ভোজন বিলাসি ঘুম, নাকি উল্টা-টা?

নেটের লাইন ছিল না, একটু আগে আসলো। এই লেখাটা তখনই দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারলাম কই? যাই হোক, সিরিজের মাঝখানে একটা বদখত পোস্ট দেবার কারণে নিজেই নিজের ব্যান পেপারে আগেই সিগনেচার করে রাখছি। বাকিটুকু সদস্যবৃন্দের দয়া/করুণা/দান/ব্লা-ব্লা-ব্লা…

শুয়ে আছি অন্ধকারে। ক্যাডেট কলেজে আগে কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর দিত। এখন আর দেয় না। শুধু যদি প্রেপ চলে তখন দেয়। ইভনিং প্রেপ/ নাইট প্রেপ বন্ধ থাকলে নো জেনারেটর। তাই আজ আমরা আঁধারে।

বিছানার উপরে বেশ ক’জন বসা। কিছু ছেলেপেলে বাইরে লনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে ক্যাডেটীয় স্টাইলে – ৩ টান, ২ টান, ১ টান, সার্কেল। এক কোণায় কি গুটুর গুটুর গল্প চলছে। কান পাতলে একটু একটু বোঝা যায়, ওসব মেয়ে-সংক্রান্ত আলাপ। এটা হাসান না হয়ে যায় না। মেয়েদের যত রকম বিড়ম্বনার গল্প সবচেয়ে ভাল ও-ই ফাদতে পারে। আর সে কি উদ্ভট সব সাব্জেক্ট! কোন মেয়ে কবে ম্যানহোলের ভিতর পড়ে গিয়ে সেইরকমের হেনস্থা হল; কার বয়ফ্রেন্ড কবে আরেকটা মেয়ে কে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললঃ “মিট মাই গার্লফ্রেন্ড…” ; কবে সে নিজে একটি মেয়ের অসৎ ইচ্ছাকে চরম অপমানে গুড়িয়ে দিয়েছিল এই সব। গল্পগুলির পুরোটা শোনা হচ্ছে না, কারণ অন্ধকার… অন্ধকার কিভাবে জানি শব্দ শুষে নিচ্ছে।

আমার পাশে একটি গিটার রাখা। গিটারটা দেখা যাচ্ছে অন্ধকারেও, কারণ তার কালারটা এমনই যে বাইরে জানালা দিয়ে হালকা চাঁদের আলো যা-ই আসে সেটা গ্রহণ করে এক ধরণের গ্লো দেয়। পুরো রুমের ভিতর ঐ একটা জিনিস একটু পরিস্কার ভাবেই দেখা যাচ্ছে আর বাকি আন্দাজের উপরে। পেটের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করলাম। মেহরাজের গলাঃ “এই, আদনান, একটা গান গা না!” এখন আবার গান… কেবল ঘুম থেকে উঠলাম, উঠেই দেখি কারেন্ট নাই, মেজাজ গিয়েছে চড়ে… এখন আবার গান! আমি বললাম “দোস্ত, ভাল্লাগতেসেনা”। ও তা-ও নাছোড়বান্দা- “এই দেখ্‌ দেখ্‌ আমি একটা গান লিখসি, আয় আমরা দুইজনে বসে এটা কম্পোজ করে ফেলি”। ওর এত আগ্রহ দেখে আর নিরাশ করতে মন চাইল না। গিটার টা টেনে নিয়ে বসলাম; বললাম “কই গান দেখা”। ও একটা খাতা না ডায়রি গোছের কিছু এগিয়ে দিল। আমি ভেবে পেলাম না এই অন্ধকারে আমি কিভাবে ঐ ডায়রির পাতা থেকে লেখা পড়ব, তাও দেখার চেষ্টা করলাম। কি কি জানি লেখা বোঝা যাচ্ছে আবার যাচ্ছে না। মেহরাজ একটু অধৈর্য হয়ে উঠলঃ “কি রে তুই তো বাজাচ্ছিস না।”
“আরে আমাকে পড়তে দিবি তো।”
“পড়া লাগবে না তুই মিউজিক বানা।”
“কি আজিব! পড়ার জন্য ডায়রি আগায়ে দিলি, এখন বলিস পড়া লাগবে না, ঠিইইইইক আছে, ব্যাপার না…” আমি একমনে গিটারে টুং-টাং প্লাকিং করতে লাগলাম। হঠাৎ হঠাৎ চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, বুঝি না ছেলেপেলে আমার গিটারের মিউজিক শোনে নাকি কথা বলার বিষয়ের গতি হারিয়ে ফেলে চুপ হয়ে যায়। আমি আমার মত গিটারের তারে আঙ্গুল বুলিয়ে যাই।

হঠাৎ দূরে একটা ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাই। কলেজ বেল টা বেশ দূরে, তাই বলে এত দূরে নয় যে এত হালকা শোনা যাবে। মনে হচ্ছে হাজার মাইল দূর থেকে শব্দটা ট্রাভেল করে আসতে আসতে ম্রিয়মান হয়ে গিয়েছে। মনে হয় এটাই ডিনার বেল। আমি একটু জোরে বলে উঠলাম- “অই ঘড়ি আছে কার কাছে দেখতো কয়টা বাজে?” ঐ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা কে যেন বলে উঠল “আটটা”। গলাটা এবার চিনতে পারলাম না, আবার অন্ধকার শব্দ খেয়ে নিচ্ছে। হুম, তাহলে ডিনার বেল-ই। এখন খানা আসবে। একটু ভাল লাগতে থাকল, চাঙা চাঙা মনে হতে লাগল।

গিটারটা একপাশে আবার এলিয়ে রেখে উঠে পড়লাম; হাত ধুয়ে আসতে হবে। মেহরাজ একটু ‘কই যাস কই যাস’ করছিল, আমি আর পাত্তা দিলাম না। আজ মনে হয় মুরগী দিবে। আগে না আসলে ভাল পিস-টায় বুকিং দেওয়া যাবে না। কিন্তু হাত ধোবার জন্যও এত দূর হাঁটা লাগবে? ক্লাস টেনের ফর্ম থেকে সেই ওয়াশরুম পর্যন্ত। দূর থেকে আবার ঠাস ঠাস করে শব্দ পাচ্ছি। জুনিয়র গ্রুপ মার্চ করে মনে হয় ডায়নিং হলে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল, ইস! সেই মার্চ করার দিনগুলি কি কষ্টেরই না ছিল! ঠাস ঠাস শব্দ থেমে গেছে টের পাই। হাত ধুয়ে আবার ফিরে আসি সেই ক্লাস টেনের ফর্মে, যেখানে আমাদের ব্যাচকে এলটমেন্ট দেওয়া হয়েছে সব ডেস্কগুলি সরিয়ে।

ফিরে গিয়ে দেখি খাবার চলে এসেছে অল্রেডি। কিন্তু অন্ধকারে কিছু তো দেখা যায় না। কোনমতে হাতড়ে একটা প্লেট হাতে নিলাম। গিটার টা আর বিছানায় নেই, কোথায় সেটা এখন দেখাও যাচ্ছে না। যেই জায়গাটায় ওটা শোয়ানো ছিল সেখানে আহমেদ বেশ জুড়ে বসেছে। ও জোড়াসিন হয়ে বসলে কেন জানি অনেক জায়গা খেয়ে দেয়। বাকি কয়েকজন তাকে চাপ দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার ঐ হাড্ডি হাড্ডি হাঁটুর কাছে খুব একটা পাত্তা পাচ্ছেনা। এজন্য টুকটাক গালিও খাচ্ছে সে। আমি প্লেটের দিকে মনযোগ দিলাম। আরে! আমার প্লেটে ভাত, মুরগির মাংস, ঝোল, টিকিয়া, সালাদ এগুলো বেড়ে দিল কে? কানের কাছে আজাদের গলা শোনা গেল “খা, খা…” মাথা ঘুরিয়ে খুঁজলাম তাকে, পেলাম না। যাক গে, খাওয়া শুরু করলাম।

ধুৎ! অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। খেতে গিয়ে মরিচে কামড় বসিয়ে দিয়েছি। পানি খুঁজছি, পাচ্ছিনা। কি করা! ভয়ঙ্কর স্বাদ মুখে নিয়েই খেতে লাগলাম। কিন্তু খেতে পারছি না। মুরগির মাংস ছাড়াতে গিয়ে দেখি ওটা একটা হাড্ডিসার পিস। মেজাজটাই গেল খারাপ হয়ে। কোনমতে টিকিয়া আর সালাদ দিয়ে শেষ করে উঠে গেলাম, হাড়-হাড্ডি ট্র্যাশ করে আসি বাইরে। কিন্তু অন্ধকারে ওগুলি বাইরের ‘ইউজ মি’ তে ফেলতে গিয়ে বেড়াছেড়া লাগিয়ে দিলাম, সব বাইরে পড়ল। ধুত্তরি, জায়গাটাই নোংরা হয়ে গেল!

ফাঁকা প্লেট হাতে আবার ভেতরে ঢুকলাম। সাথে সাথে ফকফকা! কারেন্ট চলে এসেছে। দেখি, আমাদের জন্য ডেকচি ডেকচি ভাত, গরুর মাংস ইত্যাদি রুমের ঠিক মাঝ বরাবর সাজানো। সবাই হুমড়ি খেয়ে আছে ওগুলির ওপর। মাশরুফের বিরাট খোদার খাসি মার্কা দেহখানি সেখানে সবচেয়ে দাপটের সাথে কাড়াকাড়ি করে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। “অই তুই না খাইছিস, আবার কি?” আমি কানে তুললাম না, গরুর মাংস বাছাই করতে উদ্যত হলাম। ভাত পরে নিব। শুধু একটু বললামঃ “খাইসি তো কি অইসে? আবার খামু। খিদা যায়নাই।” ভাত নিতে গিয়ে দেখি পোলাও। ওয়াও! আজ তাহলে ইমপ্রুভ ডিনার! কিন্তু ইমপ্রুভ ডিনারে গরুর মাংস কেন? ঐ হল, এত ভাবার সময় নাই। অনেক ক্ষুধা পেটে। উঁচু করে ভাত নিয়ে ঝোল দিয়ে মাখিয়ে সাটাতে বসে গেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি, একটু পর নাকি কনসার্ট। রিউনিয়নে কনসার্ট ছাড়া জমে নাকি? কিন্তু এ কেমন রিউনিয়ন এটাই মাথায় ঢুকছে না। ক্যাডেটরা মার্চ করে ডায়নিং-এ যায়, এক্স-ক্যাডেটদের খাওয়ার ব্যবস্থা রুমের মধ্যে, কোন হৈ-হুল্লোড়ের সাড়াশব্দ নাই, অন্য ইনটেকের ভাইদের দেখা নাই, পাওয়ার সাপ্লাই-এর ঠিক নাই, গরমকালে ডেট ফিক্স করা হয়েছে… নাহ এবারের রিউনিয়নের এ্যারেঞ্জমেন্ট খুবই ফালতু!

প্রথম লোকমা-টা মুখে দিব, সাথে সাথে আবার অন্ধকার, সেই ইষৎ চাঁদের আলো বাদে। কি বিপদ! হঠাৎ টের পেলাম আমার হাতে খাবার নেই। প্লেট-ও নেই। কিছুই নেই। আমি বিছানাতে শুয়ে; শুধু রুমের ভেতর হালকা একটা আলো ছড়িয়ে আমার কম্পিউটারের মনিটরটা উজ্জ্বল হয়ে আছে…

একরকম বাজে ভাবেই ঘুমটা ভেঙ্গে আমার রিউনিয়নে ক্লাস টেনের ফর্মে বসে ব্যাচমেটদের সাথে মধুর ইম্প্রুভ ডিনার খাওয়ার এত সুন্দর স্বপ্নটার তেরোটা বাজিয়ে দিয়ে পেটের ভিতর গুড়গুড় শব্দে জানান দিল – বেশ খিদে পেয়েছে। ক’টা বাজে দেখার জন্য হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটাতে চাপ দিলাম – রাত ৯ টা। ডিনার টাইম।

১,৩৭৬ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “ভোজন বিলাসি ঘুম, নাকি উল্টা-টা?”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    মাশরুফের বিরাট খোদার খাসি মার্কা দেহখানি সেখানে সবচেয়ে দাপটের সাথে কাড়াকাড়ি করে যাচ্ছে

    ওই শালা,আমি কবে দাপাদাপি কইরা খাইছি?????আমি বরং পারলে সব খাওয়া দোস্তদের পাঠায় দিতাম x-( x-( x-( x-( x-(

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমরা এসএসসি ক্যান্ডিডেট থাকার সময় কলেজের জেনারেটর নষ্ঠ হয়ে যায়, হারিকেন দিয়ে প্রেপে আর হাউসে পড়াশুনা করা লেগেছে, চরম মজা হত, তবে আরো মজা হয়েছিল ১১ এ গিয়েও দেখলাম যে হারিকেনের যুগ তখনও চলছে, তখন খালি অপেক্ষায় থাকতাম কখন কারেন্ট যাবে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : স্বপ্নচারী (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।