ঢাকা কাহিনী

আমার জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা পুরোটাই ঢাকায়, আরো নির্দিষ্ট করে বললে মিরপুরে। কিন্তু ৯৬তে কলেজে যাওয়ার পর থেকে ঢাকার মেহমান হয়ে গিয়েছি। প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে কয়েক মাস পর পর কিছুদিনের জন্য ঢাকায় বেড়ানোর মত করে। প্রতিবারই ঢাকায় গিয়ে নতুন কিছু দেখা হয়। কোনটা ভাল লাগে, কোনটা খারাপ আবার কিছু কিছু রীতিমত চমকে দেয়।

গত সপ্তাহেও এভাবে ঢাকা বেড়ানো হলো প্রায় পাঁচ মাস পরে। এই বেড়ানোর হালকা কিছু অভিজ্ঞতা নিয়েই এই লেখা। দিনলিপি ছাড়া কিছুই লেখার নেই আমার, আবার আমার গতানুগতিক দিনগুলো এতটাই রুটিনে বাধা যে তা নিয়ে লেখারও কিছু খুঁজে পাই না। তাই এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলাম না।

ঢাকায় গিয়ে আমার অবশ্য করনীয় একটা কাজ হলো হলে গিয়ে মুভি দেখা। সাধারনত সেটা বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সেই হয়, মাঝে মাঝে বলাকা। এবার নতুন একটা জায়গা হয়েছে, যমুনা ফিউচার পার্কে ব্লকবাস্টার্স সিনেমা। ‘গ্রাভিটি’ সিনেমাটা এতদিন ধরে না দেখে অপেক্ষায় ছিলাম হলে গিয়ে দেখবো বলে, নেট থেকে প্রদর্শনীর সময় দেখে জ্যামের কথা মোটামোটি ভাল সময় হাতে রেখেই বের হয়েছিলাম। কিন্তু সবসময়ের মত এবারো ঢাকার ট্রাফিক আমাকে হতাশ করেনি, গিয়ে পৌছালাম ১৫ মিনিট পরে। মুভি দেখার চিন্তা বাদ দিয়ে ভাবলাম মার্কেটটাই ঘুরে দেখি, যদিও পুরোপুরি চালু হয়নি, হাতে গোনা কয়েকটা দোকান মাত্র চালু হয়েছে। এর আকার, আয়তন আর দোকানগুলোর বিন্যাস দেখে মনে হলো এটা অতিরিক্ত রকমের বড়। প্রথম দু এক বার ঠিকমত চিনে উঠতে রীতিমত ট্রাভেল গাইড লাগবে।

ঢাকায় আমার নিয়মিত বাদাম, ফুচকা, চটপটি খাওয়ার জায়গা হলো ধানমন্ডি লেক। বছরের পর বছর ধরে যাওয়ায় বেশ কিছু অপরিচিত পরিচিত মুখ আছে। এর মাঝে একজন একটা ছোট্ট মেয়ে, পথ শিশু। চকলেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর কাউকে কিছু খেতে দেখলে সেটার ভাগ চায়। ও বিশেষ ভাবে আমাদের চোখে পড়েছিল ওর চুলের কারনে। তখন ওর চুল রাঙ্গানো। অবাক হয়ে আমার বউ কিভাবে করেছে জানতে চাইলে সে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করছিল কিভাবে চুলে হেয়ার কালার লাগাতে হয়। এরপর থেকে যত বারই দেখা হয়েছে ওর কাছ থেকে চকলেট কিনেছি সেই সাথে হালকা গল্প গুজব। এবার যেয়েও দেখলাম, চুলে রঙ নেই কিন্তু চোখে পড়লো সে বড় হয়ে উঠছে। হঠাৎ করে ওর সামনের দিনগুলো চিন্তা করে তীব্র হতাশা বোধ করা শুরু করলাম। শুধুমাত্র ভুল(?) পরিবারে জন্ম নেয়ার কারনে সে আহ! কি কিউট বেবি, সুইট বেবি না শুনে বড় হচ্ছে অন্যদের করুনা নির্ভর করে, আর প্রস্তুত হচ্ছে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছু শোনার জন্য। তবে আমার দৌড় ঐ পর্যন্তই, হালকা হতাশা বোধ, দুঃখবোধ, ব্লগে ফেসবুকে তা লিখে কিছু হাততালি কামানো আর নিজেকে মহান হিসেবে পরিচয় দেয়া। তারপর লেকের পাশের কেএফসিতে গিয়ে হাজার টাকা খরচ করে মুরগী খাওয়া।

ঐ লেকেই কিছুক্ষন পরে দেখলাম উলটো পরিবেশ, উলটো পরিবারে বেড়ে ওঠা এক তরুনী, আরো কয়েকজন ফ্রেন্ডদের সাথে খুব আনন্দ উচ্ছলতার সাথে আড্ডা দিচ্ছে, হাতে জ্বলছে সিগারেট। অনভ্যস্ত চোখ, অনভ্যস্ত মন জিনিষটা সহজ ভাবে নিতে পারলো না। ব্যাপারটাকে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া, স্বাধীনতা হিসেবে দেখবো নাকি উচ্ছন্নে যাওয়া হিসেবে দেখবো?

প্রতিবার ঢাকায় গিয়ে ছেয়ে মেয়েদের নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড চোখে পড়ে। এবার চোখে পড়লো মেয়েদের ওড়না। ভয় নেই, ওড়না পরার ধরন না, ওড়নার রঙ নিয়ে। অনেককেই দেখলাম রংধনূর সাত রঙের ওড়নায়। প্রথম দেখাতেই যেটা মনে করিয়ে দিয়েছিল LGBT মুভমেন্টের Rainbow Flag এর কথা। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল এই ওড়না পরে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছিল তারা LGBT মুভমেন্ট সম্পর্কে কি মত পোষন করে। কিন্তু সাহস করে আর জিজ্ঞাষা করা হয়নি।

বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ঢাকা সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে দেখলাম। এর অংশ হিসেবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সব দেশের পতাকা সহ একটা প্লাকার্ড লাগানো হয়েছে। অবাক হলাম পতাকার ক্রমধারা দেখে। বাংলাদেশের পতাকা সবার নিচে, আর এর উপরে বাকিদের পতাকাগুলো ঠিক কি হিসেবে সাজানো হয়েছে বুঝে উঠতে পারলাম না। এসব ক্ষেত্রে সাধারনত মনে হয় এলফাবেটিক অর্ডার মেনে চলা হয় কিন্তু এখানে হয়নি। ভিনদেশি জাতীয় পতাকার ব্যবহার নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে সেখানে শহর জুড়ে এভাবে পতাকার এলোমেলো ব্যবহার বেশ চোখে লাগলো।

৭ মার্চ বিকালে বেরিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের উদ্দেশ্য। পার্কে বাদাম খাওয়া আর স্বাধীনতা স্তম্ভ ঘুরে আসা, রথ দেখা আর কলা বেচা এক সাথে করার আশায়। টিএসসির দিকে যেতে দেখি মানুষের ঢল, মাত্র কোন সমাবেশ শেষ হয়েছে। এর মাঝে শুনতে পেলাম মাইকে হিন্দি গান ভেসে আসছে। একটা খোলা পিক আপ, সামনে বঙ্গবন্ধুর চেতনা নিয়ে বড় একটা ব্যানার ঝুলছে আর উপরে বাঁধা মাইকে বাজছে সেই হিন্দি গান, আর পিক আপে হাত পা ছুড়ে নাচছে বেশ কিছু নারী কর্মী আর তাদের নেতৃত্বে থাকা এক পরিচিত নারী নেত্রী মাউথ পিসে আহবান জানাচ্ছে আশেপাশের সবাইকে একটু মজায় অংশগ্রহন করার জন্য। মনে মনে বললাম, ভাল তো, ভাল না?

শুভেচ্ছা।

১,২০৬ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “ঢাকা কাহিনী”

    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      ইটা বেশি থুইও না আবার, ঢাকা এমনিতেই ইটার ভারে ডেবে যাওয়ার অবস্থা 😛


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        Rainbow Gathering LGBT movement নিয়ে আদৌ কিছু জানবে কিনা সেটাই সন্দেহ। মতামত থাকা তো দূরে থাক।

        অন্যান্য দেশের পতাকার সাথে বাঙলাদেশের পতাকা টাঙ্গানোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে আইনে। যদিও এই নিয়ে মাতামাতি করা নফল কাজ তাই আর বেশী কিছু বললাম না। :brick:

        মেয়েটার জন্ম ভুল পরিবারেই। এই পাপের বোঝা ওকেই টানতে হবে। তবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে সিগারেট হাতে নারী দেখা খুব একটা অস্বস্তিকর কখনোই ছিল না। নিজের নানীকে দেখেছি নিয়মিত ধুমপান করতে। তবে অবশ্যই সেটা জনসম্মুখে নয়। খাবার ঘরে নাতিদের খাওয়ানোর সময়। সেই ছোটকাল থেকে প্যাসিভ স্মোকিং এর শিকার আমি! 🙁 বাঙলাদেশের আপামোর জনতা দেখে অভ্যস্ত নয় তবে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। ঢালাও মন্তব্য করবো না, তবে পরিচিত নারী ধূমপায়ীর বেশীরভাগের হাতেখড়ি চোখের সামনে কারন ব্যাপারটা কেতাদুরস্ত বলে। হয়তো এর সাথে আধুনিকতাও মিশে আছে। আরো আছে নিয়ম ভাঙার আগ্রহ। সেই থেকে অভ্যাস। 🙂 (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    লেখা ভালো লাগল। চায়নীজ পেইন্টিংএর মতো। একটানে ছবি আঁকা।
    পথশিশুদের কষ্টকর জীবনের কথা তো আমরা জানি - কিন্তু আজকাল প্যালেসে বড় হওয়া অনেকের জীবনের পরিণতি দেখে মনে হয় যে কোন পরিস্থিতিতে একটি আনন্দদায়ক জীবন কাটানোর জন্য অর্থনৈতিক অবস্থার থেকে বুদ্ধিমত্তা, সচেনতা এবং পরিকল্পনা দরকার। এটি শুধুই আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
    আমরা অনেক সময় আধুনিকতার সাথে নতুন কিছুকে মেনে নেওয়া বিষয়টি একাকার করে ফেলি। যেমন ধূমপান বিষয়টি অস্বাস্থ্যকর। এখন রাস্তাঘাটে মেয়েদের প্রকাশ্য ধূমপানের বিষয়টি বাংলাদেশে নতূন হলেও তাকে আধুনিকতা বলে ভেবে নেওয়ার তো কোন কারণ দেখছি না। নতূনত্বতা তো আর অস্বাস্থ্যকর বিষয়টি অস্বীকার করতে পারে না। এটিও আমার ব্যক্তিগত মতামত।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      ধন্যবাদ আপু।

      যে কোন পরিস্থিতিতে একটি আনন্দদায়ক জীবন কাটানোর জন্য অর্থনৈতিক অবস্থার থেকে বুদ্ধিমত্তা, সচেনতা এবং পরিকল্পনা দরকার।

      দারুন বলেছেন :thumbup:

      ধূমপানের বিষয়ে আমিও খানিকটা এভাবেই ভাবছিলাম। যেখান ধূমপান বিরোধী ক্যাম্পেইন যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে চলছে সেখানে হঠাৎ করে পুরো নতুন একটা গ্রুপ আধুনিকতা বা যে নামেই হোক এটা শুরু করলে সেটা চিন্তার বিষয়।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      আপা ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যলয়ে যে কয়জন বন্ধুকে ধুমপান করতে দেখেছে তারা আমার সামনেই শুরু করেছে। তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করেছি শুরু করার কারণ কি। তারা বলেছে, "its fun and smoking is cool." বলেছি স্বাস্থ্যের কথা। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, "তুই কেন টানিস? জ্ঞান দিতে আসবি না।" আমার-আপনার কাছে আধুনিকতা না হলেও যারা শুরু করছে তাদের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিকই "cool" তবে যা বলছি ২০০৫ সালের কথা। এরমাঝে ৯ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখনকার খবর কি জানি। তবে বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বলে এখানে কোন সমস্যার উত্তরণ হয় অবনতি হয়। সেই বন্ধুরা আগে ঘেরাও দেয়া টঙ এর দোকানে বা ৫-৬ জন বন্ধুর আড়ালে টানতো । এখন হয়তো রাস্তায় বসেই টানে।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. দিবস (২০০২-২০০৮)

    একটা কথা সাহস করে বলে ফেলি। দেশে যেয়ে আমার যেটা মনে হয়েছে গত দুই বারে, দেশের ছেলে-মেয়েরা (২০-২৫) নীরবে হয়তো মানসিক রোগী হয়ে উঠছে হয়তো নিজের অজান্তেই। আমি জানি না আমার ধারণা কতটুকু সত্যি, তবে অনেকের চিন্তা ভাবনা, মানুষজনের চালচলণ এসব দেখে এরকম মনে হইছে। আর জনসংখ্যাটাকে আর কোনভাবেই সম্পদ বলে নিজেকে শান্তনা দিতে পারছি না।

    ব্লগে তারকা ব্লগারদের আনাগোণা, মন ভাল করে দিচ্ছে। 😀


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।