“জ্বি ভাইয়া”: এক ক্যাডেট বন্ধুর গল্প

আমি এখন যার বাসায় বসে লিখছি, গল্পটা তাকে নিয়ে।

২০০০ সাল। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে আইসিসিএলএম চলছে। আমরা তখন ক্লাস টেন-এ। আমি গিয়েছিলাম ব্যান্ড পার্ফরমার হিসেবে, কিবোর্ডিস্ট। ওটা আমার প্রথম ইন্টার ক্যাডেট কলেজ মিট-এ যাওয়া। অন্যরকম এক্সাইটমেন্ট। সিনিয়ররা কলেজ থেকে আসার সময় বলে দিয়েছে ওই টাইমটা ফ্রি– কোন ইয়েস প্লীজ, নো প্লীজ এর বালাই নাই, কথা বলার সময় সাবধান হয়ে দাঁড়ায় থাকার দরকার নাই; এই সব নানা কারণে আরো বেশী আনন্দ।

নতুন বেশ কিছু বন্ধুর সাথে পরিচয় হল সেবার। ভয়ঙ্কর ট্যালেন্টেড কয়েকটা মিউজিশিয়ান ভাই-কেও দেখলাম। রংপুরের আহ্‌মেদ ভাই (গিটারিস্ট) তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি উনার প্লেইং দেখে ইন্সট্যান্ট ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। ধুর্‌ কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাই…যাই হোক, সেবার প্রথমবারের মত মেয়ে ক্যাডেট দেখার ভাগ্য হল। পাঠকরা প্রয়োজনমত ‘সৌ’ অথবা ‘দুঃ’ বসিয়ে নিতে পারেন, আমি যদিও সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে ‘সৌ’-ই বসাব কারণ আমাদের একটা অপরিসীম আগ্রহ ছিল ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ-এর ব্যাপারে।

আমারও সেই আগ্রহের কমতি ছিল না, তাই গার্লস যখন অডিটরিয়ামে প্রবেশ করল, তাদের দিকে আমার (এবং বোধ করি আমাদের সকলের) উৎসুক দৃষ্টি। আমি আবার খুঁজছিলাম এ্যাপুলেটে চার দাগ। কি করব? ফেলো ফিলিংস জিনিসটা তো রক্তে টিউন হয়ে গেছে। পেয়েও গেলাম। তক্কে তক্কে থাকলাম তাদের ইভেন্ট দেখার জন্য।

যথারীতি ইভেন্ট শুরু হল। আমার মনযোগ ছিল মিউজিকাল ইভেন্টগুলার প্রতি। সেখানেই পাওয়া গেল এই গল্পের প্রধান চরিত্রকে। অসম্ভব সুন্দর গলার কারুকাজে নজরুল আর উচ্চাঙ্গতে সে তার দক্ষতা দেখিয়ে দিল। সাধারনত এই ইভেন্টগুলাতে কারো তেমন একটা ইন্টারেস্ট থাকেনা মন দিয়ে দেখার। বিশেষ করে আমার মত রক ফ্যানের তো নয়-ই। সবাই ঝিমায় বসে বসে। অবাক করা ব্যাপার, আমি তার গান মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলাম। নজরুলের “খোলো খোলো খোলো গো দুয়ার” বিখ্যাত হয়ে গেল তখন!
(

    অফ-টপিক

: গান টা কোন জায়গায় পেলাম না, কারো কাছে থাকলে দয়া করে adnan1852@gmail.com এ সেন্ড করবেন প্লীজ!!)

মেয়েটার ছোট করে কাটা চুল (বব্কাট না কি বলে যেন সেটাকে ঠিক জানা নাই), বড় বড় চোখ, চেহারার মধ্যে একটা অন্যরকম শান্ত ভাব; আর পারফর্মেন্সের কথা তো বললাম-ই… সন্দেহাতীতভাবে আকর্ষনীয় 😡 এবং ঈর্ষনীয় 😐 । আহমেদ ভাই-এর বেলায় যা হয়েছিল, এর বেলায়-ও সেরকম – আমি ইন্সট্যান্ট ফ্যান হয়ে গেলাম!!

ধীরে ধীরে ব্যান্ড কম্পিটিশনের দিন এল। কেউ কিছু মনে না করলে আমি একটু প্রাইড নিয়ে নিই: ঐ সময়ে ব্যান্ড সাইডটা আমার উপরে অনেকখানি ডিপেন্ড্যান্ট ছিল; কারণ এই সেক্টরে আমি আমার কলেজে সেই সময়ে বিশেষ পারদর্শী ছিলাম বাকি সবার থেকে, ইভেন আমার ক্লাস 12-এর ব্যান্ড মেম্বারদের থেকেও। সবাই আমার উপর অনেক ভরসা করত। আমরা লিজেন্ড-এর ‘বাংলাদেশ’ গান-টা করেছিলাম; অর্ডারগুলা আমি সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। রাকিব ভাই, রায়হান ভাই, সাদিক ভাই, নাসির ভাই… এই ক’জন পুরাপুরিভাবে আমার আই-কন্ট্যাক্ট-এর ভরসা নিয়ে স্টেজে উঠেছিলেন (সিনিয়রদের এই প্রেইজ আমাকে অনেক ভাললাগা দিয়েছিল; হয়তো তাঁদের সেই অনুপ্রেরণাও আমার এতদূর আসার পিছনে দিশা… উনাদের শ্রদ্ধা জানাই :hatsoff: )।

ঐদিন আমরা একটা বিশেষ কারণে (টেনশনটা আমারই বরং বেশি) বেশ নার্ভাস ছিলাম। কারণটা বলিঃ- আমাদের কিবোর্ড আই.সি.সি তে আসার ক’দিন আগে ডিস্টার্ব দেয়। এ্যাডাপ্টার লাগানোর জায়গাটিতে লুজ কন্টাক্ট। নানা কসরত করে তার কিবোর্ডে রীডের সাথে লাগিয়ে তবে বাজানো যেত এবং তা খুব সাবধানে, একটু বেকায়দা নড়া লাগলে ছুটে যেত, আবার কসরত করা লাগত। তো, আমরা গ্রীনরুমে গিয়ে দেখি সব ইন্সট্রুমেন্ট স্ট্যান্ড-বাই করা, আর গার্লস-দের আর আমাদের কিবোর্ড একই মডেল। আমার মনে হল আমাদের যখন সমস্যা, ওদের কাছে একটু সাহায্য চেয়ে দেখি। হাসান ভাই (কলেজ প্রিফেক্ট)কে বললাম। উনি এগিয়ে গেলেন কথা বলার জন্য (উনি আবার মেয়েদের সাথে ডিল করায় বেশ পটিয়সী ছিলেন কি না!)। উনাদের নেগোসিয়েশন শেষে আমার সাথে গার্লস-এর আপুরা কথা বললেন, এবং বললেন যে- দেওয়া যেতে পারে তবে *শর্ত প্রযোজ্য*: ফাইন টিউনিং নব সেট করা আছে ওটাতে হাত দেওয়া যাবে না। আমি চিন্তা করলাম যে থাক, আমাদের একটা বিশেষ টিউনিং আছে ওটা না পেলে হবেনা… সুতরাং ঐ প্লান বাদ দিলাম; ঠিক করলাম যা থাকে কপালে, রিস্ক নিয়েই বাজাব।

আল্লাহর রহমতে আমাদেরটা ভালয় ভালয় শেষ হল কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই। একসময় আসলো ওদের পালা। দেখলাম, সেই মেয়েটাও সেখানে একজন সদস্য। আরো দেখলাম, সে-ও আমার মতই – কিবোর্ডিস্ট। অন্যরকম ভাল লাগল O:-) , যেটার ডেফিনিশন ‘প্রেম’ বা ঐ জাতীয় কোন শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয় (কথাটা এভাবে বললাম কারণ আমার মনে হয় ইতিমধ্যে পাঠকরা ঐ লাইনে অনেক কিছু চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছেন)। এই ভাললাগাটা শুধুমাত্র মিউজিশিয়ানরাই জানে।

সব কলেজকেই একটু সময় দেয়া হয় প্রস্ততির জন্য। তাদের বেলায় এই প্রস্তুতির সময় অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল কারণ দূর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের কিবোর্ডে কি একটা NOISE বা HUMMING-এর সমস্যা দেখা দিল। কোনভাবেই সুরাহা করা যাচ্ছেনা। ডাক পড়ল জেসিসি’র কিবোর্ডিস্ট-এর (আমার আর কি!)। গেলাম, আমাদের কিবোর্ড সেট করলাম। তখন আবার আরেক জাতীয় ‘প্রাইড’ ফিল করছিলাম এই ভেবে যে, আমরা জেসিসিয়ানরা আরেকটা কলেজের সাহায্যে আসতে পেরেছি, আমাদের কলেজের ‘ইম্প্রেশন’ ভাল হয়ে গেল… ইত্যাদি — সে এক মহান মহান ভাব B-) !!

এবার শুরু হল আসল খেল। ওরা যেই বাজাতে যায়, সেই কানেকশন ছুটে যায়। আমি ২ বার গেলাম স্টেজে, তাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসলাম যে এভাবে বাজাতে হবে, এখানে এই সমস্যা। মিলল না। সে ভুল করেই যাচ্ছে। শেষমেষ আমি একটু ধৈর্যহারা হয়েই বললামঃ “লো অক্টেভে আসবা না, কি বোর্ড স্ট্যান্ড নড়াবা না, ঠিকমত বাজাবা; বুঝছ?” আমার সেই কিঞ্চিত রাগান্বিত অবস্থায় ও আমাকে বিষ্মিত করে দিয়ে হালকা ভয় মাখানো মিষ্টি গলায় বললঃ “জ্বি ভাইয়া!”… … … ভাইয়া??! ~x( ক্লাসমেট ভাইয়া ডাকলে বিষয়টা খুব একটা সুখকর হয়না (অন্তত আমার কাছে হয়নি), তার উপরে সে এমন একজন প্রতিভাবান শিল্পী, যার আমি অলরেডী ফ্যান হয়ে গেছি, যার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য মন উতলা হয়ে আছে!

তারপর অবশ্য ওদের সমস্যাটা সনাক্ত করা গিয়েছিল। তারাও সুন্দরভাবেই তাদের পারফরমেন্স শেষ করতে পেরেছিল। আমারই শুধু সেটা গ্যালারিতে বসে দেখা হয়নি, উইংস-এর পিছে দাঁড়িয়ে দেখেছি, ইন এনি কেস যদি কোন অসুবিধা আবার দেখা দেয়। কিন্তু সেখানেও চমক অপেক্ষা করছিল (অবশ্যই সেটা শুধু আমার জন্য), কারণ মাইলস-এর ‘পিয়াসী মন’ গানটার কিবোর্ড সে যা বাজালো – 😮 – মাইন্ডব্লোয়িং এক্যুরেসী!!!

আমার ইচ্ছাগুলি সবই পূরণ হয়েছেঃ তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব… যাকে বলে ‘জিগরি দোস্তি’ এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলী – মিউজিক্যাল বন্ডেজ। আর ঐ প্রতিভাবান শিল্পী কথাটা বললাম না? …আমি ওর বাসায় এসে ওর আর্ট-এর সেন্স দেখে আরো বেশি ‘কাইত’ হয়ে গেলাম। আঁকার কি মারাত্নক হাত তার! :salute: এখন আর মুগ্ধতা ফ্যান-এর পর্যায়ে নাই — এসি-টেসি ছাড়িয়ে সায়েন্স ফিকশন গল্পগুলির মত ‘ক্রায়োজনিক চেম্বার’ জাতীয় কিছু একটা হয়ে গেছে!!

আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমার এরকম মাল্টিট্যালেন্টেড একটা খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে।

ওহ্‌ হো…… ওর বাসায় বসে লিখছি আর ওর নামটাই বলতে ভুলে গেলাম 😛 … আমার এই সুপার কোয়ালিটি বন্ধুটির নাম আফরোজ (মগকক -১৯/১০১৫)।

৫,০৯৮ বার দেখা হয়েছে

৫৬ টি মন্তব্য : ““জ্বি ভাইয়া”: এক ক্যাডেট বন্ধুর গল্প”

  1. রকিব (০১-০৭)
    কথাটা এভাবে বললাম কারণ আমার মনে হয় ইতিমধ্যে পাঠকরা ঐ লাইনে অনেক কিছু চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছেন।

    ঠাকুর ঘরে কে রে :awesome: :awesome: , আমি কলা খাইনি ;;; ;;;

    গুরু আমি কিন্তু কিছু কই নাই...
    আপনার ভক্ত হয়েছিলাম পরী গানটা শুনে। আপনার আর আজাদ ভাইয়ের কলেজ পিকনিকে(আপনাদের লাষ্ট) গাওয়া গানটা শুনে পোলাপাইন অনেকদিন পর্যন্ত গুনগুনাইতো :guitar: :guitar: ।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    ভাইগনা,
    খুব সুন্দর স্মৃতিচারণ... :clap:
    তোমার গানের/বাজনার কোন ইউটিউব/ই-স্নিপস লিঙ্ক থাকলে শেয়ার কইরো তো...
    অফটপিকঃ আমার এমসিসি ব্যাচমেট নিসার(এখন আর্মিতে)গানবাজনা করতো, একটা অ্যালবামও বাইর করসিলো...বাই এনি চান্স, তুমি কি ওকে চিনো?


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. রাফি (০২-০৭)

    ভাই কেউ যে নিজের বন্ধুর কথা এত সুন্দর করে বলতে পারে এইটা আপ্নারে না দেখলে বুঝতাম না। খুবই সুন্দর একটা লেখা। আপনার এই লেখা পরার পর আমারও এই রকম অনেকের কথাই মনেয় পরে যায়!!! কিন্তু কি আর করা, একই প্রেক্ষাপট ও পটভুমি হওয়া সত্তেও আসল জনই অন্যরকম। আমি প্রথম তিন দাগ নিয়ে গেলেও শালার চোখ পরে যাইয়া তিন তারার উপর =((
    তবে পরবর্তিতে অনেক লিজ্জা পাইসিলিম। :shy:
    আখন কিন্তু অনেক ভাল হয়ে গেসি O:-) । প্লীজ কেউ আবার বান চাইয়েন না । মানুষটা আমি অতিব ভাল। :-B

    জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আফরোজকে আমি "আমাদের ব্যাচের লতা মুঙ্গেশকার" ডাকতাম।২০০১ আর ২০০২ দুইটা আইসিসিএলএমএম এ ওর গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।একবার ও বলেছিল যে অর আম্মা ওকে সারেগামা না কখগঘ আগে শিখিয়েছে তা ওর মনে নেই।আমি যে একবিন্দু বাড়িয়ে বলছিনা তা ওর গান শুনলে যে কেউই বলবেন।এমন প্রতিভাবান একজনশিল্পী আমার বন্ধু-এই গর্বেই আমার মাটিতে পা পড়েনা।আফরোজ, কেমন আছিস দোস্ত?

    অফ টপিক-আফরোজ ছিল ওদের লাল হাউসের হাউস প্রিফেক্ট।২০০২ আইসিসিএলএমএম করে এসে আমাদের লাল হাউসের হাউস প্রিফেক্ট এনামকে আমি "আফরোজ" বলে ডাকা শুরু করেছিলাম ওর সম্মানে।প্রথম প্রথম কিছু মনে না করলেও পরে একদিন ক্রসবেল্ট নিয়ে তাড়া করেছিল আমাকে... 🙁

    জবাব দিন
  5. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    আদনান !! তোমার স্মৃতিচারন ভাল লাগসে । আরো লিখো । গানের লিন্ক থাকলে দাও শুনে দেখি ।
    অ.ট. তুমি কি আর্বোভাইরাস এর সাথে পারফর্ম কর নাকি । (আহসান ভাইতো ওদের ব্যান্ড এই ছিল)

    জবাব দিন
  6. আইরিন জামান সুরভী (১৯৯৭-২০০৩)

    আমার এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে নিয়ে এত সুন্দর একটা লেখা দিয়েছে, পড়ে খুব ভাল লাগল। ইনটেক '৯৭ জিন্দাবাদ!
    গেয়ে যাও আফরোজ, তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ।
    লিখে যাও আদনান, তোমাকেই খুঁজছে সিসিবি!!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।