একজন খাঁটি মানুষের প্রস্থান, গুরু তোমায় সালাম…

ওরচেস্টারশ্যায়ার কাউন্টি আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। আমাদের প্রথম কাউন্টি খেলা ক্রিকেটার সাকিব এই কাউন্টির হয়েইখেলেছে। কিছুদিন আগে ওরচেস্টারশ্যায়ার খবরের শিরোনামে এসেছিল, তবে সেটা সাকিবের কারনে নয়। আদ্রিয়ান সংকর নামের জনৈক ক্রিকেটারের কারনে। যার সাথে এ মৌসুমেই চুক্তি করেছিল তারা, কিন্তু চুক্তির ১৫ দিনের মাথাতেই তা বাতিল হয়ে যায়। কারন প্রকাশ পেয়ে যায় আদ্রিয়ান সঙ্কর চুক্তির আগে সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে যে গুনগান করেছিল আর কাগজপত্র দেখিয়েছিল তার পুরোটাই ভূয়া। এমন কি বয়স ও কমিয়েছে ভুয়া সার্টিফিকেটের মাধ্যমে। ক্রিকেট তার ফর্ম ও বিভিন্ন দলে খেলা সম্পর্কে জাল তথ্য তো দিয়েছেই তবে আমার কাছে সবচেয়ে চমক জাগানো তথ্য হলো তার আর্সেনাল ফুটবল একাডেমিতে থাকার খবর, আর কিছু না হোক পোলার পছন্দ আছে।

উন্নত বিশ্বে এরমক জালিয়াতি একরকম অবিশ্বাষ্য, সে কারনেই ব্রিটিশ মিডিয়া এটা নিয়ে ভালই মাতামাতি করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এটা কোন ব্যাপারই না। জালিয়াতিতে আমরা বহুদূর এগিয়ে আছি। যেকোন সার্টিফিকেটের জাল বের করা তো আমাদের কাছে পানি ভাত, পরিচয়পত্রের ক্ষেত্রেও একি অবস্থা। আর এসব জাল কাগজপত্রের জোরে কতলোক কত জায়গায় অধিষ্টিত হচ্ছে। পত্র পত্রিকায় কিছুদিন পর পরই এরকম কিছু ঘটনা উদঘাটনের ঘটনা চোখে পড়ে, দেখে এখন আর তেমন একটা প্রতিক্রিয়া হয় না। তবে কিছুদিন আগে এক ভূয়া ডাক্তারের কাহিনি পড়ে আমি রীতিমত হতবাক। নামের সাথে মিলে যায় এরকম আরেকজন ডাক্তারের সার্টিফিকেটের ফটোকপির জোরে সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিল এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে, তার অবহেলায় এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসে। বর্তমানে সে জেলে আছে। পত্রিকায় যেহেতু একবার তার কাহিনি উঠে গিয়েছে তখন তার আর মনে হয় শাস্তি না হয়ে যাবে না। কিন্তু এতদিন ধরে সে যে ভূল চিকিৎসা করে আসলো তার দায় কে নেবে? আর যে হাসপাতাল কতৃপক্ষ যাচাই বাছাই না করেই তাকে নিয়োগ দিল তার বিচার কে করবে? এতদিন তো ছিল শুধু ভন্ড পীর, ভূয়া কবিরাজি আর স্বপ্নে পাওয়া ঔষধের চিন্তা, কিন্তু এখন যে হাজার টাকা ভিজিটের এসি রুমে বসা ডাক্তাররাও ভুয়া বের হচ্ছে… এদের কাছ থেকে মানুষ বাচবে কিভাবে?

আমাদের দেশে মনে হয় এমন কোন জায়গা নাই যেখানে কিছু ভুয়া নাই, ইদানিং কিছু ভুয়া ক্যাডেটেরো দেখা পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেটা ভার্চুয়াল জগতে। ফেসবুকে সেই রকম প্রোফাইল পিকওয়ালা কিছু বালিকাদের ইনফোতে দেখা যায় তারা নাকি ক্যাডেট কলেজে পড়েছে, তবে সেটা ময়মনসিংহ না, অন্য কোন এক বয়েজ ক্যাডেট কলেজ, বোঝেন অবস্থা!

এত ভেজালের ভিড়ে খুব অল্প সংখ্যক নির্ভেজাল মানুষের মধ্যে একজন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। গুরু আজম খান। যখন থেকে আমি গান শোনা শুরু করেছি (বড় ভাইদের ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজামো গান) তখনো সে সবার মুখে মুখে ছিল, তবে নতুন গান মনে হয় তেমন একটা ছিল না। তবে আশেপাশের বড় ভাই চাচাদের কাছে তার কনসার্টের কাহিনি শুনতাম, খোলা জীপে করে সামনে পিছনে ১০-২০টা জীপ আর বাইক নিয়ে কনসার্টে গাওয়ার কাহিনি সেসময় মিথ বলে মনে হত। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার কাছের লোকদের স্মৃতিচারন গুলো শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল আমি কত কমই না জেনেছি। বিশেষ করে এবিসি রেডিওর ক্যাফে লাইভে তিন প্রজন্মের উচ্চারনের শিল্পীদের কথা শুনতে শুনতে শিউরে উঠছিলাম। গানের গুরুর পাশাপাশি তার আরেক পরিচয়, আরো বড় পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা। বেশ কয়েকবার সে সময়ের অভিজ্ঞতা তার মুখে শুনেছি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, একাত্তরের দিনগুলিতেও পড়েছিলাম আজম খানের কথা। কিন্তু নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে সে কখোনোই আলাদা কোন অহমিকা প্রকাশ করতে দেখিনি। উল্টো এক সাক্ষাৎকারে আশেপাশের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আস্ফালন দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেয়া নিয়ে অভিমানের কথা বলছিলেন।

এক দিক থেকে আমি বেশ ভাগ্যবান, আজম খান আমার একরকমের সরাসরি গুরু। অবশ্যই সেটা গানের গুরু নয়, সাতারের গুরু। কলেজ থেকে এক ছুটিতে এসে সাতার শেখার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম মোশাররফ সুইমিং পুলে (ঢাকা স্টেডিয়ামের পাশে)। সেখানে থাকত একজন মাত্র প্রশিক্ষক, নির্ধারিত এক ঘন্টার মধ্যে তার দেখা পাওয়া যেত ক্ষনিকের জন্য। শুরুতে কোন একটা ড্রিল দেখিয়ে সেটা চালিয়ে যেতে বলত, বাকি এক ঘন্টা সেটা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। এরকমি একদিন সুইমিং পুলে দাপাদাপির মাঝে পাশ থেকে কে যেন বললো আজম খান এসেছে। এর আগে তাকে কখনো সামনা সামনি দেখিনি। নিজের মুখচোরা স্বভাবের জন্য কথা বলা হয়নি সেদিন, যদিও বাকিরা সাতারের ফাঁকে ফাঁকে ভালই আড্ডাবাজি করছিল। পরের দিন
গিয়ে দেখলাম গুরু আগেই চলে এসেছে। পানিতে নামার পরে সে নিজেই আমাদের নতুন গ্রুপের কাছে এসে সাতার শেখানো শুরু করলো। টানা বেশ কয়েকদিন তার কাছে সাতার শেখার সুযোগ হয়েছিল। যদিও সে ছুটিতে সাঁতারটাকে পুরোপুরি আয়ত্ত্ব করতে পারিনি ( এখনো পারিনি, ৬ মাস পর পর ৫০ মিটার পার হবার সময় মনে হয় পুলসিরাত পার হচ্ছি) তারপরো সাতারের মূল বিষয়গুলো শিখেছিলাম গুরুর কাছ থেকেই।

আজম খানের গান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকেও আমাদের জন্য শিক্ষনীয় মনে হয় তার জীবনযাপন। কোন অহংকার, অহমিকা, প্রাপ্তির হিসাব না করে একদম নিজের মত করে কী সাধারন ভাবেই না থাকতেন তিনি। তার প্রতি শ্রদ্ধা…

…ওরে ফুলবানু পারলি না বাচাতে…

১,৭২৫ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “একজন খাঁটি মানুষের প্রস্থান, গুরু তোমায় সালাম…”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    বড় ভাল লোক ছিল এই লোকটা।
    ভাল লোকগুলা কেমন চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। যাদেরকে খারাপ ভাবি তারা থেকে যাচ্ছে। তবে একটা জিনিস ভাল লাগে এই লোক জেনে গেছে যে দেশের সবাই তাকে কতটা ভালবাসে।

    জবাব দিন
  2. মনজুর (৮৯-৯৫)

    কখনো সামনা-সামনি কথা হয়নি, দেখা হয়নি, ঠিক কথা বলতে পারার মতো দুরত্বেও কথনো পাওয়া হয়নি। তাঁর শুধু তিন কি চারটা লাইভ কনসার্ট উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো মাত্র।
    তারপরও, খুব কাছের কোনো মানুষ অনেক দূরে ফিরে না পাওয়ার দেশে চলে গেলে বুকের ভিতর যেমন ফাঁকা অনুভুতির সৃষ্টি হয়, মনের ভিতর যেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে.. তেমনি কিছু কষ্টের অনুরনন অনুভব করছি।

    জবাব দিন
  3. সাইফুল (৯২-৯৮)

    আহসান,

    তোমার মত আমারও গুরুর সাথে সুইমিং এর অভিজ্ঞতা আছে এবং ঐ "মোশাররফ সুইমিং পুলে"।

    গুরু বড় ভাল লোক ছিলেন। এতদূরে বসেও সেইসব দিনের কথা মনে পরে যাচ্ছে, যখন কমলাপুরে তার খুব কাছাকাছি থাকতাম।

    অন টপিকঃ লেখাটা ভাল হয়েছে :clap: (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইফুল

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।