সাংবাদিকতা: টানটান উত্তেজনার যেই জীবন

সাংবাদিকতার বিষয়টি কিভাবে প্রথম মাথায় এসেছিল মনে করতে পারছি না। আমার পরিবার বা ঘণিষ্টজনদের মধ্যে এ পেশায় কেউ তখনো ছিলেন না। এইচএসসি পাশের পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হলাম, প্রায় একই সাথে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতাও শুরু করেছিলাম। কেউ সে সময় শেখায়নি। সৃজনশীল লেখালেখি করতাম ক্যাডেট কলেজে থাকতে আর সংবাদপত্র পাঠের আগ্রহ ছিল ভীষণ। ফলে সংবাদ লেখার ভাষাটা পাঠ থেকেই রপ্ত করেছিলাম।

তবে এটা স্পষ্ট মনে করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দুটো বিভাগে চেষ্টা করেছিলাম। অর্থনীতি এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। দুটোতেই টিকেছিলাম। নিজের আগ্রহ ছিল সাংবাদিকতায়। কিন্তু বাবা কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তাই তাকে সন্তুষ্ট করতে ভর্তি হয়েছিলাম অর্থনীতিতে।

সচিত্র সন্ধানী, রোববার, ছুটি- এরকম সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখতে লিখতে শুরু হয়েছিল। আর একাধিক দৈনিক পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতায় সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে লিখে পোস্ট করে দিতাম। পত্রিকাগুলোর সম্ভবত লেখার অভাব ছিল। তারাও সেসব ছাপতো! এভাবেই সাংবাদিকতায় সাহস আসে নিজের মধ্যে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম শুরু থেকেই। ১৯৮৩ সালে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। আর দু’বছর পড়ে আমিও অর্থনীতি ছেড়ে দিলাম। পাস কোর্সে ডিগ্রি দিয়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। এবারও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর সাংবাদিকতায় তখন এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছি যে, ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েও সাংবাদিকতা পড়তে গেলাম না! না পড়েই দ্বিতীয় বিভাগ পাবো নিজের উপর এমন আস্থায় গেলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।

বাবা চাননি আমি সাংবাদিকতা করি। কিন্তু আমি ততোদিনে রাজনীতি আর সাংবাদিকতায় নিজের ভবিষ্যত ঠিক করে ফেলেছিলাম। সাপ্তাহিক একতায় কন্ট্রিবিউট করি নিয়মিত, সন্ধানী বা আরো সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাভার স্টোরি করি। এমন চলতে চলতে পেশাদার হিসাবে মাসে ১২শ টাকা বেতনে ঢুকে পড়লাম একতা’য়। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি। অন্য কোনো পেশার কথা কখনো ভাবিনি।

‘পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তে’র ঝড়ে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়লো সোভিয়েত ইউনিয়নে। প্রভাব পড়লো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেও। একতা সম্পাদক মতিউর রহমান পার্টি এবং পত্রিকা দুটোই ছাড়ছেন। আমিও সে সময় কমিউনিস্ট রাজনীতিকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে রিপোর্টার হিসাবে যোগ দিলাম দৈনিক সংবাদ-এ। মতি ভাই ‘ভোরের কাগজ’ করলেন। পত্রিকটি করার ৬ মাসের মাথায় সংকট এলো বড়োসড়ো। মতি ভাই চাইলেন তার সঙ্গে দাঁড়াই। একরকম লুকিয়ে ছাড়লাম সংবাদ, ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দিলাম ভোরের কাগজ-এ।

১৯৯৮ সালে মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বের করলাম প্রথম আলো। ৩ বছরের মধ্যে প্রথম আলো সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হলো। ৫ বছরে হলো ব্যবসা সফল। আমিও বিজনেস এডিটর থেকে সিটি এডিটর হয়ে নিউজ এডিটরের দায়িত্ব নিলাম। ২০০৭ সালের মার্চে যখন প্রথম আলো ছাড়ি, তখন চিফ নিউজ এডিটর। সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে আনন্দ, উত্তেজনা উপভোগ করেছি প্রথম আলোতে।

পরের ৩ মাস নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে ছিলাম দৈনিক সমকাল-এ। এ সময় হাতে এলো নতুন চ্যালেঞ্জ। ২৪ ঘণ্টার নিউজ টিভি চ্যানেলের বিষয়ে আমার আগ্রহের কথা জানতেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ট্রান্সকম গ্রুপ চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। তারা বললেন, টিভি তো নেই। এফএম রেডিও করবেন? টিভি বা রেডিও কোনোটারই কিছু তখন জানতাম না। আর রেডিওতে যেহেতু সংবাদ প্রাধান্য থাকবে, তাই রাজি হয়ে গেলাম।
এরপর গত সাড়ে ৬ বছরে নানা ভুল-ত্রুটি থেকে শিখলাম। শেষ একবছরে সংবাদের গুরুত্ব কমিয়ে বিনোদনে প্রাধান্য দিয়ে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় এফএম স্টেশন এবিসি রেডিও।

ফ্রিল্যান্স থেকে পেশাদার, প্রায় ৩০ বছরের শেষ দু’বছর বাদ দিলে আমার জীবনে ধ্যান-জ্ঞান, ভালোবাসা, নেশা সবটাই সংবাদ নিয়ে। রেডিও আমাকে বিনোদন জগত নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি, নিয়েছিও। রেডিও আমাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে।

পেশাগত জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার বলতে দ্বিধা নেই, সংবাদ-তথ্য, এর বিশ্লেষন আমার প্রথম ভালোবাসা। বাসায় এখনো ৭/৮টি সংবাদপত্র পড়ি, দেশের-বাইরের নিউজ চ্যানেলগুলো আমার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। চেতনে অবচেতনে এখনো সংবাদ-সাংবাদিকতা আমায় ভীষণভাবে টানে। টানটান উত্তেজনার সেই জীবনটা ভীষণ মিস করি।

অক্টোবর ৩০, ২০১৩

১১ টি মন্তব্য : “সাংবাদিকতা: টানটান উত্তেজনার যেই জীবন”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাদের দেশে বাপ-মা এর স্বপ্ন/ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে কত ছেলে-মেয়েদের অপছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে হয়- তার হিসেব নেই!

    যাই হোক, আপনার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের জন্য অভিনন্দন! :clap:

    আজীবন এরকম উচ্ছ্বল, সজীব এবং আমাদের প্রেরণা উৎস হয়ে থাকুন... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. জিয়া নূরনবী (২০০২-২০০৮)

    কলেজ থেকে ইচ্ছা ছিল সাংবাদিকতা কিংবা বাঙলা সাহিত্য নিয়ে পড়বো। মা-বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে হয়ে ওঠে নাই। আপনার কাহিনী অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।


    ব্জলে উঠুক বারুদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (২০০৫-২০১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।