কোথায় পাবো এমন মানুষ!

বেনজির আহমেদ

বেনজির আহমেদ

দিনটা এমনভাবে শুরু হবে ভাবিনি। মোবাইল নিঃশব্দ করে ঘুমাই। আজ জেগে উঠেই দুঃসংবাদ নিয়ে আসা সুকান্ত গুপ্ত অলকের ক্ষুদে বার্তাটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বেনজির ভাই নেই! মুহূর্তের জন্যও কিছুতেই বাস্তবটা মাথা থেকে সরাতে পারছি না, বেনজির আহমেদ আসলেই আর নেই।

প্রথম পরিচয় কবে? মনে নেই। রাজনীতি করতেন না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি’র (সিপিবি) সবার সঙ্গে ঘণিষ্ট ছিলেন। আশির দশকে সচিত্র সন্ধানী অথবা একতা’র সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল। তারপর মানুষটার অনেক কাছাকাছি থাকার সুযোগ এসেছে বহুবার। ‘মুলধারা’র সঙ্গে আমাকে যুক্ত করেন তিনি। কাভার স্টোরি করার দায়িত্ব দিতেন। কিন্তু খুব কাছাকাছি আসার সুযোগ এলো আরো পরে।

১৯৯২-এর সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ভোরের কাগজ বেরিয়েছে ৬ মাস হলো। আর্থিক কারণে মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান) আর চালাতে পারছিলেন না। সাবের হোসেন চৌধুরী অর্থায়নে এগিয়ে এলেন। এ সময় ভোরের কাগজের কিছু নেতৃস্থানীয় কর্মীর সঙ্গে সমস্যা চলছিল। তাদের বিদায় করে সাবের ভাই পত্রিকার দায়িত্ব নেবেন। নির্দিষ্ট দিন টাকা লেনদেন করে কাগজপত্র সইসাবুদ করে তাদের চলে যাওয়ার কথা। আমি তখন সংবাদ-এ কাজ করি। দুপুরের পর ভোরের কাগজের শাহবাগের অফিসে গিয়ে হতবাক! অফিসের বাইরে রাজ্যের মানুষের ভিড়। ঠেলে ঢুকতেই দেখি একদল বাইরের লোক মতি ভাইকে অফিসের একটি কক্ষে আটকে রেখেছে। কাছে গেলাম। মতি ভাই বললেন, ওরা টাকা নিয়েছে। এখন সই করা কাগজ ফেরত চাইছে। বেনজিরকে পরিস্থিতি জানাও। জানলাম, বাংলাদেশের সংবাদপত্রে তথাকথিত ‘নতুনধারা’র প্রবর্তক এই ব্যক্তি টাকা নিয়ে বিদায়ের কাগজে সই করে সেটা ফেরত চাইছে! কারণ পত্রিকাটি তার দখল নিতে হবে।

ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আমাকে বেরুতে দিচ্ছিল না। তারপরও জোর করে বেরিয়ে এলাম। সোজা পল্টনে সচিত্র সন্ধানী অফিসে গিয়ে বেনজির ভাইকে সব জানালাম। সন্ধ্যার পর পুলিশ গিয়ে মতি ভাইকে উদ্ধার করে। সেদিন থেকে ভোরের কাগজের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। পরের ৬ মাস সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে মতি ভাই, বেনজির ভাইকে নিয়ে থানা-পুলিশ, আইনজীবীর চেম্বার আর আদালত দৌড়াদৌড়িতে কেটে গেল।

আস্তে আস্তে সব ঠিকঠাক হয়ে এলো। বেনজির ভাই ভোরের কাগজের ব্যাবস্থাপনা সম্পাদক। মতি ভাইয়ের চেয়ে উনার সঙ্গেই ঘণিষ্টতা বেশি গড়ে উঠে। সুখ-দুঃখের সব কথা তারই সাথে। মতি ভাইকে যা বলতে সাহস পাই না, বলি বেনজির ভাইকে। তিনি হয়ে উঠলেন ভোরের কাগজের ঘাত – প্রশমক বা ‘শক এবজরভার’। শুধু আমাদের সঙ্গে মতি ভাইয়ের নন, সাবের ভাই আর মতি ভাইয়ের মাঝেও তিনি এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

অসাধারণ মানুষ একজন। রুচি, পড়াশুনা, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক সব কিছুতেই। সব বিষয়েই কথা বলা যেত তার সঙ্গে। পরিবার, অফিস, রাজনীতি, সাহিত্য-সাংবাদিকতা সব। বড় ভাই হয়েও সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছিল তারই উদারতায়। সব কাজে উৎসাহ দেয়ার দারুণ মন ছিল তার।

১৯৯৮ সালে কাজের ক্ষেত্রে মতি ভাই আর বেনজির ভাইয়ের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার একটা খারাপ সময় এলো। সাবের ভাইয়ের সঙ্গে পত্রিকার নীতি-পরিচালনা নিয়ে মতি ভাইয়ের বনিবনা হচ্ছিল না। মতি ভাই ‘প্রথম আলো’ বের করবেন। মঞ্জু (মোজাম্মেল হোসেন) ভাই আর আমি সেটাও বেনজির ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। বললাম, সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছি। ভোরের কাগজে সেটা খুব বেশিদূর হবে না। বেনজির ভাই মানা করলেন না। অনিশ্চিত তিনি নিজেও। জানতেন, মতি ভাই এবং তার সঙ্গে সাংবাদিক-কর্মীদের একটা বড় চলে গেলে তাকেই সব ধকল সামাল দিতে হবে। তিনি বুঝেছিলেন, এ অবস্থায় তারও তেমন কিছু করার নেই।

পরে যখন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; বেনজির ভাই বলতেন তিনি একটা স্বস্তি, শান্তির জীবন চান। মিডিয়া থেকে অবসর চান। সে অবসর তিনি নিয়েছিলেন।

মিডিযায় কাজ করেও তিনি ছিলেন নেপথ্যের মানুষ, সবসময়। সারাজীবন বললেও ভুল হবে না। সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক সবার সঙ্গে ঘণিষ্টতা ছিল তার। সব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল প্রবল। অথচ ভীষণ বিনয়ী, সরল। পরিমিতি বোধ তাকে করেছিল আরো পরিশীলিত। এমন একজন মানুষ আর কোখায় পাবো্, বলতে পারেন কেউ!

যেখানেই থাকুন, অনেক ভালো থাকুন বেনজির ভাই। যে জীবনে কোনো সংকট থাকবে না, যে জীবন হবে নির্ভার-নির্ভাবনার; সেখানে নিশ্চয়ই একদিন আমরা মিলিত হবো। সেই জীবনে আবার আপনার সঙ্গে আড্ডায় বসতে চাই। আমাদের গল্প কোনোদিন ফুরোবে না।

সাংবাদিক বেনজির আহমেদ আর নেই

৭ টি মন্তব্য : “কোথায় পাবো এমন মানুষ!”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এমন শ্রদ্ধেয় মানুষের গল্পগুলো আমরা সবসময় মারা যাবার পর জানতে পারি। তার বিনয়ের গল্প, সংগ্রামের গল্প গুলো আগে থেকেইজানা থাকলে আমরা উপলধ্বি করতে পারতাম কি হারাচ্ছি আমরা।

    যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন...


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মাহমুদুলের কথাগুলো আমারো কথা।
    বেনজির আহমেদকে নিয়ে আরো লিখুন সানাভাই।
    বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আপনার প্রজন্মের কিছু কথা শেয়ার করেন না প্লিজ!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।