উদারতা বনাম রক্ষণশীলতা- ধর্মীয় প্রেক্ষাপট

মাস কয়েক আগে এখানে সহ সদালাপ ব্লগে “আমি কেন ব্লগে লেখালেখি কমালাম” শিরোনামে আমার একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্কে সহনশীলতা প্রদর্শনের জন্যে ব্লগারদেরকে সদুপোদেশ দেওয়ার পাশাপাশি ধর্মের মৌলিক বিধি-বিধানের বাইরে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ইত্যাদি সেকেন্ডারী বিষয়গুলোতে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরে উঠে নিরপেক্ষ দৃষ্টি অর্জনে আমি আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ধর্মীয় উদারতা ও রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা কিছুটা এসেছিল প্রবন্ধটিতে। প্রচুর কমেন্ট পড়েছিল আমার লেখাটিতে এবং অনেকগুলো কমেন্ট ছিল মুসলমানদেরকে ধর্মীয় রক্ষণশীল কিম্বা উদারপন্থি হিসেবে ভাগ করার মনোভাব বা প্রচেষ্ঠার বিরোধীতা করে। আলোচ্য প্রবন্ধটি লেখার আইডিয়াটা মাথায় এসেছিল মূলত তখনই।

ইন্টারনেট ঘাটলে উদারতা বা ‘লিবারালিজম’-এর আভিধানিক সংগা যেহেতু সহজেই চোখে পড়বে, কাজেই এখানে আলাদা করে লিবারালিজম-এর সংগা দেয়া থেকে বিরত থাকছি । যাহোক, অধিকাংশ সংগায় লিবারালিজমকে মধ্যযুগ উত্তর একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন (a political and/or social philosophy) হিসেবে সংগায়িত করা হয়েছে এবং এর দ্বারা মূলত মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত ধর্মীয়-স্বাধীনতা, সিভিল-লিবার্টি, ইত্যাদি অধিকার প্রতিষ্ঠার ও সামাজিক প্রগতিশীলতার ধ্যান-ধারনাকে বুঝানো হয়েছে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে লিবারালিজম বলতে সাধারনত আধূনিক প্রোটেস্ট্যান্টিজমকে বুঝানো হয় যেটার সংগায় বলা হয়- “Liberalism is a movement in modern Protestantism that emphasizes freedom from tradition and authority, the adjustment of religious beliefs to scientific conceptions, and the development of spiritual capacities” (বঙ্গানুবাদ: লিবারালিজম হলো আধূনিক প্রোটেস্ট্যান্টিজমের অন্তর্গত একটা গণআন্দোলন যা ঐতিহ্য ও কর্তৃত্ব থেকে মুক্তির, বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনার সাথে ধর্মের উপযোজনের ও আত্মিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব দেয়)।

পক্ষান্তরে, রক্ষণশীলতা বা ‘কঞ্জারভেটিজম’ এমন একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন যা ঐতিহ্যগত ধ্যান-ধারনা ও প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতিকে লালন করে এবং এসমস্ত বিষয়ে কোনো তাৎক্ষণিক পরিবর্তনকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করে। অন্য কথায়, কঞ্জারভেটিজমকে সামাজিক প্রগতিশীলতার বিপরীত মতধারা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কোনো কোনো দার্শনিক। একইভাবে, ইন্টারনেট ঘাটলে ‘কঞ্জারভেটিজম’-এর আভিধানিক সংগা যেহেতু সহজেই চোখে পড়বে, কাজেই এখানে আলাদা করে কঞ্জারভেটিজম-এর সংগা দিচ্ছিনা। প্রতিষ্ঠিত ধর্মসমুহের ধর্মীয় বিধি-বিধান যেহেতু অনেকটা অবধারিতভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কঞ্জারভেটিজম-এর অংশ, কাজেই আলাদা করে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে কঞ্জারভেটিজম-এর সংগা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

আলোচ্য প্রবন্ধে আমি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদারতা ও রক্ষণশীলতা কিছুটা আলোচনা করে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এ বিষয় দুটোকে দেখার চেষ্টা করবো। তবে আগে থেকেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ কারনে যে, এ প্রবন্ধটিও গত প্রবন্ধের মত সাইজে খানিকটা বড় হয়ে যেতে পারে।

আমেরিকার রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ‘লিবারাল’ ও রিপাবলিকান পার্টি ‘কঞ্জারভেটিভ’ হিসেবে পরিচিত। ডেমোক্র্যাটিক বা কঞ্জারভেটিভ পার্টির অর্থনৈতিক মূলনীতি আমার এ লেখার উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় বলে তা এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। মূলত সামাজিক (ও তৎসূত্রে রাজনৈতিক) প্রেক্ষাপটে এই দুই পার্টির মূলনীতি ও দর্শন নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো আমি। প্রথমেই আসি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিষয়ে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে এদেশের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সার্বিক দলীয় আদর্শ হলো ‘প্রো-চয়েস’। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে থেকে যার যেভাবে খুশী জীবন-যাপন করবে এবং তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথার প্রয়োজন নেই। বলাবাহুল্য, ডেমোক্র্যাটদের প্রো-চয়েস কনসেপ্টটা ঈশ্বরের মনোনীত জীবন বিধানের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই কনফ্লিক্টিং। পক্ষান্তরে, রিপাবলিকান পার্টির সার্বিক দলীয় আদর্শ হলো ‘প্রো-লাইফ’ যা ঈশ্বরের মনোনীত জীবন বিধানের সাথে বহুলাংশেই সংগতিপূর্ণ। ‘প্রো-লাইফ’ কনসেপ্টটা ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ আফগানস্থান আক্রমন উত্তর রেভারেন্ড প্যাট রবার্টসনকে Afghan Children’s Fund-এর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ প্রদানকালে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক প্রেস রিলিজে প্যাট রবার্টসনের প্রতিষ্ঠান, Christian Coalition of America সম্পর্কে প্রশংসা করতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটার অংশবিশেষ তুলে ধরছি। তিনি বলেছিলেন- “This mighty institution has successfully protected America from all manner of smut-peddlers, Jesus-killers, lesbos, fetus-murderers, faggots, and Darwinists…” (বঙ্গানুবাদ: এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আমেরিকাকে সব ধরনের শরীরী-ব্যবসায়ীদের, যীশু-হত্যাকারীদের, মেয়ে-সমকামীদের, ভ্রূণ-হত্যাকারীদের, ছেলে-সমকামীদের, এবং ডারউইনবাদীদের কুচক্র থেকে সফলভাবে রক্ষা করেছে…)। আমেরিকার সামাজিক (ও তৎসূত্রে রাজনৈতিক) প্রেক্ষাপটে রিপাবলিকান পার্টির সার্বিক ‘প্রো-লাইফ’ দর্শন সম্ভবত বুশের উক্ত উক্তির মধ্যেই সর্বোতভাবে নিহিত।

মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকান মুসলিম অভিবাসীদের অধিকাংশই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক। এদেশে ভোট প্রদানের সুবিধাপ্রাপ্ত প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদেরকে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, “কংগ্রেস, সিনেট কিম্বা প্রেসিডেন্ট টিকেটে এবার কাদেরকে ভোট দিচ্ছেন?” তবে শতকরা পঁচানব্বুই ভাগ ক্ষেত্রে আপনি আশা করতে পারেন সম্ভাব্য উত্তরটা হবে, “ডেমোক্র্যাট”। ইরানে থাকতে যিনি আহমেদিনেজাদের কঞ্জারভেটিভ দলকে ভোট দিয়েছেন, ফিলিস্তিনে থাকতে যিনি কঞ্জারভেটিভ হামাসকে ভোট দিয়েছেন, কিম্বা বাংলাদেশে থাকতে যিনি কঞ্জারভেটিভ ও রেডিক্যাল জামাতে ইসলামকে ভোট দিয়েছেন, তিনি অনেকটা অবধারিতভাবেই এদেশে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেন (একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত ২০০০ সালের ডেমোক্র্যাটিক টিকেট যেটার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন জোসেফ লিবারম্যান, একজন ইহুদী)। মজার ব্যাপার হলো, এদেশে মাইনরিটিদের মুখপাত্র ডেমোক্র্যাটিক পার্টি শুধু সেক্যুলারই নয় বরং ভয়ানকভাবে লিবারাল। সমকামী বিয়ে, গর্ভপাত, মানব ক্লোনিং, স্টেমসেল গবেষনা,… ডেমোক্র্যাটরা এসব প্রচলিত ঈশ্বরবিরোধী (এবং একইসাথে ইসলামবিরোধী) ব্যাপার-স্যাপারের শুধু সমর্থকই নয়, বরং পৃষ্টপোষকও। পক্ষান্তরে রিপাবলিকানরা সমকামিতাবিরোধী, গর্ভপাতবিরোধী, পতিতাবৃত্তিবিরোধী, ডারউইন তত্ত্ববিরোধী, মানব ক্লোনিং ও স্টেমসেল গবেষনা বিরোধী,…। মোদ্দা কথা আমরা মুসলমানরা ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক যে সমস্ত বিষয়ে রক্ষনশীল, এদেশের রিপাবলিকান পার্টি সেসব ব্যাপারে শুধু রক্ষনশীলই নয়, বরং পৃষ্টপোষকও। কাজেই ত্বত্ত্বগতভাবে এদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের গণহারে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা অনেকাংশেই ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ, এদেশের মুসলমানদের অধিকাংশই রিপাবলিকান ব্লকের বিরুদ্ধাচারী। কিন্তু কেন? কারন হলো, অসংখ্য রিপাবলিকান ‘আল্ট্রা কন্‌জারভেটিভ’ এবং তারই ফলস্বরূপ অনেকটা অবধারিতভাবেই মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমবিদ্বেষীও।

এটা একটা ইন্টারেষ্টিং পর্যবেক্ষণ। একজন মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রকটতা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় শুধু স্বধর্মের, স্ববর্ণের কিম্বা নিজ মতাদর্শের মানুষ ছাড়া পৃথিবীর বাকি সবার জন্যে সে তার হৃদয়ের দরজাকে বন্ধ করে দেয়। যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিম্বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কারো প্রবেশাধিকার থাকেনা তখন। তার হৃদয়ের উদারতা মুছে গিয়ে সেখানে গেঁড়ে বসে ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের কিম্বা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের প্রতি অসহনশীলতা ও বিদ্বেষ। আমেরিকান মিডিয়ায় ও রাজনীতিতে ‘আল্ট্রা কন্‌জারভেটিভ’ হিসেবে পরিচিত রাশ লিম্বোহ, শ্যন হ্যানিটি, গ্লেন বেক, নিউট গিংরিচ, রিক স্যান্টোরাম, মিশেল বাকম্যান, সেরাহ পেইলিন,… সম্ভবত এভাবেই কট্টর রক্ষণশীলতার পথ ধরে ক্রমে একেকজন রেডিক্যাল মনোভাবাপন্ন মানুষে পরিনত হয়েছেন। এবং সেই একই পথ ধরে এদেশের রিপাবলিকান পার্টি ক্রমে পরিনত হয়েছে একদল কট্টর রক্ষণশীল ও উগ্রপন্থী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পার্টিতে। যে কারনে রিপাবলিকান পার্টিতে মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘূদের অনুপ্রবেশ ক্রমশ নিম্নমূখী। সম্ভবত সেই একই কারনে বিজেপিতে ভারতীয় মুসলিমদের কিম্বা বিএনপিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘূদের অনুপ্রবেশ শূন্যের কোঠায়।

যাহোক, খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী আমেরিকান সমাজে উদারতা ও রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা এদেশের প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি ওপরে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমেরিকান সমাজে লিবারালদের ক্ষেত্রে ধর্মপালনকে যত সহজে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আলাদা যায়, কঞ্জারভেটিভদের ক্ষেত্রে তত সহজে সেটা করা যায়না। এবং সম্ভবত সেকারনেই লিবারালিজম-এর আভিধানিক সংগায় ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ধারনাটা আলাদা করে থাকলেও কঞ্জারভেটিজম-এর আভিধানিক সংগা অল-ইনক্লুসিভ (all-inclusive)। বর্তমানে খ্রীষ্টধর্মে সাধারনভাবে চার্চ যেহেতু রাষ্ট্র থেকে আলাদা, কাজেই কঞ্জারভেটিজম অনেকাংশে একধরনের আর্থ-সামাজিক আন্দোলন যেটাকে পশ্চিমা রাজনীতিকরা বর্তমান বিশ্ব-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলেও বাইবেলভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মত চুড়ান্ত এজেন্ডা পশ্চিমা রাজনীতিতে অনুপস্থিত। খ্রীষ্টীয় মৌলবাদ পশ্চিমাবিশ্বে সম্প্রতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও এবং ‘আল্ট্রা কন্‌জারভেটিভ’ মতধারার উত্থান ঘটলেও আমেরিকার কিম্বা পশ্চিমাবিশ্বের কোনো দেশের অদূর ভবিষ্যতে তালেবান শাষিত আফগানস্থানের মত অনুরূপ কোনো দেশে পরিনত হওয়ার তেমন সুযোগ নেই।

পক্ষান্তরে, ইসলাম ধর্মের বিগত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিকে মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন থেকে যেহেতু সাধারনভাবে আলাদা করা হয়নি (হয়ত কিছু ব্যতিক্রম বাদে), কাজেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট সমাজে চুড়ান্ত কঞ্জারভেটিজম একদিকে যেমন কঞ্জারভেটিভ সামাজিক আন্দোলনের গন্ডী পেরিয়ে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে (অল-ইনক্লুসিভ), অপরদিকে চুড়ান্ত লিবারালিজম একইভাবে লিবারাল সামাজিক আন্দোলনের গন্ডী পেরিয়ে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। এছাড়া এই দুই চুড়ান্ত সীমারেখার মাঝে রয়েছে আংশিক চাওয়া-পাওয়ার অভিমত-সম্পন্ন অসংখ্য মতধারা যাদের একেক দলের চাওয়া একেক রকম। শরিয়ার প্রশ্নে চুড়ান্ত লিবারালিজমকে ‘০’ (শূণ্য) এবং চুড়ান্ত কঞ্জারভেটিজমকে ‘১০০’ (একশ) ধরলে ইসলামের মৌলিক আদেশগুলো মেনে (যথা নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত) শরিয়ার (রাজনৈতিক প্রয়োগের) ব্যাপারে উক্ত স্কেলে ‘০’ থেকে ‘১০০’র মধ্যে যে কোনো সূচক বরাবর মনোভাব পোষন করেও আপনি হয়ত কখনই সরাসরি কোনো ‘রাইট’ (right), ‘রং’ (wrong) প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়ে কিম্বা স্পষ্টভাবে কোনো দলের পক্ষাবলম্বন না করে পুরো জীবন পার করে দিতে পারবেন। কেননা বর্তমান বিশ্বের সার্বিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চুড়ান্ত কঞ্জারভেটিজম কিম্বা চুড়ান্ত লিবারালিজম- কোনো মতধারার অনুসারীদেরই যেমন একক বিজয় পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তেমনি করে এই দুই মতধারার মধ্যে সরাসরি সংঘাতেরও খুব একটা সম্ভাবনা নেই (হয়ত কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। কাজেই আমার গত প্রবন্ধে (আমি কেন ব্লগে লেখালেখি কমালাম) মন্তব্য করতে গিয়ে জিয়া ভাই (আবু সাঈদ জিয়াউদ্দিন) “…যে যার ব্যক্তিত্ব আর বুঝের ভিত্তিতে ইসলামকে অনুসরন করবে। এখানে কেউ উদার হলো কিনা, কেউ রক্ষনশীল হলো কিনা — তাতে খুব একটা বেশী সমস্যা না…” বলে যে মন্তব্যটা করেছিলেন সেটা এ যুগের মুসলমানদের শরিয়া বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে যে অত্যন্ত বাস্তব একটা পর্যবেক্ষণ, সেটা বলা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশে আধূনিক ‘কমিউনিজম’-এর উত্থান ও জনপ্রিয়তা সমাজ থেকে ধর্মকে অনেকাংশেই উচ্ছেদ করে। কমিউনিষ্ট ব্লকের বেশীরভাগ দেশেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মপালন কমবেশী নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি, তৎকালীন সেক্যুলার পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও ধর্মহীনতার বাতাস লাগে। দেশে দেশে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মানুষদের মাঝে ধর্মহীনতা বৃদ্ধি পায়। তারই সূত্র ধরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা প্রসারে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে সেসময়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিংশ শতাব্দির শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে কমিউনিজম স্বভাবতই বিশ্বব্যাপী তার গ্রহনযোগ্যতা হারায়। কমিউনিষ্ট দেশগুলোতে বসবাসকারী মানুষের ওপর একসময়ের জোর করে চাপিয়ে দেয়া ‘ধর্মহীনতা’ কমিউনিজমের বিলুপ্তির সাথে সাথে অস্তিত্বের প্রশ্নের মুখোমুখি পড়লে বিশ্বের কোনায় কোনায় সৃষ্টি হয় এক ধরনের ‘রিলিজিয়াস ভ্যাকুম’ বা ধর্মীয় শূন্যতা। সেসময় বিশ্বের আরেক চলমান রাষ্ট্রব্যাবস্থা, পুঁজিবাদ দেশে দেশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোও সেসব দেশে ধর্মীয় শূন্যস্থান পূরন করতে শুরু করে। এবং মানুষ যেন নতুন করে স্ব স্ব ধর্মকে পুনরায় আবিষ্কার করতে শুরু করে। আর পুঁজিবাদের, বিশেষ করে তৎকালীন অপর পরাশক্তি আমেরিকার মদদপুষ্ট আগ্রাসী পুঁজিবাদের উন্নতি ও প্রসারের অন্যতম প্রধান দুটো উপাদান, টাকা ও ধর্ম সবিশেষ ভূমিকা পালন করে সেসব দেশের রাজনীতিকে চুড়ান্ত রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে। এবং অবধারিতভাবে ধর্মের রাজনীতিকরন করা হয় সেসব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। বিজেপি কিম্বা জামাতে ইসলামের মত উগ্র কঞ্জারভেটিভ দলগুলো দেশে দেশে পায়ের নীচে শক্ত মাটি পায় সেসব দেশের একসময়ের জনপ্রিয় লিবারাল রাজনৈতিক দলগুলোর নাকের ডগায় বসেই।

যাহোক, পুঁজিবাদী সমাজে ধর্মের রাজনীতিকরণের কারনে অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে কঞ্জারভেটিভ মতধারার উত্থান ও শক্তি অর্জন সহজে দৃষ্টিগোচর হলেও কঞ্জারভেটিভ ও লিবারাল মতধারার মধ্যে পরষ্পরকে নিউট্রালাইজ করার যে ব্যালান্স, তা সার্বিকভাবে হুমকীর মুখে পড়েনি সম্ভবত। এবং সত্যি বলতে কী, একটা দেশের আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়ায় ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে এ ব্যালান্স না থাকলেই বরং সমস্যা। সম্ভবত যে কারনে কমিউনিজম টিকে থাকতে পারেনি। আমেরিকায় কঞ্জারভেটিভরা না থাকলে লিবারালদের একক উগ্র পলিসির কারনে আমেরিকান সমাজের ধর্মীয় ও পারিবারিক অবকাঠামো হয়ত এতদিনে হুমকীর সম্মুখীন হতো। কাজেই সমাজে কঞ্জারভেটিভ আইডিয়োলজির উপস্থিতি একটা গ্রহনীয় পর্যায় পর্যন্ত অকাম্য নয়। সমস্যা হলো, ইসলাম সাধারনভাবে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ায় এবং কঞ্জারভেটিভ ইসলামপন্থি মতধারার একটা ক্ষুদ্রাংশের রাজনৈতিক আদর্শ চরম অনমনীয়, আধূনিকতাবিমুখ, সংস্কারবিরোধী ও সহিংস হওয়ায় সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের কারনে ও তথ্য মিডিয়ার সুবাদে তাদের মতধারা ও কর্মকান্ড সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ জানতে শুরু করেছে এবং পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসকারী মুসলমানদের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়ছে প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বনের এবং এদের কর্মকান্ডকে ইসলাম ধর্মের আলোকে ‘রাইট’, ‘রং’ হিসেবে বিচার করার। বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর এ সবিশেষ চাপে যেন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

নাইন-ইলেভেনকে বুশ প্রশাষন বা ইহুদীদের ষড়যন্ত্র বলে (প্রকৃত সত্য যাই হোক), কিম্বা বর্তমানকালের মসলিম সন্ত্রাসকে ইকনোমিক্স-এর ‘সাপ্লাই-ডিমান্ড’-এর ফলাফল বলে (ইকনোমিক্স-এ আমার যতটুকু প্রাথমিক জ্ঞান আছে, সেটা অনুযায়ী শেষোক্ত আর্গুমেন্টটার যদিও কিছুটা ভিত্তি আছে) আমরা স্পষ্ট পক্ষাবলম্বন কিম্বা ‘রাইট’, ‘রং’ প্রশ্নোত্তরকে এড়ানোর যতই চেষ্টা করি না কেন, সমস্যা হলো ইসলামের অল-ইনক্লুসিভ কঞ্জারভেটিভ মতধারার অস্তিত্ব সম্বন্ধে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ কমবেশী অবগত এবং ওপরোল্লেখিত সহিংস মতধারার মুসলিম ক্ষুদ্রাংশের কর্মকান্ডকে দিয়ে গোটা মুসলিমবিশ্বকে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা করছে অধিকাংশ পশ্চিমা মিডিয়াসহ অসংখ্য ইসলামবিরোধী ফোরাম ও সংগঠন। কাজেই পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসকারী মুসলমানরা কোন্‌ ধ্যান-ধারনা ও বুঝের ভিত্তিতে ইসলামকে অনুসরন করছে, তা প্রকাশ করা ক্রমে জরুরী হয়ে পড়ছে এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসকারী মুসলিম স্কলাররা এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বলাবাহুল্য, এই ধ্যান-ধারনা ও বুঝ যে ইসলামী শরিয়ার ইন্টারপ্রিটেশন ও প্রয়োগ নিয়ে জিজ্ঞাস্য, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার আজকের আলোচনা মূলত শরিয়ার রাজনৈতিক ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে। তবে সরাসরি ইসলামী শরিয়ার ওপর আলোচনা না করে (যে অথরিটি আসলে আমার নেইও যেহেতু আমি কোনো ওলামা নই) মূলত শরিয়া বিষয়ে ডিফারেন্ট স্কুল অব থট-এর ওলামাদের উদার ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গীর কথা উল্লেখ করবো আমি। এবং পাঠকদের বিরক্তির উদ্রেক না করার লক্ষ্যে মাত্র দু’একজনের উদাহরন নিয়ে আলোচনা করবো লেখার কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে।

প্রথমেই উল্লেখ করবো প্রয়াত আনোয়ার আল-আওলাকির কথা যিনি গতবছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইয়েমেনে ইউএস রিমোট কন্ট্রোল্ড মিসাইলের আঘাতে নিহত হয়েছেন। কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যাচেলর ডিগ্রী ও স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এডুকেশনে মাস্টার্স ডিগ্রী করা আওলাকি নিজস্ব প্রচেষ্টায় ইসলামের ওপর প্রচুর পড়াশোনা করেন এবং নানা সময়ে বিভিন্ন মুসলিম স্কলারদের সান্নিধ্যে এসে অসাধারন ইসলামী জ্ঞান অর্জন করেন যা তাকে ১৯৯৪ সালে কলোরাডোর ডেনভার ইসলামিক সোসাইটির ইমাম পদ পেতে সহায়ত করে। প্রায় বছর দুয়েক সেখানে ইমামতি করার পর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি স্যান ডিয়েগোর ‘আর-রিবাত আল-ইসলামী’ মসজিদের ইমাম পদে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর ২০০১ সালের প্রথম দিক থেকে ২০০২ সালের শেষ দিক পর্যন্ত তিনি ওয়াশিংটন ডিসির অদূরে ‘দার আল-হিজরাহ’ মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা উত্তর জার্মানীর হামবুর্গ শহরে সম্ভাব্য ২০তম হাইজ্যাকার, রামজি’র এ্যাপার্টমেন্টে পুলিশের তল্লাশী চালানোকালীন তার ব্যক্তিগত টেলিফোন লিষ্টে আওলাকির নাম পাওয়া গেলেও এবং নাইন-ইলেভেনের পরপরই এফবিআই আওলাকিকে বার কয়েক জেরা করলেও নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার সাথে আওলাকির সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমান স্থাপন করতে তারা ব্যর্থ হয়। বরং আমেরিকার রাজধানীর কাছাকাছি অবস্থানের সুবাদে ও ইংরেজীতে অত্যন্ত পারদর্শিতার কারনে আওলাকিকে বিভিন্ন আমেরিকান মিডিয়ার পক্ষ থেকে এ সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে আহ্ববান করা হলে তিনি এ হামলার প্রতি নিন্দা জানান এবং এটা মুসলমানরা করে থাকলে তারা ইসলামকে বিকৃত করেছে বলে অভিমত দেন। পরবর্তীতে, মুসলিম-আমেরিকানদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও তাদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আমেরিকান প্রশাষনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলে তারা উল্টে আওলাকিকে নির্বাচন করেন এবং আওলাকি পরবর্তীতে পেন্টাগন ও ইউএস ক্যাপিটল ভবনে পর্যন্ত গমন করেন।

যাহোক, ২০০২-এর জুলাইতে টেরোরিজমের সাথে সংযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে টাকা লেন-দেনের কারনে আওলাকির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত করা হয় এবং ইউএস ফেডেরাল টেরর ওয়াচ লিষ্টে তার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। আমেরিকায় বসবাসের আবহাওয়া ক্রমে ভীতিপ্রদ ও প্রতিকুল বলে মনে হওয়ায় ২০০২-এর শেষভাগে আওলাকি আমেরিকা ত্যাগ করে লন্ডনে পাড়ি জমান। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে তিনি লন্ডন ত্যাগ করে আদি পিতৃভূমি, ইয়েমেনে প্রত্যাবর্তন করেন।

আওলাকির ওপর টাইমস্‌ বা নিউজউইক পত্রিকায় প্রকাশিত গোটা কয়েক ফিচার পড়েছি গত চার, পাঁচ বছরে। ইয়েমেনের পাহাড়ি এলাকায় আরব পোষাক পরিহিত ও রকেট লঞ্চার হাতে পোজ দেয়া এসব ফিচারে সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার সাথে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ, আমেরিকার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের সংগবদ্ধ হয়ে জিহাদ পরিচালনার জন্যে তার আহ্ববান, ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত সংবাদ স্রেফ পড়ার জন্যেই পড়েছি। আওলাকির ওপর আমার প্রথম কিছুটা আগ্রহ জন্মে ২০০৯-এর নভেম্বরে টেক্সাসের ফোর্টহুড আর্মি পোষ্টে ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত মেজর নিদাল মালিক হাসান কর্তৃক ১৩ জন সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করার ও অন্তত আরও ৩০ জনকে আহত করার সংবাদ শোনার পর। আমেরিকান কর্তৃপক্ষ নিদাল হাসানের এ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পেছনে আওলাকির অনুপ্রেরণাকে অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করে (ডিসেম্বর ২০০৮ থেকে জুন ২০০৯ পর্যন্ত দুজনের ভেতর বিনিময় হওয়া অন্তত ১৮ টা ইমেইলের ভিত্তিতে)। এছাড়া ‘ক্রিস্টম্যাস ডে আন্ডারওয়্যার বম্বার’ হিসেবে খ্যাত ওমর ফারুক আব্দুলমুত্তালেব কর্তৃক ২০০৯-এর ডিসেম্বরে নর্থওয়েষ্ট এয়ারলাইনের একটা প্লেনে বোমা বিস্ফোরণের প্রচেষ্টার পেছনে এবং ‘টাইমস্‌ স্কয়ার বম্বার’ হিসেবে খ্যাত ফয়সাল শাহজাদ কর্তৃক ২০১০-এর মে মাসে নিউ ইয়র্কের টাইমস্‌ স্কয়ারে গাড়িভর্তি বোমা বিস্ফোরণের প্রচেষ্টার পেছনেও আওলাকির অনুপ্রেরণাকে অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করেছে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের শেষ দিকে হজ্জ্বে গিয়ে সদ্য প্রয়াত আওলাকি সম্পর্কে প্রচুর স্তুতিবাদ শুনে তার সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ জন্মায় আমার। আমার হজ্জ্ব সংগীদের অন্তত তিন, চার জনের মুখে (যারা সকলেই বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র) অহরহ আওলাকির “লাইফ অব মুহাম্মাদ” লেকচার সিরিজের ভূঁয়সী প্রসংশা শুনে (the most eloquent, the most beautiful and greatly influential) হজ্জ্ব শেষে ফিনিক্সে ফিরে “লাইফ অব মুহাম্মাদ- মক্কান পিরিয়ড”-এর ১৬টা সিডি এবং “লাইফ অব মুহাম্মাদ- মদিনান পিরিয়ড”-এর প্রথমাংশের ১৮টা সিডি যোগাড় করলাম (দ্বিতীয়াংশের ১৯টা সিডি এখনও যোগাড় করা হয়নি আমার)। আওলাকির এই লেকচার সিডি বের হয়েছে ২০০০ সালে, যা নাইন-ইলেভেনের আগে। সম্ভবত আওলাকি যখন ডেনভার ইসলামিক সোসাইটির ইমাম ছিলেন (১৯৯৪~১৯৯৬) তখন এই লেকচার সিরিজ রেকর্ড করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে আল-বাশীর নামে ডেনভার ভিত্তিক একটা প্রকাশনা সংস্থা সিডি আকারে বের করে। লেকচারের যেখানে যেখানে কোরানের আয়াতসমুহ পাঠ করা হয়েছে, সেখানে আওলাকির গলার বদলে সুমধুর কন্ঠের কোনো এক ক্বারীর তেলাওয়াত সংযুক্ত করা হয়েছে। গত চার, পাঁচ মাস ধরে অফিসে আসা-যাওয়ার পথে গাড়িতে সিডিগুলো শোনার ভিত্তিতে ইসলামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আওলাকির উল্লেখযোগ্য কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ ও অনুসিদ্ধান্ত নীচে লিপিবদ্ধ করছি:
১) সুরা বুরূজ-এর তাফসীরে এক বিশ্বাসী যুবকের ঘটনা আছে যাকে পেগ্যান সম্রাট নানা উপায়ে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে সে নিজেই সম্রাটকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে তাকে একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বেঁধে বিসমিল্লাহ বলে সর্বসমক্ষে তীর নিক্ষেপ করলে সে মারা যাবে এবং এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রায় সকলেই আল্লাহর মনোনীত ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায় যাদেরকে সম্রাট অগ্নিপূর্ণ একটা গর্তে নিক্ষেপ করে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। উক্ত যুবকের কথা উল্লেখ করে আওলাকি কনক্লুড করেন যে, এ ঘটনার আলোকে বর্তমানকালের মুসলিমদের সুইসাইড বম্বিং যৌক্তিক ও ব্যাখ্যাযোগ্য।
২) ইসলামপূর্ব ‘সালাত’ শব্দ দ্বারা ‘সাপ্লিকেইশন’ বা ‘সনির্বন্ধ আবেদন’ বুঝানো হলেও ইসলাম উত্তর ‘সালাত’ শব্দ দ্বারা যেমন স্রেফ নামাজকে বুঝানো হয়, তেমনি করে ইসলামপূর্ব ‘জিহাদ’ শব্দ দ্বারা ‘স্ট্রাগল’ বা ‘সংগ্রাম করা’ বুঝানো হলেও ইসলাম উত্তর ‘জিহাদ’ শব্দ দ্বারা স্রেফ আল্লাহর রাস্তায় সশস্ত্র যুদ্ধ করাকে বুঝায়। এযুগের ইসলামপন্থিদের কোনো মতধারা যদি বর্তমানকালে ‘জিহাদ’ শব্দ দ্বারা ‘স্ট্রাগল এগেইন্সট্‌ নফ্‌স্‌’ বা ‘আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম’ বুঝানোর চেষ্টা করে, তবে তা সম্পূর্ণরূপে ভুল। কোরানে ‘জিহাদ’ বলতে কেবল আল্লাহর রাস্তায় সশস্ত্র যুদ্ধ করাকেই বুঝানো হয়েছে এবং এ যুগের মুসলমানদেরও সর্বোতভাবে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করা উচিত।
৩) রাসুল (সঃ) মাদানী জীবনে নিজে ১৯ টা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন (গাজওয়া) এবং সাহাবীদেরকে ৫৫ টারও বেশী সশস্ত্র অভিযানে পাঠিয়েছেন (সারিইয়া)। সে হিসেবে রাসুলের (সঃ) মাদানী জীবনের ১০ বছরে মুসলিমরা ৭০ টার অধিক যুদ্ধ করেছে যা বছরে গড়ে ৭ টার মত যুদ্ধ। প্রতিবছর গড়ে ৭ টা করে যুদ্ধ করলে যুদ্ধের পরিকল্পনা, অর্থায়ন, আয়োজন, যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহন ও প্রত্যাবর্তনকে ধর্তব্যের মধ্যে নিলে বলতে গেলে পুরো বছরই লেগে যায়। সে হিসেবে ইসলামিক স্টেট গঠন উত্তর রাসুলের (সঃ) জীবদ্দশায় মুসলিমদের মাদানী জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে মূলত কুফ্‌ফারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করে এবং সব যুগের মুসলমানদের জন্যেই আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করার গুরুত্ব অপরিসীম।
৪) মদিনাতে রাসুল (সঃ) মুসলমানদের নিয়ে ফেইথ-বেজড্‌ স্টেট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতি ও বর্ণের উর্ধ্বে উঠে। বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ম্যাপ দেখলে বুঝা যায় এগুলো মদ্যপায়ী ঔপনিবেশিকদের অবজ্ঞাপূর্ণ আঁকা-আঁকির ফল। ইসলামে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের কনসেপ্ট থাকলেও জাতিভেদের ধারনা নেই। কাজেই মুসলমানদের ভেতর আলাদা আলাদা জাতিভেদ কিম্বা রাষ্ট্র থাকা উচিত নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা থাকবে ঐক্যবদ্ধ ইসলামী খেলাফতের আন্ডারে। এবং সেটা হলে ইসলাম পুনরায় বিজয়ী হবে।
৫) অবিশ্বাসী যুদ্ধবন্দীদের কাউকে কাউকে রাসুল (সঃ) নিঃশর্তে মুক্তি দিয়েছেন, কাউকে কাউকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দিয়েছেন এবং ইসলামের শত্রুদের কাউকে কাউকে তার নির্দেশে এক্সিকিউটও করা হয়েছে। অমুসলিম বন্দীদেরকে টৃট করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিজস্ব শরিয়া আইন রয়েছে এবং জেনেভা কনভেনশন বা অনুরূপ কোনো আন্তর্জাতিক আইন-কানুন মুসলমানদের জন্যে মানা জরুরী নয়।
৬) মদিনার বনু নাযির গোত্রের ইহুদীরা রাসুলের (সঃ) বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে আত্মরক্ষার জন্যে যেভাবে দূর্গের ভেতরে অবস্থান নিয়েছিল, আজকের ইসরায়েলী ইহুদীরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মাঝে দেয়াল তুলে সেভাবেই যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করছে। মুসলিম সমর্থিত বর্তমান ইসলামী ‘ইন্তিফাদা’র (প্রতিরোধী শক্তির) নির্ভিক সন্তানদের সম্মুখ সমরের মোকাবেলায় কুফ্‌ফারদের এহেন সুরক্ষিত দেয়ালের পেছন থেকে কিম্বা প্লেনের ককপিটে বা নৌযানের গর্ভে বসে আক্রমন চালানোর কৌশল এটাই প্রমান করে যে, মুসলিমভীতি এযুগের কুফ্‌ফারদের হৃদয়কেও আচ্ছাদন করে রেখেছে।
৭) ওহুদের যুদ্ধের আগে আবু সুফিয়ান আনসারদের কাছে মেসেজ পাঠিয়েছিল এই বলে যে, তাদের যুদ্ধ মক্কা থেকে হিজরত করে আসা মুহাজিরদের বিরুদ্ধে, মদীনার আনসারদের বিরুদ্ধে নয়; কাজেই আনসাররা যেন যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে। অথচ মুহাজিরদেরকে মদীনাবাসী শুরুতে আশ্রয় দিলে মক্কার এই কুফ্‌ফাররাই আনসারদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে হত্যা করার হুমকী দিয়েছিল। বলাবাহুল্য, মুসলমানদের ভেতর বিভক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তারা একথা বলেছিল যেন মুহাজিরদেরকে প্রথমে নিঃশেষ করার পর পরবর্তীতে তারা আনসারদেরকে নিঃশেষ করতে পারে। সেদিনের কুফ্‌ফারদের সাথে আজকের কুফ্‌ফারদের কোনো পার্থক্য নেই। এযুগের কুফ্‌ফাররা বলছে তাদের যুদ্ধ শুধুমাত্র মুসলিম টেররিষ্টদের বিরুদ্ধে, শান্তিকামী সাধারন মুসলিমদের বিরুদ্ধে নয়। বলাবাহুল্য, তথাকথিত মুসলিম টেররিষ্টদেরকে নির্মূল করার পর কুফ্‌ফাররা যে পুরো মুসলিম উম্মাহকেই নির্মূল করতে সচেষ্ট হবে সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

এ তালিকাকে পাতার পর পাতা লম্বা করা যাবে। তবে প্রবন্ধের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে তা করা থেকে বিরত থাকছি। একথা সত্যি যে, রাসুলের (সঃ) মক্কী জীবনের ওপর আওলাকির লেকচারকে আমার কাছে ওভারঅল “one of the most eloquent” ন্যারেশন বলে মনে হলেও রাসুলের (সঃ) মাদানী জীবনের ওপর আওলাকির লেকচারকে (যা মূলত ইসলামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ইন্টারপ্রিটেশন) “one of the most ill-conceived, hate-filled and grossly provoking” ন্যারেশন বলে মনে হয়েছে। কেননা, রাসুলের (সঃ) মাদানী জীবনের ঘটনাসমুহের বর্তমান উপযোগিতাকে (তথা শরিয়াকে) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নিদারুনভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ, সহিংসতা ও নৃশংসতাকে উৎসাহিত করেছেন।

যাহোক, আওলাকির এহেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল (তথা উগ্র কঞ্জারভেটিভ) মতধারার বিপরীতে এ সমস্ত বিষয়ে ‘লিবারাল স্কুল অব থট’-এর ওলামাদের মতধারা কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ক্রমানুসারে তুলে ধরছি আমি:
১) গত ২০ বছর ধরে তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ততার কারনে সুরা বুরূজের তাফসীরে বর্ণিত উক্ত বিশ্বাসী যুবকের ঘটনা অন্তত কয়েক শ’ বার শুনেছি আমি তাবলীগের বিভিন্ন বয়ানে। তাবলীগপন্থিদের অভিমতে এটা হলো ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাস্তায় নিজের পুরো জীবন ব্যয় করা। বিশের দশকের প্রথম ভাগে (১৯২০ সাল পরবর্তী) ভারতের দেওবন্দের মওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধল্‌ভী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে শত শত ওলামা রয়েছেন যারা উক্ত ঘটনার এই লিবারাল ব্যাখ্যা গ্রহন করেছেন এবং তা প্রচারও করছেন।
২) তাবলীগপন্থি সহ বর্তমানকালের ওলামাদের অনেকেই ‘জিহাদ’ শব্দ দ্বারা মূলত এ যুগের মুসলমানদের জন্যে ‘স্ট্রাগল এগেইন্সট্‌ নফ্‌স্‌’ বা ‘আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম’ বুঝিয়ে থাকেন, আল্লাহর রাস্তায় তথাকথিত সশস্ত্র জিহাদ করাকে নয়।
৩) রাসুলের (সঃ) ১০ বছরের মাদানী জীবনে আল্লাহর রাস্তায় ৭০ টার অধিক জামাত পাঠানোর তথ্য গত ২০ বছরে তাবলীগ জামাতের বিভিন্ন বয়ানে অন্তত কয়েক শ’ বার শুনেছি আমি। বলাবাহুল্য, তৎকালীন জিহাদে গমন বা প্রেরণকে তাবলীগপন্থিরা বর্তমানের আলোকে আল্লাহর রাস্তায় গমন বা প্রেরণ বলে থাকেন। এছাড়া হুদাইবিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্যে কেন বিজয় ছিল সেটার ব্যাখ্যায় অসংখ্য ওলামাকে আমি বলতে শুনেছি যে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রাসুলের (সঃ) ওপর চাপিয়ে দেয়া এসব যুদ্ধের কারনে তিনি ইসলাম প্রচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির কারনে যুদ্ধ বন্ধ থাকায় তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান। যা আওলাকির ব্যাখ্যার সাথে পুরোপুরিই কনট্রাডিক্টিং।
৪) বর্তমানকালের রাষ্ট্র ও জাতিভেদের উর্ধ্বে উঠে ‘প্যান-ইসলামিজম’-এর ব্যানারে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরকে একক ইসলামী খেলাফতের আন্ডারে আনার ও ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মনোভাব পোষনকারী প্রয়াত ওসামা বিন লাদেন ও আনোয়ার আওলাকি উভয়ই তাদের দীক্ষাগুরু হিসেবে প্রখ্যাত ঈজিপশিয়ান স্কলার সৈয়দ কুতুবের কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের উপমহাদেশের অনেক ওলামা মওলানা মওদুদীকে সৈয়দ কুতুবের উপমহাদেশীয় ভার্শন বলে চিত্রিত করে থাকেন। মওলানা মওদুদীর মতবাদ লালনকারী তৎকালীন জামাতে ইসলামের অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার পেছনে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার কনসেপ্টকে কারন হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করে থাকেন। বর্তমান বিশ্ব-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘রাষ্ট্র’ ও ‘জাতীয়তা’র কনসেপ্ট যেখানে সমাজবিজ্ঞান ও পৌরবিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং যে কারনে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ আজ মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, সেখানে আওলাকির গোটা মুসলিমবিশ্বের জন্যে আধূনিক রাষ্ট্রবিহীন একক ইসলামী খেলাফতের কনসেপ্ট কতখানি বাস্তবতাবিবর্জিত তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখেনা।
৫) বন্দীদেরকে টৃট করার ক্ষেত্রে গায়ের জোরে জেনেভা কনভেনশনের নীতিসমুহ ভঙ্গ করা এক কথা (যেমনটা ইসরায়েলীরা করছে ফিলিস্তিনী বন্দীদের ক্ষেত্রে কিম্বা আমেরিকা করছে মুসলিম সন্ত্রাসী সন্দেহে আটককৃত বন্দীদের ক্ষেত্রে) আর সর্বস্বীকৃত অধূনা আন্তর্জাতিক নীতিমালার বিরুদ্ধে কোনো একটা সুনির্দিষ্ট ধর্মের মধ্যযুগীয় ধর্মীয় আইনকে পাবলিক্‌লি টেনে এনে দাঁড় করানো আরেক কথা। আওলাকির মত উগ্রপন্থি ওলামাদের ফতোয়ায় প্ররোচিত হয়ে মুসলিম সন্ত্রাসীরা অমুসলিম জিম্মিদের শিরোচ্ছেদ করে সেসবের ভিডিও প্রচার করছে যা বিশ্বব্যাপী ইসলামের ভাবমূর্তিকে নিদারুনভাবে ক্ষুণ্ণ করছে।
৬) আওলাকির এহেন বক্তব্য যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ বা শান্তি আলোচনার পরিবর্তে পারষ্পরিক ধর্মভিত্তিক সংঘাত চালিয়ে যাওয়ার প্রতি সরাসরি উৎসাহ ও ইন্ধন প্রদানকারী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনীদেরকে সমর্থন করি এবং একইসাথে ইসরায়েলীদের অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনী ভূখন্ড দখল করে রাখার বিরোধীতা করি মূলত ন্যায়-অন্যায় বোধের কারনে; ফিলিস্তিনীরা ইসলামী ‘ইন্তিফাদা’ শক্তি আর ইসরায়েলীরা কুফ্‌ফার বলে নয়। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতি আমার সহানুভূতি এখানে সেকেন্ডারী ফ্যাক্টর হলেও ন্যায়-অন্যায় বোধ প্রাইমারী ফ্যাক্টর। আমার ধারনা, মুসলিমবিশ্বের ওভারঅল মনোভাব সম্ভবত সেটাই। তা না হলে ফিলিস্তিনী ভূখন্ড মুক্তির সামাজিক আন্দোলনে ইউরোপসহ বিশ্বের হাজার হাজার অমুসলিম (কুফ্‌ফার) মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামিল হতেননা।
৭) বলাবাহুল্য, আওলাকি এ বক্তব্যের মাধ্যমে যে মুসলিম সন্ত্রাসীদের সবিশেষ মিশনের পেছনে বিশ্বব্যাপী সকল মুসলমানদের সমর্থনকে আহ্ববান করেছেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অথচ, ধর্মীয় সন্ত্রাসকে নিন্দনীয় কাজ ও অনৈসলামিক বলে অভিমত দিয়েছেন এ যুগেরই অসংখ্য ওলামা।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এটুকু বলে রাখা প্রয়োজন যে, ওপরোক্ত বিষয়গুলোতে তাবলীগপন্থিদের ইন্টারপ্রিটেশনকে আমি কিন্তু সরাসরি ‘সঠিক’ বলছিনা কিম্বা প্রমোট করারও চেষ্টা করছিনা যেহেতু আমি নিজে তাবলীগপন্থি। আমি শুধু ‘লিবারাল স্কুল অব থট’ ও লিবারাল ইন্টারপ্রিটেশনের অস্তিত্বের প্রতি দিক নির্দেশন করছি।

যাহোক, ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু বলা যায় যে, ইসলামী শরিয়ার রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকে যেমন উগ্র ও সহিংস দিকে টেনে নিয়ে গেছেন কেউ কেউ বা কোনো কোনো মতধারা, তেমনি করে যুগপোযোগি বুদ্ধিবৃত্তিক ও লিবারাল দিকে টেনে নিয়ে গেছেন অন্যরা। যেহেতু রাজনীতিকে ইসলাম থেকে সাধারনভাবে কখনও পৃথক করা হয়নি, কাজেই সম্ভবত উভয় ধরনের ব্যাখ্যা নিয়েই মুসলমানদেরকে বাস করতে হবে। সেক্যুলার শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এ যুগের মুসলমানদেরকে অনেকখানি এগিয়ে নিলেও ইসলামী শরিয়ার রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় উগ্র, বিদ্বেষপূর্ণ ও সহিংস দৃষ্টিভঙ্গী পোষন করা থেকে যে উল্লেখযোগ্যভাবে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি তার প্রমান আমার হজ্জ্ব সংগীদের একাংশ, যারা বুয়েটের মত উঁচু মানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ করে এবং আমেরিকার মত উন্নত ও ধর্মীয় উদারতার দেশে বাস করেও আওলাকির মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইসলামী শরিয়াকে দেখেন। আশার কথা, পশ্চিমাবিশ্বে বসবাসকারী অসংখ্য ওলামা সম্প্রতি জুম’আর খুতবাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে ইসলামী শরিয়ার উদ্দেশ্য ও বর্তমান উপযোগিতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছেন এবং শরিয়া যে অনেকাংশেই আল্লাহর ইবাদত ও একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন-যাপন সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধি-বিধান, সে ধরনের অভিমত দিতে শুরু করেছেন। যেহেতু ওলামারাই ইসলামী চিন্তা-চেতনার আধার, সম্ভবত তারাই পারবেন রাজনীতি সংক্রান্ত ইসলামী শরিয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের উগ্র ও সহিংস মনোভাব পোষনকারী ক্ষুদ্রাংশের কিম্বা তাদের মৌন সমর্থনকারীদের দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন আনতে।।

রচনাকালঃ আগষ্ট, ২০১২

১,২৯৩ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “উদারতা বনাম রক্ষণশীলতা- ধর্মীয় প্রেক্ষাপট”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আবিদ ভাই,

    অসাধারণ! :boss: :boss:

    ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে এমন বিশ্লেষণ সম্প্রতি আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

    সেক্যুলার শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এ যুগের মুসলমানদেরকে অনেকখানি এগিয়ে নিলেও ইসলামী শরিয়ার রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় উগ্র, বিদ্বেষপূর্ণ ও সহিংস দৃষ্টিভঙ্গী পোষন করা থেকে যে উল্লেখযোগ্যভাবে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি তার প্রমান আমার হজ্জ্ব সংগীদের একাংশ, যারা বুয়েটের মত উঁচু মানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষালাভ করে এবং আমেরিকার মত উন্নত ও ধর্মীয় উদারতার দেশে বাস করেও আওলাকির মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইসলামী শরিয়াকে দেখেন।

    শিক্ষাকে সেক্যুলার করতে গিয়ে পাঠ্যসূচী থেকে ধর্মকে বাদ দিলে এ'ছাড়া আর কি ফল আসবে? আমার মতে, ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক সব সময় আলোচনায় থাকা দরকার, এবং বাস্তব প্রেক্ষিতে এর পরিমার্জনও দরকার।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বিশাল লেখা ভাইয়া।
    আর ইউ কে তেও একই অবস্থা।
    অভিবাসীরা ৯৯ শতাংশ লেবারকে সাপোর্ট করে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন একটা লেখা আবিদ ভাই, নতুন ভাবে অনেক কিছু জানা হলো। আশা করি আপনার কাছ থেকে এ ধরনের লেখা আরো পাবো। :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আব্দুর রহমান আবিদ (৮০-৮৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।