এলোমেলো মুভি ব্লগ-২

এবার চার দেশের চারটি মুভি। মুভিগুলো একটু কম পরিচিত, প্রথমটি বাদে বাকিগুলো সম্পর্কে কিছু না জেনেই দেখা শুরু করেছিলাম। আগের বারের মত এবারো বলে নিচ্ছি, মুভিগুলো নিয়ে হালকা আলাপ নিয়েই এই পোস্ট, কোন রিভিউ নয় স্রেফ দর্শক প্রতিক্রিয়া তবে হালকা স্পয়লার যুক্ত।

রণ (Rann)

অনেকদিন আগে সিসিবিতে এহসান ভাইয়ের এই ব্লগে রণ মুভিটার প্রিভিউ পড়েছিলাম। সেটা পড়ে দেখার জন্য আগ্রহ তৈরী হয়েছিল কিন্তু দেখা হয়ে ওঠেনি। সত্যি কথা বলতে এটা যে রিলিজ হয়েছে সেটাই জানতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত টিভি চ্যানেলের কল্যানে সেটা দেখা হয়ে গেল।

রাম গোপাল ভার্মা পরিচালিত এই মুভির কাহিনী মিডিয়াকে ঘিরে। বিজয় হর্ষবর্ধন মালিক (অমিতাভ বচ্চন) ইন্ডিয়া ২৪/৭ নামের নিউজ চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার যেটি সব সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে। বিজয় মালিক কখনোই তার নীতির সাথে আপোষ করে না, কিন্তু তার ফলে সে সম্মান পেলেও তার চ্যানেল ব্যবসা সফলতা পায়নি যা নিয়ে বিজয় হর্ষবর্ধনের আমেরিকা ফেরত ছেলে জয় মালিক (সুদিপ) বেশ চিন্তিত। অপরদিকে হেডলাইন ২৪/৭ সব দিক থেকেই ইন্ডিয়া ২৪/৭ এর বিপরিত, তারা মূল সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে মশলাদার খবর তৈরী করে প্রচারেই বেশি আগ্রহী। যার ফলশ্রুতিতে এটি সবচেয়ে ব্যবসা সফল চ্যানেল যার সিইও আমরিশ কক্কর (মনিশ ভেল) এক সময় ইন্ডিয়া ২৪/৭ এই কাজ করতো, যে কারনে জয় এর সাথে আমরিশের লড়াইটাও তাই পেশাগত দিকের উর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। আমরিশ সফলতার জন্য কোন নীতির ধার ধারে না, ইন্ডিয়া ২৪/৭ এর ভিতরের খবর পেতে সে সেখানের কর্মচারীদের কাছ থেকে খবর ও কিনে নেয়।


সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী (কে কে রায়না) একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগনের কাছে পরিচিত, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা মোহান পান্ডে (পরেশ রাওয়াল) গতানুগতিক দূর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সন্ত্রাসবাদের সাথেও তার যোগাযোগ রয়েছে। নির্বাচনের আগে আগে সে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িয়ে মিথ্যা প্রচারনা চালানোর পরিকল্পনা করে, আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ইন্ডিয়া ২৪/৭ এর মাধ্যমে সেটা প্রকাশ জরুরী হয়ে পড়ে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় মোহান পান্ডের সহযোগী, ব্যবসায়ী নাভিন সাঙ্ক্যালা ( রজত কাপুর) যে কিনা বিজয় মালিক এর মেয়ের স্বামী। নাভিন তার সফলতার জন্য ক্ষুধার্ত শ্যালক জয় মালিককে রাজি করতে সক্ষম হয় আর জয় মালিক তাদের নিজেদের তৈরী করা তথ্য প্রমানাদি আর আবেগি কথা দিয়ে তার বাবাকে কনভিন্স করতে সক্ষম হয়। এ সবের মাঝে এ মুভির মূল চরিত্র পুরব শাস্ত্রী (হৃতেশ দেশমুখ) যোগ দেয় ইন্ডিয়া ২৪/৭ এ যে কিনা বিজয় মালিককে শুরু থেকেই তার আদর্শ মনে করে এসেছে। তার সাথে কাজ করতে পেরে সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। সেই স্ব উদ্যোগে সেই সন্ত্রাসী হামলা আর সে বিষয়ে পরিবেশিত খবরের উপর অনুসন্ধান চালিয়ে সত্য উদঘাটন ও তা প্রকাশের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে থাকে আর সেটাকেই বলা যায় এই মুভির মূল কাহিনী।

বেশ প্রত্যাশা নিয়ে মুভিটা দেখা শুরু করেছিলাম, পুরোটা দেখে হতাশ হতে হয়নি। কাহিনীতে নতুনত্ব আছে তবে শেষটা প্রেডিক্টেবল, তবে পুরো সময়ই বেশ একটা গতি ছিল। আর অমিতাভ, রিতেশ দেশমুখ সহ সবার অভিনয়ই ভাল লেগেছে, বিশেষ করে অনেকদিন পরে পরেশ রাওয়ালকে ভিলেন চরিত্রে দেখে ভাল লেগেছে। সব মিলিয়ে ভাল লাগার মত একটা মুভি।

দি সিক্রেট ইন দেয়ার আইস (The Secret in Their Eyes)


আমার দেখা প্রথম আর্জেন্টাইন মুভি, দারুন একটা ক্রাইম থ্রিলার, যার মূলে আছে রোমান্টিকতা। মুভির মূল চরিত্র বেঞ্জামিন এসপাসিত সদ্য অবসর নিয়েছে। এতদিন সে কাজ কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেছে এক ক্রিমিনাল কোর্টে। অবসরের পরে সে উপন্যাস লেখা শুরু করে তার তরুন জীবনের এক অসমাপ্ত ধর্ষন ও হত্যার কেস এর কাহিনী নিয়ে। যেখানে পুলিশ প্রথমে ভুল লোককে গ্রেফতার করে, নির্যাতন করে তার কাছ থেকে স্বীকারোত্তি ও গ্রহন করে নেয়। কিন্তু এসপাসিত ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করে মূল অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় তাকে গ্রেফতারে ব্যর্থ হয়। এক বছর পরে এক স্টেশনে দেখা হয় সেই ভিকতিমের স্বামী মোরালেসের সাথে, যে কিনা প্রতিদিন বিভিন্ন স্টেশনে বসে থাকে সেই অপরাধীকে চিহ্নিত করার আশায়। মৃত স্ত্রীর প্রতি এই ভালবাসা দেখে এসপাসিত আবারো তদন্তে নামে, এ কাজে তার সাথে সবসময়ই সাথে থাকে তার সহকর্মি স্যানডোভাল। আর বেআইনি ভাবে কেস পূনঃতদন্ত শুরু করতে সাহায্য করে তাদের বস ইরিন যদিও প্রাথমিক অবস্থায় সে সে এসপাসিত আর স্যানডোভালের কাজের বিরুদ্ধে ছিল। এক পর্যায়ে তারা খুনী গোমেজকে গ্রেফতারেও সক্ষম হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সে আবার বেরিয়ে আসে আর এসপাসিতদের ধরাছোয়ার বাইরে চলে যায়। প্রতিশোধ নিতে তার লোকেরা এসপাসিতকে হত্যা করতে এসে ভুল করে হত্যা করে স্যানডোভালকে। এর পরে এসপাসিত শহর ছেড়ে পালায়। এখানেই সে কেস এর কাজ থেমে যায়। উপন্যাস লিখতে গিয়ে এসপাসিত আবার ফিরে আসে আইরিনের কাছে। স্মৃতি রোমন্থনে উঠে আসে তাদের মাঝের অব্যক্ত প্রেম। আর এতদিন পরে সেই অসমাপ্ত কেসের সাথে তাদের অসমাপ্ত প্রেমেরও এক অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি ঘটে।

আমার ম্যাড়ম্যাড়ে বর্ণনায় কিছুই ফুটে ওঠেনি, তবে আমার কাছে দারুন লেগেছে অস্কার জেতা এই মুভিটি।

ফোর লায়ন (Four Lion)


ব্রিটিশ ব্লাক কমেডি। কাহিনি গড়ে উঠেছে শেফিল্ডে, পাঁচজন আনাড়ি ব্রিটিশ জিহাদিস্টকে ঘিরে। তারা ব্রিটেনে বসে বোমা হামলার পরিকল্পনা করে, যা তৈরীর জন্য তারা হাস্যকর উপায়ে বিভিন্ন উপাদান জোগাড় করে, তার পরীক্ষা চালায়। এর মধ্যে থেকে দুজন, ওমর আর ওয়্যাজ পাকিস্তানে জিহাদি ট্রেনিং এ যায়, যেখানে উল্টো ভাবে ধরে রকেট ফায়ার করে তারা হত্যা করে ফেলে ওসামা বিন লাদেনকে, যার ফলে তাদেরকে আবারো ব্রিটেনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুরো মুভিতে স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে সেখানের নিরাপত্তা বাহিনির ব্যর্থতাকে, সাধারন মানুষের অসতর্কতাকে সেই সাথে তথাকথিত জিহাদিদের মোটিভেশনের পিছনের নির্বুদ্ধিতাকে।

মুভিটা দেখতে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় হাসিতে ফেটে পড়েছি কিন্তু বুঝতে পেরেছি সেখানে হাসা আমার মোটেও উচিৎ হয়নি, আবার এমন কিছু জায়গা এসেছে যেখানে বুঝতে পেরেছি আমার হাসা উচিত কিন্তু হাসিতে পারিনি। এর উল্টোটাও হয়েছে, মন খারাপ করা উচিত হচ্ছে না জেনেও মন খারাপ হয়েছে। খুব বেশি ব্লাক কমেডি খুব বেশি আমার দেখা হয়নি, তবে এটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে আইডিয়াল ব্লাক কমেডি।

হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ (What Eating Gilbert Grape)

আমেরিকার ছোট এক শহরে গিলবার্ট গ্রেপকে (জনি ডেপ) তরুন বয়সেই তার পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। গিলবার্ট অল্প বয়সেই বাবা হারায়, তারপর থেকে তার মা ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে, যার ফলশ্রুতি তার শরীর ভয়ঙ্কর রকম আকার ধারন করেছে। বড় বোন ঘরের কাজ করে আর ছোট বোন বেশ ছোট। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার অটিস্টিক ছোট ভাই আর্নি (লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও)। গিলবার্ট কাজ করে একটি মেগা শপে, যেটি একটু পুরোনো ধরনের, শহরে নতুন গড়ে ওঠা আরেকটি শপের কারনে তাদের ব্যবসা ভাল যাচ্ছে না। গিলবার্টকে মূলত ব্যস্ত থাকতে হয় আর্নিকে সামলে রাখতে, যে কিনা প্রায়ই শহরের পানির ট্যাঙ্কি বেয়ে উঠে যেতে যায়। আর এসবের পাশে তার শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক বিবাহিত নারীর সাথে।


গিলবার্টের এই জীবনে পরিবর্তন আসে যখন তাদের শহরে গাড়ী নষ্ঠ হয়ে ট্রেইলারসহ আটকে পড়ে বেকি নামের এক তরুনী আর তার দাদী। গিলবার্টের সাথে বেকির ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে, আর্নিও বেকিকে পছন্দ করে। বেকির প্রতি গিলবার্টের মনযোগ বাড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে, সেই গৃহিনীর হৃদয় ভেঙ্গে যায়, তার স্বামী হঠাৎ মারা যায় যদিও অনেকে সন্দেহ করে তাকে তার স্ত্রীই খুন করেছে, আর্নির প্রতি মনযোগের অভাব একদিন আর্নি সারারাত কাটায় বাথটাবে। আরো কিছু ঘটনা ঘটে, এক সময় গিলবার্টের মায়ের শারীরিক স্থুলতাও আলোচিত বিষয় হয়ে দেখা যায়। মুভি শেষ হয় এলই সাথে মন ভাল ও খারাপ হওয়া অনুভূতির মাধ্যমে।

মুভিটা দেখা শুরু করেছিলাম কিছু না জেনেই। এটাকে বলা যায় স্মল টাউন ফ্যামিলি মুভি, কাহিনি এগিয়েছে খুব সরলভাবে। আহামরি কোন চমক না থাকলেও পুরো সময়ই আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছে। তবে এ মুভিতে সবচেয়ে ভাল লেগেছে বাচ্চা কালের ডি ক্যাপ্রিওর অভিনয়। অটিস্টিক চরিত্রে দূর্দান্ত করেছে সে, আমার দেখা ওর অন্যতম সেরা অভিনয়।

২,০৯৮ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “এলোমেলো মুভি ব্লগ-২”

  1. রকিব (০১-০৭)

    ২ আর ৪ দেখা হয়েছে। দি সিক্রেট ইন দেয়ার আইস' দারুন লাগছে। আর তার চেয়েও বেশি ভাল্লাগছিল হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ। বিশেষত, পিচ্চি লিওনার্দোর এই সিনেমাটা তার অভিনীত সেরা পাঁচের তালিকায় থাকা উচিৎ বলে হয়েছে। ডেপ সাহেবের কথা না হয় নাই বলি।

    অফটপিকঃ একটু স্পয়লার টাইপ হয়ে গেছে আকাশদা। উপরে অ্যালার্ট দিয়ে দিয়েন 😛


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      লিওনার্দো আসলেই দূর্দান্ত অভিনয় করছে।

      স্পয়লার না করার চেষ্টায় ছিলাম, তবে মুভি নিয়ে নতুন লেখা শুরু করছি শিখতে সময় লাগবে 😛 , এলার্ট দিয়ে দিলাম। (কোন কোনটা স্পয়লার হইছে, নাকি সব গুলোই ?)


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    "হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ" খুব ভাল লেগেছিল। প্রথম মুভিটা দেখতে ইচ্ছে করছে। রিভিউ ভাল লেগেছে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    কয়েকটা মুভি কিনেছি গত সপ্তাহে। একটাও দেখার সময় পাইনি আজো। অনেকের দেখা 'অটোগ্রাফ'ও। আর প্রায়ই আগে দেখা মুভি আবার কিনি!! মনে থাকেনা বলে............


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।