রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি কিছু করা যায়?

এসএসসি পরীক্ষার পর কলেজে ফিরে এসেছি। ক্লাস ইলেভেন। দারুণ সময়। পড়াশুনার চাপ নেই, আবার মোস্ট সিনিয়রদের মতো দায়িত্ব নেই। যতোরকম সৃজনশীল বাদরামির জন্য প্রস্তুত। যেন যুদ্ধে নামার শ্রেষ্ঠ সময়। সময়টা ১৯৭৮ সাল।

কিশোর বয়স। হাত-পাগুলো লম্বা হচ্ছে। শরীরটাও। কিন্তু মনটা, মাথাটা! যেন জায়গায় দাঁড়িয়েই দীর্ঘ সময় ধরে ডান-বাম করতে থাকে। ভীষণ স্পর্শকাতর থাকে মনটা। যা দেখে সবই আচ্ছন্ন করে রাখে। মেঘ-বৃষ্টি আর সবুজ-নীল খেলা করে অবিরত। বাগানে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, ক্লাসে-প্রেপে মাঝে-মধ্যে উদাস হয়ে যাওয়া, লাইব্রেরির তাবৎ রোমান্টিক কবিতা আর গল্পের বইগুলো এক নিশ্বাসে শেষ হয়ে যায়।

নাক আর ঠোটের মাঝের অংশে হালকা-সরু কালো লোমগুলো জানান দেয় বয়ঃসন্ধির। লাইট-অফের পর প্রায় সব বন্ধুই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রেজার হাতে নিয়ে হালকা লোমগুলো পরিস্কার করতে করতে ভাবি আহ্‌ এগুলো কবে যে ভারি হবে! কড়া মারের ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম আর চকচকে বুটের সঙ্গে মসৃন গাল- স্মার্ট, বুটেড-ক্লিন শেভড বেস্ট ড্রেসড ক্যাডেট!

নজরুল হাউসের ক্যাপ্টেন ফর্সা সোহেল ভাইয়ের টকটকে গালটা শেভ করার পর রং পাল্টে যেত। কিশোর লালচে গালের ত্বকে সবুজ আভা তাকে যেন বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক যুবকে পরিণত করে ফেলতো মূহুর্তেই। আমাদের সানি, বিটু, ডুমহাম তখন রীতিমতো যুবকে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত শেভ করে। আর বাকিদের একটা অংশের চলে এক তুমুল প্রতিযোগিতা, নিজের গালের সঙ্গেই।

এরই মধ্যে আমাদের রাজার নাকের নিচে বেশ স্পষ্ট কচি গোঁফ সবার নজরে পরে। হ্যা, আমরা তাকে রাজা নামেই ডাকতাম, দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন প্রবাসী কামরুল ওই বয়সেই এই নামটা দিয়েছিল সম্ভবত। কারণ সে চলতো ধীরে, কথা বলতো আস্তে। তবে গলার স্বরটায় অন্যরকম একটা মেজাজ ছিল, এখনো আছে। হয়তো এ কারণেই তাকে এই নিকটি সার্থকভাবে দেয়া হয়েছিল। আজো বন্ধুরা তাকে যখন রাজা নামে ডাকে, ভীষণ মিস্টি একটা হাসি নিশ্চিতভাবেই উপহার পায়। ১৯৭৪ সালে ১৭ আগস্ট ক্লাস সেভেনেও সে আর আমি রুমমেট ছিলাম। ঘণিষ্টতা জন্মেছিল তখন থেকেই।

তো রাজার কচি গোঁফের কথা হচ্ছিল। রবীন্দ্র হাউসে আমরা তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা অব্যহত রেখেছিলাম ওটা ঝেঁড়ে ফেলতে। কিন্তু রাজার এক কথা, সে কামাবে না। আমরা যতোই বলি, তাকে কিছুতেই নাড়ানো যায়না। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না।

বুদ্ধিটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল মনে নেই। ষড়যন্ত্রের সেই শুরু। ফিসফাস-গুজগুজ চলে। এমনই একদিন রাত দশটায় লাইটস অফ হয়। অপেক্ষার সময় যেন কাটে না। কয়েক কিশোর ছাড়া হাউসের কেউ আর জেগে নেই। ক্যাডেটরা ঘুমিয়ে পড়েছে এমন নিশ্চিন্ত হয়ে হাউস মাস্টার, টিউটরও চলে গেছেন।

শুরু হয় অপারেশন। মীরজাফর রুমের মধ্যেই ছিল! নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলে দিলে একে একে সাত-আট কিশোর ঢুকে পরে। অন্ধকারেই রাজার বিছানার চারপাশে জড়ো হয় সবাই। নিশ্চিন্ত হয়, ঘুমে কাদা হয়ে আছে বন্ধুটি। কেউ একজন দাঁড়ায় সুইচবোর্ডে। একজনের হাতে আবার রেজার। সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুমের বাতি জ্বলে ওঠে। ঝাপিয়ে পরে কিশোররা কেউ রাজার হাত, কেউ পা, কেউ মাথা, কেউ মুখ চেপে ধরে। রেজার হাতের কিশোরটি মহাউৎসাহে কাজে নামে। কিন্তু কিসে কি? এত্তোজনে মিলেও ধরে রাখতে পারে না রাজাকে। চিৎকার করে ওঠে রাজা, “আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে………”। হায়, গোঁফ আর কাটা হয়না। অপারেশন ব্যর্থ! বরং রাজার ওই চিৎকার বা হাহাকারে অনেকটা অপরাধীর মতো সব পালিয়ে বাঁচে।

এরপর এক কঠিন সময়। হাউসের কারো সঙ্গে কথা বলে না রাজা। আমরা তার চারপাশে ঘুরঘুর করি, চেষ্টা চলে মান ভাঙ্গানোর। কিন্তু রাজাকে হতে হয় কঠিন হৃদয়ের! বন্ধু বর্জন চলে তার বিপুল বিক্রমে। অন্য হাউসের বন্ধুরা সব জেনে যায়। তবুও তাদের সঙ্গেই রাজার সখ্য আরো বেড়ে যায়!

না রাজা তো রাজাই। শেষ পর্যন্ত কি বন্ধুদের সঙ্গে রাগ করে থাকা চলে? এইচএসসি পরীক্ষার আগে কি পরে আবার আমাদের রাজা আমাদের কাছে ফিরে আসে। সেই পুরনো বন্ধু। যেন ওইরকম একটা বাদরামির ঘটনা আদৌ ঘটেনি। আর আমরা তখন থেকেই আজো ওকে সুযোগ পেলেই ক্ষেপাই, “আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে………..”

আমাদের রাজা, সবুজ হ্যাট মাথায়।

আমাদের রাজা, সবুজ হ্যাট মাথায়।

[এখানেই আছে আমাদের রাজা, সবুজ হ্যাট মাথায়। গত ১৬ জানুয়ারি, ২০০৯ আমাদের ২১তম ব্যাচের এক পারিবারিক পিকনিকের ছবি]

রাজা প্রায়ই এই ব্লগে ঢুকে আমার লেখা পড়ে, প্রশংসা করে। আমি জানি কোন একদিন সে জেনে যাবে তাকে নিয়ে আমার এই লেখাটার কথা। ভীষণ সরল অসাধারণ আমাদের বন্ধুটি পড়বে, হাসবে। তারপর অন্য বন্ধুদের কাছে লিংক পাঠাবে। :hatsoff: বন্ধু।

৩,০৯১ বার দেখা হয়েছে

৪৮ টি মন্তব্য : “রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি কিছু করা যায়?”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    এইচএসসি পরীক্ষার আগে কি পরে আবার আমাদের রাজা আমাদের কাছে ফিরে আসে...

    🙁 🙁 🙁
    তারমানে তো ভাই অনেক দিন রাগ করে ছিলেন... :-B
    উরি বাবা...ইতো রাআআগ... 😕
    (কপিরাইটঃ ঐশ্বরিয়া, দেবদাস ছবি)

    আপনাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক...চিরকাল... :hatsoff:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. শোয়েব (৯৪ - ০০)

    লেখা কিম্বা মন্তব্য কোনটাই না দিয়ে চুপচাপ পড়ে চলে যাওয়ার জন্য রাজা ভাইয়ের ব্যাঞ্চাই।

    'ব্যাঞ্চাই' থেকে বাঁচার জন্য রাজা ভাইকে আনতিবিলম্বে লেখা দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

    জবাব দিন
  3. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    ভাই,
    অসাধারণ লাগসে...রাজা ভাইয়ের সাথে আপনার বন্ধুত্বের মত সব ক্যাডেটের সাথে সব ক্যাডেটের বন্ধুত্ব অমর হোক... :hatsoff:

    পোস্টের প্রথম অংশে "গালের সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা"র বর্ণনাগুলাও ব্যাপক মজার... :))


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  4. তাইফুর (৯২-৯৮)
    আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তার খুশিতেই চলি ...

    রাজাভাই দেখি পারফেক্ট রাজা ... রাজা ভাইকে এই ব্লগে নিয়মিত সদস্য হিসেবে দেখতে চাই।
    অসম্ভব সুন্দর লেখাটার জন্য সানা ভাইকে :salute:
    (ফাজিলের চোখ আটকায় ...

    এত্তোজনে মিলেও ধরে রাখতে পারে না রাজাকে। চিৎকার করে ওঠে রাজা, “আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে………”

    ফাজিলের মন বলে, "শয়তান ... দেহ পেলেও মন পাবি না"।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ক্লাস ইলেভেন, দূর আপনাদের বেল আছে নাকি?

    আমি এই কাম ফার্ষ্ট শুরু করি ক্লাস এইটে। মোয়াজ্জেম ভাই যে পাংগা দিছিল বাপ্রে বাপ।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।