ওরা এগারো জন

এগার জনের দলে আগে থেকে চিনতাম একমাত্র মিনহাজকে। ফৌজদারহাটে আমাদের জুনিয়র। ঢাকায় আমেরিকান সেন্টার এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে আমাদের কয়েক দফা ওরিয়েন্টেশন হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক। টিকেট চলে এসেছে। কোন হোটেলে আমরা থাকবো তার ওয়েবসাইটও মেইল খুলে দেখে নিয়েছি। সুইমিংপুল আছে, আছে জিমনেশিয়াম, রুমে ইন্টারনেট। বিশাল হোটেল, তার চেয়েও বিশাল এলাকা জুড়ে। দেখতেও চমৎকার। নানা ধরণের জরিপ সফলভাবেই পূরণ করেছি। ভিসার আবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে সময়মতো। সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ জেনে সময়মতো সেখানে হাজির হলাম। সমস্যা দেখা দিল এখানে এসেই।

সাক্ষাৎকারের পর ভিসা অফিসার একটি ফরমে আমার নাম ও নম্বর লিখে পাসপোর্টটি ফেরত দিয়ে বললো, তোমার বিষয়ে আরো কিছু তথ্যের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। তুমি ওয়েবসাইটে গিয়ে এই নম্বরটি নিয়মিত নজর রাখবে। সেখানেই আপডেট জানবে। বেরিয়ে এসে সহযাত্রী এবং আমেরিকান সেন্টারে আমাদের কর্মসূচির তত্ত্বাবধানকারী পারভীন আপাকে ‘ধরা খাওয়া’র দুঃসংবাদটি জানালাম। এগারো জনের দলে আমাকে নিয়ে দুজনকে ঝুঁলিয়ে দিয়েছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভিসা অফিস। তাই ভ্রমণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিল।

অফিস ও বাসায় মুখ গম্ভীর করে অগ্রগতি জানালাম। আমেরিকান সেন্টারের পারভীন আপা অবশ্য আগেই বলেছিলেন, ভিসা নিয়ে এরকম সমস্যা হতে পারে। তবে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। এমনও হতে পারে যেদিন ফ্লাইট, সেদিনই ভিসা হবে। তখন ভিসা হাতেই বিমানবন্দরে দৌঁড়ুতে হবে। আবার টিম চলে যাওয়ার পর ভিসা হলে তখন ফ্লাইট সময়সূচি তারা পরিবর্তন করে দেবে। এমন সব আশ্বাসের পরও ভিসা নিয়ে অনিশ্চয়তায় মন ভরে না। অফিসে সবাই জানে আমি যাচ্ছি, আবার তাদের নিশ্চিত করেও বলতে পারছি না যে যাচ্ছিই……

কর্মসূচিটা ৫ সপ্তাহের। দীর্ঘসময়। আমি আরো এক সপ্তাহ নিজের জন্য রেখে আগেই ফেরার তারিখ ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু এই অনিশ্চয়তায় যুক্তরাষ্ট্রে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বা পরিচিত কাউকে জানাতে পারছিলাম না। আমেরিকান সেন্টার থেকে খোঁজখবর নিচ্ছে। আমাদের কর্মসূচির পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকেও জানানো হয়েছে। ওরা বলছে, তৈরি হয়ে থাকেন। কিন্তু তারপরও মনের সংশয় তো কাটে না।

দেখতে দেখতে ৩০ মার্চ এসে যাচ্ছে। এখনো দূতাবাসের ভিসা অফিস থেকে কিছু জানানো হয়নি। ২৮ তারিখ পার হতে চলেছে, ৪৮ ঘণ্টাও হাতে নেই। সন্ধ্যার পর পারভীন আপার ফোন। বললেন, কাল সকাল ১০টায় দূতাবাসে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দেবেন। ঠিক ১০টায়। আমি ওয়েবসাইটে গিয়ে ট্রেকিং নম্বর দেখি, সেখানে কোনো আপডেট নেই! তাহলে! যোগাযোগ হলো আমার মতোই আরেক ঝুঁলে থাকা সোহাগের সঙ্গে। ও জানালো, তাকেও সকাল ১০টায় যেতে বলা হয়েছে।

২৯ মার্চ সকাল ১০টার কিছু আগেই ভিসা শাখায় দুজনে পৌঁছে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ডাকা হলো। এবার একজন বাঙালি কর্মকর্তা এলেন। পাসপোর্ট দুটো নিয়ে তিনি বললেন, ‘স্যার আপনারা কি এখানে অপেক্ষা করবেন, নাকি একটু ঘুরে ০১টার দিকে আসবেন?’ আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা ঘুরে আসি।

সোহাগ আর আমি বেরিয়ে গেলাম, গুলশান মার্কেটে। কিছু জরুরি কেনাকাটা দরকার। সেসব সেরে দূতাবাসে ০১টার আগেই পৌঁছে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ডাক পেলাম। ওই কর্মকর্তা রাবার ব্যান্ডে বাধা পাসপোর্ট দুটো দিয়ে বললেন, ‘স্যার ঘণ্টা দুয়েক পর খুলবেন, স্টিকার এখনেো ভেজা আছে।’ দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে গেলো। নতুন দুশ্চিন্তা নাকি স্বস্তির, নিজেও জানি না! শেষ পর্যন্ত যাচ্ছি!

দুশ্চিন্তার কারণ, প্রস্তুতি তো কিছুই নিইনি। অফিসে অনেক কাজ জমে আছে। সেসব গুছাতে হবে। কাজ ভাগ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে। ওষুধ কিনতে হবে। ডলার লাগবে। দেড় মাস থাকবো না। পরিবারেও প্রস্তুতি দরকার। বাসায় বাজার-টাজার সব ঠিকঠাক আছে তো? অফিস সেরে বেরুলাম রাত সাড়ে ১২টায়। ততক্ষণে ৩০ মার্চ এসে গেছে। সকাল সাড়ে ১০টায় যে ফ্লাইট!

[দেশে ফেরার আগে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিয়ে লেখার তাগিদ দিয়েছিলেন সাইফ শহীদ ভাই। ঢাকায় ফিরেও সিসিবির কামরুল, জিহাদ, সামিয়া থেকে শুরু করে সামীউর একই কথা শুনিয়েছে, লিখতে হবে। এমনকি যুক্তরাজ্য প্রবাসী রায়হান রশীদও বললো, ভাইয়া লিখবেন কিন্তু। লিখবো, লিখবো বলে সবাইকে আশ্বাস দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত অনিশ্চয়তা দিয়েই শুরু হলো এবারের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী। ধারাবাহিকের পরিণতি ভালো হয় না জানি। একটা তো ঝুঁলে আছে এই ব্লগের মতোই। তবু উপায় নেই। সবাইকে স্বাগতম।]

১৪ টি মন্তব্য : “ওরা এগারো জন”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।