স্মৃতির বিশ্বকাপ-৪

স্মৃতির বিশ্বকাপ ১, ,


২০০২ (দঃকোরিয়া-জাপান)

২০০২ এর বিশ্বকাপের সাথে ফুটবল ছাড়াও আরোও অনেক ধরনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কারন টুর্নামেন্ট হয়েছিল কলেজের লাইফের একদম শেষ সময়ে। এইচএসসি পরীক্ষার মাঝে এর শুরু আর বিশ্বকাপ শেষ হবার আগেই আমরা কলেজের বাইরে। এ কারনে এই বিশ্বকাপের স্মৃতিটা একটু অন্যরকম ভাবে উজ্জ্বল। তবে এ লেখায় আপাতত বিশ্বকাপের স্মৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।

আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার কারনে সে সময়ে শুধুমাত্র আমরাই কলেজে, বাকিরা সে সময় ছুটিতে। এর মাঝেই শুরু হলো বিশ্বকাপ। আমাদের পরীক্ষার মাঝে তখন ১৪ দিনের একটা গ্যাপ। তাই সময়টা পুরো ফুটবলের পিছনেই ব্যয় হলো। আর টুর্নামেন্ট এশিয়াতে হবার কারনে খেলার টাইমিং কলেজে বসে দেখার পক্ষে বেশ সুবিধাজনক হলো। দুপুর, বিকাল সন্ধ্যায় খেলা। তবে রাত জেগে খেলা দেখার যে আনন্দ তা বেশ মিস করেছিলাম।

২০০২ এর বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আমার জন্য অর্ধেক শেষ হয়ে যায়, কারন হল্যান্ড কোয়ালিফাই করতেই ব্যর্থ হয়। খবরটা যেদিন নিশ্চিত হয় তারপর দুদিন প্রায় শকড হয়েছিলাম, ঠিক বিশ্বাষ করতে পারছিলাম না। তবে বিশ্বকাপ কাছাকাছি আসতেই সেটা অনেকটা কাটিয়ে উঠলাম। মূলত এন্টি আর্জেন্টিনা এবং তারপর আস্তে আস্তে এন্টি ব্রাজিল হয়ে যাওয়া এক বিরল প্রজাতির সাপোর্টার হয়ে উঠলাম। আর এ বিশ্বকাপে ছিলাম পুরো ফ্রি-ল্যান্স সাপোর্টার। প্রতি ম্যাচ হিসেবে আলাদা আলাদা টিমকে সাপোর্ট দিতাম, সেই সাথে আর্সেনালের খেলোয়াররা যে দেশে আছে তাদের তো অবশ্যই।

বিশ্বকাপের শুরুটা ছিল আমার জন্য ভয়াবহ। নবাগত সেনেগাল ফ্রান্সকে হারিয়ে দেবার পর দেশের প্রায় ৮০% লোকের সেকেন্ড টিম (আফ্রিকান+মুসলিম) হয়ে উঠলেও আর্সেনাল লজেন্ড থিয়েরি অঁরি’র দলের এ হার মেনে নেয়া বেশ কষ্ঠকর ছিল। তবে শুধু এ হারেই থেমে না থেকে ফ্রান্স সর্বনাশের সোলো কলা পূর্ণ করে কোনো গোল না করেই বিশ্বকাপের ১ম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিল। মাঝে হেনরি আবার লাল কার্ড ও খেলে বসলো। ইউরো ২০০০ এ পর্তুগালের খেলা দেখে ওদের ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। ওদের খেলার স্টাইলের কারনে আশা ছিল ওরা বিশ্বকাপে হল্যান্ডের অভাব পূরন করবে।কিন্তু তারাও চূড়ান্ত ভাবে হতাশ করে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়লো।

সেই বাছাই পর্ব থেকে প্রিয় দল আর খেলোয়ারদের ব্যর্থতার কারনে ২০০২ এর বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল আমার সবচেয়ে কষ্টের বিশ্বকাপ। কিন্তু সেটা না হয়ে এটা পরিনত হলো সবচেয়ে আনন্দের বিশ্বকাপে। আর তার কারন গ্রুপ এফ, আর্জেন্টিনার গ্রুপ। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে কোন মতে হারালো আর্জেন্টিনা, তারপরের ম্যাচ সেই ইংল্যান্ডের সাথে। আগের বিশ্বকাপের ভিলেন বেকহ্যাম ততদিনে শুধু ইংল্যান্ডের নয় পুরো বিশ্বের ফুটবল হিরোতে বদলে গিয়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে পা ভাঙ্গা এবং শেষ মুহুর্তে ফিট হয়ে বিশ্বকাপ খেলায় নাটকিয়তা আরো বেড়ে যায়। সেই বেকহ্যামই পেনাল্টি স্পট থেকে গোল করে ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জিতিয়ে দেয়। এ খেলার পরে আর্জেন্টাইনদের যেভাবে পচানি দিয়েছিলাম, আহা… মনে হয়েছিল এরকম দিন জীবনে একবারই আসে।

তবে আমার সে ধারনা ভুল প্রমান করে সেরকম দিন আবারো এলো, আরো উন্নতভাবে। সুইডেনের সাথে খেলার আগে আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরন ছিল না জিততে পারলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়। খেলার আগে সেদিন কমন রুম ভরে উঠেছিল সুইডেনের পতাকায়, সেখানের সবচেয়ে বড় পতাকাটাও সেদিন ছিল সুইডেনের। আমাদের এই একদিনের সাপোর্টারদেরকে সুইডেন হতাশ করেনি। সেভেনসনের দারুন এক ফ্রিকিক থেকে গোলে সুইডেন এগিয়ে যাবার পর থেকেই আমাদের উৎসব শুরু হয়ে যায়। এর আগে অবশ্য বেঞ্চে বসেই ক্যানিজিয়া লালকার্ড পাবার পরে কম উল্লাস হয়নি। শেষ মুহুর্তে আর্জেন্টিনা গোল একটা শোধ করলেও লাভ কিছু হয়না। এর পরে আর্জেন্টিনার সাপোর্টারদের উপরে যে ঝড় নেমে এসেছিল তা না বলাই ভাল।

সেভেনসনের ফ্রিকিকের সময় আর্জেন্টিনার ওয়াল !!!

১ম রাউন্ডে এসব বড় ধরনের অঘটনের ঘটনা ঘটার পর ২য় রাউন্ড তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক ভাবেই এগোয়, শুধুমাত্র গাস হিডিঙ্কের কোরিয়ার কাছে ইটালির হেরে যাওয়া বাদে। যদিও নেগেটিভ ইটালিকে আমি কখনোই দেখতে পারি না, তারপরো ঐদিন যেভাবে জোর পূর্বক হারানো হয়েছিল তাতে মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়েছিল। আজব ব্যাপার ছিল দঃ কোরিয়ার একস্ট্রা টাইমে জয়সূচক গোলদাতা ইতালির এক ক্লাবে ফুটবল খেলত। ওই ম্যাচের পরে তাকে ক্লাব থেকে বহিঃস্কার করা হয়।

এই দঃ কোরিয়া তাদের চমক অব্যাহত রেখে কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে হারিয়ে দিল স্পেনকে। জার্মানী হারালো ইউএসকে। আর দুই চমকের দলের খেলায় তুরস্ক হারায় সেনেগালকে। তুরস্কের খেলা আমার বিশ্বকাপের প্রথম থেকেই ভাল লেগেছিল। বিশেষ করে প্রথম ম্যাচে ব্রাজিলের সাথে দারুন লড়াই করার পর থেকে। হাকান সুকুর, হাসান সাস, উমিত দাভালাদের সবচেয়ে ভাল যে জিনিষটা লেগেছিল সেটা হলো ফাইটিং স্পিরিট। তবে তুরস্কের সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়ার আর এই বিশ্বকাপের প্রিয় গোলকিপার ছিল রুস্তু রেকোবার। পাইরেটের মত চেহারার এই গোলকিপার পারফর্মেন্স এখনো চোখে ভাসে।

তবে কোয়ার্টার ফাইনালের মূল আকর্ষন ছিল ব্রাজিল-ইংল্যান্ড ম্যাচ। খেলা ছিল শুক্রবারে, সাড়ে বারোটা বা দেড়টায়। জুম্মার নামাজের কারনে খেলার বেশ কিছু অংশ মিস হবার আশংকায় আমরা সংকিত। কিন্তু ঐ দিন সকালেই ক্যাডেট লাইফের সবচেয়ে আজবতম অর্ডারেগুলোর একটা পেলাম। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে খেলা দেখার জন্য কলেজের প্রিন্সিপাল মহাদয় (রইস উদ্দিন) জুম্মার নামাজ এক ঘন্টা এগিয়ে দিয়েছেন। শোয়া একটার জামাত হবে শোয়া বারোটায়। আর একটা আজব দিক ছিল আমাদের আর্জেন্টিনার সাপোর্টারেরা। যেখানে সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার অধিকাংশ জনগন চিরশত্রু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলকে সমর্থন করছিল সেখানে আমাদের দেশি আর্জেন্টিনা পার্টি ইংল্যান্ডের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছিলো। ম্যাচ সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নাই। রোনালদিনহোর সেই ফ্রি-কিক যা কিনা মিস হিট হয়ে অসাধারন এক শটে পরিনত হয় (যার পেছনে ডেভিড সিম্যানেরও যথেষ্ট অবদান ছিল) এর বদৌলতে শেষ ৩০ মিনিট ১০ নিয়ে খেলেও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ব্রাজিল।

সেমিফাইনালে সাপোর্ট করেছিলাম জার্মানী আর তুরস্ককে। অফিশিয়ালেরা দঃ কোরিয়াকে আর টেনে তুলতে পারলো না, জার্মানীর কাছে হেরে সেমি ফাইনালেই শেষ হয় ওদের জন্য স্বপ্নের এই টুর্নামেন্ট। আর অন্য দিকে আবারো সেই একমাত্র গোলে ব্রাজিলের কাছে হার মানতে হয় ওদের।

৩য় স্থান নির্ধারনী ম্যাচ নিয়ে কখনোই আকর্ষন পাই না, তবে সেবার তুরস্কের জন্য খেলা দেখছিলাম, আর সেসময় কলেজ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এসেছি। শেষ পর্যন্ত তুরস্ক ম্যাচ জিতে যায়। তবে অবাক লেগেছিল ম্যাচের শেষে, উভয় দলের খেলোয়ারেরা একসাথে হয়ে দর্শকদের অভিবাদন জানানো।

২০০২ এর ফাইনাল ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বোরিং ফাইনাল। একে তো কলেজের কমন রুম ছেড়ে বাসায় বসে খেলা দেখে মজা পাচ্ছিলাম না, তার উপর কোন দলকেই সেভাবে সাপোর্ট করছিলাম না। তবে একজন গোলকিপার (অলিভার কান) গোল্ডেন বল জেতায় বেশ খুশি হয়েছিলাম।

(অনেক চেষ্টা করেও বিশ্বকাপের আগে সিরিজটা শেষ করতে পারলাম না, ২০০৬ নিয়ে শেষ পর্ব দিতে হবে বিশ্বকাপ শুরুর পরেই…)

১,১৩৪ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “স্মৃতির বিশ্বকাপ-৪”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    ২০০২ এ ব্রাজিল ছাড়া সমর্থন করেছিলাম তু্রস্ককে। হাসান সাস আর রুস্তু রেকোবার কথা মনে আছে- ওদের খুব ভালো লেগে গিয়েছিল।

    আহ্‌! বিশ্বকাপ চলেই আসল। 😀

    জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    ২০০২ এর বিশ্বকাপের সময় রশীদ হলে ৫০২ নম্বর রুমে ছিলাম। ৫০৫ নম্বরে থাকা আমাদের কলেজের এক ব্যাচ সিনিয়র ইমরান ভাই কিভাবে কিভাবে জানি ডিশের একটা কানেকশন ম্যানেজ করে ফেললেন। ঠিক হলো আমরা ওই রুমেই এই টুর্নামেন্ট দেখবো। কোপা আমেরিকার সেমি ফাইনালে হন্ডুরাসের কাছে দুই গোলে হারের পর থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা রীতিমতন স্বর্গবাস করছে। হলের ক্যান্টিনে আলোচনা বা তর্কাতর্কি করতে করতে বিশ্বকাপ এসে গেলো। প্রথম ম্যাচ ছিলো ফ্রান্স আর সেনেগালের মধ্যে। প্রায় গোটা ম্যাচ ছিলো ফ্রান্সময় আর অন্যদিকে সেনেগাল সামান্য কয়েকটা আক্রমন করেছিলো এবং তার একটাতে বাবা ডিউপ বার্থেজকে বোকা বানিয়ে এবং গোটা ফ্রান্সকে স্তব্ধ করে দিয়ে ম্যাচের একমাত্র গোল করে বসে। স্প্যানিশ লীগের কল্যানে স্পেনেরও একটু একটু ফ্যান ছিলাম। স্লোভেনিয়ার সাথে ওদের খেলা ভালোই উপভোগ করেছি। এরপরের দিন ছিলো ব্রাজিলের খেলা। খেলা দেখার আগে এবং খেলা দেখার সময় নানা রকম কুসংস্কার পালন করলাম ইমরান ভাইয়ের নেতৃত্বে। কিন্তু আমাদের সব প্রচেষ্টা আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ করে দিয়ে তুরস্ক আগে গোল দিয়ে বসলো। এই গোল হবার ৪৫ সেকেন্ড আগে আমি প্রেডিকশন করেছিলাম তুরস্ক আগে গোল দেবে। আমার সাথের দর্শকেরা সবাই ব্রাজিলের ফ্যান হওয়ায় কেউই আমার ভবিষ্যত বানীর প্রতিভার মর্যাদা না দিয়ে আমাকে কুফার অবতার বানিয়ে দিলো। সেই মুহুর্ত থেকে ওই বিশ্বকাপের জন্যে আমার নাম হয়ে গেলো অ্যালবাট্রস। ফ্রান্স ট্র্যাজেডির পুনারাবৃতির আশংকা কিছুটা মিথ্যা প্রমান করার জন্যে রোনালদো দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকেই গোল শোধ দিয়ে দিলো। এই গোলটার আগেও আমি সফলভাবে প্রেডিক্ট করতে পেরে ছিলাম ১ মিনিট আগে। কিন্তু তাতেও আমার দুর্নাম ঘুচলো না।ব্রাজিলের তুলনাতে সেদিন তুরস্কের পারফর্মেন্স ছিলো অনেক ভালো। যা হোক, রিভালদো সেদিন খুব ভালো খেলতে না পারলেও, অভিনয়ের দক্ষতা দেখিয়ে তুরস্কের একজনকে লাল কার্ড খাইয়ে দেয়। এর ঠিক পরের মিনিটেই মনে হয় ব্রাজিল একটা পেনাল্টি পেয়ে যায় এবং সেটা থেকে জয়সুচক গোল করে রিভালদো। অন্য ফেবারিটদের মধ্যে জার্মানি সৌদি আরবকে ৮ গোলে পুরো উড়িয়ে দেয়। এছাড়া পর্তুগালের সোনালী প্রজন্মের শেষ বিশ্বকাপ দেখতে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু আমাদের সবাইকে চুড়ান্ত হতাশ করে ফিগো, রুই কস্তা, নুনো গোমেজেরা প্রথম ম্যাচেই ইউনাইটেড স্টেটসের কাছে হেরে গেলো। গ্রুপ অফ ডেথে থাকা আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচে তারা নাইজেরিয়ার সাথে বেশ ভালো আক্রমনাত্মক ফুটবল খেললেও কোনো গোল পাচ্ছিলো না। ভেরন, জানেত্তি, ওরতেগারা খুব বেশী সুন্দর ফুটবল খেলতে গিয়ে বেশ কয়েকজনকে কাটিয়ে যে অন্য কাউকে পাস দিতে হয় বা পোস্টে যে শট নিতে হয় এই ব্যাপারটা মনে হয় বারবার ভুলে যাচ্ছিলো। আমার মনে আছে, প্রথমার্ধের মাঝামাঝি দিকে ইমরান ভাইয়ের মতন পাড় অ্যান্টি আর্জেন্টিনাও বিরক্ত হয়ে চিৎকার করতেন, আল্লাহর ওয়াস্তে শট নে রে ভাই, শট নে। আসলেই এরা মাঝমাঠ থেকে বড় পেনাল্টি এরিয়া পর্যন্ত যে সময় নিতে ততক্ষনে মাঝমাঠ থেকে মিডফিল্ড বা সেন্টার লাইনের অপর প্রান্ত থেকে ফরয়ার্ডেরা এমনকি গ্যালারী থেকে দশর্কেরাও নেমে আসতে পারে ডিফেন্সের জন্যে। যাই হোক আমাদের মুখে ছাই দিয়ে বাতিস্তুতার একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত জিতে যায়। এই গ্রুপের অন্য খেলাতে ইংল্যান্ড সুইডেনের সাথে ড্র করে। ফ্রান্স তাদের দ্বিতীয় খেলাতে গোলশুন্য ড্র করে বাদ পড়ে যাবার মুখোমুখি হয়। স্পেন যথারীতি তাদের স্বভাবসুলভ আক্রমনাত্মক ফুটবল দিয়ে প্যারাগুয়েকে উড়িয়ে দেয়। ওই ম্যাচটার রেজাল্ট ছিলো ৩-১ এবং প্যারাগুয়ের একমাত্র গোলটা পুয়োলের করা আত্মঘাতি গোল হওয়ায় ম্যাচ শেষে দেখা গেলো সবগুলো গোলই করেছে স্পেন। ব্রাজিলের দ্বিতীয় খেলার দিনে বুয়েটে ছাত্রদলের দুটো গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এর পরে বেশ কয়েকদিন খেলা দেখার কোনো মুড ছিলো না। হলে বিভিন্ন গোলোযোগের কারনে হল বন্ধ করে দেয়ায় বাসাতে চলে আসি। প্রথম রাউন্ডের বাকি খেলাগুলো আর তেমন ভাবে দেখা হয়নি।

    দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা দেখা শুরু করি আকিকের বাসায়। আমি, অদ্বিত আর রনি ছাড়াও সেখানে আসতো জেসিসির মামুন, ঢাকা কলেজ থেকে পাস করা আমাদের মেকানিক্যাল ব্যাচমেট রাশেদ। ২০০২ এ ফেবারিটদের মধ্যে ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা আর পর্তুগাল প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। আর ইতালি হয় গ্রুপ রানার আপ। যথারীতি জার্মানি তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ জিতলেও আমাদের হতাশ করে মেক্সিকো স্টেটসের কাছে হেরে যায়। গ্রুপ পর্বে স্পেনের গোল পেতে কোনো ঝামেলা না হলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে এসে আয়ারল্যান্ডের সাথে তাদের জয় আসে টাইব্রেকারে। সব চাইতে অবাক করা ব্যাপার ছিলো ইতালির সাথে কোরিয়ার জয়। তবে তাদের এই জয়ে ভাগ্য এবং ভুল রেফারিং এরও বেশ ভালো ভুমিকা ছিলো। প্রথম রাউন্ডে সহজ গ্রুপ পাওয়া ব্রাজিল একটু শক্ত প্রতিপক্ষ পায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। বেলজিয়াম কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারলেও রিভালদো আর রোনালদোর গোলে জিতে যায়। প্রথম রাউন্ডে ফ্রান্সকে হতবাক করে দেয়া সেনেগাল দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইডেনকে গোল্ডেন গোলে হারিয়ে দেয়।

    আমরা প্রতিদিন খেলা শেষে চা, সিগারেট আর সিঙ্গারা বা মোগলাইয়ের সাথে ম্যাচ অ্যানালাইসিস করতে করতে এক সময় খেয়াল করলাম আমরা যারা একসাথে খেলা দেখছি সবাই ব্রাজিলের সাপোর্টার। এই জন্যে ম্যাচ দেখার সময় কোনো তর্কাতর্কি করা হচ্ছে না। তাই কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ দেখার জন্যে আমরা আর্জেন্টিনার এক সাপোর্টারকে আমন্ত্রন করে আনি। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম ম্যাচ ছিলো ব্রাজিল আর ইংল্যান্ডের মধ্যে। এবং দুঃখজনকভাবে ডিফেন্সের ভুলের কারনে ব্রাজিল প্রথমেই একটা গোল খেয়ে যায়। সেই আর্জেন্টিনা সমর্থকের তীর্যক বাক্যবান হজম করতে করতে অবশষে আমাদের ভাগ্যে শিকে ছিড়লো। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ মিনিটে রিভালদো একটা গোল দিয়ে সমতা আনে। এরপরে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে অসাধারন একটা ফ্রী কিক থেকে ডেভিড সীম্যানকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে গোল করে রোনালদিনহো। আরাম করে আর্জেন্টিনার সেই সাপোর্টারকে পচানো শুরু করতে না করতেই ভুতুড়ে একটা লাল কার্ড দেখে বের হয়ে যেতে বাধ্য হলো আমাদের নতুন হিরো রোনালদিনহো। বাকি ম্যাচগুলোতে জার্মানি আর তুরস্ক তাদের নিজেদের ম্যাচ জিতলেও কোরিয়া তাদের চমক অব্যাহত রেখে এবং আবারো ভাগ্য আর বাজে রেফারিং এর সুযোগে এবার স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দেয়। যতদুর মনে পড়ে টাইব্রেকারে কোরিয়ার গোলকিপারের দক্ষতার চাইতে স্পেনের পেনাল্টি টেকারদের ব্যর্থতা বেশি ছিলো।

    জার্মানির সাথে কোরিয়ার সেমিফাইনালে আশা করেছিলাম কোরিয়া তাদের ভাগ্য ধরে রাখতে পারবে। কোরিয়া প্রথম থেকেই ড্র এর লক্ষ্যে খেলতে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি বালাক একটা গোল দিয়ে দেয়। গোল খাবার পরে কোরিয়া কিছুটা আক্রমন করে খেলতে থাকলেও জার্মানি লীডটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখল। গোলের আনন্দের সাথে বালাখ আর জার্মানি বিশাল একটা ধাক্কাও খেয়ে বসে। গোলটা হবার কিছু আগে বালাক একটা হলুদ কার্ড দেখায় সাস্পেনসনের ফাঁদে পড়ে ফাইনাল না খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়। অন্যদিকে দুই গ্রুপমেট ব্রাজিল আর তুরস্ক মুখোমুখি হবার আগে বসফরাসের ষাঁড় হাকান সুকুর দাবি করে উঠলো যে ব্রাজিলের সাথে জেতার লক্ষ্য নিয়েই নামবে তুরস্ক। কিন্তু খেলার সময় ব্রাজিলের ডিফেন্ডারেরা হাসান সাস আর হাকান সুকুরকে লাগাম বন্দি করে রাখতে সক্ষম হয়। রোনালদো আর রিভালদো চমৎকার সব আক্রমনগুলো তুরস্কের গোলকিপার রুস্তুর অসাধারন দক্ষতার কাছে ধরা খেয়ে যেতে থাকে। অবশেষে রোনালদোর একটা শট রুস্তুর নাগালের জাস্ট বাইরে দিয়ে পোস্টের কোণা দিয়ে জালে জড়ায়। এই একমাত্র গোলে ব্রাজিল টানা তৃতীয়বারের মতন ফাইনালে ওঠে।

    তৃতীয়স্থান নির্ধারনী ম্যাচের আগে আমরা হাকান সুকুরকে বসফরাসের ষাঁড়ের বদলে বসফরাসের বলদ ডাকা শুরু করেছিলাম। তবে কোরিয়ার সাথে খেলা শুরু হবার সাথে সাথে সে গোল দিয়ে দেয়। কিক অফ নিয়েছিলো কোরিয়া। ওদের মিডফিল্ডের একজনের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে সে সোজা গোল দিয়ে দেয়। এইটাও বেশ ভালো ম্যাচ হয়েছিলো। দশ মিনিটের মধ্যে কোরিয়া সমতা আনে। তবে প্রথমার্ধের মধ্যে তুরস্ক ৩-১ গোলে এগিয়ে যায়। একেবারে শেষ মিনিটে কোরিয়া আরো একটা গোল দিয়ে ব্যবধান কমাতে সক্ষম হয়।

    ফাইনালে ব্রাজিল বেশ চাপিয়ে খেলা শুরু করলেও গোল পাচ্ছিলোনা অলিভার কানের জন্যে। দ্বিতীয়ার্ধের সময় রিভালদোর একটা শট ঠিকঠাক ভাবে ক্লিয়ার করতে না পারায় সেটা রোনাল্ডোর পায়ে চলে আসে, আর সে গোল দিয়ে দেয়। কিছুক্ষন পরে ঠিক এই জুটিই আরেকটা গোল দিয়ে দেয়। এবং ব্রাজিলের পাঁচ নম্বরটা নিশ্চিত হয়ে যায়। 😀 😀 😀 😀 😀

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    এই বিশ্বকাপটা ব্যাপক আরাম কইরা দেখছিলাম... B-)
    বিশ্বকাপের জাস্ট আগে আগে মেডিকেল এ আর পড়ুম না ডিসিশন নিয়া গাট্টি-বোচকা বাইন্দ্যা বাড়ি ফেরত গেছিলাম...সাথে ছিল অনেক অপকর্মের সাথী ইসলাম...ব্রাজিল চ্যাম্প হবার কারনে ভাল লাগাটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল... :awesome:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯৮-২০০৪)

    বিশ্বকাপের পরে রোনালদিনহো প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন থেকে বার্সায় চলে আসে,তারপর তো ইতিহাস...
    রোমারিওকে দলে না নিয়ে স্কলারি নিজ দেশে অনেকের চক্ষুশূল হলেও বিশ্বকাপের পর সব কিছু বদলে যায়।ডুঙ্গা যদি এবার চ্যাম্পিয়ন হত তাহলে বলতাম না,কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে যেঃ ব্রাজিলে এবার রোনালদিনহো,পাতোকে দরকার ছিল।বিশেষ ভাবে কাকার বদলী কেউ ছিল না(জুলিও ব্যাপ্টিস্টা বা রেমিরেস তো ঐ মানের না)।এছাড়া কাকা আর রোনালদিনহোকে এক সাথেও খেলানো যেত,আগে যেমন হয়েছে।
    একই ভাবে ম্যারাডনার উচিত ছিল জানেত্তি,রিকুয়েমকে দলে রাখা,তাহলে মেসি আরও বেশি বলের যোগান পেত,সে তো নিচে নেমে এসে বল নেয়াতে অভ্যস্ত না,মেসি বার্সায় মেইন স্ট্রাইকারদের একটু পিছনে ডান দিকে খেলে থাকে।আর টেভেজ/হিগুয়াইনের সাথে বদলী করে প্রতি ম্যাচেই মিলিতোকে খেলানো দরকার ছিল।
    আমি যদি কোচ হতাম...।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।