এক নতুন উৎসব

শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিলাম বলে অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুমটাও ভাংতোনা হয়তো যদি না মা ফোন করতেন। খুশীতে তরল হয়ে যাওয়া মায়ের কন্ঠস্বরে আমিতো অবাক। কি এমন ঘটলো যে মা এত খুশী?
– “কিরে এখনো ঘুমাচ্ছিস? ফ্রেশ হবি কখন, নাস্তা করবি কখন, আর রেডী ই বা হবি কখন?”
অনেকটা যেন আমি ঈদের ছুটিতে না গেলে নামাযের আগে মা আমাকে যেভাবে ফোন করে বলতেন ঠিক তেমন।
– “কেন কি হইছে মা? কোথায় যেতে হবে? আর তুমিই বা এত খুশী কেন?”
– “মানে? তুই কি ভোট দিতে যাবিনা? সবাই দিয়ে ফেললো তো। আমিও দিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি ওঠ। রেডী হয়ে আমাকে ফোন দে।”
লাইনটা কেটে দিলেন মা। আমার তো চোখ ছানাবড়া। এটা কি স্বপ্ন দেখলাম? না স্বপ্ন না। আমার বসও ফোন করলেন-
– “কি আহসান, ভোট দিতে যাবেনা?”
– “স্যার, ইয়ে মানে, জ্বি যাবো।”
– “কখন যাবে? সবাই তো ভোট দিয়ে চলেও এসেছে।”
কম্বলের মাঝ থেকেই ডাহা মিথ্যা বলে দিলাম, “স্যার আমি ইনফ্যাক্ট ড্রেস পড়ে রেডী হচ্ছিলাম।”
– “ওকে। ঠিক আছে।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল সাড়ে দশটা। টিভি অন করলাম। চোখ বুলিইয়ে নিলাম চ্যানেলগুলোতে। সবকিছুই ভালো মতো হচ্ছে। ফোন করে ব্রেকফাস্ট (টি-ব্রেক/মিল্ক ব্রেক বললেই হয়তো ভালো হতো) রেডী করতে বলে নিজে রেডী হবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

মাথায় আমার একটা ব্যাপারই ঘুরতে থাকলো। আমার মায়ের মত পুরো দস্তুর একজন গৃহিণী যার রাজনীতি কিংবা দেশের ক্ষমতায়ন বা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির মত জটিল ব্যাপারগুলোর প্রতি কোনই আগ্রহ নেই সেই তিনি ই আজ আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ভোট দেবার জন্য যেতে বলছেন। তবে কি আসলেই দেশের সবাই আজ সচেতন? আসলেই কি দেশে গুণগত অনেক পরিবর্তন চলে এসেছে?

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়েই ভোট কেন্দ্রের দিকে এগুলাম। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুল হচ্ছে আমাদের কেন্দ্র। গিয়ে দেখলাম কেন্দ্র মোটামুটি ফাঁকা। নিরাশ হলাম। আমার মা যেরকম ঈদের আনন্দ নিয়ে আমাকে ফোন করলেন, এখানকার পরিবেশতো তা বলেনা। যাইহোক, জীবনে প্রথমবারের মত ভোট দিতে এসেছি…আমার নিজের ভোট…মনের মাঝে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি অনুভব করছি। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, আমার এই একটি ভোট হয়তো দেশের পরিবর্তনের জোয়ারে অবদান রাখবে…কিংবা ঠেলে দেবে দূর্নীতি, কালোবাজারী, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি ইত্যাদি নামক গহীন অন্ধকারে। তাই আমাকে সচেতন হতে হবে। বুথে গিয়ে ব্যালট পেপারটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। লম্বা সেই এক টুকরো সাদা কাগজে যেন আগামী ৫ বছর কে দেখতে পাচ্ছি। আমার সমস্ত ঈন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করে তুললাম। না, ভূল করা যাবেনা। কোনভাবেই না।

হিসাব-নিকাশ যা করার করে ফেললাম। আমার নিজের ভোট, আমি নিজে দেখে শুনে, যাকে খুশী তাকেই দিয়ে দিলাম। খুব সাবধানে ব্যালট পেপারটি ভাঁজ করে স্বচ্ছ বাক্সে সযতনে ঢুকিয়ে দিলাম। মনে হলো, কাঁধের উপর থেকে অনেক বড় একটা গুরু দায়িত্ত্বের ভাড় নামিয়ে রাখলাম। নিজেকে অনেক হালকা মনে হলো। অনেক তৃপ্তও মনে হলো। দেশ গঠনে এই প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি, তাই এর অনুভূতিটাকে একান্ত নিজের মত করেই উপলব্ধি করছিলাম।

ভোট শেষে আমার এক কোর্সমেট বললো ও দায়িত্বপালনের জন্য বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে যাবে, আমি যেতে চাই কিনা। কোন কিছু চিন্তা না করেই যাবো বলে ফেললাম। একটা বিশেষ সংস্থার সাদা জীপে করে বেসামরিক পোষাকে বের হলাম। রাস্তায় নামতেই দেখি একদম ফাঁকা রাস্তা। শুধু মাত্র রিক্সা চলছে। অনেকগুলো কেন্দ্রই দেখলাম। এর আগের নির্বাচনের চিত্রের সাথে ঠিক মেলাতে পারছিলামনা। সবাই এত সুশৃংখলভাবে কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, যে ভাবাই যায়না এটা আমার দেশের কোন নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র। সতস্ফূর্তভাবে নারী-পুরুষ আসছে যাচ্ছে। কেন্দ্রের সামনে অস্থায়ী চা, পান-সিগারেট, ঝাল মূড়ি, বাদামওয়ালা, খাবারের দোকানগুলো যেন একটা অন্যরকম আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

শহর এলাকায় ঢুকলাম। একই চিত্র। কোন তফাৎ নেই। রাস্তা ঘাট, মানুষ গুলো সব কিছু এত ভালো লাগছিলো যে আমি বলে বঝাতে পারবোনা। আমার দেশের মানুষগুলো যে এত ডিসিপ্লিনড হতে পারে, তা আমি কখনো ভাবিনি। আজ সিলেট শহরেরও যেন রুপের জোয়ার এসেছে। বিয়ের আসরে কনে যেরকম রুপের দ্যূতি ছড়ায়, সিলেট শহরটাও যেন আজ সেইরকম দ্যূতি ছড়াচ্ছে। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। শহরের মাঝেও কি শান্তিময় পরিবেশ। দলে দলে মানুষ নানা সাজে সজ্জিত হয়ে অনেকটা যেন উৎসবের জন্য তুলে রাখা পোশাকটি পরিধান করে রাস্তায় নেমে এসেছে। রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে তরুণীদের উচ্ছ্বল উপস্থিতিও ছিল নজড় কারার মত। সবকিছু মিলিয়ে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ যেন অনেকদিন দেখিনি।

একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে ঝাল মুড়ি খেলাম। সেখানে কিছু লোকজনের সাথে কথাও বললাম। সবাইই ভীষণ খুশী। শ্মশ্রুমন্ডিত ঝালমুড়িওয়ালার ভাষ্যমতে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম নাকি নির্বাচনের মতই একটি নির্বাচন হচ্ছে। আমি নিজেও অনুভব করছিলাম ব্যাপারটি (অন্তত সিলেট শহরকে দেখে)।

আমার প্রশ্নগুলির উত্তর আমি আস্তে আস্তে পেতে শুরু করলাম। কেন আমার মায়ের মত একজন সাধারণ গৃহীণিও আজ এতটা উচ্ছ্বল, কেন আজ আমার বসও সামরিক ব্যাপার স্যাপারের বাইরের একটা ব্যাপারে আমার খোঁজ নেয়, সাধারণ মানুষের এত বেশী সতস্ফূর্ত উপস্থিতি, এতবেশী ডিসিপ্লিনড আচরণ, এত উৎসবমুখর পরিবেশ এ সব কিছুই কি কোন শুভ ইঙ্গিত বহন করে? সত্যিই কি দেশে গুণগত পরিবর্তন এসেছে? সত্যিই কি আমার দেশটি আজ সোনার বাংলাদেশ হবার পথে এক ধাপ এগিয়েছে? সত্যিই কি আমার জীবনের প্রথম ভোটটি দেশে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে?

আপনাদের সবার কি ধারণা?

৫,২৮১ বার দেখা হয়েছে

৫১ টি মন্তব্য : “এক নতুন উৎসব”

  1. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    আমি নিজেও আজকে কম অবাক হচ্ছি না, সারাদিন বসে থেকেও একটা জরুরী পরিস্থিতির খবর পেলাম না। সত্যি কি দেশের মানুষ আজ দেশটাকে একধাপ সামনে নিয়ে গেল...???
    আমি অপেক্ষা করে আছি যারা বিদেশী পর্যবেক্ষক ছিলেন তারা এবার কি বলেন শোনার জন্য... :clap: :clap: :clap: চমৎকার পোস্ট আহসান ভাই... :salute: :salute: :salute:
    অফটপিকঃ

    রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে তরুণীদের উচ্ছ্বল উপস্থিতিও ছিল নজড় কারার মত।

    আজকাল এসব জিনিস একটু বেশীইইইইইইই চোখে পরে মনে হয়... 😛 😛 😛
    আন্টিইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই............... :awesome: :awesome: :awesome: :awesome: :awesome: :awesome: :awesome: :awesome:

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে তরুণীদের উচ্ছ্বল উপস্থিতিও ছিল নজড় কারার মত।

    ভাইসব,দক্ষিণবঙ্গে বিবাহ খাইতে দলে দলে যোগ দিন।ঠিকানাঃএই ব্লগের সিও মেজর কমান্ডো আহসান ওরফে আমাদের প্রাণপ্রিয় আহসান ভাই 😀

    অফ টপিক-লেখাটা অসাধারণ হয়েছে আহসান ভাই। আমিও এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছি।ঠিক যেন আমার অনুভূতিটাই তুলে ধরেছেন।

    জবাব দিন
  3. রহমান (৯২-৯৮)

    বস,
    একজন ভোটারের অনুভুতি দারুন ভাবে ফুটে উঠেছে আপনার লেখায় :clap: । লেখাটা পড়ে আফসোস আরো বেড়ে গেল। ইচ্ছে করছিল এখনি ভোট দেয়ার জন্য দেশে ছুটে যাই। এবারো ভোট দিতে পারলাম না 🙁 । অনলাইনে ভোট দেয়ার সিষ্টেম থাকলে ভাল হতো 😛

    জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিলাম বলে অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুমটাও ভাংতোনা হয়তো যদি না মা ফোন করতেন। খুশীতে তরল হয়ে যাওয়া মায়ের কন্ঠস্বরে আমিতো অবাক। কি এমন ঘটলো যে মা এত খুশী?
    - “কিরে এখনো ঘুমাচ্ছিস? ফ্রেশ হবি কখন, নাস্তা করবি কখন, আর রেডী ই বা হবি কখন?”

    বিশ্বাস করুন, বিস্তারিততে ঢোকার আগে এতটুকু পড়ে আমি ভেবেছিলাম আন্টি বুঝি পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাবেন 😛 😛 😉 😉 ।

    ভালো লাগছে বস :clap: :clap: ।
    এইরকম পরিবেশটার মতোই যেন আগামী দিনগুলো পাই।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  5. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    তানভীর,
    শরম পাইতাছি মিয়া। কই ভালো লেখি? নিজেই তো সন্তুষ্ট হইতে পারিনা...
    আর দাওয়াতের কথা কইতাছো?
    এনি টাইম বাডি...
    আমি না থাকলেও আব্বা আম্মা বাসায় থাকবেন ইনশাল্লাহ...

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমার ধারণা সম্ভবত আমার বাবার জন্মেও (বাঁইচ্যা থাকলে জিগান যাইতো) এইরকম একটা দূর্দান্ত শান্তিপূর্ন ভোট দেখে নাই! কেউ কাউকে বলে দেয়নি কিন্তু নিজে নিজেই সুশৃঙ্খল হয়ে যে দৃষ্টান্ত বাঙালিরা ২৯ ডিসেম্বর দেখিয়েছে আমার কাছে তো এটা নজিরবিহীন মনে হয়েছে।

    আহসান, আমাদের প্রায় সবারই একই পর্যবেক্ষণ। আমি নির্বাচন কমিশন, সামরিক বাহিনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে :salute: জানাই। এইবার এমন একটা ভোটার তালিকা না হলে এমন দারুণ ভোট হতো না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  7. আহ্সান (৮৮-৯৪)
    কেউ কাউকে বলে দেয়নি কিন্তু নিজে নিজেই সুশৃঙ্খল হয়ে যে দৃষ্টান্ত বাঙালিরা ২৯ ডিসেম্বর দেখিয়েছে আমার কাছে তো এটা নজিরবিহীন মনে হয়েছে।

    সত্যিই...

    আমি নির্বাচন কমিশন, সামরিক বাহিনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে জানাই। এইবার এমন একটা ভোটার তালিকা না হলে এমন দারুণ ভোট হতো না।

    এরকম মন্তব্য অবশ্যই ভবিষ্যতে দেশ ও জাতি গঠণের যেকোন কাজে প্রাণ দিয়ে কাজ করার উৎসাহ জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস...।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহ্সান (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।