স্মৃতির বিশ্বকাপ-৩

বিশ্বকাপ শুরু হতে আর এক সপ্তাহও বাকি নেই, স্মৃতিচারনের এখনো বাকি রয়েছে বেশ খানিকটা… আজ এর তৃতীয় পর্ব।

স্মৃতির বিশ্বকাপ-১
স্মৃতির বিশ্বকাপ-২

১৯৯৮(ফ্রান্স)

১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ ছিল সম্পূর্ন আলাদা। ক্যাডেট কলেজে প্রথম বিশ্বকাপ। যদিও বিশ্বকাপের অর্ধেক হবার আগেই ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল তারপরো কলেজের খেলাগুলোর স্মৃতিই বেশি উজ্জ্বল। বিশ্বকাপের উত্তেজনা শুরু হয়ে গিয়েছিল টার্মের শুরু থেকেই, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল গ্রুপিং, ফ্লাশ বোর্ডে টুকটাক কার্টুন চলছিল। এরপর শুরু হলো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল (আরো ভাল ভাবে বললে এন্টি আর্জেন্টিনা- এন্টি ব্রাজিল) ফুটবল ম্যাচ। বিশ্বকাপ শুরু হবার আগেই কলেজ সরগরম।

টুর্নামেন্ট শুরুর দুদিন আগে দেখলাম বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের পাশে বিশাল বিশাল দুটো বাঁশের উপরে টিভি এন্টেনা লাগাচ্ছে গ্রাউন্ডস্ম্যানেরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল পুরো ক্যাম্পাসের লোকজনের খেলা দেখার জন্য সেখানে দুটো টিভি লাগানো হবে। গেমস টাইমের পরে তাঁর টেনে কারেন্টের লাইনও নেওয়া হলো। তবে বিপত্তি দেখা গেল পরেরদিন সকালে। রাতের আধারে কলেজের মাস্তান কুকুর বাহিনী পুরো তার কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে। কুকুর বাহিনীর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য সে রাতে আবার আবারো তার বিছানোর পরিকল্পনা করা হলো তবে এবার কারেন্টের কানেকশনসহ। তবে পরবর্তীতে সে পরিকল্পনা বাতিল করা হলো আর আমাদের বিশ্বকাপের গ্যালারী হলো সেই চিরচেনা কমন রুম। আর ক্লাস নাইনে থাকায় আমাদের জায়গা আক্ষরিক অর্থেই গ্যালারীতে হয়েছিল। দুটো বেঞ্চ পাশাপাশি রেখে তারুপর আরেকটা বেঞ্চ তুলে তৈরী হতো সেই গ্যালারী। বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনাকর মুহুর্তে হুড়মুড় করে এই গ্যালারী ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাও কম ছিলনা।

বিশ্বকাপের আগেই পুরো কলেজ ভাগ হয়ে গেল দুই ভাগে, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। এর বাইরে আমার মত যারা অন্যান্য দলের সমর্থক ছিল তারাও মূলত প্রথমে এন্টি আর্জেন্টিনা, এন্টি ব্রাজিল হিসেবে পরিচিতি পেল। পুর কলেজে হল্যান্ডের সাপোর্টার ছিল ৩-৪ জন। তাই খুব একটা আওয়াজ তুলতে পারিনি, তবে বিশ্বকাপের ঠিক আগে এক প্রস্তুতি ম্যাচে হল্যান্ড ৫-০ গলে জিতল, গোল করে ছিল ৫ জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়ার। এরপরেই কিছুটা আওয়াজ তুলেছিলাম।

কমনরুম ভরে উঠলো বিভিন্ন দেশের পতাকায়, মূলত আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের। পতাকা ছেড়া নিয়ে বেশ কিছু সিরিয়াস গ্যাঞ্জাম ও হয়েছিল। তবে সবচেয়ে কালারফুল ছিল বাতিল হয়ে যাওয়া সাদা পাঞ্জাবি আর ক্লেজ থেকে দেয়া কাফনের কাপর টাইপের হাফ শার্ট গুলোকে জার্সি ব্যানার ইত্যাদিতে রূপান্তর করা। আর্জেন্টিনা পার্টির জন্য কাজটা অনেক সহজ ছিল, শুধু নীল স্ট্রাইপ টানলেই হলো। ব্রাজিলিয়ানেরা মনযোগ দিল বুকে পিঠে প্তাকা আকার দিকে। আর্ট ক্লাসের ওয়াটার কালার দিয়েই এইসব শিল্পকর্ম চলতো। অনেকে প্রফেশনালও বনে গিয়েছিল, শার্ট প্রতি কোক-কোন। ব্রাজিলের হির ছিল রোনাল্ডো, দ্যা ফেনোমেনন। আর আর্জেন্টিনার ছিল সেই সময়ের ম্যারাডোনা ( ওরা অবশ্য প্রতি দুই বছর পর পর নতুন ম্যারাডোনা খুঁজে পায়) ওর্তেগা। তবে বিশ্বকাপ শুরু হবার পর অনেককেই নতুন করে চিনেছিলাম। এরমধ্যে সেরা ছিল চিলির জা-সা (জামারেনো-সালাস) জুটি।

আর ছিল প্যারাগুয়ের গোলকিপার চিলাভার্ট। পেনাল্টি, ফ্রি কিক নেয়া এই কিপারের কিপিং ও ছিল অসাধারন। ২য় রাউন্ডে ফ্রান্সকে প্রায় আটকে ছিল, শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন গোলে হেরে যায় তারা। মনে আছে চিলাভার্টের একটা লাকি কয়েন ছিল, যেটা ও সব সময় গোল লাইনের পেছেওনে রাখত।

কোয়ার্টার ফাইনাল দেখে ছিলাম বাসায় এসে। কলেজের মত জমজমাট না হলেও বাসার ছাদে সব ফ্লাটের লোকজন মিলে খেলা দেখার আয়োজন খুব একটা কম ছিল না। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে হল্যান্ডের পক্ষে একা একা সাপোর্ট দিতে হলেও কোয়ার্টার ফাইনালে বিশাল সমর্থন পেয়ে গেলাম। কারন আর কিছুই না, খেলা যে আর্জেন্টিনার সাথে। ক্লুইভার্টের গলে হল্যান্ড শুরুর দিকেই এগিয়ে যায়, কিছুক্ষন পরেই সমতা নিয়ে আসে আর্জেন্টিনা। সেকেন্ড হাফে লাল কার্ড খায় হল্যান্ড। কিন্তু এখানেও সমতা নিয়ে আসে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার একালের ম্যারাডোনা (সে সময়ের) উপাধির প্রতি সুবিচার করে চিটিং করে পেনাল্টি আদায়ের চেষ্টা এবং পরবর্তীতে বামন হয়ে চাঁদ ছোবার চেষ্টা ( ভ্যান ডার সারের মত তাল গাছের মুখে ঢূঁস দেয়ার) ফলাফল লালকার্ড। কিন্তু তারপরেই বার্গক্যাম্পের যাদু। ঐ গোলের বর্ননা দেবার মত ক্ষমতা আমার নেই, নিজের চোখেই দেখে নিন। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত আমার ফেভারিট গোল।

সেমিফাইনালে হল্যান্ডের খেলা পড়ল ব্রাজিলের সাথে। এবারে গ্যালারীর পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার সব আর্জেন্টিনা পার্টি আমার দলে, আগের ম্যাচেই যারা আমার বিরুদ্ধে আওয়াজ দিচ্ছিল। তবে এই সেমিফাইনাল আমার জীবনের অন্যতম ফ্রাস্টেতিং ম্যাচ। ক্লুইভার্ট একাই এতগুলো সুযোগ নষ্ঠ করেছিল যে মনে হচ্ছিল এসকাবারোর মত ওকেও গুলি করে মারি। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গিয়ে হেরে গেল হল্যান্ড।

সেমিফাইনালে এইরকম ট্রাজিক হারের পরে ফাইনাল নিয়ে তেমন একটা আকর্ষন পাচ্ছিলাম না, তবে চাচ্ছিলাম ব্রাজিল যাতে না যেতে। ফ্রান্স সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা টুর্নামেন্টের শুরুতে ছিল না, তবে আস্তে আস্তে ভালই লাগছিল। টেকো জিদানের হেডে করা দুই গোলে ফ্রান্স জিতে নিল বিশ্বকাপ। তবে এর চেয়েও বড় খবর হয়েছিল রোনাল্ডোর মৃগী ব্যারাম। আর ছুটি শেষে কলেজে গিয়ে ব্রাজিল পার্টিকে এই মৃগী ব্যারাম নিয়ে যথেষ্ঠ টিজ সহ্য করতে হয়েছিল ।

২,০৮৪ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “স্মৃতির বিশ্বকাপ-৩”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    ৯৮ এর বিশ্বকাপের সময় আমরা টুয়েল্ভে ছিলাম। আমাদের যারা ক্লাব ফুটবল ফলো করতো, তাদের কাছে রোনালদো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোসের বেশ ভালো নাম শুনে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছিলো। বিশ্বকাপ শুরু হবার কয়েকদিন আগে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হাউসের পেছনের দিকটা আর্জেন্টিনার পতাকাতে পতাকান্বিত হয়ে আছে। আমরা ব্রাজিলের সাপোর্টারেরা তখন চাঁদা তুলে ব্রাজিলের বিশাল একটা পতাকা (১০ ফিট * ৮ ফিট) বানালাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটা একটা খেলা পরেই এ্যাডজুটেন্ট সিজ করে নিয়ে যায়। :(( :(( :((
    টুর্নামেন্ট শুরু হবার আগে রোমারিও ইঞ্জুরিতে পড়ে একটা হাল্কা ধাক্কা দিয়ে গেলো। ওইদিকে রোনালদো জাস্ট ফন্টেইনের রেকর্ড ভাঙ্গার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলো। সে কিন্তু এই টুর্নামেন্টের আগে বেশ দারুন ফর্মে ছিলো।
    এদিকে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাও বেশ আশাবাদি। ওর্তেগা, সিমিয়ন, ভেরন, লোপেজেরা নাকি একেকটা একেক জন ম্যারাডোনা। এরা সবাই যে ফর্মে আছে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন না হয়ে নাকি আর কোনো উপায় নাই। আসলেই আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ডে সেই রকম খেলা দেখালো। গ্রুপের তিনটা ম্যাচেই ভালোভাবেই জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে চলে গেলো। আর্জেন্টিনার মতই ফ্রান্সও ৯ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়েছিলো। কিন্তু তখন ফ্রান্সের সাপোর্টার তেমন একটা না থাকায় এদের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়নি। আর ব্রাজিলও খুব ভালো খেলছিলো তখন সেটা বলা যাবে না। প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের সাথে একটা আত্মঘাতি গোলের কারনে জিতলো। তারপরের ম্যাচে মরক্কোর সাথে ভালোভাবে জিতলেও পরে নরওয়ের সাথে একটা দুর্ভাগ্যজনক পেনাল্টির জন্যে হেরে যায়। এই গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর মধ্যে হল্যান্ড আর কোরিয়ার ম্যাচটা দেখে খুব ভালো লেগেছিলো। ওয়ান টাচ পাসিং আর টোটাল ফুটবেল একটা কম্বিনেশন দিয়ে কোরিয়াকে ৫-০ গোলে হারিয়েছিলো হল্যান্ড। তবে কোরিয়ার ফাইটিং স্পিরিটও ছিলো মুগ্ধ করার করার মত। ডিফেন্সে বসে না থেকে তারাও হল্যান্ডকে আক্রমন করে গিয়েছে সমানতালে। মোটামুটি ভাবে ফেবারিটদের মধ্যে একমাত্র ব্রাজিলের খেলাই আমার কাছে দুর্বল মনে হচ্ছিলো। এই গোটা প্রথম রাউন্ডে বিশ্বকাপের থীম সংটা বাদ দিলে আর কিছুই তেমন ভাবে উপভোগ করতে পারিনি।

    দ্বিতীয় রাউন্ডের শুরুতে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা জানালো রোনালদোর ইন্টার মিলান টিমমেট চিলির সালাস বা জামোরানো ঠিক করেছে ব্রাজিলকে হারানোর পরে রোনালদোর সাথে জার্সি বদল করবে। কিন্তু ঠিক ওই ম্যাচে ব্রাজিল তার আসল রুপ নেয়ায় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মুখে কালি মাখিয়ে দিয়ে ৪-১ গোলে জিতে গেলো। ম্যাচ শেষে সেই জার্সি বদল অবশ্য ঠিকই হয়েছিলো। দ্বিতীয় রাউন্ডের সব চাইতে উত্তেজনাপুর্ন ম্যাচ ছিলো আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ডের ম্যাচ। এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার এক খেলোয়ারকে (খুব সম্ভবত সিমিয়নকে) লাথি মেরে লাল কার্ড খায় বেকহ্যাম। ইংল্যান্ডের সমর্থকেরা এই ঘটনাকে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট বললেও ব্যাক্তিগতভাবে আমার ধারনা বেকহ্যাম লাল কার্ড না খেলেও ম্যাচের রেজাল্ট অন্যরকম হতো না। শিয়েরার বা ওয়েন যত ভালোই হোক প্রথম ৩০ মিনিটের পরে আর্জেন্টিনার ডিফেন্স কাউকে আলগা সুযোগ দিচ্ছিলো না। বেকহ্যাম থাকলে হয়তো ইংল্যান্ড আরো কিছু আক্রমন করতে পারতো, হয়তো ফ্রী কিক থেকে বেকহ্যাম একটা গোলও বের করে আনতে পারতো। কিন্তু ইংল্যান্ড সেসময় এগিয়ে থাকলে বেশী ডিফেন্সিভ হবো নীতিতে থাকায়, আমার মনে হয়, ঠিকই আর্জেন্টিনা গোল শোধ দিয়ে খেলা টাইব্রেকারে নিত। আর আমার যতদুর মনে পড়ে ইংল্যান্ড তখন পর্যন্ত কোনো টাইব্রেকারে জিততে পারেনি।

    দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচগুলোতে ফেবারিটেরা সবাই জেতায় কোয়ার্টার ফাইনালটা হয়েছিলো বেশ জমজমাট। ব্রাজিল-ডেনমার্কের ম্যাচটা ছিলো ক্যাডেট কলেজে দেখা শেষ খেলা। এর আগে ফ্রান্স-ইতালির ম্যাচে ভালো খেলা সত্ত্বেও আবার টাইব্রেকারে ইতালি হেরে যায়। ব্রাজিল-ডেনমার্কের ম্যাচটাতে দুই দলই সমানভাবে আক্রমন করে খেলেছে। একেবারে প্রথমেই গোল খেলেও আধা ঘন্টার মাথায় আবার এগিয়ে যায় ব্রাজিল। আবার ডেনমার্ক সমতা ফিরিয়ে আনলে কিছুক্ষন পরেই রিভালদোর গোলে এগিয়ে থেকে জিতে যায় ব্রাজিল। পরের দিন চলে যেতে হবে কলেজ ছেড়ে, এই জঘন্য চিন্তাটার জন্যে ঠিকঠাকভাবে উপভোগ করতে পারছিলাম না। পরের দিন কলেজ ছাড়ার দুঃখ শতগুনে বাড়িয়ে দিতে হল্যান্ডের কাছে আর্জেন্টিনা হেরে গেলো। আর্জেন্টিনা সাপোর্টারদের তো হারের দুঃখ ছিলোই, আর আমরা যারা অ্যান্টি আর্জেন্টিনা ছিলাম তাদের দুঃখ ছিলো ওদের ঠিকঠাকভাবে পচাতে না পারার। এই ম্যাচটাও দারুন জমেছিলো। দুই দলই ভালো অ্যাটাকিং ফুটবল খেলছিলো। তবে হল্যান্ডের একজন লাল কার্ড খেয়ে যাবার পরে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারন হল্যান্ড দলটা ছিলো কিং মেকার। আমাদের সারোয়ার একটা পরিসংখ্যান থেকে দেখিয়েছিলো, নক আউট পর্বে যারা হল্যান্ডকে হারাতে পারে তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু ওর্তেগা মাঝখানে মেজাজ হারিয়ে ভ্যান ডার সারকে মাথা দিয়ে ধাক্কা দেয়ায় সেও লাল কার্ড দেখে আর্জেন্টিনার অ্যাডভান্টেজটা নষ্ট করে দেয়। একেবারে শেষ মুহুর্তে বার্গকেম্প অসাধারন একটা গোল দিয়ে হল্যান্ডকে হল্যান্ডকে জিতিয়ে দেয়। আহসান ইতিমধ্যেই গোলটার লিঙ্ক দিয়েছে। এই গোলটা এই আসরের সেরা গোল।

    তবে হল্যান্ডের সাথে সেমিফাইনাল শুরু হবার আগে অবশ্য এই ফুরফুরে ভাব ছিলো না। ক্লুইভার্ট নিজের ফর্ম ফিরে পাওয়া শুরু করেছে, বার্গকেম্প, কোকু, ওভারমার্স, স্ট্যাম, ভ্যান ডার সার - সবাই দারুন ফর্মে আছে। তারপরেও আশাবাদি ছিলাম রোনালদো রিভালদো জুটি ব্রাজিল সমর্থকদের হতাশ করবে না। দ্বিতীয় অর্ধের শুরুতেই রোনালদো ব্রাজিলকে এগিয়ে দেবার পরে ব্রাজিল কেনো জানি হঠাৎ ডিফেন্সিভ হয়ে যায়। আর হল্যান্ড সেই সুযোগ পুরোপুরি নিয়ে একের পরে এক আক্রমন করতে থাকে। সে সময় খেলা শেষ হবার পরে আকিক বা অদ্বিতের সাথে ফোনে ম্যাচ অ্যানালাইসিস করতাম। শেষ ৫ মিনিটে আর গোল দিতে পারবেনা ভেবে আকিকের ফোনে ডায়াল করতে করতেই দেখি ক্লুইভার্ট গোল দিয়ে দিলো। অতিরিক্ত সময় শেষ করে টাইব্রেকারে টাফারেল বনাম ভ্যান ডার সার, দুই সেরা গোলকিপার। দুশ্চিন্তা দূর করে ব্রাজিলের কিক টেকারেরা ভালো কিক নিলো। হল্যান্ডও ভালোই চালাচ্ছিলো, কিন্তু কোকু হঠাৎ তার কিকটা মিস করে বসলো। টাফারেল ডাইভ দেবার মুহুর্তে উঠিয়ে রাখা হাতে ওর কিকটা লেগে যায়। এর পরে হল্যান্ডের আরোও একজন মিস করে ফেলায় খেলা শেষ। এই টাইব্রেকারটা জেতার পরে ব্রাজিলের জন্যে আনন্দের চাইতে হল্যান্ডের জন্যে খারাপ লেগেছে বেশী। বারবার মনে হচ্ছিলো, খেলা শেষ করার আরেকটু ফেয়ার কোনো উপায় যদি থাকতো। ইতালি-ব্রাজিল ফাইনালের সময় ইতালির চাইতে ব্রাজিল অনেক ভালো খেলেছিলো, ওই ম্যাচটাতে জয় ব্রাজিলের প্রাপ্য ছিলো। কিন্তু এই ব্রাজিল হল্যান্ড ম্যাচে হল্যান্ড অধিকাংশ সময়েই ব্রাজিলের চাইতে ভালো খেলেছে, জাস্ট টাফারেলের একটা চতুরতার কারনে গোটা ১২০ মিনিট ভালো খেলা কোকু, ওভারমার্স, ক্লুইভার্ট বা বার্গকেম্পের কষ্টটা পুরো পানিতে। ব্রাজিল টাইব্রেকারে হেরে গেলে হয়তো আরো কষ্ট পেতাম, কিন্তু মনের ভেতরে হয়তো স্বান্তনা থাকতো যে, ভালো টিমটাই জিতেছে। ফুটবল আসলেই খুব নিষ্ঠুর।

    আরেকটা সেমি ফাইনাল ছিলো ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে। ফুটবলের ইতিহাস সম্পর্কে তেমন ধারনা না থাকায় দুই দলের কোনোটাকেই গনার মধ্যে ধরিনি। তাই ভেবেছিলাম যেই যাক কোনো সমস্যা নেই। আর ব্রাজিল তো হল্যান্ডকে হারিয়েছেই। ক্রোয়েশিয়ার ডেভিড সুকার ছিলো দারুন ফর্মে আর জিদানের নাম তখন নতুন শুনছি। থিয়েরী হেনরীর নাম জানতাম না তখন। ক্রোয়েশিয়া যথেষ্ট ভালোই খেলছিলো সুকারের গোলে এগিয়েও গিয়েছিলো তারা এক পর্যায়ে কিন্তু সম্পুর্ন অপ্রত্যাশিতভাবে লিলিয়ান থুরাম পর পর দুই গোল দিয়ে ক্রোয়েশিয়ার কপালে লাথি মেরে দিলো।

    ক্রোয়েশিয়ার পরিনতিতে খুব দুঃখিত হয়েছিলাম বলা যাবে না। ক্লাব ফুটবলের খোজখবরও তখন রাখতাম না। তাই মনে করেছিলাম জিদান, হেনরী, দেসচ্যাম্পদের ক্রোয়েশিয়া প্রায় ধরা খাইয়ে দিয়েছে সুতরাং এদের ঠেকানো ব্রাজিলের কাছে কোনো ব্যাপারই হবে না, ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন। ফাইনাল খেলা শুরু হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই বিশ্বাসের নৌকা ফুটো হয়ে পানি ঢোকা শুরু হলো। তারপরেও মনকে স্বান্তনা দিলাম যে ব্রাজিল তো একটু "শেকি স্টার্ট" করেই। কিন্তু জিদান একাই ব্রাজিলের ডিফেন্স আর মিডফিল্ডের নাকের পানি চোখের পানি এক করে দিয়ে প্রথম হাফেই দুইটা দিয়ে দিলো। ব্রাজিলের খেলা দেখে মনে হচ্ছিলোনা তারা আদৌ কোনো প্ল্যান নিয়ে খেলছে। দ্বিতীয় হাফে যা হোক ব্রাজিল কিছু আক্রমন শুরু করলো কিন্তু ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করার মতন কিছুই না। শেষ পর্যন্ত আরোও একটা গোল খেয়ে রানার আপ বা কিং অফ দ্য লুজারস হয়ে ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ শেষ করলো ব্রাজিল। আমার সে সময়ে মনে হচ্ছিলো দুঃস্বপ্ন দেখছি, আশা করছিলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখবো আসলে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তখন ভেবেছিলাম ফুটবল দেখাই ছেড়ে দেবো।
    :(( :(( :(( :(( :((

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      আপনার ফাইনালের পরে যে ফিলিংস হয়েছিল, আমার সেটা হয়েছিল সেমিফাইনালের পরে।

      বেকহ্যাম সেই লাল কার্ড এর পরে জাতীয় ভিলেন এ পরিনত হয়েছিল, সেখান থেকে সে আবার জাতীয় হিরো হয়ে গেছে।এটা একটা দারুন এচিভমেন্ট। বেকহ্যামকে অনেকেই তেমন একটা পাত্তা না দিলেও আমার কাছে দারুন লাগে।

      ওয়েনের গোলটার কথা মিস করেছি, অনেকেই ওটাকে ৮৬'র ম্যারাডোনার গোলের জবাব হিসেবে দেখছিল। আপসোস লাগে এতো দারুন একটা স্ট্রাইকার ইঞ্জুরির কারনে হারিয়েই গেল।

      ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া এদের সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না, তাই সেভাবে ফলোও করি নাই সে সময়।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      মাইনুল ভাই আপনার কথায় আমি ডিফার করবো। কারণ ৯৮ আমর ফুটবল টেকনিক্যালি বুঝার পর প্রথম বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড আর্জেন্টিনা ম্যাচ আমার দেখা সেরা ম্যাচগুলোর একটি। অভিনয় পটু সিমিওনির জন্য বেখ্যাম লালকার্ড খেয়েছিলো। কিন্তু দশজনের ইংল্যান্ড দারুণ লড়েছিলো।খুব সম্ভবত সোল ক্যাম্পবেল একটি গোল করেছিলো যেটি ফাউলের অজুহাতে বাতিল করা হয়। আর্জেন্টাইন বোদ্ধারা ব্রেইমার পেনাল্টি ( ১৯৯০) নিয়ে অনেক কথা বললেও এইটা নিয়ে খাউরে কিছু কইতে শুনি না। টু মি ইট ওয়াস ক্লিয়ার গোল। ঐ বিশ্বকাপে হল্যান্ডরে দারুণ পাইছিলাম। কারণ ওরা তিনটা দারুণ ম্যাচ প্রডিউস করছে। দুইটার কথা তো সবাই বললো আর যুগোশ্লাভিয়ার সাথে সেকেন্ড রাউন্ড ম্যাচটাও দারুণ ছিলো...। তবে সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলরে ভালো লাগছিলো রিভালদোর জন্য। আমি রিভালদোর বিরাট ভক্ত তখন থেকেই(এই কারণে পরে বার্সালোনা)। ফাইনালে ব্রাজিল হারাতে একটু খারাপ লাগছিলো তবে পৈশাচিক আনন্দ পাইছিলাম জা ফন্টেইনের রেকর্ড ভাঙতে চাওয়া রোনালদোর কাতরানি দেইখা। ফ্রান্সরে ভালো পাইতাম না ব্যাজিওদের বিদায় করার পর। তবে প্যারাগুয়ে ফ্রান্স ম্যাচটা প্যাথেটিক লাগছিলো। আমার মনে আছে টানা চার মিনিট মতো বল প্যারাগুয়ের বক্সের চারপাশে ঘুরছে। এমন প্যাথেটিক দল বাদ ফালাতে ফ্রান্সকে সাপোর্ট দিছিলাম। নাইজেরিয়া অযথাই স্পেনরে বিদায় করছিলো (পাতানো খেলছিল প্যারাগুয়ের সাথে মোটামুটি শিউর।) আরও অনেক কিছুই মনে আসতেছে। আপাতত থামি।

      জবাব দিন
      • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

        ফ্রান্স প্যারাগুয়ের ম্যাচে প্যারাগুয়েকে সাপোর্ট করছিলাম চিলাভার্টের জন্য, ওদের টার্গেট ছিল খেলা টাইব্রেকার পর্যন্ত নেয়া, তারপর চিলাভার্টের ক্যারিশমায় ম্যাচ জেতা।

        আর্জেন্টিনার সাপোর্টারদের কথা আর বলিস না... কথা বলার সময় এরা এদের গুরু ম্যারাডোনাকে ফলো করে, ফালতু চিল্লাফাল্লা... এদের ইগনোর করাই বেস্ট ট্রিটমেন্ট।


        আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
        আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

        জবাব দিন
  2. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    এই বিশ্বকাপ টাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি। যদি আর্জেন্টিনা উঠতে পারেনি তারপরও ফাইনালে ব্রাজিল হেরে যাওয়ার খুব লাফালাফি করেছিলাম। বার্গক্যাম্পের এই গোলেটা এখনো চোখের সামনে ভাসে, কোন শব্দ ছাড়াই চোখ দিয়ে পানি ঝরেছিল সেদিন।

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    '৯৮ এর বিশ্বকাপ পুরোটা আরাম করে দেখতে পেরেছিলাম। আমাদের তখন এসএসসি পরীক্ষার পরের ছুটি। এই বিশ্বকাপের অনেক কিছু মনে আছে- বিশেষ করে বার্গক্যাম্পের সেই গোলটা (আর্জেন্টিনার বিপক্ষে)। ক্রোয়েশিয়ার উত্থানের কথাও মনে আছে।

    ফাইনাল দেখেছিলাম এক কাজিনের বাসায়, বেশ কয়েকজন কাজিন মিলে। সবাই ছিলাম ব্রাজিলের সমর্থক। রাত জেগে সেই খেলা দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। =(( নির্বাক হয়ে জিদানের কাছে ব্রাজিলের হেরে যাওয়া দেখতে হয়েছিল। 🙁

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯৮-২০০৪)

    '৯৮ আএ আমরা তখন ক্লাস ৭। লকারে নিজ হাতে আঁকা রবার্তো কার্লসের একটা ছবি টানিয়ে দিয়েছিলাম।এর কিছুদিন আগে সে ফ্রান্সের সাথে ফ্রি কিক থেকে এক অসাধারন গোল করেছিল।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।