চৌত্রিশের প্রথম আনুষ্ঠানিক জামাই-কেচ্ছা

মাসখানেক আগে আমার সাবেক রুমমেট আমাকে একদিন ফোন করে বলে: বন্ধু, ঈদের তৃতীয় দিন আমার বিয়ে। চলে আসিস। আমি তো বলা যায় আকাশ থেকেই পড়লাম। সাধারণত বিয়ের মাসতিনেক আগে থেকে বেশ কানাঘুষা শোনা যায়, এর বেলায় সেগুলির কোনো বালাই নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম: কে রে? সেই জন যাকে দেখেছিলুম? উত্তর পেয়ে আশ্বস্ত হলাম।

আফটার অল, আমাদের প্রথম কারোর এরকম ঘটা করে বিবাহ, তাই আমি নিজেকে কোনোভাবেই চুপ রাখলাম না। রাষ্ট্র করে দিলাম – Ali is getting married, guys! রোজার মধ্যে তার সাথে একবার দেখা-ও হল, তাকে বললাম আমি কিন্তু চারিদিকে গেয়ে বেড়াচ্ছি। ও বলল “সমস্যা নাই দোস্ত, তুই যতজনকে পারিস বলে রাখ।” ক্যাডেট কলেজের বন্ধুর প্রতি এমন উদার না হলে কি চলে?

ঈদের অনেক আগে থেকেই কথা বলে রেখেছিলাম, আমার বাসায় প্রায় পাঁচজনের থাকার ব্যবস্থা হবে। ধীরে ধীরে সেটা কমতে কমতে ২ জনে এসে ঠেকল। কারো চাকরি, কারো পরীক্ষা ইত্যাদি নানান কারণে আসতে পারল না অনেকে। (মাশরুফ তোকে কত করে বললাম; এখন তো গাইলাইতে মন চায়) … তবে শেষমেষ লোকবল যে খুব কম তা-ও না, অন্যান্যদের বাসায়-ও ছেলেপেলে ছিল। তারা সবাই সহ ঈদের তৃতীয় দিন অর্থাৎ বিয়ের দিন একত্রিত হতে পারলাম। আমার বাসায় যাদের থাকার কথা ছিল সাকিব ও হাফিজ, তারা ঐ দিন ভোরবেলা এসে পৌঁছিয়েছে।

I am ready
His triumphant arrival
Stepping out of the car

দুপুরের মধ্যে আমরা কয়েকজন ইসলামের বাসায় meet করলাম। সেখানে কিছুক্ষণ chill করলাম। আরো কয়েকজনকে ডাকাডাকি, কম্পিউটারে গান শোনা ইত্যাদি হাবিজাবি করতে করতে দেখি দুপুর ২ টা পার হয়ে গেছে। ২ টা ছিল রিপোর্টিং টাইম, আমরা খুলনার বাসিন্দারা সামান্য দেরি করে ফেলেছিলাম ভেন্যুতে যেতে। মক্কার লোক হজ্জ্ব পায়না – একটা কথা আছে না? অনেকটা ওরকম। এই গাফিলতির কারণে গেইট ধরা জাতীয় বিষয়টাতে আমরা ডিফেন্স করতে পারিনি ভেবে কিঞ্চিত দুঃখিত ছিলাম, পরে শুনি গেইট ধরা ব্যাপারটা-ই নাকি ছিল না। 😛

Happy Ali
Friends together
Bless him!
the Lap is free for only a few hours

আলীর সাথে দেখা হল রয়েল হোটেলের তিন তলায় কম্যুনিটি সেন্টারে গিয়ে; দেখি জামাইবাবু বসে আছেন হাসি হাসি মুখ নিয়ে। গেস্টরা তখনো বেশি একটা আসেনি (মনে হয় আমাদের চেয়েও লেট করা পাবলিক আছেন)। আমরা যথারীতি যেসব ক্যাডেটীয় জোকস ইত্যাদি করা শুরু করলাম, আমাদের ভাষায় বললে ‘গ্যাড়ানো’ শুরু করলাম সবাই মিলে। অল্পবিস্তর ফটোসেশন হল। কিছুক্ষণ পর দেখি কাজী এলেন, বললেন “মেয়ে কবুল বলেছে, আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি।” এরপর আলীর বিয়ে পড়ানো হল। ঐ মুহুর্তে আলীর হাসি হাসি মুখটা সিরিয়াস হয়ে গেল।

Formal ritual

বিয়ে পড়ানোর প্রসিজার শুরু হবার কিছু পরে হঠাৎ ওটা pause হয়ে গেল, কারণ ছেলের অভিভাবক অনুপস্থিত – নামাজে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এলে আবার দোয়া-টোয়া পড়ে শুরু হল ফর্মালিটি। সবার শেষে মোনাজাত। কিন্তু চারিদিকে মানুষজনের হৈচৈ-এর ঠেলায় মোনাজাতের ভাষা কিছুই বোঝা গেল না। যা হোক আমরা মোনাজাত কোনোমতে শেষ করলাম। উল্লেখ্য – মোনাজাত ওভাবে করিনি বলে যে আমাদের বন্ধুটির জন্য দোয়া করিনি তা কিন্তু না। তার জন্য শুভকামনা বুকের মাঝে তো ছিলই (থাকবেই)।

Eid Mubarak; 7 years... pretty long time mate!
Rejoice! Ali is officially married now.
Sister-in-laws

এর মাঝে আমরা আরো কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম যাদের আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমনটি-ই ধরে নিয়েছিলাম। ঈদ আর আলীর বিয়ে সম্পন্ন হবার আনন্দ একসাথে পাবার মধ্যে ভাললাগার ব্যাপারটা যেন আরো গতি পেল। ক্যামেরা ক্লিক হতে থাকল। সবাই এবার একজন আরেকজনকে তার পোষাকের চাকচিক্য ইত্যাদি নিয়ে একচোট ‘পচিয়ে’ নিলাম। আলীর সাথে ছবি তোলা শেষ করে মামুন এবার গেল অমি’র ঘরে (বউ এর ডাক নাম অমি, আলীর ভার্সিটি’র ব্যাচমেট), তার প্রফেশনাল SONY DSLR-A500 ক্যামেরায় আরো কিছু ‘তথ্য’ সংরক্ষণ করতে।

waiting to be served
the grand dish
happy hunger

এরপর আসল খাওয়াদাওয়ার পালা। আমরা প্রায় জোর করেই আলীর সাথে বসে গেলাম। জামাই-এর টেবিলে বসার একটা মজা আছে, সেটা হল – জামাই-এর বিশাল থালার বিশাল বিশাল মাংস-গোশতের ভাগ পাওয়া যায়। আস্ত মুরগি আগে কোনোদিন পাতে নিয়ে খাইনি, ঐদিন খেলাম। তবে আস্ত একটা তো আর খেতে পারিনি, আশেপাশে ভাগ দিয়েছি। ভাগ না দিলে নষ্ট করা লাগত। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম মুরগি, খাসি, মাছ, পোলাও। খাওয়া শুরুর সময় আলীর হাতের ঐ ফুল-টাইপ-জরি-টাইপ কি জানি একটা লাগায় না, ওটা খুব যন্ত্রনা দিচ্ছিল; ওটা খুলতে গিয়েও বেশ বিপাকে পড়া লেগেছে। এমন গিট্টু!

Really hungry!
the last touch before stepping out

খাওয়াদাওয়া শেষে লাগলো বিপত্তি। শ্যালিকাগণ এসে হাজির। তারা হাত ধোয়াবেন, টাকার বিনিময়ে। টাকা নিয়ে কত কাহিনী…. আলীর পকেটে কিছু নেই (যেমনটি সে তখন বলছিল), শ্যালিকা রা তখন পকেট হাতিয়ে দেখতে চায়। আমরা হা-হা করে প্রতিবাদ করে উঠি – আলী এখন বিবাহিত পুরুষ তার গায়ে হাত দিয়ে, আরো ভাল করে যদি বলি তাহলে ‘থাই’-এ হাত দিয়ে এরকম অসামাজিকতা ঘোরতর অন্যায়। পরে আমাদের একজন ক্রেডিট কার্ড বের করে দিল, তাতেও তাদের মন ভরেনা। আমাদের ব্যারিস্টার সাহেব ইসলাম বাবাজী তার বিদেশী কার্ডখানা তখন দিয়ে দিল, তা-ও তারা খুশি না। তাদের দরকার ক্যাশ। আমরা তো তখন মোটামুটি ঐ শ্যালিকাদের “backdated… এই অনলাইনের যুগে মুঘলযুগীয় চিন্তাভাবনা… ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হোন…” ইত্যাদি বলে ধুয়ে দিলাম। যাই হোক শেষমেষ একখানা টাকাসমেত খামে রক্ষা হল। খাবার টেবিলে ঝগড়া করতে করতে আমাদের হাত শুকিয়ে গিয়েছিল, ধুতে গিয়ে জান শেষ!!

Passion for death
Tea & Cigar
same shoes

একটা মোটামুটি লম্বা চা-সিগারেট ব্রেক-এর পর আবার গেলাম উপরে। মালাবদলের পালা চলে এলো। খুব ভাল লাগল এই জুটিকে দেখে – খুশি খুশি হাসি হাসি দেখলেই মন ভরে যায়। কত অনুষ্ঠানেই তো যাই, কিন্তু বিয়ের সময় বর ও কনে দুজন-ই কেমন একটা সিরিয়াস সিরিয়াস চেহারা করে থাকে। ভাল লাগে নাকি ও? আলী কত ভাল ছেলে, তার মিষ্টি হাসিখানা দিয়ে আসর উজ্জ্বল করে রেখেছে। আমার কাছে অন্ততঃ কনের চেয়ে বরের হাসিটাই বেশি আকর্ষনীয় লাগল। সবাইকে ‘অন্য কিছু’ না ভাবতে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

মালা বদল ১
মালা বদল ২
Dhishum!!!
Juice never tasted better before!

বিয়ের পর ছেলের বাড়ি যাত্রা। আলীকে আবার ধন্যবাদ দিতে হয় – আমাদের প্রায় ১১ জনের জন্য সে একটা মাইক্রো স্ট্যান্ডবাই রেখেছিল তার নিজের উদ্যোগেই। খুব-ই উপকার হয়েছে ওটা থাকার কারণে। সন্ধ্যার দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সারা রাস্তা দারুণ মজা করতে করতে যশোর গেলাম। আলীর বাসায় গিয়ে সোজা তার বাসর ঘরে হানা দিলাম সবাই। দেখি জামাই-বউ আমাদের স্বাগত করার জন্যই যেন বসে আছে। সবাই একে একে ছবি তুললাম তাদের সাথে। এর মাঝে একটা ‘ইম্পর্ট্যান্ট’ কাজ করে নিলাম – আলীকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে একটা গিফট দিলাম। জিনিসটি যেকোনো নব্যবিবাহিতদের জন্য একটি জরুরী জিনিস হিসেবে বিবেচ্য (থাক্, আর বেশি ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নাই, এখানে সবাই বুদ্ধিমান)!!! 😀 … এতকিছুর পর আমাদের বেশ কজন আবার তাদের কীর্তিকলাপে শিগগির বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় এমন বাসনাও আচরণগতভাবে প্রকাশ করল।

বাসর ঘর
Saqib & me
মিষ্টিমুখ
A very special gift
বড় সাধ জাগে!!!

ঐদিন সারারাত আড্ডা হল। অনেক মজা হল মামুনের বাসায়। আড্ডার মাঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আলীকে ফোন করে জ্বালাবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আলীকে ফোন করতে লাগল সবাই। আলী প্রতিবার-ই বলে “দোস্ত, একটু বিজি আছি, পরে ফোন দে…. দোস্ত আমি তোকে পরে কল দিচ্ছি” ইত্যাদি। আমরা তো হেসেই কূলহারা! আমাদের ‘ঐ জিনিসটা’র ইস্তেমাল করা শুরু হল কিনা সেটা নিয়ে বেশ ফুসুরফাসুর শুরু হল মধ্যরাতে। পরে বেচারাকে ক্ষমা করে দিলাম। প্রথম রাতটা বানচাল করা ঠিক না, অলুক্ষুণে ব্যাপার (!) হতে পারে আর কি!! …

we are...
reception
... if you want it!

যাই হোক পরদিন রিসেপশন পার্টি। এদিন আর কারোর লেট হয়নি। সবাই সময়মত উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু সেদিন আলীর সাথে বিশেষ সময় কাটাতে পারিনি কারণ সে অতিথি আপ্যায়নে মহাব্যস্ত ছিল। খাওয়াদাওয়ার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা বিদায় নিয়েছি। অনেকের ছুটি শেষ, রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা আবশ্যক হয়ে গিয়েছিল।

I am clean again!

বিদায়ের দিন আমার এক মাসের সাধনার জিনিসটাকেও বিদায় দিতে হয়েছে 🙁

২,৮৯২ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “চৌত্রিশের প্রথম আনুষ্ঠানিক জামাই-কেচ্ছা”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ইয়ে আদু, তোর একমাসের সাধনার জিনিস বলতে আমি ভাবছিলাম তুই "ঐ" জিনিসটা একমাস ধইরা ক্যারি করছস,পরে তোর ফকফকা খোমা দেইখা আশ্বস্ত হইলাম যে নাহ,কাহিনী ভিন্ন ;;;

    জবাব দিন
  2. আন্দালিব (৯৬-০২)

    আলীর জন্যে অনেক শুভকামনা! ফেইসবুকে ওর হাসিমুখ আর পাশে বসা বউয়ের হাসিমুখ দেখে মন ভরে গেছে। সুখে থাকুক দুইজনেই।

    পোস্ট মজারু হয়েছে। আমাদের ব্যাচের প্রথম বড়ো বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো তোমার লকার পার্টনারের। সেই বিয়েতেও আমরা বেশ বড়োসড়ো "গিফট" দিয়েছিলাম। সব ক্যাডেট মনে হয় একই ধরনের, ব্যাচ বদলালেও রিচুয়াল বদলায় না! ;;;

    গোঁফটা ভালোই ছিলো। না ফেললেই পারতা! 🙂

    জবাব দিন
  3. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    পোষ্ট খুবই মজার ছিল, কিন্তু কিছু বিষয়ে না বলেই পারছি না,
    ১) বিয়েতে বন্ধুরা ত আরও উলটা কাজে কর্মে সাহায্য করে, তোমরা তো দেখছি পুরাই গেষ্ট সেজে গিয়েছিলে...পচা পচা বন্ধুর দল :thumbdown:
    ২)

    আমার কাছে অন্ততঃ কনের চেয়ে বরের হাসিটাই বেশি আকর্ষনীয় লাগল। সবাইকে ‘অন্য কিছু’ না ভাবতে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি

    কি ভাব্ব?? ;)) ;)) তোমার কেন মনে হল "অন্য কিছু" মনে হতে পারে??? চোরের মন পুলিশ পুলিশ ;;;
    ৩)

    খাবার টেবিলে ঝগড়া করতে করতে আমাদের হাত শুকিয়ে গিয়েছিল, ধুতে গিয়ে জান শেষ!!

    এখানে ঝগড়া শব্দটির আগে "মধুর" কথাটি যোগ করলে আরো বেশ শোনাত। (বাই দ্যা ওয়ে, সেই সব ঝগড়া সঙ্গীদের মধ্যে কাউকে আবার...... 😉 )


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।