মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং কিছু ভাবনা

মাঝে মাঝেই ভাবি, সেইসব মানুষগুলির কথা যারা নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে কোন কিছু না ভেবেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কোন কিছু চিন্তা না করেই…জীবনের নিশ্চয়তা নেই জেনেও। কত্ত সাহসী ওরা…কত্ত নিঃস্বার্থ ওরা…কত্ত নির্লোভ ওরা। ওরা তো আমাদেরকে শিখিয়ে গেছে দেশকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়…। ঠিক যেমন আল্লাহ-তা’লা মানুষের হেদায়েতের জন্য যেভাবে নবী রাসুলদের পাঠিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই যেন দেশকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় তা শেখানোর জন্যই হয়তো আল্লাহ এই মানুষগুলোকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের মাঝে।

ব্যাপারটা অনেকটা উপলব্ধি করার। বই পড়ে, গল্প শুনে কিংবা সিনেমা/নাটক দেখে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে হয়তো জ্ঞান আহরণ করা যায়, কিন্তু উপলব্ধি করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা বোঝায়, তা যেন ঠিক আসেনা…। আসলে অগোছালোভাবে কি লিখছি বুঝে ঊঠতে পারছিনা। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঠিক করতে পারছিনা কোথা থেকে শুরু করবো…কিভাবে শুরু করবো।

ছোটবেলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শুনেছি। বই পড়া, নাটক – সিনেমা দেখা, টক-শো – কতভাবেই না জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা অনেক বড়, অনেক পবিত্র…বুঝতে পেরেছি। তবে হঠাৎ করেই একদিন (ঠিক কবে তা মনে নেই) মনে প্রশ্ন উঁকি দিল, “আচ্ছা মুক্তিযোদ্ধারা কোন লাভের আশায় যুদ্ধ করেছিল?”
ভাবতে থাকি…
নামের জন্য?
…উত্তর পাইনা।
টাকা পয়সার জন্য?
…উত্তর পাইনা।
তবে কিসের জন্য? কিসের আশায় তাঁরা জীবন বাজি রেখেছিল? কোথায় থাকবে, কি খাবে, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্জায় আশ্রয় জুটবে কিনা কোন কিছুরই নিশ্চয়তা ছিলনা। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কোথায়, কে, কিভাবে আছে কোন কিছুই জানা ছিলোনা। তারপরেও কিসের আশায় তাদের এত বড় ত্যাগ? …উত্তর পাইনা।

নিঃস্বার্থ এই মানুষগুলো যে কত বড় মাপের তা বুঝতে আমার আরো কিছু সময় লেগেছিল। যুদ্ধ করতে গিয়ে তারা কত কষ্ট করেছিলেন তা আমি সত্যিকার অর্থে কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনি (যা এখন বুঝতে পারছি)। এই উপলব্ধি আমার প্রথম এসেছে নিজে যুদ্ধ করার পরে। কঙ্গোতে আমি যখন জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে একের পর এক অপারেশন করেছি, তখনই জীবনে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কত কষ্ট করেছিলেন। কত বড় ছিল তাদের ত্যাগ। আমার মত এরকম সুশিক্ষিত একজন সৈন্য যে অনেক উন্নত প্রশিক্ষণ পেয়েছে, তার ই যদি এত কঠিন মনে হয় যুদ্ধ নামক ব্যাপারটাকে তাহলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যাদের কিনা অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ বেসামরিক জনতা তারা কি করে এই কঠিন ব্যাপারটা কে খুব সহজে গ্রহণ করে নিলেন???? মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কয়েক কোটি গুণ বেড়ে গেল।

একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুনতো, আপনি জানেননা আপনার পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছে, কেমন আছে…তাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা…আর একটু পরে বেঁচে থাকবেন কিনা…ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর জন্য খাবারের জোগান হবে কিনা… রাতের বেলা একটু ঘুমাতে পারবেন কিনা…। কেমন বোধ করছেন আপনি? অথচ এই মানুষগুলো এর কোন কিছু দ্বারা-ই বিচলিত হননি। আত্মত্যাগের বড় শিক্ষা এরচেয়ে আমাদের জন্য আর কি হতে পারে? আমরা আজ “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে” বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি… কিন্তু আসলেই কি আমরা জানি বা বুঝি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কি বোঝায়? দেশপ্রেম ব্যাপার টা আসলে কি জিনিষ?

বুকে হাত দিয়ে বলুনতো কয়জন আমরা সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য ভাবি…দেশের মানুষের জন্য ভাবি? আজ আমরা কোন কিছু করতে গেলে প্রথমেই ভাবি, কাজটা করতে গেলে আমার কি কি লাভ হবে…আমার পরিবারের কতটুকু লাভ হবে…আমার পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কতটুকু উজ্জ্বল হবে। দেশের ক্ষতি হলে আমার কি আসে যায়? দেশের মানুষের ক্ষতি হলে আমার কি আসে যায়? এবার তুলনা করুনতো নিজেকে ঐ নিঃস্বার্থ মানুষগুলোর সাথে।

মনে মনে হয়তো বলছেন, ওরা তো বোকা ছিল। আমি কেন ওদের মত বোকা হবো? হ্যা, আসলেই ওই মানুষগুলো বোকা ছিল। দেশকে ভালোবেসে ওরা বোকামী করেছে। কিন্তূ একটা কথা মনে রাখবেন, ওই বোকা মানুষগুলোর বোকামীর জন্যই আজ আপনি আপনার পরিবার পরিজন নিয়ে সু্খে আছেন। কোন এক সন্তান বাবা ডাকতে পারছেনা বলেই হয়তো আজ আপনার সন্তান আপনাকে বাবা ডাকতে পারছে। কোন এক স্ত্রী আজ স্বামীর সোহাগ থেকে বঞ্চিত বলেই কিন্তু আজ আমরা স্বামী-স্ত্রী’র ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না। যে সন্তান তার বাবার স্নেহের বিনিময়ে, যে স্ত্রী তার স্বামীর সোহাগের বিনিময়ে, যে ভাই/বোন তার ভাইয়ের আদর ও ভালবাসার বিনিময়ে, যে পিতা-মাতা তার সন্তানের ভালবাসার বিনিময়ে আমাদের আদর, সোহাগ, ভালোবাসা নিশ্চিত করেছেন, আমাদের এই সুন্দর দেশটিকে উপহার দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আমাদের কৃতজ্ঞ্রতা কতটুকু প্রকাশ করেছি? আদৌ করেছি কি?

আজ আমরা আমাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য নির্দিধায় অন্যের সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই। অথচ আমার সন্তানের যেন কোন ক্ষতি না হয় সে দিকে শকুনী দৃষ্টি রাখছি সব সময়। একবার চিন্তা করুনতো সেই সব বাব-মা’দের কথা যারা আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাদের আদরের মানিককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছন। নিজেদের এই স্বার্থপরতার জন্য কি আমাদের একটুও লজ্জিত হওয়া উচিৎ নয়?

শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসছে সেই সব জনক জননীর প্রতি যারা জাতিকে উপহার দিয়েছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। তাদের এই উপহারের কারণেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সাবিনা ইয়াসমিনের এই গানটা আমাকে তাই খুব বেশী আলোড়িত করেছে। সালাম সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি। সালাম সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি। সালাম আমার স্বাধীন বাংলা মা-কে।

১,৯৮১ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং কিছু ভাবনা”

  1. অসীম (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাইজান, যাদের দরকার (?) ছিল দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছে। ওই পর্ব শেষ। পরের পর্ব দেশ শাসন করা। ৩৯ এ পা দিল দেশ। যা কিছু দেখার সবাই মিলেই দেখছি। আজই আমার কলেজের জুনিয়ররে বললাম, পলিটিশিয়ানদের সাথে কানেকশন রাখনা, চাকুরি পাবেনা। মিয়া গর্দভ। ছেলেটি ডাক্তার।এটা বাস্তবতা। বস, বুড়া বয়সে কান্না পায়। কোনটা হব, ইমোশনাল না প্র্যাক্টিকাল ? আপনাকে সালাম।

    জবাব দিন
  2. রহমান (৯২-৯৮)

    বস্‌, অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু কিছু অত্যাবশকীয় কারনে বলতে পারছি না।

    শুধু এটুকু বলে যাই, আমাদের সবার সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমরা এ বিষয়ে অনেক পিছিয়ে।

    লেখাটা আবেগ থেকে তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন বোঝা যাচ্ছে। আপনার অনুভূতিকে জানাই :salute:

    জবাব দিন
    • আহ্সান (৮৮-৯৪)

      রহমান,
      মুক্তিযোদ্ধাদের এই আত্মত্যাগের ব্যাপারটা আমাকে বেশ অনেক দিন ধরেই ভাবাচ্ছিল। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাবিনা ইয়াসমিনের "সেই রেল লাইনের ধারে" গানটা মাথার ভিতরে ঘুরছিল। তাই সকাল থেকেই গানটা শুনছিলাম। গানটা শোনার পরে নিজের মধ্যে কেমন যেন সব কিছু ওলট পালট হয়ে যেতে থাকলো। সারাদিনে গানটা প্রায় ১০০ বারের মত শোনা হয়ে গেছে। এখনো শুনছি...। নিজের ভাবনাগুলো সবার সাথে শেয়ার করে মনটা একটু হাল্কা করার প্রয়াস থেকেই লেখাটি লেখা। যতটুকু যত্ন নিয়ে লেখাটি প্রয়োজন ছিল, তা পারিনি।

      জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    নিজের কাজে সামান্যতম বাধা পেয়ে যখন আমরা বিচলিত হয়ে যাই তখন আমাদের একবার ভাবা উচিৎ এর চেয়ে কত শতসহস্রগুন বাধা সামনে নিয়ে আমাদের মুক্তিযদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন।
    আমার মত এরকম সুশিক্ষিত একজন সৈন্য যে অনেক উন্নত প্রশিক্ষণ পেয়েছে, তার ই যদি এত কঠিন মনে হয় যুদ্ধ নামক ব্যাপারটাকে তাহলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যাদের কিনা অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ বেসামরিক জনতা তারা কি করে এই কঠিন ব্যাপারটা কে খুব সহজে গ্রহণ করে নিলেন????

    একজন পুরোদস্তর কমান্ডোর মুখ থেকে যখন এ কথা বের হয়-শ্রদ্ধায় মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আপন অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে যায়।

    অনেক অনেক ধন্যবাদ আহসান ভাই।

    জবাব দিন
  4. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    বন্ধু,
    তোর লেখাটা দেখে ভাল লাগলো।
    সময় করে উঠতে পারি না।
    ইফতেখারের সাথে সেদিন দেখা হলো - ওর কাছে শুনলাম সিলেটের গল্প।
    তুই ভাল আছিস তো...?
    ভালো থাকিস - দোস্ত - আমাদের ভালো থাকার ভাল করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।
    :hug:


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।