলো সব পূরণ করে ফেললে আপনি মোটামোটি মানের ‘মানুষ’ হয়ে গিয়েছেন তবে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সময় এখনো হয়নি। এগুলো শুধুমাত্র প্রাথমিক কিছু শর্ত, এর বাইরেও আরো অনেক শর্ত রয়েছে, সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন শর্ত যোগ হচ্ছে। তাই চোখ, কান খোলা রেখে প্রস্তুত থাকুন, নিজের ‘মানুষ’ মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখুন। এটি বেশ কষ্ঠসাধ্য কাজ, সার্বক্ষনিক সতর্কতা জরুরি। তবে আনন্দের বিষয় একটাই, আপনি আপনার মস্তিষ্ককে ছুটি পাঠিয়ে দিতে পারেন। ‘মানুষ’ হবার জন্য সেটাও অতন্ত জরুরী।

২,২৮০ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “সবার উপরে মানুষ সত্য *”

    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      ধন্যবাদ মহিউদ্দিন 🙂

      মস্তিষ্ককে ছুটি পাঠানোর ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক ভাবে বোঝাতে পারিনি। আমি এটা দিয়ে আসলে অপ্রকৃতস্থ বোঝাতে চাচ্ছিলাম না, বোঝাতে চাচ্ছিলাম মস্তিষ্ককে কাজে লাগানো যাবে না, কারন কাজে লাগালে আর 'মানুষ' হওয়া হবে না।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    হিসাব করে দেখলাম দেহে মনুষত্বের পরিমান প্রায় শূণ্যের কোঠায়! 🙁


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    রফিক আজাদ একবার পাবলো নেরুদার একটা কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। শেষ লাইনটা ছিল এইরকম:
    "আমিতো চাইনা যেতে অন্য কোন গ্রহে
    এখানে আছি, এইতো আমার ভালো"

    ওটার সাথে সুর মিলিয়ে আমারও বলতে ইচ্ছা হচ্ছে:
    "আমিতো চাইনা হতে এই রকমের মানুষ
    যা আছি, তাইতো আমার ভালো"


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।