তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৪

তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৩
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ২
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ১

আজ ইউনিভার্সিটির পিকনিক। সকাল বেলা রিপোর্ট করতে হবে ঘাটে। বিশাল দু’টি লঞ্চ ভাড়া করা হয়েছে। নদীপথে ট্রিপ, সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। জিনিসপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। মোড়ের সামনে ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধু অপেক্ষা করছে, একটু আগে তার ফোন এল। একসাথে যাব। হেঁটে হেঁটে খানিকটা গিয়ে দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কিনে রিকশা ঠিক করলাম। সুন্দরবনে সিগারেট পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। সামনে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। বললঃ “এত দেরি করলি কেন?” আমি উত্তর না দিয়ে বললামঃ “উঠ।” সকালের কুয়াশা ভেদ করে আমাদের রিকশা টুক টুক করে চলতে শুরু করল।

ঘাটে পৌছে দেখা হল আরো কিছু ফ্রেন্ডের সাথে। ওরা সবাই বেশ আগেই পৌছে গেছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আমাকে সাধল, নিয়ে দুটো টান দিয়েছি যেই অমনি ভো করে সাইরেনের আওয়াজ শুনলাম। সবাইকে বোর্ড করার জন্য ফার্স্ট ওয়ার্নিং। সিগারেটের শেষটুক ফেলে দিয়ে ধাপ বেয়ে লঞ্চের দিকে এগোলাম। মামুন দেখলাম তার গিটার-টা সঙ্গে বাধিয়ে এনেছে। যাক, খুব বোরিং যাবে না তাহলে দিনটা। নির্লিপ্ত সময়গুলোতে বসে বসে ওর গান উপভোগ করা যাবে। আমার এই বন্ধুটির আবার দারুণ গানের গলা। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার যদি ওর মত গানের গলা হত! গান করি, কিন্তু ওর মত এত সুন্দর সুর আমার গলা দিয়ে বেরোতে চায় না।

ব্রেকফাস্টের আইটেম দেখে একটু দমে গেলাম। বাসা থেকে খেয়ে আসা দরকার ছিল। এত বেশি সাধারণ মেনু, দেখে ভক্তি আসল না। ২টা পাউরুটি, একটা কলা, আর রসগোল্লা। ঝালের প্রতি আমার একটা বিশেষ প্যাশন আছে, কিন্তু এতো দেখি সবই মিষ্টি জিনিস। তা-ও আবার যে রসগোল্লা দিয়েছে সেটা স্পঞ্জ, একটা অন্যতম ডিসগাস্টিং মিষ্টান্ন আমার কাছে। মনে মনে পিকনিক অর্গানাইজিং কমিটিকে ধুয়ে দিলাম। কিন্তু কি বা করার আছে? বিরস বদনে কোনমতে সেগুলি সাবাড় করলাম। হাতে নিয়ে তো আর ঘুরে বেড়ানো যায়না, আর খাবার ফেলে দিতেও আমার মন চায় না।

লঞ্চ দু’টি মোটামুটি পাশাপাশি ভাসছে। এখনো ছাড়েনি। স্টুডেন্টদের দিয়ে গিজ গিজ করছে ছাদ। কারোরই এখন নীচে বসে থাকার ইচ্ছা নেই। সবাই ছাদে এসে ভীড় করেছে। পাশের লঞ্চে মনে হয় ভার্সিটির সব ত্যাদড়গুলি উঠেছে। ফাজলামি করে কিছু আর রাখছে না। মেয়েরাও বাদ নেই, ওসব বস্তাপঁচা দুষ্টুমিতে ওরাও দেখি হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেয়েদের সেন্স অফ হিউমার এত খারাপ কেন? অবসার্ভ করছি আর এসব নানান হাবিজাবি চিন্তা মাথায় আসছে। আশেপাশে পোলাপান গল্পের আসরে মেতে উঠেছে। মামুনকে দেখি এক স্যারের সাথে কথা বলছে, খুব সম্ভবত গিটারটা আপাততঃ কোথায় রাখবে সেটা নিয়ে আলোচনা। সখের জিনিস, এরকম একটা ক্রাউডে দুশ্চিন্তা হতেই পারে। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে আমি দ্বিতীয় লঞ্চটার দিকে আবার তাকালাম – এবং সাথে সাথে আমার হার্টবিট যেন এক ন্যানোসেকেন্ডের জন্য ফেইল করল। সেই নাম-না-জানা মেয়েটি! পিকনিকটা মনে হয় এবার বেশ ভালোই হবে… যদিও আমাকে নিরাশ করে দিয়ে সে ঐ লঞ্চে উঠে পড়েছে; তবুও… দেখা তো পেলাম। হঠাৎ মামুনের ডাক শুনে ফিরলামঃ “এই তোর কাছে এই চাবিটা রাখ্‌, স্যার স্পেশালী এই রুমটা আমাদের জন্য এ্যালট করেছে। ক্যামেরা-ট্যামেরা যা রাখার রেখে আয়; সেফ থাকবে।” আমি চাবিটা নিয়ে দৃষ্টি দিলাম আবার সেদিকে। কিন্তু হায়! ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। ভীড়ের ভেতর একটু খোঁজার চেষ্টা করলাম। নাহ্‌, নেই! আরেকটা ‘ভো’ শুনতে পেলাম। এখুনি বোধহয় ছেড়ে দিবে।

সারাদিন নদীপথে খুব ভাল লাগছিল। মেয়েরা গোল হয়ে বসে অন্তাক্ষরি খেলছে। সুরের কোন বালাই নাই, মাঝে মাঝে দু’একটা পিচে থাকা কন্ঠ শোনা যায়, বাকি সব চিৎকার ছাড়া কিছু নয়। তবে সুন্দরবনে ট্রিপ যতটা রোমাঞ্চকর হবে ভেবেছিলাম ততটা লাগেনি। জানিনা শুধু আমার কাছেই এমন মনে হচ্ছে কি না; অথবা এটা আমার পিকনিকের আনন্দের প্রতি অমনযোগী হবার ধারাবাহিকতা কিনা। সবাই সুন্দরবনে নেমে খুব তামাশা করেছে, শুধু আমি-ই গ্রুপের সাথে থেকেও যেন একটু বিচ্ছিন্ন। শুধু খুঁজে বেড়িয়েছি অন্য কিছু, যার সাথে সুন্দরবনের প্রকৃতির কোন সম্পর্ক নেই।

ফিরতি পথে গানের আসর হল। সবাই উপরে জমা হয়েছে। স্যার-ম্যাডামরা, স্টুডেন্টরা সব মিলে গান গাচ্ছে। কেউ একজন একটা পরিচিত গান ধরলে সবাই মিলে সেটার সাথে কন্ঠ দিয়ে হৈ-হৈ করছে। আমার কেন যেন মন যাচ্ছে না সেদিকে। ক্যামেরাটা এনেছিলাম, সেই যে রুমে ঢুকিয়েছি, নিজে থেকে বের-ই করিনি। একটু আগে নীপা এসে আমার ক্যামেরাটি নিয়ে গেল, ওরা ছবি তুলবে। আমাকেও ডেকেছে, যাইনি। সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদী দেখছি আর সিগারেট টানছি। এর মাঝে মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখি মামুন ডাকছে। বুঝলাম এবার আমাকে উপরে যেতেই হবে। কলটা কেটে দিয়ে শেষ ক’টি টান দিয়ে ফিল্টারটা নদীতে বিসর্জন দিয়ে আমি উঠে আসলাম।

গান গাইবার জন্য আমার ডাক পড়েছে। সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু ছেলেপেলে খুব করে ঠেলছে। আমি একরকম অনীহা নিয়েই গিটারটা হাতে তুলে নিলাম। সামনে বসা গাদাখানেক ছেলেমেয়ের দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে গিটারের ফ্রেটের দিকে নজর দিতে যাব, এমন সময় আবার হার্ট এ্যাটাক! এবার সিরিয়াস অবস্থা — ঐ মেয়ে অন্য লঞ্চ থেকে এইটাতে চলে এসেছে, এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আলো-আঁধারিতে কারোর চেহারাই ততটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু তার থেকে এক অন্যরকমের স্বর্গীয় বিচ্ছুরণ হচ্ছে। এ নিশ্চয়ই আমার চোখের ভুল! ও তো এ্যাঞ্জেল নয়, মানুষ; তার অবয়ব থেকে এমন আলোকচ্ছটা’র মানে কি? আমার কি মস্তিষ্কবিকৃতি হল নাকি?

“কি রে? গা…গাস না ক্যান?” সমস্বরে এ জাতীয় কিছু ধ্বনিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। মনে এখন অন্যরকম আনন্দ, সেই সাথে একটা ভয়-ও কাজ করছে। বেসুরো গলায় কি গাব এটা নিয়ে সংশয়। আমি তো আর মামুন না! আগে পোলাপানের আড্ডায় গান গাইতে আমার কোন সমস্যা হত না। জানি গান আমার হয়না, কিন্তু কে কি ভাববে অত ভাবার আমার দরকার আছে? আড্ডার সময় একটা চললেই হল। কিন্তু এবার তো আমার নার্ভাস সিস্টেম ব্রেকডাউন হবার জোগাড়। টেনশনে মাঘ মাসের সন্ধ্যায়ও টের পেলাম কানের পাশে ঘামের একটা ফোটা বড় হচ্ছে, এখুনি গাল বেয়ে নামবে।

আর ভাবনা নয়, এবার কিছু একটা সুন্দর করে প্রেজেন্ট করতেই হবে। ই-মেজর ধরে গলা ছেড়ে দিলাম…
“চল না যাই হারিয়ে দু’জন, নীরবে কোন নির্জনতায়, চল না সুখের গল্প বলি দু’জনে চোখের তারায় তারায়।।”

এরপর কি হয়েছে জানিনা, গান গাইবার সময় প্রতিক্রিয়া দেখতে পারিনি, চোখ বন্ধ ছিল। হৃদয়ের সব ধরনের সুন্দর অনুভুতিগুলো Ctrl ধরে সিলেক্ট করে করে আমার গানের সাথে মিশানোর চেষ্টা করেছি। শ্রোতারা হাতে তুড়ি দিয়ে টেমপো দিচ্ছিলো ঐ ব্যাপারটা আলাদাভাবে ভাল লেগেছে, শুধু এটা বলতে পারি। গান শেষে এতগুলি করতালির আওয়াজ আমাকে জানান দিল – খারাপ হয়নি খুব একটা। আমি চোখ মেললাম, দেখি সেই জায়গাটিতে সে নেই। আবারো খুঁজলাম, বেশ খানিকটা দূরে ঐ পাশের রেলিং-এ দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে, একমনে নদী দেখছে। গানটা কি ওর মনে দাগ কেটেছে? টেনশন… টেনশন…

গিটারটা হস্তান্তর করে ভাবলাম গিয়ে একটু কথা বলি। পরক্ষণেই আগের দিনের কথা চিন্তা করে দমে গেলাম। থাক্‌, আজ নয়। ওদিকে শুনি শ্রোতাদের বিমোহিত করে দিয়ে মামুনের গভীর কন্ঠস্বরে একটি মিষ্টি রিদম-এর মন উদাস করা গান ভেসে আসছেঃ
না থাক্‌, আজকে না হয়
বলব না ভালবাসি;
আজকে শুধু দেখব
তোমার ওই মুখের হাসি।।

to be continued…

২,০৫২ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৪”

  1. আদনান ভাই

    আমরা সকলে সেই অনুপম সুন্দরী অপ্সরীর নামটা জানতে চাই !!

    --------------------------
    লেখাটা দারুণ হইতেছে বস............
    :boss: :boss:

    ভাই, সুন্দরবনে তো কাঠের সাঁকো পার হওয়ার প্রয়োজন হয়... তখন আপনার একটু সাহায্য কি নিতে পারে ওই নাম না জানা তরুণী??
    (প্লট কইলাম আর কি! ) 😛 😛

    জবাব দিন
  2. আরিফ (৯২-৯৮)

    পাগলা,
    নায়করে মাসরুফ এর নামডা তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও, নাইলে সবাই কিন্তু বুঝে ফেলবে যে এইটা তোমার গল্প............। শেষ পর্যন্ত গান নিয়ে ব্যাবসা?

    লেখা ভাল হচ্ছে। তবে সাইজ এর কারনে বধহয় বেশি হিট হয়ে যাচ্ছে।

    জবাব দিন
  3. আব্দুল্লাহ (২০০৪-২০০৮)

    ফয়সাল ভাইয়া ঠিক প্লট ই বলে দিছেন.........মনে করেন হঠাত করে পা ফস্কে পড়ে যেতে লাগলো আর ওমনি আপনার হাত ধরে ফেলল। ভাইয়া পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
  4. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    তা-ও আবার যে রসগোল্লা দিয়েছে সেটা স্পঞ্জ, একটা অন্যতম ডিসগাস্টিং মিষ্টান্ন আমার কাছে।

    হা হা হা হা হা.........।। কতদিন স্পঞ্জের রসোগোল্লা খাই না। আমার খুবই প্রিয়...।। :awesome:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আব্দুল্লাহ (২০০৪-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।