ফিরে দেখা

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি । আমরা সাত দিনের শিক্ষাসফরে । জলপাই রঙের লক্কর ঝক্কর মার্কা কলেজ বাসে করে বেরিয়েছি । দিনের অধিকাংশ সময় কাটছে বাসের ভেতর যেন । নিজেদের বোঁটকা গন্ধে নিজেদেরই নাড়ি উল্টে আসে । আমরা যারা ষড়যন্ত্র করে পেছনের সিটগুলো দখল করেছিলাম, তাদের বাইরের মানুষদের বিরক্ত করেই সময় কেটে যেত । পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল যাচ্ছে,ওমনি আমরা  “ও ভাই! ও ভাই!”  বলে চিৎকার করতাম । চালক উৎসুক হয়ে আমাদের দিকে তাকালে আমরা বলতাম- “ভাই আপনার চাকা ঘুরছে”… বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চালক পেছন ফিরে দেখত । তারপর অস্ফুট গালাগালি করে পাশ কাটিয়ে যেত কিংবা পেছনে পড়ে যেত । আমরা বিকট শব্দে হেসে উঠতাম । কয়েকজন অবশ্য পাত্তা দিত না । নির্বিকার সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতো । তখন আমরা অন্য কিছু বলে চেষ্টা করতাম । কাজ হত না খুব একটা ।

রাঙ্গামাটি বিজিবি ক্যাম্প থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হবার আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের কলেজ বাসের দম ফুরিয়ে গেল । পাহাড়ি রাস্তা,তার ওপর সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো । ইতিমধ্যে প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের ওপর প্রচণ্ড রেগে ছিলেন ।আমরা রাঙ্গামাটি বিজিবি ক্যাম্পের ‘টি ব্রেক’ এ এরিয়া কমান্ডার পৌঁছুবার আগেই দিব্যি খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। হতবাক এরিয়া কমান্ডার এসে দ্যাখেন সবাই মহানন্দে তার ক্যাম্পের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য গোগ্রাসে গিলছে ।কেউ কেউ কয়েকদফা খেয়ে ‘এক্সট্রা মিষ্টি’ খুঁজে বেড়াচ্ছে হন্যে হয়ে । বেচারা মুখে কিছু বললেন না,হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন । আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম এবার আর রক্ষা নেই; কক্সবাজারে পৌঁছলেই প্রিন্সিপাল স্যার পাগলা মোষের মতন ক্ষেপে যাবেন । তাই বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা বেশ খুশিই হয়েছিলাম ।

মহা উৎসাহে সবাই বাস ঠেলতে লাগলাম । পেছনে স্টাফরা এসে কিভাবে ঠেলতে হবে,আমরা সবাই ‘মকরা’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল । এর মধ্যে কোত্থেকে জানি প্রিন্সিপালের ছোট ছেলে ( উরফাত,তখন ক্লাস ফাইভে পড়ত ) তার অতিকায় বেমানান ভুঁড়িখানাসহ এসে হাজির । সে ও বাস ঠেলতে চায় । একটু পর প্রিন্সিপাল স্যার এসে ‘উরফাত উরফাত’ বলে চেঁচাতে  লাগলেন । উরফাত ভিড় ঠেলে বাবার কাছে এগিয়ে যেতেই প্রিন্সিপাল স্যার কষে একটা চড় মারলেন ওর গালে । সবাই জানত ছোট ছেলের প্রতি স্যারের দুর্বলতা আছে । কিন্তু সে ধারণা নিমেষেই এভাবে গুঁড়িয়ে যাবে তা ভাবি নি । চড় খেয়ে উরফাত ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলো আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগলেন । আমরা সবাই তখন ঠেলা বাদ দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছি । স্যার ড্রাইভার আর স্টাফদের ডেকে ঝাড়লেন বেশ কিছুক্ষণ । তারপর কেন জানি বাসটাও ঠিক হয়ে গেল,আর আমরা একবুক শঙ্কা নিয়ে কক্সবাজারের পথে রওনা দিলাম।

কক্সবাজার পৌঁছুতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল । বাস থেকে নেমে লাগেজ ব্যাগ না নামিয়েই আমরা ফলইন করে দাঁড়ালাম একটা রেস্ট হাউসের সামনে । বোঝাই যাচ্ছে এখন এক দফা হবে । চারদিক সুনসান,আমরা গায়ে গা ঘেঁষে তিন লাইনে শান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । একটু পর প্রিন্সিপাল স্যার এসে দাঁড়ালেন আমাদের মাঝে । এবং মেশিনগানের মতন “ঝাড়ি” বর্ষণ করতে লাগলেন । তার মধ্যে “কাল সকালেই কলেজে ব্যাক করানো হবে এবং টানা পানিশমেন্ট চলবে” হুমকিটা আমাদের সবার পিলে চমকে দিয়েছিল । আগে কখনো সমুদ্র দ্যাখা হয়নি । যদিও বুঝতে পারছিলাম স্যারের মাথা গরম,আশা হারানোর কিছু নেই- তাও কেন জানি খুব অসহায় লাগছিল । কতক্ষণ আমরা সবাই এভাবে ‘কোমায়’ ছিলাম মনে নেই । তারপর সবাই যখন লাইন ধরে ব্যাগ হাতে রেস্টরুমের দিকে পা বাড়াল,সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমরা যারা শেষ লাইনে ছিলাম তারাও চুপচাপ সুড়সুড় করে ঢুকে পড়লাম ।

লোড শেডিং চলছে তখন । মোমবাতি জ্বালিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়াচ্ছে সবাই । পানির স্টক প্রায় ফুরিয়ে আসছে,তার ওপর নোনতা পানি গিলে ফেলার পর জীবনটাই নোনতা হয়ে গিয়েছিল সে রাতে । গোসল সেরে নিচ তলায় ডিনার করতে গেলাম আমরা। মোমবাতির আলোয় ডিনার সেরে রুমে গিয়ে সবাই যে যার মত আড্ডা দিতে লাগলো । আর প্রিন্সিপাল স্যারের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকল মুশলধারে ।

হঠাৎ স্টাফ এসে বললেন ৫ মিনিটের ভেতর তৈরি হয়ে নিচে নামতে,প্রিন্সিপাল স্যার কথা বলবেন । সবার মাথায় বাজ পড়ল যেন । অগত্যা গজগজ করতে করতে নিচে নেমে দেখি প্রিন্সিপালের মেজাজ বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে । আমরা সবাই তখন একটা ‘টুইস্ট’ এর অপেক্ষায় । ‘হয়তোবা খাওয়াবেন সবাইকে’-ভেবেছিলাম । কিন্তু উনি কোথায় যেন নিয়ে চললেন পায়ে হেঁটে । মাঝরাতে এতগুলো বিচ্ছু মিলে কোথাও যাচ্ছি- এতেই মন ভালো হয়ে গেলো । রাস্তার মোড় ঘুরে হঠাৎ একটা চাপা গর্জন শুনতে পেলাম । তখন বুঝতে পারলাম সমুদ্রের কাছাকাছি এসে গেছি হয়ত । একটু পর পথ শেষ হয়ে এল, আর প্রথমেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো । এমন অদ্ভুত সুন্দর কিছু দ্যাখার ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম । পাহাড়সমান ঢেউ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে । ধবধবে সাদা,ফসফরাসের ঢেউ । প্রিন্সিপাল স্যার ইশারা করলেন এগিয়ে যেতে ।

আমাদের আনন্দকে মাটি করতে স্টাফদের উৎসাহের একফোঁটা কমতি ছিল না; রীতিমতো বাঁশি বাজিয়ে তাদের উন্নত বুদ্ধিমত্তার জানান দিচ্ছিলেন । সমুদ্রের গর্জনে পাশের জনের কথাও ভালো করে শোনা যাচ্ছিলো না ।

– ” দোস্ত ”

(পাশের জনের কোন ভাবান্তর নেই দেখে কানের কাছে গলা ফ্যাটিয়ে)…” ওই শালা”

-“কিরে চিল্লাস ক্যান ?” চেঁচিয়ে বলে পাশের জন ।

– ( আবারো কানের কাছে) ” জোস না দোস্ত ? মাথাই নষ্ট !”

-(গলা ফাটিয়ে পাশের জন) ” হ রে মামা ! সেই !!”

মাঝরাতের আকাশে কিছু যাযাবর মেঘ । নারকেল গাছের ডালে সিরসির শব্দ হচ্ছে বাতাসে । বড় বড় ঢেউ ঠিক পায়ের সামনে এসে আছড়ে পড়ছে । সাতচল্লিশ জোড়া চোখ প্রাণভরে দেখে নিচ্ছে তাদের ছোট্ট দেয়ালঘেরা জীবনের দ্যাখা সেরা দৃশ্য । বুক ভরে নিচ্ছে অক্সিজেন,আকাশে দুহাত মেলে । আর পায়ের নিচে নরম বালু অল্প অল্প করে নেমে যাচ্ছে । সেদিকে কারো খেয়াল নেই অবশ্য । খেয়াল করবার মত অনেক কিছুই পেয়ে গেছি তখন আমরা ।

১,৩৩৭ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “ফিরে দেখা”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম আহসান। খুব সুন্দর করে ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তুলেছো। আমারো প্রথম সমুদ্র দেখা হয় ইলেভেনের এক্সকারশনে, আমরা পৌছে ছিলাম দিনের বেলায়, রাস্তা দিয়ে বাস চলছে, হঠাৎ করে সামনে দেখি বিশাল সমুদ্র। অন্যরকম একটা অনুভূতি। এখনো কক্সবাজার যাওয়ার সময় শেষ দিকে এসে সজাগ হয়ে তাকিয়ে থাকি সমুদ্রের প্রথম দর্শনটা পাবার জন্য।

    আরো লেখা চাই, হ্যাপি ব্লগিং 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমাদের সময় ভিপি স্যার, এডজুট্যান্ট আর ফর্ম মাষ্টার রা যেতেন আমাদের সাথে। সাথে একজন স্টাফ, রান্নার লোক এইতো। তবে স্যারদের বা এডজুট্যান্টদের পরিবার ও যেতেন।
    আমাদের এক্সকারশনের কথা মনে পড়ে গেলো।
    তবে এরিয়া কমান্ডার আসার আগেই খাওয়া টা কে কি ছেলেমানুষি বলবো না অন্য কিছু বলবো ভাবছি। বয়স তখন তোমাদের কম ছিলো মানছি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।