মস্তিষ্কে ক্যামিকাল ল্যিচ

বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। পাশে ফোন, সাইলেন্ট করা। বাতি জ্বলছে-নিভছে… ফোন আসছে। মানুষের চোখ ১৮০ ডিগ্রিতে না দেখলে হয়তো টের পেতাম না। কে ফোন করছে সেটা তুলে দেখতে ইচ্ছা করছে না, ভীষণ ক্লান্তি। অলসতায় পুরো শরীর চেপে ঠেসে আছে বিছানায়। তবু অনেক কষ্টে তুললাম – দেখি বাপ্পী ফোন করেছে। ধরার সাথে সাথে বলল: “ডুড্, কি করিস? কতক্ষণ ধরে ফোন করছি।”
“আমি ঘুমাই; মানে ঘুম থেকে উঠলাম আর কি।”
“ঘুমাচ্ছিস কেন এই সন্ধ্যার সময়? উঠ! আমার বাসায় আয়।”
“দোস্ত আমি আসতে পারব না। আমার একটু পর একটা পার্টি।”
“আয় না দোস্ত, অল্প কিছুক্ষণের জন্য আয়।”
“না দোস্ত সম্ভব না, সরি!”
“ধুর! যা শালা পার্টি খা গে!”
বিপ-বিপ-বিপ…… ফোনের স্ক্রিনটা আবার কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে উঠলো, অটো কি-লক দেবার কারণে লাইন কেটে যাবার সাথে সাথে কিপ্যাড লক হয়ে যায়। আমি পাশে নামিয়ে রাখলাম ফোনটা।

আমার বিছানার সামনেই দরজা। সন্ধ্যা বলতে আমরা যে বেগুনী নীল আকাশ বুঝে থাকি সেই ব্যাপারটি আর নেই। আকাশ অন্ধকার। তারা দেখা যাচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে হেলতে-দুলতে বেরুলাম। বাইরের লনে একটা সিড়ি মতন, ওটা দিয়ে সামনের রাস্তায় নেমে পড়া যায়। সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বসে পড়লাম, ভীষন ক্লান্ত লাগছে। সিড়ির ওপরে বসে বিরাট দুটি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। একটু পর বায়ে চোখের ১৮০ ডিগ্রি কোণে আবার কারো নড়াচড়া টের পেলাম।

আলী ভাই জিলাপী আর কেক নিয়ে এসেছেন। জিলাপীগুলি দেখতে খুব লোভনীয়, ওপরে সাদা পাউডারের মত কিছু একটা দেওয়া যেটা জিলাপী হাতে ধরলে যে আঠালো ভাবটা হয় সেটা কমিয়ে দেয় অনেক। আর খেতেও ভারি মজা। আমি জিলাপীটা এক কামড় খেয়ে হাতে ধরে বসে আছি। বেশি মজার জিনিস পরে খেতে হয়। কেকটা খুলে নিলাম। কেকের ভিতরে ‘আলী’ লেখা। বললাম: “ভাই আপনি বানাইছেন নাকি”? উনি তার চশমার ফাঁক দিয়ে একটু তাকিয়ে একগাল হাসি দিল। আমি বললাম: “জোস হইসে ভাই। এমনেই ক্ষিধা লাগছিল, এত মজার জিনিস বানাইছেন, মন চাইতেসে পুরা খায়া ফেলি।”
“বসে বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম ডিফারেন্ট কিছু করি।”
“অনেক জোস ভাই অনেক জোস!”
“আরো আছে তবে এখন দেওয়া যাবে না।”
“কেন কেন? নিয়া আসেন…. কি সমস্যা?”
“আরে অন্য আরো মানুষ আছে তো, তারা খাবে না?”
“অন্য কে? কাউকে তো দেখিনা। ভাল কথা! কাউকে দেখিনা কেন? সবাই কই?”
“অডিটোরিয়ামে।”
“মানে? অডিটোরিয়ামে কি করে? আজ কি বিষ্যুদবার?”
“না বিষ্যুদবার না। আজ ইন্টার ক্যাডেট কলেজ রেসলিং কম্পিটিশন।”
“কন কি? এইটা কবে থেকে হইল?”
“ইয়াপ! একদিনের ইভেন্ট। নতুন চালু হইসে। তোমাদের সাকিব-ও তো খেলতেছে।”
“সে কি? আমি কিছু জানিনা কেন?”
“কারণ তুমি ঘুমাচ্ছিলা। সবাই ওখানে গেছে রেসলিং দেখতে।”
“ভাই, এখনো পরিষ্কার না – আমরা তো এক্স-ক্যাডেট, তাইলে আমাদের সাকিব খেলছে কিভাবে?”
“এটার পলিসি অন্যরকম করছে। গেলে দেখতে পারতা। অবশ্য এখনো দেখতে পারো। একাডেমিক ব্লকের বাইরে বিশাল এলসিডি টিভি লাগাইসে ওখানে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে।”
“চলেন চলেন।”
“যাব। তার আগে আরেকটা মজার জিনিস খেয়ে যাও।”

উনি আমাকে একটু বসিয়ে রেখে হাউজ অফিসের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলেন। আমার ততক্ষণে ঘুমের ঘোর কেটে গিয়েছে। সামনে যে ডাইনিং হলের রাস্তাটা সেখানে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। অনেক দূর থেকে হঠাৎ হঠাৎ ঊল্লাসধ্বনি ভেসে আসছে। বুঝলাম রেসলিং কম্পিটিশন জম্পেশ হচ্ছে। ঐপাশে একাডেমিক ব্লক আর মাঠ যেখানে একত্রিত সেখানে আলোর খেলা অবলোকন করলাম – ঐটাই হবে সেই নতুন লাগানো এলসিডি স্ক্রিন। “ওকে… এই নাও।” আলী ভাই আরো একটা ঠোঙ্গায় কি যেন পেচিয়ে নিয়ে হাজির। তাকিয়ে দেখি রোস্ট। মনে হচ্ছে আস্ত কোনো প্রাণী রোস্ট করে ফেলা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: “কি এটা ভাই? কিসের রোস্ট?”
“হাতির বাচ্চা। ডায়নিং হল থেকে চুরি করে এনেছি।”
“সেকি? হাতির বাচ্চা? হাতির বাচ্চা কি এত ছোট হয় নাকি? কোয়েল পাখি সাইজের জিনিস মনে হচ্ছে।”
“হুমম। এটা স্পেশাল হাতির বাচ্চা। একেবারে পিচ্চি। খেয়ে দেখো খুব টেস্ট।”
আমি অবাক বিষ্ময়ে হাতির বাচ্চা খেতে খেতে একাডেমিক ব্লকের দিকে হাটতে লাগলাম।

হাতের রোস্ট অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় পোড়পোড়া ফ্রাই হয়ে গিয়েছে। বসে বসে সেই হাতির বাচ্চা ফ্রাই আমি এখনো খেয়ে যাচ্ছি। বাপরে! এত ছোট একটা জিনিসে এত পরিমানে মাংস কোথা থেকে? আমার মনে হচ্ছে আমি এই জীবনে এটা খেয়ে শেষ করতে পারব না। মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে রেসলিং দেখতে দেখতে স্ক্রিন থেকে হঠাৎ একটা সবুজ রঙের আগুন বেরিয়ে এসে আমার উপরের জ্যাকেটখানা পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই সাথে হাতে ধরে থাকা এই রোস্টও।

রেসলিং-এ বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজ অংশ নিয়েছে। মেয়েরাও বাদ যায়নি। তবে তারা শারীরিক ক্ষমতায় যেহেতু ছেলেদের থেকে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে, তাই তাদের ম্যাজিক ব্যবহার করার অনুমতি আছে। আমাদের সাকিব খেলোয়াড় নয়, কোচ। জিনিসটা রেসলিং হলেও বিভিন্ন উয়েপন্ ব্যবহার করার অনুমতি আছে। সব মিলিয়ে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়! ক্যাডেট কলেজে রেসলিং, সেখানে ম্যাজিক, আবার অস্ত্র, বিশালদেহী রেসলার ক্যাডেট… ১৭/১৮ বছর বয়সে তো অমন দেহ হবার কথা না। কি খায়? হাতির বাচ্চা??

গার্লস-এর মেয়েরা প্রাচীনকালের ম্যাজিশিয়ানদের মত আলখেল্লায় ঢেকে চলে এসেছে, স্ট্রোবলাইটের ঝলকানিতে শুধু নাক থেকে নীচের চিবুক পর্যন্ত দেখা যায়, চোখ ছায়ার আড়ালে। শক্তি আর ম্যাজিকের এক অভূতপূর্ব লড়াই, দর্শকদের কাছে নিঃসন্দেহে খুব মজাদার। তবে দু’একবার ম্যাজিক লিক করে বাইরে চলে আসে। সেরকমের একটাই বোধ হয় ক্যামেরা থ্রু করে স্ক্রিন দিয়ে বের হয়ে আমার রোস্টের এমন অবস্থা করেছিল।

কলেজে এত কিছু এত রকম পরিবর্তন হয়ে গেল, আর আমি কিছুই টের পেলাম না? এমন কি ঘুম-টা ঘুমালাম আমি???

(উপরে বর্ণিত সকল কিছু আমার স্বপ্নদৃশ্য ছাড়া আর কিছু নয়। আমি প্রায়ই ক্যাডেট কলেজ নিয়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখি যার বাস্তবতার সাথে কোনো ছোঁয়া থাকেনা, কিন্তু কলেজের প্রেক্ষাপট একমাত্র অপরিবর্তিত থাকে। দুপুরে ঘুমিয়ে এই সন্ধ্যা ৭টার দিকে উঠলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসব আগডুম-বাগডুম দেখেছি। ভাবলাম শেয়ার করি। 😛 )

১,০৯১ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “মস্তিষ্কে ক্যামিকাল ল্যিচ”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    ইন্টেরেস্টিং ......
    আমি একবার দেখেছিলাম ক্যাডেট কলেজে আবার লেখাপড়া শুরু করেছি| তবে হাউজের রুমে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি| ডিটেইল উদ্ধার করার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল ... 🙁 🙁

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ক্যাডেট কলেজ নিয়ে আমিও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। প্রায়ই আমাদের জহির ওস্তাদকে দেখি। তার গোফ একপাশে কাটা আরেকপাশে আছে। আর সেটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেই আগের মত খ্যাক খ্যাক করে উঠে বলেন, 'শালার "নমুনা" বানাইছে.......'

    জবাব দিন
  3. হুমায়রা(২০০২-২০০৮)

    মেয়েদের রেস্লিং টা স্বপ্নেও ইন্টারেস্টিং করতে পার লি না?
    হি হি হি হি 😀 😀 😀

    আমি নিজেও অন্তত সপ্তাহে একবার হলেও ক্যাডেট কলেজের স্বপ্ন দেখি 🙂 🙂 🙂

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।