কর্ণের কথা (মিথলজি)

চারিদিক আলো করে ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে, ভোর হওয়ার সময়টা রাধেয়র ভীষণ পছন্দের । আজও প্রাচীন বটগাছটার নীচে বসে সূর্যোদয় দেখছিল সে । কি বিপুল বিক্রমে রাতের অন্ধকারকে দূরে হঠিয়ে সূর্যের আগমন ! প্রতিদিন দেখে তবু মুগ্ধতা কাটেনা । খুব আপন মনে হয়, মনে হয় সূর্যের মতো সেও যদি সব অন্ধকারকে জয় করতে পারত । এসব আবোল-তাবোল ভাবছে আর তার প্রিয় ধনুকটাতে হাত বুলাচ্ছে রাধেয় । হঠাত মনে পরে গেল আজকে একটা বিশেষ দিন । হস্তিনাপুরের রাজকুমারদের সামরিক শিক্ষা শেষ হয়েছে । ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নগরীর সবাইকে রাজকুমারদের সামরিক কুচকাওয়াজ দেখার আমন্ত্রন জানানো হয়েছে ।

নগরীজুড়ে উতসবের প্রস্তুতি । সবাই দল বেঁধে যাচ্ছে কুচকাওয়াজ দেখতে । এসব দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে যায় । মনে পরে সারথির ছেলে হওয়ার কারণে দ্রোণাচার্যের অপমান করে স্কুল থেকে তাড়িয়া দেয়া । এরপর হিমালয়ে গিয়ে পরশুরামের সামরিক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হওয়া । সেখানে তার বংশ পরিচয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি । জীবনের শ্রেষ্ঠ ছ’টা বছর সে কাটিয়েছে । গতকাল প্রশিক্ষন শেষ করে ফিরল । আসার সময় খুব খারাপ লাগছিল, যে স্কুলটাকে আগে জেলখানার মত মনে হত সেদিন তাকে ছেড়ে আসতে দু’চোখ ভিজে আসছিল ।আসার পর থেকেই উতসবের প্রস্তুতি দেখছে । ভাবছে যাবে কিনা, কিন্তু মাকে অনেকদিন দেখেনি । মার জন্য মনটা কেমন করছে । আবার দ্রোণাচার্যের অপমান ভুলতে পারেনা, আর আজকেই সুযোগ রাজগুরুকে সে অপমানের উচিত জবাব দেওয়ার । এসব ভাবতে ভাবতে রাধেয় তো খেয়াল করেনি কখন ওর গায়ের চাদরটা সরে গিয়ে বায়ো আর্মারটা বেরিয়ে পরেছে । আর আর্মারটার দিকে পথ চলতি লোকজন হা করে তাকিয়ে আছে । বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলে ওর বায়ো আর্মারটা জ্বলজ্বল করতে থাকে । দেখে মনে হয় কয়লার আগুন । তাড়াতাড়ি চাদরটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে-ঢুকে ধীরে ধীরে বটগাছটার নীচ থেকে সরে পরল । সাত-সকালে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে আসার কোন মানে নেই, ভীড়ের মধ্যে মিশে যাওয়াই ভাল । এরকম আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে হঠাত খেয়াল করলো বাড়ির দিকে না গিয়ে ভীড়ের সাথে সাথে সেও কুচকাওয়াজ দেখতে এসে পরেছে ।

চারিদিকের জাঁক-জমক দেখে আর প্রতিদিন রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পরে । স্বপ্নেও ঠিক এরকম একটা কলোসিয়ামেই সহস্র মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সে আভিবাদন নেয় । সামনে তাকিয়ে দেখে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । অর্জুন বাদে সবার প্রদর্শনী শেষ । সে দ্রোণাচার্যের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য । তাই বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সবার পরে অর্জুন । দর্শকের প্রবল হাততালির মধ্য দিয়ে কলোসিয়ামে তার প্রবেশ । সে হস্তিনাপুরের সেরা তীরন্দাজ, চোখ বন্ধ করেও সে নিশানা করতে পারে । দর্শক অধীর আগ্রহে আপেক্ষা করছিল তার জন্য । অর্জুন কাউকে নিরাশ করলো না । মেঘের দিকে তীর ছুঁড়ে সে বৃষ্টি নামালো, আবার তীর ছুঁড়ে সে বৃষ্টি থামিয়েও দিল । এমন আজব কান্ড কেউ কখনো দেখেনি । কিন্তু আজব হওয়া আরো বাকি ছিল । এরপর অর্জুন তীর দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে দেখালো, তারপর সিঁড়ির মাথায় উঠে সবার অভিনন্দন গ্রহন করলো । প্রিয় শিষ্যের কৃতিত্বে দ্রোণাচার্য খুশি হয়ে উপস্থিত সবার সামনে অর্জুনের সমকক্ষ তীরন্দাজ ভূ-ভারতে নেই বলে ঘোষণা দিলেন । এ কথা বলার পরপরই মনে হল তিনি কলোসিয়ামের মাঝখানে কোত্থেকে উড়ে আসা একটা আগুনের গোলা দেখতে পেলেন । ভালভাবে তাকিয়ে দেখেন ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চূলের এক লম্বা যুবক দাঁড়িয়ে । আর তার সারা শরীর আগুনের মত জ্বলছে মনে হচ্ছে সূর্য যেন মাটিতে নেমে এসেছে । এরপর শুরু হল সে যুবকের তীরন্দাজি । তীর ছুঁড়ে সে বৃষ্টি নামিয়ে সে বৃষ্টি মাটিতে নামার আগেই কলোসিয়ামের উপর ছাদ বানিয়ে ফেলল । তারপর তীর ছুঁড়ে অর্জুনের তীরের সিঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ছাই করে দিল । এখানেই শেষ হলে ভাল হতো কিন্তু এরপর সে অর্জুনকেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে বসল । অর্জুন রাজবংশের ছেলে কোথাকার এক এলেবেলে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাতে ভয় পাওয়ার ছেলে সে নয় । রাধেয়কে শেষ করেই সে ফিরবে । দ্রোণাচার্য ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন, এছেলে কোন সাধারণ ছেলে নয় । তাই তিনি প্রিয় শিষ্যকে বাঁচানোর জন্য বললেন,

.. হে ভিনদেশী যুবক । আমাদের রাজ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের কিছু নিয়ম কানুন আছে ।
নিয়মানুযায়ী দুই প্রতিদ্বন্দীকে তাদের নাম এবং বংশ পরিচয় দিতে হয় ।
আর দ্বন্দ্বযুদ্ধ সবসময় সমানে সমানে হয় । আমরা তো অর্জুনের পরিচয়
সবাই জানি । এখন তোমার পরিচয় দাও ।

…আমি রাধেয় । অধিরথের ছেলে । রাধা আমার মা ।

একথা শুনে দ্রোণা সহ সবাই হাসতে লাগলো । অর্জুনের বড় ভাই ভীম বলে উঠল,

….সারথির ছেলে তো ঘোড়ার দেখাশোনা করবে । এখানে কি চাও ।

একথা শুনে সারা উপস্থিত অভিজাতেরা হাসতে লাগলো । আর যে রাধেয়কে দেখে এতক্ষন সূর্যের মত মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে ধীরে অস্তমান সূর্যের মত ডুবে যেতে লাগলো । এসব শ্রেণীবৈষমী হায়েনাদের মাঝে একজনই রাধেয়র ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিল । সে হল রাজকুমার দূর্যোধন । সে তখন বলে উঠলো,

…..যে বংশ পরিচয় দিয়ে আপনারা মানুষের মেধা যাচাই করছেন । বলুনতো দ্রোণা আপনার আসল পিতা কে । বলুনতো আমাদের পরম পিতামহের বাবা কি করতেন । পারবেন বলতে পারবেন না । ঠিক আছে বংশ মর্যাদাই যদি আপনাদের দরবারে যোগ্যতার মাপকাঠি হয় । তাহলে আমি রাজকুমার দূর্যোধন আজ থেকে আংগা রাজ্যের রাজত্ব রাধেয় কে দিয়ে দিচ্ছি । আর রাধেয় আজ থেকে আর রাধেয় না, আজ থেকে রাধেয় হচ্ছে আংগারাজ কর্ন ।

এ কথা বলে রাজকুমার দূর্যোধন তার মাথা থেকে আংগার রাজমুকুট খুলে রাধেয়র মাথায় পরিয়ে দিল । ঘটনার আকস্মিকতায় আর সবার মত রাধেয় নিজেও ভীষণ অবাক হয়ে গেল । সারাজীবন বংশপরিচয়ের জন্য তাকে গালমন্দ করেছে সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা । আজ তাদেরই একজন তাকে এ অপমান থেকে রক্ষা করলো । আবেগে কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে উঠলো । তখনি সবার সামনে রাজকুমার দূর্যোধনকে হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করে বলল,

…মহারাজ আপনার এ ঋণ আমি কেমন করে শোধ করব ।

রাজকুমার দূর্যোধন রাধেয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

…..তোমার বন্ধুত্ব দিয়ে । আর কিছু চাইনা ।

…তাই হবে বন্ধু ।

এভাবে আমাদের সারথির ছেলে রাধেয় রাজা কর্ন হয়ে উঠলো । আর এদুজনের বন্ধুত্ব, সে আরেক গল্প অন্যদিন বলব ।

ডিসক্লেইমার: পরীক্ষামূলক লেখা । তপু, রায়হান আর আন্দালিবের লেখায় অনুপ্রানিত হয়ে লিখলাম । কেমন লাগলো বলবেন । আর গল্পের সূত্র মহাভারত হলেও আমি নিজের মত করে লেখার চেষ্টা করেছি ।

৪,২৯৭ বার দেখা হয়েছে

৬০ টি মন্তব্য : “কর্ণের কথা (মিথলজি)”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    অসাধারণ ভাইয়া প্লিজ পরের পার্ট গুলা লেখেন। আমি নিজেকে কি বলে ধন্যবাদ দিব খুঁজে পাচ্ছিনা । নিতান্তই একটা লেখা লেখার পর এত গুলা ভাল ভাল মিথ জানতে পারছি তাও নতুন করে খুবই ভাল লাগছে।

    জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    এসব ভাবতে ভাবতে রাধেয় তো খেয়াল করেনি কখন ওর গায়ের চাদরটা সরে গিয়ে বায়ো আর্মারটা বেরিয়ে পরেছে ।

    (হাসতে সাহতে পড়ে যাবার ইমো) ...... তোমার বর্ননা জটিল লাগলো। কর্ণ মহাভারতে আমার সবচে প্রিয় চরিত্র। আশা করি তুমি তাকে যথার্থভাবেই চরিত্রায়ন করবে ......

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৪-২০০০)

      আরে এইটা কি ধারাবাহিক নাকি? ভাইয়া মহাভারতের যেই সাইয । বেশিরভাগ ঘটনা ভুলে গেছি । উইকিতেও আমার মনমত ইনফরমেশন নাই । প্রচুর গুগল করে কর্ণের অংশগুলো পড়ে ভুলে গিয়ে নিজের মত করে লিখেছি । আপনার ভাল লেগেছে যেনে খুশি হলাম ।

      জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    বাহ্‌! এখন দেখি পুরা পৌরাণিক সপ্তাহ চলতেছে। 🙂
    দোস্ত...চমৎকার হইছে। প্লিজ, আরও কয়েকটা গল্প লিখে ফেল এইখানে।
    আর পৌরাণিক বই কেনার দরকার নাই। সিসিবিতে পাবলিক এইভাবে লেখা শুরু করলে সব কাহিনীই জেনে যাব। 😀

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    পথের পাঁচালী আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। আর সেখানেই প্রথম কর্ণের খোঁজ পাই। কর্ণের মাটিতে ডুবে গিয়ে মৃত্যু বড় কষ্ট দিয়েছিলো। আদনান ভাই দারুণ। আমার প্রিয় রাজপুত্রকে তুলে আনার জন্য হ্যাটস অফ (ইমোগুলো কই যে গেলো)। আরো লিখেন। মহাভারতের ছোট ছোট অনেক মজার মিথ আছে। আসতে থাকুক একে একে।

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৪-২০০০)

      ধন্যবাদ ভাইয়া । আপনার কমেন্ট পড়েই নতুনভাবে লিখার আইডিয়াটা এসেছে । আমিতো আরেকটু হলে সায়েন্স ফিকশন মহাভারত লিখতে জাচ্ছিলাম । না লিখে মনে হয় ভালোই করেছি । আমি ইচ্ছে করে দেব-দেবীদের দূরে রেখেছি । সামনে যদি এ গল্পটাকে বাড়াই কিভাবে বাড়াবো চিন্তার বিষয় ।

      জবাব দিন
  5. জাফর (৯৫-০১)

    খুব ভাল লাগল। খুব শীঘ্রই পরের পার্ট আশা করছি।

    একটা অংশ পড়ে নিজের কলেজ জীবনের সাথে মিল পেলাম,

    জীবনের শ্রেষ্ঠ ছ’টা বছর সে কাটিয়েছে । আসার সময় খুব খারাপ লাগছিল, যে স্কুলটাকে আগে জেলখানার মত মনে হত সেদিন তাকে ছেড়ে আসতে দু’চোখ ভিজে আসছিল
    জবাব দিন
  6. দিহান আহসান

    আদনান ভাইয়া, পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম, ক্যাডেট কলেজ'কে নিয়ে আসার লোভ টা সামলাতে পারেননি। ভাল হয়েছে, বই এর মত লিখলে অনেক কিছুই বুঝতে কষ্ট হত।
    পরের পর্বটা তাড়াতাড়ি নামানো যায় কি?

    জবাব দিন
  7. আন্দালিব (৯৬-০২)

    চমৎকার হয়েছে বস। এত ভালো যে এখন পরের পর্ব পড়ার ইচ্ছা হইতেছে। কর্ণ আমার কাছে খুবই প্রিয় চরিত্র। পঞ্চপাণ্ডব বা কৌরবদের আমার কাছে অনেক প্রাউড মনে হয়। সেই তুলনায় কর্ণ অনেক ডাউন টু আর্থ, প্র্যাকটিকাল, এবং সাহসী যোদ্ধা। খালি পপুলার বলে অর্জুনকে জিতায়ে দিছিলো, নাইলে কর্ণের সমান যোদ্ধা একটাও নাই! :thumbup:

    খেয়াল করেছেন, কর্ণের জন্ম-ইতিহাসের সাথে যীশুর জন্ম-ইতিহাসের (বাইবেল ভার্সন) একটা মিল আছে। এটা আমার খুব কৌতূহল উদ্রেক করেছিল একটা সময়ে।

    এইটার পরের পর্ব চাই। আমি একটা লিখলাম তারপরে সবাই অফ গেলে খেলবো না। তপু আবীর লেখা ছাড়তে হবে। আর আপনাকেও লিখতে হবে!! :thumbup:

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৪-২০০০)

      ব্যাপারটা আমিও ভেবেছি, তবে টাইমলাইন মনে হয় ভিন্ন । কিন্তু মজার ব্যাপার সবগুলো মিথ কিন্তু চারিত্রিক দিক দিয়ে একিরকম । সামান্য কিছু হেরফের । এর পরের পর্ব যে কি নিয়ে লিখব ভাবছি । মহাভারত তো অনেক বড় । কোনদিক দিয়ে যে লিখি ~x( তবে লিখব । তোদের উতসাহ খুব ভাল লেগেছে । আমি আরেকটু হলে এক্স-ম্যান ধরনের মহাভারত লিখে ফেলেছিলাম :))

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।