বেশ্যানগর

বেশ্যানগরে রাত দশটার পরে বিকটাকার ট্রাক প্রবেশ করে। বলা উচিত ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে ঢোকে। দুর্দান্ত বেগে, সজোরে, এবং নির্ভুল লক্ষ্যে। তার আগে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে গড়িয়ে, ধীরে ধীরে পড়তে থাকে এই গ্রীষ্মে। দমফাটা গরমে ছয়টার কাঁটা ঘড়ি ছেড়ে পারলে বেরিয়ে আসতে চায়। সাড়ে ছয় পেরিয়েও গরম বাতাসের আঁকুপাকু শ্বাস থামে না। তারপরে কালশিটে পড়লে, রাস্তার বুকের ওপরে, কোমল শিথিল সিএনজি বা গাড়ি চলাচল করে। তাদের ধুকপুক গরম ইঞ্জিনের দাগ লেগে থাকে ফ্লাইওভার কিংবা বিলবোর্ডের গায়ে। ক্লান্তচলন ছেড়ে একসময় তারা গৃহস্থের ঘরে ফেরে, গ্যারেজে, গোডাউনে, ছাদের তলায়। তারপরে ক্রমশ শান্ত হবে রাজপথ, ভেবে সকলেই ঘরে ফিরতে চায়। সেসময়ে, এই বেশ্যা নগরে ঠিক কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও একটা নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে।

ফটকের এপাশে ওপাশে পথের চিহ্ন প্রকৃতি আলাদা। ওপাশে কাঁচা ইট, এপাশে ঘন কংক্রীট। তারপরে ধীরে পথ হয়ে ওঠে পিচগলা আলকাতরা-গোলা। ট্রাকের শরীরের ভীড়ে, হেডলাইটের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে সেই নরোম নালীতে-উপনালীতে-গলিতে-উপগলিতে। পাড়া সজাগ হয়ে যায়। ঘরের বাতি নিভিয়েও ঘামভেজা মিশ্রিত শরীরে উল্কি এঁকে দেয় ট্রাকের শিস। শীৎকারের শব্দ ছাপিয়ে সবাই শুনতে থাকে, সারি সারি ট্রাক নেমে আসছে, জড়ো হচ্ছে! তাদের জমায়েতে অশ্লীল চালক সমবায় সমিতির হলুদ-দেঁতো নেতা হাত তুলে রাখেন। সবাই নীরবে তাঁকে অনুসরণ করে। পথের মাঝে তখনও বিচ্ছিন্ন কয়েকটা সিএনজি ঘুরছে। মালিকের জমা টাকার পরে, নিজের ঘরের জন্য কিছু উপার্জনের আশায়। এখনও বউয়ের কাছে ফিরতে পারেনি, রাতের বাজার সেরে, এমন ঘষটানো চাকুরে বলদগণের বাহন হওয়ার ধান্দায়।

মিরপুর দশের মোড়েই রাত জমে থাকে দশটার পরে। সেখান থেকে কাকলি রেলগেইট, খালি দশ খালি দশ খালি দশ। সিএনজিওলা হাঁকে। সওয়ার চারজন হলেই দে-ছুট। ছুটে ট্রাকের পিছনে পিছনে, ওভারটেকের সাহস নাই। একটু পরে সেটা সামনে থেকে সরে যায়। আরেকটা ট্রাক দেখা যায় রাস্তার মোড়ে আড়াআড়ি খুব শিথিল পড়ে আছে। একবারে সে উল্টো ঘুরতে পারে না, বেশ্যানগরের নালীগুলো অনেক সরু। দু’পাশে প্রচুর ফুটপাত ছাপানো হকারের টং। নীল নিরোধক পলিথিনে মোড়ানো ছাপড়া। সেগুলোকে বাঁচিয়ে শক্ত ট্রাকের উল্টো ঘুরতে দু’বার আগুপিছু হওয়া লাগে। আস্তে আস্তে তার প্রগমণ দ্যাখে নীরব সিএনজি। তারপরে একটু ফাঁকা পেয়েই সেই দানবের পেছনের চিপা আইল্যাণ্ড উপড়ে সে ছুটে। যাত্রীগুলো একটু ঝাকুনিতে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে সামলায়। কম্পাঙ্ক বাড়লে আমরা হয়তো অপরিচিতকেও আপন ভাবি।

দশটার পরে মাইয়্যা, মাগীরাও নামে। ঘোমটা দেয়া সারি সারি মেয়েরা সূর্যের সাথে ওঠে, চাঁদের সাথে ডোবে। সোডিয়াম আলোর উজ্জ্বলতায় তারা ঘরে ফিরে। ভোরে আবার সেই আলোর ম্রিয়মাণ চোখের ওপর দিয়েই তারা কাজে বেরুবে। এই মাইয়্যাগুলার দু’পায়ের ঘন ওঠানামা, হাতের পর্যাবৃত্ত মন্থনের ওপর নির্ভর করছে এই বেশ্যানগর। স্থূলাঙ্গী, শীর্ণাঙ্গী, শাদা, শ্যামলা হাজারো নারীকে সাজিয়ে রাখতে খুপরি খুপরি ঘরে তীব্র আলোতেই তারা সেলাই হয়ে যায়। সেই নীরব ঘটাং ঘটাং সূঁচ তাদের শরীরে কোন দিক দিয়ে ঢোকে আর বের হয় কে জানে? এমন সেলাই, দাগও থাকে না শালার! এই মাইয়্যাগুলা ট্রাকের পথের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরে। তাদের মাঝ থেকে কেউ কেউ ট্রাকের সাথে মিশে হারিয়ে যায়, পরের দিন সেলাই হওয়ার আগেই।

আরো কেউ কেউ এই শুনশান নগরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। দুগ্ধফেননিভ শয্যায়। শুভ্রকুসুমিত ব্রীড়া শতফুটো চাদরে মাখা থাকে। মলিন লুঙ্গি তুলে তাদের স্বামীরা পাশে শোয়। সারি সারি শরীর, সারি সারি ঘাম, থাম, আলো, চিৎকার, ঘুম, মরণ। এভাবে শহরের রাত বাড়তেই থাকে। চাঁদের কলার সাথে তুলনাবাজির দিন শেষ। এখন ঋতুস্রাবের দিনের সাথে তুলনা খুবই মোক্ষম মিলে যায়। এক মাসে সেটা মিস হলেই সকলে সজাগ হয়। এমআর এমআর বলে কিশোরী-যুবতী ছুটে ছুটে আসে আরো হাজারো সাজানো বিগলিত শুভ্র বিছানায়। সেখানেই তাদের শরীর থেকে মুক্তো বেছে নেয়া হয়। এই শহরের ঝলমলে আলোকসজ্জায় খুব দরকারি সেসব মুক্তো। ঐ মাইয়্যা-মাগীরা কী করে জানবে সেই কথা?

ট্রাকের চালকেরাও একদিন ক্লান্ত হয়। বেশ্যানগরের ফটক বার বার পার হতে হতে, পার হয়ে যেতে যেতে তারা যখন শুনতে পায় খোপ খোপ খোঁয়াড় থেকে গৃহস্থরা বেরিয়ে আসছে। ফুটপাত থেকে উঠে আসতে থাকে মাইয়্যারা, খুপরি থেকে হকারের স্যান্ডলের শব্দও পাওয়া যায়! এভাবে দলে দলে কোটি কোটি মুখ, কোটি কোটি ঘামকণা। তরল আগুনচাষী সূর্যের আলো বেরুনোর আগেই তারা জমায়েত হয়। তাদের জমায়েতের উদ্যান এই বেশ্যানগরে একটাও নাই। তারা ঘরের ব্যালকনিতে জমা হয়। ওভারব্রীজের ওপরে জমা হয়। মরাধ্বজা লেকের পাড়ে জমা হয়। কনস্ট্রাকশন সাইটের বালুতে তাদের বিষণ্ণ ছায়া পড়ে। ছায়া কেঁপে কেঁপে ওঠে। এই বেশ্যানগরে তাদের অনবদ্য ইতিহাস হা, হা করে শ্বাস নিতে নিতে একদিন গুমখুন হয়ে যায়।
***
[থাকলে টের পাই না। না থাকলে হাঁসফাঁস করি। মাঝে লেখালেখি আসছিল না বলে অফলাইনে ঘুরাঘুরি করতাম, হঠাৎ কালকে থেকে লগইন করতে না পেরে ভাবলাম, আমাকে কেউ ব্যান করলো কী না! :(( তারপরে শুনলাম, না ফয়েজ ভাই কী জানি বলছেন, না করছেন, তারপর থেকে এমন! আমি জানি না, বড়োদের ব্যাপার স্যাপার। ছোটমানুষ, ছোট চাওয়া। সিসিবি ফিরে আসছে এই আনন্দে একটা দুঃখের লেখা। সবার কাছে মার্জনা হউক, আমার বেরসিক পোস্ট, বেমক্কা লেখা।]

৩,৯৪৬ বার দেখা হয়েছে

৫৩ টি মন্তব্য : “বেশ্যানগর”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    খুবই ভালো লাগলো আন্দালিব। :clap: :clap: :clap: :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:

    তবে এদের কষ্টের পাশাপাশি এদের যে ছিটেফোঁটা আনন্দের মুহুর্তগুলো আছে তা নিয়ে একটা প্যারা লিখলে পরিপুর্ন লাগত।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      মাইনুল ভাই, ফোকাসে তো খালি 'তারা' না, আরো অনেকেই, আমরা সবাই। কোন না কোনভাবে এই নগরের সকল মানুষই বেশ্যাবৃত্তিতে নিমজ্জিত। বিত্তহীনের পেশাটিকে আমরা বেশ্যাবৃত্তি নাম দিয়েছি, কিন্তু বিত্তশালি মানুষেরা যেভাবে নিজেদের সবকিছুই বিক্রির খাতায় তোলে, তাতে আমি কোন পার্থক্য পাই না। ভাষাটাও আমাদের পক্ষে, তাই নিজেদের ক্রিটিক করে এমন ভাষা আমরা বানাইনি।
      সুখের বা আনন্দের মুহূর্তগুলো আসলে চোখের ঠুলি। আমরা কতটা খারাপ আছি সেটা ভুলিয়ে দেয়ার, ভুলে থাকার মিথ্যা প্রয়াস। সেটা এজন্যেই এখানে আনি নাই।

      পড়ার জন্য ধন্যবাদ বস্‌।

      জবাব দিন
      • মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

        সেটা ঠিক আছে ......... কিন্তু সেই সামান্য সুখ বা চোখের সেই ঠুলিটা আছে বলেই আমরা-ওরা সবাই রাতে স্বপ্ন দেখি, রাতে ঘুমানোর আগে পরের দিনের হিসেব খাতাটা সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় - হবে জেনেও কল্পনা করতে চাই, আচ্ছা, ব্যাপারটা এমন হলে কেমন হবে ?? এই ঠুলি বা স্বপ্নই তো আমাদের এবং ওদের বাঁচিয়ে রাখছে, তাই না??

        জবাব দিন
        • আন্দালিব (৯৬-০২)

          সেটা তো অবশ্যই, ভাই।

          এই লেখাটা কেবলই নগ্নসত্যের। আমি চেয়েছি প্রতিটি ব্যক্তির, শ্রেণি-লিঙ্গ নির্বিশেষে ক্রিটিক করতে। যেমন পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র আমাদের ফাঁপা নিঃস্ব করে দিচ্ছে, তেমনি বিত্তহীনেরাও দোষবিহীন এমন নয়। সব শ্রেণিরই সমস্যার এবং খামতির জায়গাটা তুলে ধরতে চাইছিলাম।

          সুখের কথাটা আমাদের যাপিত জীবনের প্রলেপ, বেঁচে থাকার প্রেরণা। সেকারণেই এখানে সেটা অনুপস্থিত। হয়তো অন্য কোন লেখায় সেটাকে আনবো তুলে।

          জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      লাবলু ভাই, বড়ই অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন। এখন গুমোর ফাঁস হয়ে যাবে যখন আমি বলবো যে আমার কমলকুমার মজুমদারের লেখা পড়াই হয় নাই! (আমি পুরাই মূর্খ মানুষ)।

      সম্ভবত আমার মাথায় একটা সমস্যা আছে। একটা বিষয়কে দেখার চোখ একটু অন্যরকম। মানে, মিলে না সবার সাথে। অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই যেটা ভাবে, বুঝে সেটা বুঝতে আমার অনেক সময় লাগে। আবার দেখা যায় আমি সেই বিষয়টাকে যেভাবে বুঝছি, সেটা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। বিষম বিপদ!

      সেকারণে আমি বাক্যালাপ কমিয়ে দিয়েছি। এখন লিখিই, আর ভাবিই। পড়াশুনা কম বলে নিজে নিজে যেটা বুঝতেছি সেটাই লিখি। তবে এখন একটু দুনিয়ার বেসিক জ্ঞানগুলোর লাইনে কিছু কিছু পড়তেছি। দিব্যচক্ষু কারে বলে জানি না, কিন্তু সেইটা মনে হয় খুলে যাইতেছে একটু একটু কইরা! 😀

      খুব ভাল লাগলো লাবলু ভাই, আপনি কমেন্ট করলেন বলে! :boss:

      জবাব দিন
  2. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    লেখাটা বুঝতে বেশ সময় লাগলো। তবে সবকিছু না বুঝলেও আসল থিমটা মনে হয় বুঝেছি। কমেন্টে তোর জবাবগুলো এই প্রক্রিয়াটাকে কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। উপমার প্রয়োগ গুলো বেশ হয়েছে......।। ;))

    জবাব দিন
  3. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    না ফয়েজ ভাই কী জানি বলছেন, না করছেন, তারপর থেকে এমন!

    আরে দূর কতবার কইলাম, আমি না আমি না। সব ,৯৪ আর ,৯৬ ব্যাচের।

    ও তুমিও দেখি ,৯৬ ব্যাচের।

    কারে গালি দিলা তুমি বেশ্যা কইয়া, ঢাকারে নাকি মিরপুর রে? :grr:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    আন্দা, তোর এই লেখা একদম গরম গরম পড়ছিলাম সামুতে। তখন অবলীলায় বলে দিছি বুঝছি। এখন কমেন্ট দেইখ্যা মনে হইতাসে বুঝা শেষ হয় না এই ধরণের লেখায়।
    আমার কাছে কিন্তু ভাল্লাগছে। কেননা বেশ্যাংরে আমরা কেউই বেশ্যাদের চেয়ে উপরে নয় কিংবা ঘুরে ফিরে ডিফারেন্ট ডাইমেনশনে বেশ্যাবৃত্তিতে ব্যস্ত। এই বোধ টা আমার সাথে মিলছিলো বইলা ই কিঞ্চিত আরাম বোধ করছি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আন্দালিব (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।