খিচুড়ি-২

ক।
ডিসেম্বর, মার্চ এই মাসগুলো আমাদের জাতির জীবনে আলাদা স্থান দখল করে আছে। এ মাসগুলোকে ঘিরে সকল মাধ্যমেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়, উদযাপন করা হয় বিভিন্ন ভাবে। মার্চের ক্ষেত্রে প্রায় পুরো মাস জুড়ে এ আয়োজন চললেও ডিসেম্বরে বিজয় দিবস অর্থাৎ ১৬ তারিখের পরে অধিকাংশ আয়োজনের সমাপ্তি হয়। এবারো হয়ত এর মধ্যে হয়ে গিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী দিনগুলো নিয়ে আমার কৌতহল বেশ আগে থেকেই। ১৭ ডিসেম্বর সকালে সবাই যখন একটা স্বাধীন দেশে ঘুম থেকে উঠল তখন অনুভুতিগুলো কেমন ছিল এগুলো জানতে ইচ্ছে করে। সেই সাথে পরবর্তীতেযারা এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছিল তাদের মনের ভাবনাগুলো জানতে ইচ্ছে করে। কি ছিল তাদের মনে?

খ।
এবারের বিজয় দিবসের চমক হলো সা কা চৌ এর গ্রেফতার। যদিও আমি চমকটা বেশ দেরিতেই পেয়েছি। ফজরের নামাজের পরে বিশেষ মোনাজাত শেষে আবারো আরাম করে লেপের নিচে ঢুকে ঘুমের ২য় পর্ব শুরু করে দেই। ঘুম থেকে উঠে প্রীতিভোজ, এসব শেষে নেটে ঢুকে সুখবরটা পেলাম। তবে তার সমর্থনে কথা বলার লোকেরো অভাব হচ্ছে না, আগামীকাল হরতালও ডাকা হয়েছে। অবশ্য এগুলো যে হবে জানাই ছিলো। তার থেকে শকড হয়েছি অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া দেখে, একটা গ্রুপ যে তাকে সমর্থন দেবে তা জানি কিন্তু বড় একটা গ্রুপের সাকা’র ব্যাপারে তেমন কিছু জানাই নেই। তারা এটাকে দেখছে সরকার বিরোধী দলের গতানুগতিক রাজনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে, যেগুলোর প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই।

গ।
বিভিন্ন খবরে দেখলাম সাকা চৌ এর পরিবার চোস্ত বাংলা এবং ইংরেজিতে এর প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে, তাদের মুখে সভ্য দেশ, অত্যাচার এই সব শব্দগুলো শুনে চামড়ায় জ্বলুনি উঠলেও নিজের স্বামী/বাবা’র সমর্থনে তারা এগুলো বলবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ খবরের পরেই আরেকটা রিপোর্ট দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের সর্বকনিষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম ওরফে লালু বীর প্রতিকের পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। গতবছর সে মারা যাবার পরে সংসার চালানোর জন্য তার স্ত্রী বাসায় কাজ করছে, ১৪ বছরের ছেলে ঢুকে গিয়েছে গার্মেন্টসে, ছোট মেয়েকে বাবার কথা জিজ্ঞেষ করলে সে কান্না ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলো না, অন্যদিকে সাকা’র মেয়েকে দেখলাম শুদ্ধ বাংলা ইংরেজিতে সাংবাদিক সম্মেলন করতে। আর আমরা লালু’র ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়তি কোন কিছু তো করতে পারিইনি, এখন পর্যন্ত সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাটাও দিতে পারিনি, অথচ সে একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা!

অস্ত্র সমর্পনের সময় বঙ্গবন্ধুর কোলে 'বীর বিচ্ছু'

ঘ।
এবারের বিজয় দিবস আরো একটি দিক থেকে ইউনিক। সেটা হলো এ বিজয় দিবসে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়েছে। কক্সবাজারে আয়োজিত সাফ মহিলা ফুটবলে পাকিস্তান দলের খেলা ছিল, সেখানে বাজানো হয় এই জাতীয় সঙ্গীত। পত্রিকা থেকে জানলাম, ফিক্সচার জানার পর থেকেই নাকি পাকিস্তান দলের ম্যানেজার এটা নিয়ে ভাবছিল, কিন্তু আমাদের আয়োজক কমিটির সেটা আসেনি। সেখানকার দর্শকদের প্রতিক্রিয়া নাকি মিশ্র! একজনের মতামত দেখলাম অন্য কোন দিনের কথা আলাদা কিন্তু বিজয় দিবসের দিনে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা যায় নাকি! তবে বিজয় দিবসের দিনেও মাঠে পাকিস্তানের সাপোর্টারের অভাব ছিল না। আগের ম্যাচে মালদ্বীপের সাথে ম্যাচে নাকি পুরো গ্যালারী পাকিস্তানকে সাপোর্ট করছিল। ক্রিকেটে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সমর্থকেরা দুটো যুক্তি দেখায়, এক হলো ভাল খেলা আর দুই হলো মুসলিম দেশ। মহিলা ফুটবলে পাকিস্তানের পারফর্ম্যান্স চোখ ধাঁধানো কিছু না, আর মালদ্বীপ, আফগানিস্তান দুটোই মুসলিম দেশ। তাহলে এদের সাথে খেলায় পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার পিছনে কি যুক্তি কাজ করতে পারে? এতই পাকিস্তান প্রেম এতই শক্তিশালি যে বিজয় দিবসের দিনেও তাদেরকে সমর্থন করে যাচ্ছে!

ঙ।
প্রায় ১৮ বছর পরে এর চেয়ে ভয়াবহ জিনিষ আবিষ্কার করলাম। ১৯৯২ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কথা পুরোপুরি মনে নেই, তখনো ক্রিকেট সেভাবে বুঝে উঠিনি, আর স্কুল টাইমে খেলা হওয়ায় সেভাবে দেখাও হয়নি। তবে ফাইনালের কথা মনে আছে পুরোপুরি। চারিদিকে পাকিস্তানী সাপোর্টারদের মাঝে আমরা কিছু এন্টি পার্টি আওয়াজ তুলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের প্রিয় ইমরান খানই বিশ্বকাপ নিল। আনন্দে বাজি পটকা ফুটলো। আর আমরা ব্যর্থ মনরোথে তাদের বিভিন্ন ধরনের কটাক্ষ হজম করলাম। আশেপাশে নাকি গরু জবাই করা হয়েছিল বলেও শুনেছিলাম। তবে মাত্র দুদিন আগে জানতে পারলাম সেদিন ছিল ২৫ মার্চ! ৭১ এর ভয়াল সেই গনহত্যার রাতের মাত্র ২১ বছর পরে এদেশেরই কিছু মানুষ পাকিস্তানিদের বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল! ছিঃ

৮৫০ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “খিচুড়ি-২”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার পিছনে কি যুক্তি কাজ করতে পারে? এতই পাকিস্তান প্রেম এতই শক্তিশালি যে বিজয় দিবসের দিনেও তাদেরকে সমর্থন করে যাচ্ছে!

    পাকিস্থানকে সাপোর্ট করা দুঃখজনক। কেউ কেউ এক ধর্মের কথা বলে, কেউ কেউ ভালো খেলার কথা। কিন্তু তুমি ঠিকই ধরিয়ে দিছো যে, ধর্মের অযুহাতে যদি ওদের সাপোর্ট করা যায়, তাইলে মালদ্বীপ বা আফগানিস্তান কি দোষ করলো? কাজেই, এটা গ্রহনযোগ্য যুক্তি নয়। আর, ভালো খেলা (ক্রিকেটে) পাকিস্তান একাই খেলে না, আরো ভালো ভালো দল আছে। কাজেই, ওটাও দূর্বল যুক্তি।

    কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যারা পাকিস্তান দলকে সাপোর্ট করে, তাদের প্রায় সবাই এটা না বুঝেই করে, পাকিস্তানী জাতীয়তায় বিশ্বাসী বলে নয়।

    কাউকে কাউকে বলতে শুনি জাতীয়তাবাদের সাথে খেলাধূলার সম্পর্ক নেই। এটা আসলে ঠিক নয়, বরং খেলাধূলা এখন জাতীয়তাবাদ গঠন+শক্তিশালী করার অন্যতম উপায়। তাই কাকে সমর্থন করবো তা' ভেবেচিন্তে করা উচিত। তা না হলে না-বুঝেই আমাদের জাতীয় শত্রুদের পক্ষে চলে যাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      পাকিস্তানকে যারা সাপোর্ট করে তারা প্রথমত সাপোর্ট শুরু করে আশেপাশের মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, জাতীয়তাবাদের সাপোর্টার হিসেবে নয়। কিন্তু সাপোর্টের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আস্তে আস্তে ক্রিকেট ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি, বায়াসনেস বাড়তে। এটা আশংকাজনক। যেকোন পাকিস্তানি সাপোর্টারের সাথে তর্কে জড়ালে তাদের কাছ থেকে যে ধরনের উত্তর পাওয়া যায় তা ভয়াবহ।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  2. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    শেষ হয়ে গেছে শোষকের দিন
    বিদ্রোহ শুরু হোক
    অধিকার নিতে চলে এসো যত
    নিচের তলার লোক
    আবার লড়াই হোক।।

    আবার লড়াই হোক।


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  3. নঈম (৮৭-৯৩)

    ভাল লিখেছ। আমার প্রতিক্রিয়া:
    ক। "ভাবনাগুলো জানতে ইচ্ছে করে" :-/
    খ। "সা কা চৌ এর গ্রেফতার" 😀
    "তারা এটাকে দেখছে সরকার বিরোধী দলের গতানুগতিক রাজনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে" :bash:
    গ। "আমরা লালু’র ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়তি কোন কিছু তো করতে পারিইনি" 🙁 :bash: :no:
    ঘ। "এ বিজয় দিবসে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়েছে" ~x(
    "এতই পাকিস্তান প্রেম এতই শক্তিশালি যে বিজয় দিবসের দিনেও তাদেরকে সমর্থন করে যাচ্ছে" 😡
    ঙ। "৭১ এর ভয়াল সেই গনহত্যার রাতের মাত্র ২১ বছর পরে এদেশেরই কিছু মানুষ পাকিস্তানিদের বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল" x-( 😡 :gulli:

    জবাব দিন
  4. মুহিব (৯৬-০২)

    কেন জানি আমাদের দেশের লোকেরা পাকিস্তানকে এত সাপোর্ট করে? তবে জাতিসঙ্ঘ মিশনে এসে যা দেখলাম যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চাইলেও অনেক পাকিস্তানি আজও তৎকালীন শাসকদের সমালোচনা করে বলে ৭১ এ তাদের ভুল অনেক বড় মাপের। আমি জানি না এটা লোক দেখানো কি না? :dreamy: :dreamy:

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      ভুল ছিল স্বীকার করার পর তাদের বক্তব্য কি ধরনের? 'ঠিকভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতে পারলে আমরা ভাই ভাই এখনো এক সাথে থাকতে পারতাম' এ ধরনের কিছু?


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
      • মুহিব (৯৬-০২)

        অনেকটা সেরকমই। এটা কতিপয় ব্যার্থ রাজনীতিবিদের ব্যার্থতা এবং অদূরদর্শিতার ফলাফল। তবে পাকিস্তানীদের দেখলে নিজেদের অনেক ভাল মনে হয়। এরা বাংলাদেশীদের চাইতেও দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের মুখে কোন বিষয়ে ইনশাল্লাহ মানে হইল এই বিষয়টা ওরা করবে না বা মিথ্যা আশ্বাস। (জনৈক পাকিস্তানীর উদ্ধৃতি)

        জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      মেজাজ খারাপ করে দেবার জন্য দুঃখিত ফয়েজ ভাই। আরো মেজাজ খারাপ হতে পারে এই শুনে যে সে যে খেতাব পেয়েছে সেটা জানার জন্যই তাকে নাকি ১৯৯৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, এর আগে কেউ তাকে খবরটাই জানায় নি, সম্মাননা তো পরে।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।