অর্ধচন্দ্র (গলাধাক্কা নহে)

বাংলাদেশে নূতন একখানা কথা দারুণ চলিতেছে আজকাল – ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ইহার প্রচলন লক্ষ্যনীয়। উদাহরণস্বরূপঃ আমরা যাহাকে ডেলাইট সেভিং টাইম বলিয়া আখ্যা দেই, তাহা কিন্তু অল্পশিক্ষিত জনগণের নিকট ‘ডিজিটাল টাইম’ নামেই অধিক পরিচিত।

যাহাই হৌক, ভাবিতে ভালই লাগে, গর্ববোধ হয়, আমরা এখন যুগের সাথে মার্চ করিতে পারিতেছি। কারো কারো হয়তো ইহাও মনে হইতে পারেঃ “ধুর, আমেরিকা-টামেরিকা’র বেল আছে? বাংলাদেশ ও এখন ডিজিটাল যুগে আয়া পরসে। এক্কেরে নামায়া দিমু না??” ভাল, এই জাতীয় আত্মবিশ্বাস বহন করা শাবাসি পাইবার যোগ্য বটে। তবে ইহাও খেয়াল রাখা দরকার যে, আমরা আমাদিগের এই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রজেক্ট সফল করিবার পেছনে কতখানি প্রজ্ঞার নজির রাখিতেছি।

এই বিষয়ে বিরাটাকার গল্প ফাঁদা যাইতে পারে, তবে আমি ভিন্ন আলোচনায় না যাইয়া বরং আসন্ন রোযার দিনক্ষণ সম্পর্কে কিছু বয়ান করিব।

রোযার মাস নিকটস্থ হইলে আমাদিগের একটি খুব প্রচলিত custom হইল চাঁদ দেখিবার উদ্দেশ্যে বাড়ির ছাদ, উঠান অথবা এহেন যেকোন বহির্মুখি গমন। আজকাল সরকারি উদ্যোগে আকাশযান সহকারে মেঘের উপরিভাগ হইতে চাঁদ দেখার project লওয়া হইয়া থাকে। নিঃসন্দেহে খুবই আধুনিক চিন্তা; কারণ আসমানে মেঘের ঘনঘটা হইলে তো চাঁদ দেখিতে গিয়া বিমর্ষবদনে পুনরায় ফিরিয়া আসিতে হইবে ঘরে। কেউ কেউ অবশ্য উৎফুল্ল হইতে পারেন, “বৃষ্টি হইবে” ইহা ভাবিয়া। বাংলাদেশের মানুষ বড়ই প্রেমাক্রান্ত, বৃষ্টির আভাস তাহাদের প্রেমময় মনে সুখের বর্ষণ ঘটাইতে কোনোই বিলম্ব করেনা। তাই সরকারের এই ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ে চাঁদ দেখার এবং আমাদিগের প্রেমবিলাসি মনকে রোযা ও ঈদের প্রতি মনোযোগী করিবার প্রয়াসটিকে বাহবা না দিয়া পারা যায়না।

এইবার খানিক দেশের বাহিরে দৃষ্টিপাত করি, যেখানে অন্ততঃ এই অধমের জানা মতে বিজ্ঞান চর্চা আরো অধিকতর হইয়া থাকে। এবং আমার একান্ত ধারণা এই যে, আমার ধারণা মিথ্যা নহে। কিছু প্রাসঙ্গিক প্রমাণ দিলেই ব্যাপারটি গোচর হইবে। মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কথাই ধরি – এখন আমাদিগের আর পাইরেটস অব দি ক্যারাবিয়ানের ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো’র সেই লম্বা চোঙ্গামতন দূরবীক্ষণ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়না, কারণ আমরা অধিকতর sophesticated equipments ব্যবহারের জ্ঞান রাখি। তাহারা পৃথিবীতে নয়, মহাশুন্যে গিয়া অবস্থান করিয়া দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে আমাদের সহায়ক। কৃত্রিম উপগ্রহের সাথে ইহাদিগের সম্পৃক্ত করিয়া ঊর্ধ্বালোকে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়া থাকে। আজকালকার অতি আধুনিক কম্পিউটার তাহাদিগের নিয়ন্ত্রক হিসাবে কর্তব্যরত, মানুষের কষ্ট করিবার দিন আর নাই।

এই সব কম্পিউটার, স্যাটেলাইট, টেলিস্কোপ, ইলেকট্রনিক কম্যুনিকেশন এবং যত রকমারি যন্ত্রপাতি, এ যে আমাদের জীবনকে সহজ করিয়া দিয়াছে তাহার প্রমান আমার এই ব্লগ। আমার ইহা হাতেও লিখিতে হইতেছে না, আবার পড়ানোর জন্য কাউকে ইহা যেখানে লেখা হইতেছে তাহার নিকটেও অবস্থান করার প্রয়োজন হইতেছে না। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বসিয়া একটি প্রজ্জ্বলিত চৌকো বস্তুর দিক তাকাইয়া হাতের দশটি আঙ্গুল নাড়াচাড়া করিতেছি আর লেখা হইতেছে। যাহারা পড়িতেছেন তাহাদিগেরও কোনো খাটুনি নাই, শুধু ‘মাউস’ নামক জিনিসটি কয়েকটিবার নাড়াচাড়া করিয়া নির্দিষ্ট জায়গাসমূহে click করিয়া দিলেই হইল, তিনি পৃথিবীর যে দেশেই থাকেন না কেন।

আশা করি আপনারা মাউস/কিবোর্ড নাড়িতেছেন আর আমার এই লেখা পড়িতেছেন। তো, যেইখানে ছিলাম — আমরা এই সব Technology -এর আশীর্বাদ লইয়া জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন করিতেছি। অনেক নূতন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতেছি। দিনকতক আগে মহাকাশ বিশারদগণের তথ্যের উপরে ভিত্তি করিয়া ভোর বেলায় বাংলাদেশের বহু মানুষ মাঠে-ঘাটে নামিয়া গিয়াছিল ‘পূর্ণ সূর্যগ্রহন’ দেখিবার অভিপ্রায়ে। আমরা সফলভাবে তাহা অবলোকন করিয়াছি এবং [নিশ্চয়ই] আনন্দিত হইয়াছি। যাহারা ঐ সময়ে বাহির হইয়া এই বিরল দৃশ্য স্বচক্ষে দেখিতে পারেন নাই তাহারা ইন্টারনেটে ছবিসম্বলিত প্রতিবেদন পাইয়াছেন। কোনোদিকেই কমতি নাই। সুতরাং কিছুক্ষণ আগে আমি বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারনা অবলম্বনের যে একটু ফিরিস্তি দিয়াছিলাম তাহা মিথ্যা বা কল্পনা নহে। আমরা আসলেই Digital হইয়া যাইতেছি অন্য সব উন্নত দেশের মত। কি মজা কি মজা!!!

কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, অন্য সকল বিষয়ে আমরা বিজ্ঞানকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করিলেও ধর্মীয় বিষয়াদিতে এর প্রতিফলন ঘটাইতে নারাজ। যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট এই ক্ষেত্রটিতে বিজ্ঞানের ব্যবহারকে আমরা ঠিক কোন্‌ কারণে উপেক্ষা করিয়া তাহাকে মোল্লা-মৌলবীদের যথেচ্ছ অপব্যবহারের উপকরণ বানাইয়া রাখিতে চাহি তাহা সম্পর্কে বোধ করি আমরা নিজেরাও জ্ঞাত নই।

আমি ক্ষমা চাহিতেছি, মূল প্রসঙ্গে আসিবার পূর্বে বিশালাকার ভূমিকা দিবার জন্য। বিষয় হইল এই যে, আমরা বিজ্ঞানের ব্যবহার করিয়া এত কিছু করিতেছি, বিজ্ঞানের যাদু কাজে লাগাইয়া আবহাওয়া ও জলবায়ুর খোঁজ লইতেছি, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ ইত্যাদি পর্যালোচনা করিতেছি; বিজ্ঞান যখন এত কিছু অসাধ্যসাধন করিতে পারে, সেথায় সামান্য চাঁদ দেখা তো অতিশয় সহজ ব্যাপার হইবার কথা। এবং তাহাই সত্য। মহাকাশ গবেষনার একটি অংশের মধ্যে চন্দ্রের পৃথিবীপৃষ্ঠ হইতে দৃষ্টিগোচর হইবার ব্যাপারটিও একখানা বিষয় বটে।

আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে উনারা যাহা বলেন তাহা হইল এই যে, চাঁদ দেখা যাইবার ভিত্তিতে পৃথিবী কয়েকটি zone-এ বিভক্ত। এইসব এলাকা ভেদে চাঁদ দেখা যাইবার ব্যাপারটি ভিন্ন ভিন্ন হইতে পারে। কখনো কখনো এমনটিও হইতে পারে (বিশেষজ্ঞমতে) যে পৃথিবীর কোন এলাকা থেকেই চন্দ্রমাসের প্রথম চাঁদ দৃশ্যমান হইবে না। মনুষ্যবসবাসকারি এলাকাগুলোতে চাঁদ মাসের ২য়, ৩য় এমনকি ৪র্থ দিনেও দৃষ্টিগোচর হইতে পারে, তবে তাহা বড়/পুরু চাঁদ হইবে। ঘটনা এমনতর হওয়া অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু প্রকৃত দৃশ্য এমনই, বিজ্ঞানের এই অবদান উপভোগ করিবার সাধ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা মোল্লাগোষ্ঠি’র চাঁদ ‘দেখা’র উপরে ভরসা করিয়া বসিয়া আছি, রোযার মাসে কখনো [দূর্ভাগ্যজনকভাবে] চাঁদ দেখা Zone-এর ভেতর না পড়িয়াও উড়োজাহাজযোগে উড্ডয়ন করিয়া চাঁদের খোঁজে মূল্যবান Fuel ধ্বংস করিতেছি, যেখানে অন্য সকল বিষয়ে বিজ্ঞানের মতামতকে আমরা সাদরে এবং বিশ্বাসের সহিত আমন্ত্রণ জানাইতেছি — এমন হইলে ইহা আমাদের ঠিক কোন বস্তুটির অভাব বলিয়া প্রতীয়মান হইবে তাহা আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরা পড়িতেছে না।

বিজ্ঞানের যুগে বসিয়াও যদি আমরা চন্দ্রমাস-নিয়ন্ত্রিত রোযা ও ঈদের সঠিক সময় নির্ধারণ করিতে না পারি, অক্ষিগোলক বাহির করিয়া আকাশপানে চাহিয়াই থাকি কখন সেই বাঁকা চাঁদ দেখা যাইবে সেই আশায়, তবে সৃষ্টিকর্তার সেই আদেশ “তোমরা শবে কদর খুঁজিয়া লও”-ও পালন করা হইবে না যেহেতু আমাদিগের সময় নীর্ণয় সঠিক হয়নাই, ফলতঃ সেই মহান রাতের ফজিলত হইতে বঞ্চিত হইব, আর যেই দিনে রোযা রাখা নিষিদ্ধ করা হইয়াছে সেই ঈদের দিনেও দিব্যি রোযা রাখিয়া ঘুরিয়া বেড়াইব এবং আত্মবিশ্বাসের সহিত মনে করিতে থাকিবঃ “আহ্‌! কত ঈমানদার হয়্যে গেইলাম; এক মাস রোযা রাইখল্যাম। আইজ ঈদ। আল্লাহ, আমার রোযা কবুল করেন, ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ করেন।” আপনি যেরকম তাহার আদেশ-নির্দেশ পালনে গাফিলতি ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তিনিও আপনার ইচ্ছা পূরণে কার্পন্য দেখানোর পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। ঈদের আনন্দ হয়ত পরিপূর্ণ করিবেন, তবে রোযা ও তাহার Merits কতখানি আমলে নিবেন সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকিয়াই যায়।

আমার জ্ঞান অতি সীমিত; তিনিই মহাজ্ঞানী, তিনি ভাল বুঝিবেন কি হইবে। তবে মানুষ হিসেবে, যেহেতু তিনি আমাদিগকে সম্মান দিয়াছেন তাঁহার ‘শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ আখ্যায়িত করিয়া, তাই অন্ততঃ একটি ক্ষুদ্র প্রতিদানস্বরূপ (যদি ধৃষ্টতা না হইয়া থাকে) এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্কের সামান্য যদি আমরা ব্যবহার করতঃ বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানকে তাঁহার নির্দেশনাসমূহের সঠিক প্রয়োগে কাজে লাগাই, আমার মনে হয় তাহাই হইবে আমাদিগের পক্ষে মঙ্গলজনক। আর জাতিগতভাবে বলিতে যদি যাই ~ ডিজিটাল বাংলাদেশ বলিয়া একখানা কথা শুরুতে যে বলিয়াছিলাম, তাহা যথাযথভাবেই ফলিত হইবে।

১,৭০৭ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “অর্ধচন্দ্র (গলাধাক্কা নহে)”

  1. কি যে বললেন বুঝলাম না পুরাপুরি...... 🙁

    যতটুকু বুঝলাম, আপনি "মোল্লা"দের উপর খুব বিরক্ত।
    আমার তো মনে হয়,সিস্টেমে সেইরকম বড় সমস্যা নাই.... ডিজিটাল-এনালগ এইগুলা এতটা বড় ফ্যাক্টর না...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আদনান (১৯৯৪-২০০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।