নেশা

নেশা… ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কি ভয়াবহ তার প্রকৃতি। একবার যার আসক্তি হয়, তার আর রক্ষে নেই। ধীরে ধীরে তার অস্তিত্বকে গ্রাস করে নিতে থাকে এই শব্দটি। সমর্পিত হতে হয়; নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়, বিলীন হয়ে যেতে হয়!

এই যে আমি, আমি কি নেশা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি? এখনো রাত হলে মনে হয় কখন পাবো তাকে, যাকে হনন করে আমি নিজেকে একটি সুখী মানুষ মনে করতে থাকব। কোনোদিন যদি সেটার অভাববোধ হয়, আমি স্থির থাকতে পারিনা। মধ্যরাতের শেষে ছটফট করতে থাকি, একটা বিতৃষ্ণা নিয়ে বিছানায় যাই, কিন্তু কেটে যায় সারারাত, নির্ঘুম। শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আলো ফোটা দেখি। নতুন আরেকটি দিনে নতুন করে আবার তার জন্য অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়। এই প্রতীক্ষার অসহ্য সময়টাতে আমার সেই গানটির কথা বার বার মনে হতে থাকেঃ “প্রথমত, আমি তোমাকে চাই… … … শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।”

তার পরও আমি আবার নেশায় জর্জরিত হই। বার বার এই নেশা আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে চায় ভিন্ন মাত্রার কোনো জগতে। সেখানে আমার ইন্দ্রিয়গুলো তাদের স্বকীয় অনুভুতিশক্তিকে বিসর্জন দিয়ে একাকার হয়ে যায় অন্য কোনো অতীন্দ্রিয় আবেগের সাথে। বিমোহিত হয়ে আমি শুনে যাই তাদের গুঞ্জন। ওদের কথোপকথনে আমার মাথার ভেতরে অনুরণিত স্নায়ুকোষেরা কখনো আনন্দিত, কখনো বিষন্ন। আবার মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু অনুভুতিকে মার্বেল গুলির মত ছুঁড়ে দেয় এই নেশা, তারা গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যায় সমস্ত শরীরে; তখন আগুন জ্বলতে থাকে সমস্ত স্বত্তায়। সেই তাপ সব বয়সের মানুষ সহ্য করতে পারেনা, দূরে সরে যায়। আবার কারো কারো মনে সঞ্চারিত হয়ে যায় সেই উত্তাপ। বড় ভাল লাগে তখন।

উত্তপ্ত আমার মাঝে আরো একটি নতুন নেশা চেপে বসতে চায়। সে চায় আমার দেহকে ঠান্ডা করে দিতে, কিন্তু সেটা অন্য কোনো ভাবে নয়, দেহের তাপটাকে মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করে দিয়ে। আমি চরম উত্তেজনা নিয়ে দৌড়াতে থাকি, হাঁপাতে থাকি, ভয়ের হিম শীতল স্পর্শে কাঁপতে থাকি; কিন্তু আমার শরীর ঘামেনা, কখনো আপত্তিও করে না ভয়কে স্বাগত করতে চাইলে। আমিও ভয়ঙ্কর আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ি বিশাল সব দৈত্য-দানবের মাঝে, তারা আমার চোখের সামনে জঘন্যভাবে ছিঁড়ে ফেলে আমার প্রিয়জনকে। আমি আরো ক্রোধান্বিত হই। প্রতিশোধস্পৃহায় কেঁপে ওঠে আমার অন্তরাত্মা। দ্বিগুন ভয়াবহতায় আমি নিজেকে মূর্তিমান করি, ওদের শেষ দেখে ছাড়ি। এত কিছুর পরও তবু আমি ক্লান্ত হইনা, কর্দমাক্ত হইনা, ঘর্মাক্ত হইনা, রক্তাক্ত হইনা… নতুনভাবে খুঁজতে বের হই আরো কোনো নেশাজাগানিয়া কল্পজগতের তল্লাশে।

এত সব নেশার ভীড়ে আমার জীবন যখন ওষ্ঠাগত, তখনো নেশা আমার পিছু ছাড়েনা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সামনে এগিয়ে যাই। সময় আমার কাছে থেমে আসতে চায়। মন পূর্ণরূপে নিবিষ্ট হয় এক অবর্ননীয় গভীরতায়, যেখানে অন্ধকারের মাঝেও খুঁজে পাওয়া যায় অপার্থিব ঔজ্জ্বল্য। তার অবয়বে যখন দক্ষিনা হাওয়া খেলে যায়, সাথে সাথে ওড়া কালো মেঘের ঘনঘটায় আমার নেশাতুর মন শিহরিত হয়ে উঠে। তার ছায়া যেখানে এসে তার সাথে মিলিত হয়, সেই বিন্দু থেকে শুরু করে আমি আমার অস্তিত্বকে কল্পনা করতে থাকি। তার মৃদু চলনে আমার হৃদস্পন্দন ধাবিত হয় অন্য এক ছন্দ-গতিতে, সেই রূপ-ভঙ্গিমায় মোহিত এই হৃদয় বুঝতে পারেনা কখন সে থেমে যাচ্ছে, আর কখনই বা ধুকধুক করছে!

নেশা করতে করতে মাতাল এই আমি আবার টলতে টলতে বসে যাই নতুন এক নেশায়ঃ যেখানে বর্ণ, শব্দ আর বাক্যের এক বর্ণীল রংধনু ধেয়ে যায় চিন্তার আনাচে-কানাচে, যার রং আবার ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে; করে দিতে পারে উদাস, আবার এনে দিতে পারে উচ্ছাস!

২০ টি মন্তব্য : “নেশা”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    দারুন লেখা আদনান ............

    তবে চার নম্বর প্যারার নেশাটা কি বুঝিনি ...... :no: :no:

    তার অবয়বে যখন দক্ষিনা হাওয়া খেলে যায়, সাথে সাথে ওড়া কালো মেঘের ঘনঘটায় আমার নেশাতুর মন শিহরিত হয়ে উঠে। তার ছায়া যেখানে এসে তার সাথে মিলিত হয়, সেই বিন্দু থেকে শুরু করে আমি আমার অস্তিত্বকে কল্পনা করতে থাকি। তার মৃদু চলনে আমার হৃদস্পন্দন ধাবিত হয় অন্য এক ছন্দ-গতিতে, সেই রূপ-ভঙ্গিমায় মোহিত এই হৃদয় বুঝতে পারেনা কখন সে থেমে যাচ্ছে, আর কখনই বা ধুকধুক করছে!

    এইটা কি সুমি ??? নাকি সিগারেট ???

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

      দিলাম তো... লাস্টের টা-ই তো ওটা!!

      নেশা করতে করতে মাতাল এই আমি আবার টলতে টলতে বসে যাই নতুন এক নেশায়ঃ যেখানে বর্ণ, শব্দ আর বাক্যের এক বর্ণীল রংধনু ধেয়ে যায় চিন্তার আনাচে-কানাচে, যার রং আবার ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে; করে দিতে পারে উদাস, আবার এনে দিতে পারে উচ্ছাস!
      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : স্বপ্নচারী (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।