একজন দীপাবলি

ও বাড়ীর কানা বুড়ী সকাল থেকে তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে, “আমার যে বড় কষ্ট হচ্চে গা”!

কিন্তু গল্পটা কানাবুড়ীর নয়। গল্পটা দীপার। দীপাবলি সেন! বাড়ীর আদর করে ডাকা নাম – দীপা/টুনি। টুনি নামটা অবশ্য বাবাই ডাকতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর এ নামে তাকে আর কেউ ডাকে না।

কোলকাতায় দীপাদের জমিদারী সম্পত্তি ছিল। কিন্তু বাবা যেবারটায় খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সেবার সবকিছু বিক্রি করতে করতেই দীপাদের অভাব অনটনের শুরু। তবে এই অভাব দীপাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে!

সে সুন্দরী মেয়ে। অন্য সুন্দরী মেয়েদের রাস্তায় বেরোলে যে যন্ত্রণাগুলো পোহাতে হয়, তাকেও তার সবই পোহাতে হয়েছে। এরপরেও প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়ে পড়াশোনা করা, কল সেন্টারে চাকরী করা, অজিতের সাথে প্রেম করা, অজিতের হাত খরচ দেয়া এই সবকিছুই করেছে সে এই সময়টাতে।

অজিতের সাথে প্রেমটাও হয়েছিল খুবই ভুল একটা সময়ে! ঘরে যখন মোটামুটি খাওয়ার চালটা পর্যন্ত নেই, তখন মা সিদ্ধান্ত নিলেন দীপার বিয়ে দিয়ে দিবেন। ভালো একটা সম্বন্ধও পাওয়া গেল। আর তখনই এই চালচুলোহীন অজিতের সাথে দেখা, প্রেম। এতো সাধারণ একটা ছেলে, কোনদিক দিয়েই আকৃষ্ট হওয়ার কিছু নেই। দেখতে ভালো না, কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না। পড়াশোনাও তেমন একটা করেনি। সারাদিন মিউজিক করে বেড়ায়।

ওর মিউজিকেরও আগা মাথা কিছু বোঝা যায় না। একদিন ওর নতুন একটা মিউজিক শুনে দীপা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। অজিত অবশ্য খুবই মন খারাপ করেছিল এতে। কিন্তু দীপার কি দোষ? একে তো মিউজিকটা ছিল বিরক্তিকর, এরপর আবার রাতে ডিউটি থাকাতে খুব একটা ঘুম হয়নি! তাই চোখ দুটো লেগে এসেছিল।

অবশ্য ওর এই মিউজিকই শেষ রক্ষাটা করল। বোম্বের বড় কোন পরিচালক পছন্দ করেছে ওর কাজ। সামনের তিনটি ছবির জন্য কন্ট্রাক্ট করিয়েছে। আর কিছু সাইনিং মানিও পাঠিয়েছে। আজকেই এসে আংটি পড়িয়ে গেল। বেশ ঘটা করেই করল অনুষ্ঠানটা। দীপা এতো খরচ করতে বাঁধা দিতে চেয়েছিল, অজিত শোনে নি।

সে আগামীকাল বোম্বে চলে যাবে। সামনের দুই মাস দেখা হবে না। এই দুই মাস দীপার এই “সুখী সুখী” মুখটা না দেখলে তার চলবে না, তাই এতো খরচ।দুই মাস পরে ফিরে এসেই বিয়ে। বিয়ে করে ওকেও নিয়ে যাবে বোম্বে! এই সুখ মাথায় নিয়ে বেশ আরাম করেই ঘুমিয়েছিল দীপা। কিন্তু রাত দুইটার দিকে একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। খুব বাজে একটা স্বপ্ন।

ভয়ে ঘেমে গিয়ে সারা শরীর ভিজে গেছে। অন্ধকারে হাতরে ফোনটি খুঁজে অজিতকে ফোন দিয়ে শুধুমাত্র “আ আআআ” জাতীয় কিছু গোঙানির শব্দই করতে পারল। তার গোঙানির শব্দ এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে, সে শব্দে পাশের রুমে মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা দৌড়ে এসে দীপাকে জড়িয়ে ধরল আর পীঠ ঘষে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ীর নীচে মোটর সাইকেলের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। অজিত এসেছে।

অজিতকে সুস্থ দেখে কিছুটা শান্ত হল দীপা। যদিও গোঙানির শব্দটা একটু পরপর ফিরে আসছিল কিন্তু কাঁপুনিটা কমেছে আর ঘামও কমে আসছে। অজিতও তাই কিছুটা আশ্বস্ত হল আর ঠাট্টাসুলভ একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। কি হয়েছিল বলতো? দীপা, মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, পানি খাব। মা পানি আনতে বেরিয়ে গেল আর এই সুযোগে দীপা অজিতের হাত চাপ দিয়ে ধরে বলল, দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তোমার বোম্বে যাওয়া চলবে না।

অজিত যেন এর চেয়ে অবাক আগে কোনদিন হয়নি, এমন একটা ভাব করে, দীপার মুখের উপর চলে আসা কিছু চুল সরিয়ে বলতে লাগল, একটা দুঃস্বপ্নের কারণে বোম্বে যাব না, এ কি হয়! বোম্বে না গেলে খাব কি? আর বিয়েটাই কীভাবে হবে, শুনি? তোমার মত সাহসী মেয়ে শুধুমাত্র একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেল? কি ছিল স্বপ্নটার মধ্যে বল তো?

দীপা বলতে চাচ্ছিল না। শুধু বারবার বলছিল, তোমার যাওয়া চলবে না বলেছি, ব্যস। আর কোন কিছু বলতে এস না। আমি যে ভয় পেয়েছি, আমি চাইনা তুমি সেটা পাও। শুধু এতটুকু মনে রেখ, তোমার বোম্বে যাওয়া কোনমতেই আর হবে না। অজিতকে নিষেধ করতে গিয়েই মনে হয় স্বপ্নের কথাটা আরও একবার দীপার মনে পড়ে গেল। শরীরেও তাই আবার ঘাম দেয়া শুরু করল আর কপালটা কুচকে গিয়ে মনে হল খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তার ভেতরে ভেতরে।

কিন্তু অজিতের গম্ভীর মুখটা দেখে বুঝল, না বলে উপায় নেই। তাই এক হাত দিয়ে ওর এক হাত শক্ত করে ধরে, আর এক হাত বুকের কাছে রেখে, কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনেকটা ফিসফিস করে বলল, স্বপ্নে কি দেখলাম, জানো? দেখলাম, “ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম বাংলাদেশে যাচ্ছে”।

কথাটা শুনতেই মোস্তাফিজুরের বোলিং, তামিম/সৌম্য সরকারের ঝড়, সাকিব/মুশফিকের জলদ গম্ভীর ব্যাটিং অজিতের চোখে ভেসে উঠল। সবশেষে মাশরাফি আর তাসকিনের “চেস্ট বাম্প” টি কল্পনা করে আর তার মাঝে পড়লে কি অবস্থা হয় সেটি আন্দাজ করতে গিয়ে অজিত নিজের অজান্তেই একটু কেঁপে উঠেছিল।

এরই মাঝে মা পানি নিয়ে রুমে ঢুকে গিয়েছিল। অমন অলুক্ষনে স্বপ্নের কথা শুনে তার হাত থেকে গ্লাস মাটিতে পড়ে গেল। দাঁত দিয়ে শাড়ির আচল কামড়ে ধরে মাও কেঁদে ফেলল আর অনেকটা বিলাপের মত বলতে লাগল, এ তুই কি স্বপ্ন দেখলি রে দীপাআআআআআ!

ওদিকে কানাবুড়ী তারস্বরে চিৎকার করেই চলেছে, “আমার যে বড় কষ্ট হচ্চে গা”। কষ্ট যেন তার একাই হচ্ছে, আর কারো কোন কষ্ট নেই…!

১,৮৫২ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “একজন দীপাবলি”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    জমাটি ভাবেই তো এগুচ্ছিলো গল্পটা, কৌতুক করতে গিয়ে এভাবে তার (গল্পটার, দীপার না) এবরশন না করলেই কি চলতো না???
    😛 😀 😛 😀 😛 😀


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    শেষে এসে গল্পের ভেতরে একেবারে জল ঢুলে গেল!
    ছো ছো... কেমন করে ওমন অলুক্ষণে কথা লিকলি, বল দি কি নি? 😛


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. সাইদুল (৭৬-৮২)

    লেখা ভালো হয়েছে, তবে তাড়াহুড়ো না করলে আরও ভালো হত,
    কলকেতার দিদিমনিরা কব থেকে জলকে পানি বলা শুরু করলো? না আমি ভুল বুঝেছি?


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাজী সাদিক (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।