অতঃপর মখলেছের খায়েশ পূরণ

(গল্পের প্রতিটা চরিত্র কাল্পনিক। দয়া করে কোন বাস্তব ঘটনার সাথে মিল খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না!)

অতঃপর মখলেছের খায়েশ পূরণ হইল! তবে মখলেছের খায়েশ পূরণ হওয়াটা অতটা সহজ ছিল না বটে। যদি শুরু থেকে দেখিতে হয়, তবে ভবপুর জেলার কুসুমপুর গ্রামে নজর ফেলিতে হইবে। আর প্রত্যুশের প্রথম দৃষ্টিটিই পড়িবে গ্রামের পেছনের নিরীহ পাটক্ষেতটিতে!

পাটক্ষেতের আইল ধরিয়া কিছুদূর ভিতরে গিয়া বসিলে বাহির থেকে দেখা যায় না, কে মলত্যাগ করিতেছে! মখলেছ তাই সকাল সকাল বদনা সহকারে পাটক্ষেতের পানে রওনা হয়। এই সময়টা কেউ ডাকিলে কিংবা পথ আগলাইলে তাহার ভালো লাগে না। কারণটি এমন নয় যে প্রকৃতি তাকে সকাল বেলাতে প্রবল বেগে ডাকে। বরং মূল কারণটি হচ্ছে ঠিকঠাক সময়মত বসিতে পারিলে, অর্ধেক কর্ম সম্পাদন হওয়াকালীন সময়ে সখিনা এই পথটি দিয়া মলত্যাগ করিয়া ফিরে।

সখিনা যখন প্রায় কাছাকাছি চলিয়া আসে, তখন খুব একটা ক্যোঁৎ মারিয়া প্রবল শব্দে বায়ু নির্গত করিয়া নিজের অবস্থান জানান দেয়া যায়। এতে করিয়া প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়া সখিনার সামনে বিব্রত তো হইতে হয়ই না বরঞ্চ সখিনাকে খুব একটা বিরক্ত করা হয় বৈকি! বায়ু নির্গমনের শব্দে সখিনা যখন উড়িয়া গিয়া আইল ছাড়িয়া পাটক্ষেতে পড়ে, তখন বিরক্ত হইয়া মা-বোন সংক্রান্ত বেশ কিছু গালি গালাজ করে। সকাল সকাল সখিনার গালি শুনিতে বেশ লাগে। কলিজা শীতল হইয়া যায় একেবারে। বাঁচিয়া থাকাটা মনে হয় স্বার্থক!

এমনই মলত্যাগ এবং বায়ুত্যাগ করিয়া যখন মখলেছের প্রেমময় জীবনে ভ্রমর কিংবা মাছি উড়িয়া বেড়াইতেছিল, তখনই সে খবরটি পাইল। কীভাবে কীভাবে যেন এসএসসি এবং এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই এ প্লাস পাইয়া বসিয়াছিল মখলেছ। তাহার স্পষ্ট মনে আছে এসএসসিতে একটি এবং এইচএসসিতে দুইটি পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণই করে নাই। তারপরও কীভাবে এই এ প্লাস বস্তুটি জুটিল তাহা সে কিছুতেই মিলাইতে পারিতেছিল না। আর এই দিয়া কি হইবে, তাহা বোঝার কোন চেষ্টাও করিল না।

কিন্তু এ প্লাসের মূল মাহাত্ম্য সে বুঝিতে পারিল যখন এলাকার এক বড়ভাই বলিল সে ঢাকায় বড় বিদ্যাপীঠের ভর্তি পরীক্ষার জন্য খুব একটা আগাইয়া গিয়াছে। কিন্তু আগাইয়া গিয়া কি হবে, তা নিয়া মখলেছের মোটেও কোন উৎসাহ দেখা গেল না। কেননা এলাকার যত বড়ভাই ঢাকায় বড় বিদ্যাপীঠে পড়িয়াছে, তাহাদিগকে সারাটা দিন শুধু পড়াশোনা করিতেই দেখিয়াছে। সে মোটের উপর কোন পড়াশোনা না করিয়া কীভাবে ঢাকায় বড় বিদ্যাপীঠে পড়িবে, ইহা সে কোনভাবেই ঠাহর করিতে পারিল না।

অবশেষে যখন সেই একই বড়ভাই প্রশ্নপত্রের একটি কপি আনিয়া দিয়া বলিলেন, এই প্রশ্নখানা হুবহু পড়িয়া ল। ইহাতেই কাজ হইবে। তখন মখলেছ সারাদিন সারারাত প্রশ্নসমূহের উত্তর মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে গেল। পরীক্ষা হলে গিয়া যখন দেখে হুবহু একই প্রশ্ন আসিয়াছে, তখন মখলেছের খুশীর আর সীমা রইল না। আর এতে করিয়াই মখলেছের নাম ভর্তি পরীক্ষার ওয়েটিং লিস্টের উপরের দিকে থাকিল।

কোনমতে একটি সাবজেক্ট পাইয়া যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হইতে গেল, তখন লাল লাল নীল নীল বাত্তি এবং হরেক রকমের ললনা দেখিয়া তাহার লালা ঝড়িতে লাগিল। কোথায় গ্রামের সখিনা আর কোথায় ঢাকার ললনা। কেউ কেউ তো আবার এমন জিন্স পড়িয়াছে, যাহা পড়িবার সাধ্য তাহার নিজের এখনো হয় নাই। প্রথম দুই চার ঘণ্টা যখন মখলেছ ললনাবৃন্দের বক্ষযুগলে তাকাইয়া ছিল, তখন পর্যন্ত মাথায় ব্যাপারটি কাজ করে নাই যে, ললনাদের অনেকে ওড়নাই পড়ে নাই। তাইতো বলি, বক্ষগুলি এতো স্পষ্ট করিয়া কেন দেখা যাইতেছিল? ব্যাপারটা যখন সে বুঝিতে পারিল, তখন তখনই বাথরুমে গিয়া দুইটা ডিগবাজি দিয়া, সে যে কি “অমৃত” দেখিয়াছে, তাহা উদযাপন করিয়া আসিল।

কিন্তু শুধু ললনা দেখিয়া সময় পাড় করিলে তো আর চলিবে না। থাকার একটি ঠাই ও তো খুঁজিয়া লইতে হইবে। বড় ভাই তাহার হলের ঠিকানা দিয়া বলিয়াছিল, ঢাকায় আসিলে যোগাযোগ করিতে। তাই মখলেছ আপাতত ললনাদের মায়া ত্যাগ করিয়া বড় ভাইয়ের পানে ছুটিল। বড়ভাই হলে উঠাইবার ছলে তাহারও বড়ভাই এবং হলের সভাপতি কুদ্দুছ ভাইয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিল। কুদ্দুছ ভাই বলিলেন হলে থাকিলে সবার সাথে মিলিয়া মিশিয়া থাকিতে হইবে। এই বলিয়া মখলেছের মতই আরও কিছু চিড়িয়াকে দেখাইয়া দিল। আর বলিয়া দিল জেনারেল সেক্রেটারি মিশেলের দলের কারো সাথে আবার মিশিতে যাইও না বরং উহাদের কাউকে পাইলে ভরপুর ঠেঙ্গাইয়ো। নয়তো উহারা তোমাদিগকে ঠেঙ্গাইতে কার্পণ্য করিবে না।

তাহার এলাকার বড়ভাইও কুদ্দুছ ভাইয়ের এই কথাতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াইল। যে বড় ভাই শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন দিতে গিয়া পাঁচ হাজার টাকা লইয়াছিল, সে চার-পাঁচ বছর থাকার বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া একটি টাকাও লইল না। শুধু বলিল সেক্রেটারির দলের কাউকে পাইলে ঠেঙ্গাইতে হইবে। ইহা যে মখলেছের জন্য কোন বিষয় নয়, সেটি মনে হয় বড় ভাইরা টের পায় নাই। এলাকায় একটি শালুক থেকে আরম্ভ করিয়া বাজারের চা খাওয়া পর্যন্ত যে নানাবিধ কারণে মখলেছের নানান জনকে ঠেঙ্গানোর অভ্যাস আছে, বড় ভাইরা মনে হয় তাহা জানে না।

তবে কুদ্দুছ ভাই মাথায় তেল দেওয়াতে যে তাহাকে নায়ক সাকিব খানের মত লাগিতেছে, এইটি বলিয়া মখলেছ বেশ বিপাকে পড়িয়া গিয়াছিল। তাহার এলাকার বড়ভাই যখন তাহাকে শুধরাইয়া দিল যে উহা তেল নয়, উহাকে বলে “জেল” তখনই একমাত্র মখলেছ বুঝিতে পারিল, ঢাকার চালচলন কুসুমপুরের মত নয়।

কুসুমপুরের তিসির তেল কে এখানে “জেল” বলা হয়। কিন্তু চোর-ডাকাত-রাজনীতিবিদরা মাঝে মাঝে মামলা খাইয়া যেখানে যায়, সেটিও তো “জেল”! এমন প্রশ্ন করাতেই বাঁধিল মূল গোলযোগ। কুদ্দুছ ভাই বেশ চটিয়া গিয়াছিল এবং বেশ কিছুদিন তাহার সামনে থেকে দূরে দূরে থাকিতে হইয়াছে। যদিও সেক্রেটারি গ্রুপের সকলকে ঝেটিয়া হল হইতে বিদায় করার পর কুদ্দুছ ভাইয়ের রাগ কিছুটা পড়িয়াছিল। উপরন্তু উপহারস্বরূপ মিলিয়াছিল কিছু লাল পানি আর “জেল” এর একখানা কৌটা।

এবং দেখিতে দেখিতে মখলেছ, কুদ্দুছ ভাইয়ের কাছের লোক হইয়া গেল। একদিন তাই মখলেছ তাহার এতো কাছের বড় ভাই কুদ্দুছ ভাইকে মুখ ফুটিয়া মনের কথাটা বলিয়াই ফেলিল।

মখলেছ বলিল, ভাই, এই যে এতো এতো সুন্দরী কন্যারা এইখানে ওড়না পড়ে না, এই ব্যাপারটি লইয়া কি কিছু বলিবেন ভাই? কুদ্দুছ ভাই বেশ রাগিয়া গিয়া বলিলেন, ব্যাটা, তুই কি স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি নাকি? যে যাহার ইচ্ছামত পোশাক পড়িবে তাহাতে তোর কি বে?

মখলেছ মিন মিন করিয়া বলিল, কিন্তু ভাই, আমার যে ধরিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। কুদ্দুছ ভাই হতাশ হওয়ার মত একটি শব্দ করিয়া বলিলেন, শুধু ধরিয়া নয়, তুমি খুলিয়াই দেখিও, তবে এ বেলায় নয়। পহেলা বৈশাখ এখানে হাজার হাজার ললনা আসিবে। তাহারা যদিও শাড়ি পড়িয়াই আসিবে। কিন্তু তাহার পরেও তোমরা একত্রিত হইয়া উহাদিগকে ঘেরাও করিয়া, শুধু ধরিয়া নয়, খুলিয়াও দেখিও। আর শোন, বাথরুম করার পরে পানি ঢাল না কেন? তোমাদের ব্লক হইতে বারংবার রিপোর্ট আসিতেছে, তোমরা কি আমাকে সভাপতি থাকিতে দিবে না নাকি?

২,০৮৯ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “অতঃপর মখলেছের খায়েশ পূরণ”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    লিখা পড়ে কিছুক্ষণ হাসলাম কিন্তু পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে হতাশ হয়ে যাচ্ছি। পরিকল্পিত কিংবা অপরিকল্পিত যেটাই হোক না কেন, আমাদের মন-মানসিকতা বড় দাগে এরকমই।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    আমি বিশ্বাস করি মখলেছরা এখনো সংখ্যা লঘু, কিন্তু সংখ্যাগুরুর দল চুপচাপ এদের বেড়ে যাওয়া দেখছেন বলেই এরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে! মখলেছদের প্রতিরোধ করতে জয়নাল, আব্দুল আর বাকেররা এগিয়ে আসুক এটাই সব সময় চাই। আলোচনা, সমালোচনা ফেসবুকের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে একটি বারের জন্যও যদি আমাদের বীর পুঙ্গবেরা এগিয়ে আসতেন তবে আমার মা- বোনদের এভাবে হেনস্থা হতে হতোনা।

    লেখার প্রশংসা তো করতেই হবে, ছোট ভাইয়া! ফাটাফাটি!!

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    মুনশিয়ানায় আঁকা বাস্তবতার নির্মম পোর্ট্রেট ।
    ডিগবাজী খাওয়া মোখলেসরা আজ দ্রৌপদীর পালা করে বেলায় অবেলায় ।
    স্প্রিং ব্রেকে কিংবা ওসমানীর গেটে ।
    শংকা এটাই যে মাঝে মাঝে মনে হয় গোটা সমাজটাই যদি মানসিক বৈকল্যে আসুস্থ্যতার মাতলামীতে মাতে ।
    তবে তাকে সারাবে কে । ডাক্তার-কবিরাজ করবে কে ।

    আমাদের সন্তানদের সামনে মাথা হেট হবার পর্বটাকে জীবন নাটকের স্ক্রীপ্ট থেকে মুছে দেবে কে !

    তোমাকে অভিবাদন । আহাম্মদ ।

    জবাব দিন
    • আহাম্মদ (৯৬-০২)

      ভাই, আসলেই লজ্জায় মাথা হেট! পহেলা বৈশাখের পর থেকে কলিগ/আত্মীয়-স্বজন যে মেয়ের সামনেই পড়ছি, মাথায় একটা কথাই আসছে - "লজ্জা"! ছেলে হবার লজ্জা। কিছু ছেলে এমন করতে পারে, তার লজ্জা। ছেলে হয়ে এর কোন যুতসই প্রতিবাদ করতে পারছি না, তার লজ্জা!

      জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লিখেছিস, মুচকি হাসতে হাসতে মন, মেজাজ দুটোই খারাপ হলো।

    আর একটা কথা, আমি মোটামোটি নিশ্চিত যে তোর লেখার ম্যাসেজ এটা না কিন্তু কেউ কেউ এই লেখা থেকে ভেবে নিতে পারে যে শুধু গ্রামের পাটক্ষেতে মলমূত্র ত্যাগ করা মোখলেসরাই এ ধরনের কাজ করে। বাস্তবতা হলো তথাকথিত অনেক ভাল পরিবারের সুশিক্ষিত পুরুষও একই দোষে দোষী।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    অসুস্থ মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। বাঁচার উপায় নেই বোধ হয়।
    আমাদের সময় পাড়ায় পাড়ায় ছোট হোক, বড় হোক, খেলার মাঠ ছিল, ব্যায়ামাগার ছিল, বিভিন্ন উৎসবের দিনগুলোতে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল। পাঠাগার ছিল, সাহিত্য সঙ্গীতের প্রতিযোগিতা ছিল।
    এখন ওগুলোর বালাই নেই বলেই বোধহয় এগুলো এত বেড়ে গেছে।

    জবাব দিন
  6. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এখানে যেভাবে বলা হয়েছে, মূল ঘটনাটা আমার ধারনা তা থেকে অনেক জটিল।
    এটা দেখে একটা অতি সরলিকরন প্রবনতা তৈরী হবার আশংকা দেখতে পাচ্ছি।
    সব বিষয় নিয়ে স্যাটায়ার যে জমে না, এটা বোধহয় তার একটা উদাহরন।

    ঘটনাটা শোনার পর থেকেই বিভিন্ন সম্ভবনা নিয়ে ভাবছি, কেবলই ভাবছি। এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌছুতে পারছি না।
    খুবই জটিল মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাকে...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিনা (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।