স্মৃতিকথাঃ রোজা পর্ব

এই লেখাটার শুরু হয়েছিল পুরো একমাস আগে, রোজার শুরুতে। আজ রোজা শেষ কিন্তু লেখা আলসেমির কারনে লেখা এখনো শেষ করতে পারিনি, তাও এক রোজা বেশি অর্থাৎ পুরো ৩০ রোজা পেয়েও না। আজকের চাঁদ দেখার খুশীতে ভাবাভাবি বাদ দিয়ে দিলাম পোস্ট করে। পোস্টের বাকি অংশ বেঁচে থাকলে হয়ত আগামী রোজায় আবার দিব, সে হিসেবে এটাকে একটা বাৎসরিক পোস্ট হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। আর পুরো পোস্ট জুড়ে নিতান্তই নিজের কিছু স্মৃতি নিয়ে প্যাঁচাল পেড়েছি, পড়ে বিরক্ত হলে সেজন্য আগেই দুঃখ প্রকাশ করে নিচ্ছি। আর কেউ যদি এই বিরক্ত হবার ঝুঁকি না নিতে চান তাহলেও কোন সমস্যা নেই, তারা শুধু শেষ লাইনটা পড়লেই হবে।

রোজার স্মৃতি বলতে স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে ইফতারের স্মৃতিগুলো সামনে চলে আসে। যে সময়টা থেকে রোজার কথা মনে আছে সে সময় আমরা অনেকটা যৌথ পরিবারের মত থাকতাম। বিভিন্ন বয়সের কাজিনদের মাঝে আমি সবার ছোট। রান্না ঘরে দুপুর থেকেই ইফতারের আয়োজন শুরু হলেও আমরা টের পেতাম বিকাল থেকে। প্রথমে ডাক পড়তো বিভিন্ন ইফতার আইটেমের ঝাল,লবণ ইত্যাদি ঠিক হয়েছে কিনা তা চেখে দেখার জন্য। এরপর ইফতারের সময় হয়ে আসলে এটা সেটা আগিয়ে দেবার জন্য। ততক্ষণে রেডিও চালু হয়ে গিয়েছে। এরপর সবাই মিলে ইফতার নিয়ে গোল হয়ে বসে আজানের জন্য অপেক্ষা। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও এটা সেটা খাওয়া চলতে থাকলেও এই সময়টা পুরো পাক্কা রোজাদারের মত মুখ করে বসে থাকতাম আর আজান হলেই খেজুর মুখে দেয়া। তখন মনে হয় রোজা পড়েছিল গরমকালে। সে সময় ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না, রোজার সময় তখন বরফ বিক্রি হত। বড় বড় বরফের এক একটা খন্ড, কাঠের গুড়ো বা ভূষি মাখিয়ে রাখা হত যাতে গোলে না যায়।

প্রথম কবে রোজা রেখেছিলাম মনে নেই, কিন্তু সেটা সেটা ছিল পহেলা রোজা। তখন জানতাম ছোটদের জন্য প্রথম রোজা আর শেষ রোজা রাখলে নাকি পুরো মাসের রোজা রাখা হয়ে যায়, তবে শেষ রোজাটা নিয়ে প্রায়ই একটা ঘাপলা হত, ২৯ রোজা হলে শেষ রোজাটা আর রাখা হত না, তাই প্রথম দিনেই ঈদের চাঁদ দেখা গেলে মনটা একটু খারাপই হতো। আরেকটু বড় হলে রোজা রাখার সংখ্যা বাড়তে লাগলো, এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতাও থাকতো। পুরো মাসজুড়েই কার কয়টা রোজা হলো সেটার র‍্যাঙ্কিং চলতো। অবশ্য বাসা থেকে সব রোজা দিন রোজা রাখার অনুমতিও পাওয়া যেত না, রীতিমত বায়না ধরতে হতো। এমনও হয়েছে, পরেরদিন রোজা রাখবো বলে অনুমতি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু সেহেরিতে আমাকে ডাকা হয়নি বা ডাকলেও আমি উঠতে পারিনি। পরে সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে রাখতাম, আর সারাদিন সবাই মিলে বিভিন্ন ভাবে রাগ ভাঙ্গিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে থাকতো। প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত খাওয়া হতো, তবে সেটা অবশ্যই বিশেষ কিছু আদায় করে।

ছোটবেলা থেকেই ঘরে বানানো ইফতার আইটেমের মধ্যে ফেভারিট হচ্ছে আলুর চপ, আর ছোলা মুড়ি। বাসায় পুরো ইফতারের আয়োজন আমার মায়ের ডিপার্টমেন্ট হলেও মুড়ি মাখানোটা বাবার। এখন পর্যন্ত এই প্রাকটিস চলে আসছে, নিজের বাবা বলে বলছিনা, আব্বুর মুড়ি মাখানো অসাধারণ হয়, আর যেদিন সাথে হালিম থাকে সেদিন তো কথা নেই (ভাবতেই জিবে পানি চলে আসছে)।
বাসার বাইরে প্রথম রোজা রাখা হয় কলেজে গিয়ে, প্রথম পাঁচ বছর পুরো রোজা ছুটি পেলেও ক্লাস ১২ এ রোজায় ৭ দিন থাকতে হয়েছিল। পিটি, গেমস ছাড়া ৭ দিন খারাপ কাটেনি, তবে খারাপ কেটেছিল ছুটিতে আসার জার্নিটা। রোজা রাখার কারনে আরিচার লঞ্চে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারিনি। জীবনে ওই একবারই আরিচার ঐ অমৃত সুযোগ পেয়েও খাইনি।

এরপরে জীবনের ভয়াবহতম রোজা, বিএমএতে। ইচ্ছাকৃত কিনা জানি না, প্রথম রোজায় ছিল ট্রেনিং সিডিওল এর কঠিনতম দিন। আর স্টাফরাও যেন উঠে পড়ে লেগেছিল রোজার মাঝেও বিএমএতে কোন ছাড় নেই সেটা প্রমাণ করার জন্য। এত কিছুর পরেও রোজা ভাংলাম না। কিন্তু ৭-৮ দিন পরে মনে হয় ঈমান দুর্বল হয়ে পড়লো, তাও ট্রেনিং এর চাপে নয় খাবারের লোভে। দুপুরে ক্লাস থেকে ফিরে এক কোর্সমেটের রুমে ঢুকতেই দারুণ এক সুগন্ধ নাকে লাগলো। তেমন বিশেষ কিছু না, গরুর মাংস মিশিয়ে রান্না করা খিচুড়ি। লোভ সামলাতে না পেরে একটু মুখে দিয়েই ঐ খিচুড়ির প্রেমে পড়ে গেলাম। পরের কিছুদিন রোজা রাখিনি শুধু ঐ খিচুড়ি খাবার লোভে, এক অডার্লি সাপ্লাই দিত, ছোট পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে আসতো। এক ব্যাগ মাত্র ১০ টাকা!
বিএমএতে থাকতে রোজার সময় ভাল মন্দ খাবার লোভে শহরে গিয়ে ভোগান্তির কথা আন্দালিবের ব্লগে বলেছিলাম, তবে শহরে গিয়ে ইফতার করার দারুণ এক অভিজ্ঞতা আছে। জিইসি মোড়ে নেমেই দেখলাম মেরিডিয়ানে বুফে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে, প্রায়ই সবাই ইফতার ওখানে করার প্লান করে ফেললো। আর ইফতারও করা হলো একে বারে পয়সা উসুল করে। শুনেছি এরপর থেকে নাকি বিএমএ ক্যাডেটদেরকে বিনয়ের সাথে ম্যারিডিয়ান কর্তৃপক্ষ বুফেতে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করে আসছে। (এখানের বাকি অংশ আগামী পর্বে মানে আগামী রোজায়)

রোজার আরেক উল্লেখ যোগ্য জিনিষ হলো তারাবী, ছোটবেলায় এটা ছিল আমার পুরো দিনের শ্রেষ্ঠতম সময়। কারণ এ সময় আব্বু বাসায় থাকতো না, ফলাফল স্বরূপ আমি বাসার রাজা বনে যেতাম, টিভি দেখা, বারান্দায় টেনিস বল দিয়ে খেলা, গল্পের বই পড়া কিংবা কিছুই না করা, এসবের পূর্ণ স্বাধীনতা তখন আমার হাতে। আম্মু কখনোই আমাকে কোন কথা শোনাতে পারেনি, আর প্রতিদিন আব্বু ফিরলে সব জানিয়ে দেবার হুমকি দিলেও আমার বাঁদরামির মাত্রা তার সহ্য সীমা (যা মোটামোটি অসীমের কাছাকছি) ছাড়িয়ে না গেলে সেটা করেনি। এরকম ঘটনা ঘটতো বছরে দুতিন বার।
একটু বড় হবার পর তারাবীর নামাজ করে দিল সন্ধ্যার পরে ঘরের বাইরে যাবার সুযোগ। এমনিতে আমার জন্য সবসময় সূর্যাস্ত আইন বলবত থাকতো, তারাবীর নামাজ আমাকে সেই আইনের ফাঁক বের করে দিল। এ সময়টা বেশিরভাগই যেত পাড়ার ভিডিও গেমস এর দোকানে, মাঝেসাঝে বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি। তবে দু একদিন টাইমিং এর মিস ক্যালকুলেশনের কারনে হাতেনাতে ধরাও খেয়েছি, সেদিন অবশ্য মার একটাও মাটিতে পড়তো না। (আগামী পর্বে সমাপ্য…… )

আজকে ত্রিশ রোজা শেষ হলো, এবারের রোজায় সেহেরি খাবার একটা পার্সোনাল রেকর্ড করে ফেলেছি। এর আগে যত রোজা রেখেছি তার সর্বোচ্চ ৪০% রাখা হয়েছে সেহেরি খেয়ে, আর এবার টানা ত্রিশ দিনই সেহেরি খাওয়া হয়েছে। যার পিছনে মূল অবদান হলো বিভিন্ন মুভি আর টিভি সিরিজের, কারণ বেশিরভাগ দিনই এগুলো দেখতে দেখতে একবারে সেহেরি করে তারপর ঘুমানো হয়েছে। কাল থেকে আর সেহেরি নাই, ঈদের ছুটির পর থেকে আবার ভোরের পিটি শুরু হবে, সারারাত জেগে মুভি দেখার দিন শেষ হয়ে গেল। তাই ঈদের আনন্দের পাশাপাশি রোজা শেষ হয়ে যাওয়ার একটা দুঃখবোধও কাজ করছে। আর দেশের বাইরে প্রথম ঈদ বলে ঈদের সাথেও কেমন একটা দুঃখ দুঃখ ভাব চলে আসছে, যদিও দেশে থেকেও পরিবার ছাড়া ঈদ করা অভ্যাসের পর্যায়ে চলে এসেছে।
এসব দুঃখ থাকলেও কাল ঈদ, দালোয়ার(আমি যে শহরে আছি) ঘরে ঘরে আনন্দ। তাই আসুন ঈদের গান শুনি।

এটা রোজার ঈদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে আব্দুল হাদির গাওয়া ঈদের এই গানটি আমার বেশি প্রিয়

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

১,১০১ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “স্মৃতিকথাঃ রোজা পর্ব”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    সালামি দেন।

    ছোটবেলায় যখন বিটিভিতে হাদী দলবল নিয়ে এই গানটি গাইতেন, তখন ফ্রক পরে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এই গানটি গাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল 😀

    আই জাস্ট রুইনড মাই লাইফ :grr:

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    :clap: :clap: :clap:
    আর আমি ভালো খাবারের গন্ধে কতো রোযা যে ভাঙছি।
    আমার পছন্দ ছেহেরি না খাইয়া রোযা।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    আপনার লেখা পড়ে স্মৃতিকাতর হলাম। অনেক ছোটবেলায় যখন আমাদের বাসাতেও ফ্রিজ ট্রিজ ছিলোনা তখন রাস্তা থেকে ইফতারের আগে আগে বরফ কিনে আনতাম।

    কোনো এক অদ্ভুত কারণে রোজা না রাখলেও এইবার আমি ত্রিশদিনই সেহরি খাইছি, মৌলবাদী আম্মার কারণে 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।